৫৮ বর্ষ ৪৬ সংখ্যা / ২ জুলাই, ২০২১ / ১৭ আষাঢ়, ১৪২৮
বেসরকারিকরণের বিরুদ্ধে এবং বেতন চুক্তি সহ বিভিন্ন দাবিতে রাষ্ট্রায়ত্ত ইস্পাত শিল্পে সফল ধর্মঘট
ধর্মঘটের সমর্থনে দুর্গাপুরে শ্রমিক-কর্মচারীদের প্রতিবাদ বিক্ষোভ।
নিজস্ব সংবাদদাতাঃ রাষ্ট্রায়ত্ত ইস্পাত শিল্পে বেসরকারিকরণ রোখা, বেতন চুক্তি সহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ দাবিতে ঐক্যবদ্ধ ধর্মঘটের মধ্য দিয়ে নজির তৈরি করলেন শ্রমিকশ্রেণি। ৩০ জুন সেইলের অন্তর্গত ইস্পাত কারখানা, খনির শ্রমিক এবং অফিস কর্মচারী মিলিয়ে দেড় লক্ষ শ্রমিক কর্মচারী এই ধর্মঘটে শামিল হয়েছিলেন। এদের মধ্যে ছিলেন চুক্তি ভিত্তিক ও প্রকল্প কর্মীরাও। এর আগের দিন অর্থাৎ ২৯ জুন বিশাখাপত্তনমের ইস্পাত কর্মীরা সফল ধর্মঘট করেন।
ইস্পাত শিল্পের শ্রমিক-কর্মচারীদের আইনগত অধিকার ও দাবিগুলির প্রতি কর্তৃপক্ষ ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রকের ঔদ্ধত্য ও অবমাননাকর দৃষ্টিভঙ্গির বিরুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ ঐক্যবদ্ধ ধর্মঘটের জন্য সংগ্রামী অভিবাদন জানিয়েছেন স্টিল ওয়ার্কার্স ফেডারেশন অফ ইন্ডিয়া'র সভাপতি এবং সিআইটিইউ'র সাধারণ সম্পাদক তপন সেন। তিনি এক বিবৃতিতে বলেছেন, বিশাখাপত্তনম ইস্পাত শিল্পের শ্রমিকরা ২৯ জুন ব্যাপক আকারে ধর্মঘট করেছেন। রাষ্ট্রায়ত্ত সেইল এবং আরআইএনএল-এর সমস্ত ইউনিয়নের ঐক্যবদ্ধ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সেইল-এর অন্তর্ভুক্ত সমস্ত কারখানা, খনি ও অফিসের শ্রমিক-কর্মচারীরা ৩০ জুন সর্বাত্মক ধর্মঘট করেছেন। বিশাখাপত্তনমে স্থায়ী ও চুক্তিভিত্তিক শ্রমিক-কর্মচারীদের কোনো শর্ত ছাড়াই মজুরি বৃদ্ধির জন্য দৃঢ়ভাবে দাবি জানানো হয়। চুক্তিভিত্তিক ও প্রকল্প শ্রমিক সহ মোট দেড় লক্ষ শ্রমিক রয়েছেন সেইল এবং আরআইএনএল-এর অর্ন্তভুক্ত বিভিন্ন কারখানা, খনি ও অফিসে। তাদের মধ্যে ৭০ থেকে ৯৫ শতাংশ শ্রমিক-কর্মচারী প্রতিষ্ঠান ভিত্তিক ভিন্ন ভিন্ন হারে এই ধর্মঘটে সাড়া দিয়েছেন।
তপন সেন বিবৃতিতে বলেছেন, সরকার ও কর্তৃপক্ষের অনমনীয়তা ও নির্লজ্জ শ্রমিক বিরোধী মনোভাবের জন্য সাড়ে চার বছরেরও বেশি সময় ধরে এই মজুরি বৃদ্ধির দাবি অমীমাংসিত হয়ে আছে। ৫২ মাস পরে যখন ইস্পাত শিল্পের জাতীয় যৌথ কমিটি (এনজেসিএস)-র সাথে কর্তৃপক্ষ দ্বিপাক্ষিক আলোচনা শুরু করে, তখন তারা মজুরি বৃদ্ধির পরিবর্তে মজুরি ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধা ছাঁটাইয়ের সব নেতিবাচক শর্ত চাপানো শুরু করে দেয়। তা সত্ত্বেও সমস্ত ইউনিয়ন অসীম ধৈর্য দেখায় এবং কর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনা চালিয়ে যেতে থাকে। কিন্তু ছ'মাসের বেশি সময় ধরে (এনজেসিএস'র বিভিন্ন সভা) কর্তৃপক্ষ সেই ঔদ্ধত্যপূর্ণ মানসিকতা বজায় রাখার জন্য অবশেষে রাষ্ট্রায়ত্ত ইস্পাত শিল্পের সমস্ত ইউনিয়ন যৌথভাবে ৩০ জুন ধর্মঘটে যাবার সিদ্ধান্ত নেয় (বিশাখাপত্তনমে ২৯ জুন)।