৫৮ বর্ষ ৪৬ সংখ্যা / ২ জুলাই, ২০২১ / ১৭ আষাঢ়, ১৪২৮
রাজ্যজুড়ে যথাযোগ্য মর্যাদায় ঐতিহাসিক হুল দিবস পালিত
ডেবরায় রাধামোহনপুরে হুল দিবসের শোভাযাত্রা।
নিজস্ব প্রতিনিধিঃ প্রতিবছরের মতো এবারেও ৩০ জুন রাজ্যজুড়ে যথাযোগ্য মর্যাদায় পালিত হলো ঐতিহাসিক হুল দিবস। রাজ্য বামফ্রন্টের ডাকে এদিন বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে দিনটি পালিত হয়েছে। এই উপলক্ষে জেলায় জেলায় শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা হয় সিধু,কানু সহ অন্যান্য বীর শহিদদের। এদিন সন্ধ্যায় সিপিআই(এম) পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির ফেসবুক লাইভে 'ঐতিহাসিক হুল দিবসের ঐতিহ্য ও বর্তমান আদিবাসী সমাজের অবস্থা' বিষয়ে এক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়।
সারা ভারত কৃষকসভা, আদিবাসী অধিকার রাষ্ট্রীয় মঞ্চ, পশ্চিমবঙ্গ সামাজিক ন্যায় মঞ্চ প্রভৃতি সংগঠনের উদ্যোগেও নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে ঐতিহাসিক হুল দিবস পালিত হয়েছে।
প্রসঙ্গত, ১৮৫৫ সালে তৎকালীন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বঞ্চনা ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে এবং একইসঙ্গে সামন্তবাদী মহাজনী শোষণ, নির্যাতনের বিরুদ্ধে কৃষকদের বিদ্রোহ সংগঠিত হয়েছিল। সেই সময়ে বাংলা প্রেসিডেন্সি এলাকার অন্তর্গত সাঁওতাল পরগনা, বরাভূম, মানভূম, বীরভূম সহ বিস্তীর্ণ আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকায় এই বিদ্রোহের আগুন ছড়িয়ে পড়েছিল। এই বিদ্রোহের প্রধান সংগঠক ছিলেন চার ভাই সিধু, কানু, চাঁদ ও ভৈরব। এঁদের বসত ছিল তৎকালীন অবিভক্ত বিহার এবং বর্তমানের ঝাড়খণ্ড রাজ্যের 'ভগনাডিহি' গ্রামে। মূলত এই চার ভাইয়ের নেতৃত্বে হাজার হাজার আদিবাসী, অনাদিবাসী কৃষক, ভূমিহীন খেতমজুর, গ্রামীণ কুটিরশিল্পী, তাঁতি, কামার, কুমোর, গোয়ালা ইত্যাদি বিভিন্ন অংশের শোষিত বঞ্চিত মানুষ এই বিদ্রোহে শামিল হয়েছিলেন। সিধু, কানু মুর্মুর নেতৃত্বে সেই বীরত্বপূর্ণ প্রতিরোধের লড়াই 'সাঁওতাল বিদ্রোহ' নামেও পরিচিত। ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসক ও তাদের তল্পিবাহক জমিদার-মহাজনদের শোষণ-শাসনের বিরুদ্ধে সেই আপসহীন প্রতিরোধের লড়াই ও শহিদদের স্মরণ করে মর্যাদার সঙ্গে এই দিনটি ‘হুল দিবস’ হিসেবে রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে পালিত হয়েছে।
এই উপলক্ষে এদিন পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার ডেবরা, নারায়ণগড়, কেশিয়াড়ি, শালবনি, দাসপুর, ঘাটাল, চন্দ্রকোনা রোড, গড়বেতা, গোয়ালতোড়, ক্ষীরপাই, খড়্গপুর গ্রামীণ, পিংলা, সবং প্রভৃতি বিভিন্ন জায়গায় পদযাত্রা, সভা, আদিবাসীদের শোভাযাত্রা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ইত্যাদি নানা কার্যসূচির মাধ্যমে হুল দিবস পালিত হয়েছে। মেদিনীপুর শহর সংলগ্ন আবাস এলাকায় বীর শহিদ সিধু, কানু-র মূর্তিতে মাল্যদান সহ সংক্ষিপ্ত সভা হয়েছে।