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে যে, এই অতিমারীর সময়ে লকডাউনের মধ্যেও নিজেদের জীবন বিপন্ন করে সমস্ত স্থায়ী এবং চুক্তিভিত্তিক কর্মচারীরা ইস্পাত উৎপাদন কেন্দ্র, খনি এবং অফিসগুলি চালিয়ে যাচ্ছেন। কোভিড সংক্রমণের কারণে ৬০০-র বেশি শ্রমিক এবং আধিকারিক কর্তব্যরত অবস্থায় প্রাণ হারিয়েছেন। পরিবারগুলিকে যুক্ত করলে সংখ্যাটা ১০০০ ছাড়িয়ে যাবে। তা সত্ত্বেও মৃতদের পরিবারগুলিকে ক্ষতিপূরণ ও তাদের পরিবারের অন্তত একজনকে চাকরির যে দাবি ইউনিয়নগুলি বার বার উত্থাপন করেছে, তাতে বিন্দুমাত্র কর্ণপাত করার সৌজন্য দেখায়নি কর্তৃপক্ষ। কর্তৃপক্ষের এমন আচরণ ঔদ্ধত্যপূর্ণ।
এই বিবৃতিতে তপন সেন বলেছেন, কর্তৃপক্ষের হাজারো প্ররোচনা সত্ত্বেও ইস্পাত শিল্পের শ্রমিকদের এই ঐতিহাসিক ও বীরত্বপূর্ণ ধর্মঘট দেখিয়ে দিল, তাদেরকে হালকাভাবে নেওয়া যাবে না। এই ধর্মঘট হয়ে উঠেছে গোটা ইস্পাত শিল্পের শ্রমিকদের ঐক্যবদ্ধ লড়াই এবং সরকার ও কর্তৃপক্ষের কর্তৃত্ববাদী ও একগুঁয়ে মনোভাবকে চ্যালেঞ্জ জানানোর লড়াই।
আগামীদিনে শ্রমিক-কর্মচারীদের ঐক্যকে আরো সুদৃঢ় করে কোনোরকম পূর্ব শর্ত ছাড়াই নিয়মিত ও চুক্তিভিত্তিক শ্রমিকদের জন্য সম্মানজনক মজুরি নির্ধারণ ও বেসরকারিকরণ রুখতে এবং শ্রমিকদের অধিকারের উপর সরকারের ধ্বংসাত্মক নীতির আক্রমণকে প্রতিহত করতে লড়াই চালিয়ে যাবার আহ্বান জানানো হয়েছে এই বিবৃতিতে।
এসডব্লিউএফআই'র সাধারণ সম্পাদক ললিত মোহন মিশ্রও ধর্মঘট সফল করার জন্য শ্রমিকদের অভিনন্দন জানিয়ে বলেছেন, আগামীদিনে আরও বৃহত্তর লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।
এদিন ইন্টিগ্রেট স্টিল প্ল্যান্টের গুরুত্বপূর্ণ বিভাগগুলি ধর্মঘটে অচল হয়ে পড়ে। সেইল-এর অধীনে থাকা কয়লাখনিগুলিতে কোথাও উৎপাদন হয়নি। উৎপাদন হয়নি লৌহ আকরিকের খনিগুলিতেও। র' মেটেরিয়াল ডিভিসন (আরএমডি), কলকাতার সিএমও দপ্তর সহ সর্বত্র সফল ধর্মঘট হয়েছে। বার্নপুর আইএসপি, ইস্পাত নগরী দুর্গপুরের এএসপি এবং ডিএসপি-তে স্বতঃস্ফূর্ত ধর্মঘট হয়েছে।
এছাড়া রৌরকেল্লা, বোকারোতে ধর্মঘট ১০০ শতাংশ, ভিলাইয়ে ৭৫ শতাংশ, ডিএসপি-তে ৭২ শতাংশ, এএসপি-তে ৫৪ শতাংশ, সালেমে ৯৫ শতাংশ, বিশাখাপত্তনমে ১০০ শতাংশ সফল ধর্মঘট হয়েছে।
কোলিয়ারি ডিভিসনের চাসনালা কোলিয়ারি, জিৎপুর কোলিয়ারিতে ১০০ শতাংশ সফল ধর্মঘট হয়েছে। রামনগর কোলিয়ারিতে শাসক দলের বিরোধিতা মোকাবিলা করে ৮৫ শতাংশ সফল হয়েছে ধর্মঘট। এছাড়া আকরিক খনি রাজহারা, নন্দিনীতে ১০০ শতাংশ এবং সিএফএ চন্দ্রপুর ফেরো অ্যালয়ে ৯৫ শতাংশ শ্রমিক ধর্মঘটে শামিল হয়েছেন।
এদিন রাষ্ট্রায়ত্ত সেইল-এ শ্রমিক ধর্মঘটের সমর্থনে সিআইটিইউ'র ডাকে কাজোড়া, শ্যামসুন্দরপুর, জে কে নগর, নর্থ সিহাড়সোল, ঝাঁঝরা কোলিয়ারিতে শ্রমিক সমাবেশ হয়েছে।