হুগলি জেলার হরিপাল, পাণ্ডুয়া, বলাগড়, তারকেশ্বর ও ধনিয়াখালির বিভিন্ন স্থানে সারা ভারত কৃষকসভা, সারা ভারত খেতমজুর ইউনিয়ন এবং পশ্চিমবঙ্গ আদিবাসী অধিকার মঞ্চের যৌথ উদ্যোগে শহিদ বেদিতে মাল্যদান, আলোচনা সভা, রক্তদান শিবির, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ইত্যাদি সংগঠিত হয়েছে।
সন্দেশখালিতে হুল দিবসের সমাবেশ।
এদিন দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার সন্দেশখালিতে ভোলাখালি-র ঘটিহারা নদীর পাড়ে পশ্চিমবঙ্গ আদিবাসী অধিকার মঞ্চের উদ্যোগে বহু মানুষের উপস্থিতিতে পতাকা উত্তোলন, সিধু,কানু-র প্রতিকৃতিতে মাল্যদান ও সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে।
পুর্ব মেদিনীপুর জেলার তমলুকে নিমতৌড়ির জেলা কেন্দ্রে কেন্দ্রীয়ভাবে হুল দিবস পালিত হয়েছে। এখানে সামাজিক ন্যায় মঞ্চের উদ্যোগে শহিদ বেদিতে মাল্যদানের মধ্য দিয়ে ঐতিহাসিক সাঁওতাল বিদ্রোহের শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয়েছে।
নদীয়া জেলাতেও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী লড়াইয়ে বীর শহিদ সিধু, কানুদের স্মরণ করে মর্যাদার সঙ্গেই দিনটি পালিত হয়েছে। কল্যাণী স্টেডিয়ামের পাশে সিধু, কানু-র মূর্তিতে মাল্যদান সহ দিনটির বিশেষ তাৎপর্য আলোচিত হয়েছে।
এদিন ঐতিহাসিক হুল দিবস উপলক্ষে সন্ধ্যায় সিপিআই(এম) পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির ফেসবুক পেজে আলোচনা সভায় অংশ নেন সিপিআই(এম) ঝাড়্গ্রাম জেলা সম্পাদক ও পশ্চিমবঙ্গ আদিবাসী অধিকার মঞ্চের সম্পাদক পুলিনবিহারী বাস্কে, অধ্যাপক সুস্নাত দাশ, বাঁকুড়া জেলার গণ আন্দোলেনের নেতা সুনীল হাঁসদা এবং খেতমজুর আন্দোলনের নেত্রী বন্যা টুডু। সঞ্চালনা করেন পশ্চিমবঙ্গ সামাজিক ন্যায় মঞ্চের সম্পাদক অলকেশ দাস। বক্তারা বর্তমান সময়ে আদিবাসী প্রান্তিক মানুষদের উপর চলা নানা শোষণ-বঞ্চনা এবং তাঁদের শিক্ষা ও সংরক্ষণ সহ অন্যান্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করার বিরুদ্ধে এবং আদিবাসীদের শত-সহস্র বছরের সমৃদ্ধ সংস্কৃতি ধ্বংস করে যেভাবে পরিচিতি সত্তা ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতির মাধ্যমে বিভাজনের অপচেষ্টা চলছে, তার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান জানান।
এরই পাশাপাশি এদিন সিপিআই(এম) রাজ্য কমিটির ফেসবুক পেজে ঐতিহাসিক হুল দিবসে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান শীর্ষক একটি ভার্চুয়াল আলোচনা সভায় বক্তব্য রাখেন অশোক মুর্মু, সঞ্জয় মান্ডি, বিরসা সোরেন এবং মিনতি হেমব্রম। সঞ্চালনা করেন মধুজা সেনরায়।