৫৮ বর্ষ ৪৬ সংখ্যা / ২ জুলাই, ২০২১ / ১৭ আষাঢ়, ১৪২৮
সংযুক্ত কিষান মোর্চার ডাকে দেশব্যাপী ‘কৃষি বাঁচাও গণতন্ত্র বাঁচাও’ কর্মসূচিতে ব্যাপক সাড়া
হরিয়ানায় কৃষক বিক্ষোভ ঠেকাতে পুলিশের জলকামান।
নিজস্ব সংবাদদাতাঃ সংযুক্ত কিষান মোর্চা (এসকেএম)-র ডাকে ২৬ জুন দেশজুড়ে পালিত হয়েছে ‘‘কৃষি বাঁচাও,গণতন্ত্র বাঁচাও’’ কর্মসূচি। কেন্দ্রের সর্বনাশা তিন কৃষি আইন ও বিদ্যুৎ সংশোধনী বিল বাতিল এবং ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের দাবিতে সিঙ্ঘু, টিকরি, শাহজাহানপুর প্রভৃতি দিল্লির সীমান্তবর্তী অঞ্চল সহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে যে আন্দোলন চলছে, সেই আন্দোলনের সাত মাস পূর্ণ হওয়া এবং দেশে অভ্যন্তরীণ জরুরি অবস্থা জারির ৪৬তম বর্ষকে স্মরণে রেখে এদিন কৃষকদের বিক্ষোভ কর্মসূচি সংগঠিত হয়েছে। একইসঙ্গে ২৬ জুন সারা ভারত কৃষক সভার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা স্বামী সহজানন্দ সরস্বতীর মৃত্যু বার্ষিকীও পালিত হয়েছে। এই কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে এদিন বিভিন্ন রাজ্যের রাজধানীতে রাজভবনের সামনে অবস্থান ও স্বারকলিপি প্রদান করা হয়। রাষ্ট্রপতিকে উদ্দেশ্য করে দেওয়া এই স্মারকলিপিতে কেন্দ্রের তিন কৃষি আইন বাতিল সহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ দাবি জানানো হয়েছে। রাজ্যগুলির রাজধানী সহ দেশের নানা প্রান্তে এদিন কৃষকেরা সমবেত হয়ে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ জানান।
এদিন চণ্ডীগড়ের কাছে হরিয়ানার পাঁচকুলায় শত শত কৃষক রাজভবন অভিমুখে মিছিল করেন। হরিয়ানা ও পাঞ্জাব - উভয় দিক থেকে যাওয়া কৃষকদের একাংশ পুলিশের ব্যারিকেড ও নিরাপত্তার বেষ্টনী ভেঙে এগিয়ে যান। হরিয়ানার পুলিশ জলকামান ছুঁড়ে জমায়েত ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা করে। এখানে মিছিলে উপস্থিত ছিলেন কৃষক নেতা বলবীর সিং রাজেওয়াল, অশোক ধাওয়ালে প্রমুখ। পাঞ্জাবের কৃষকরা মোহালিতে সমবেত হয়ে পুলিশি বাধা টপকে চণ্ডীগড়ে ঢুকে পড়েন।
এদিকে পাঞ্জাব, হরিয়ানা ও উত্তরপ্রদেশের কৃষকরা গাজিপুর সীমান্তে নতুন করে সমবেত হন। কৃষকদের আনা ট্রাক্টরের সারিতে জাতীয় সড়ক ভরে যায়। কৃষকদের বাধা দেওয়া হয় এবং কয়েকজনকে আটক করে। কৃষকরা শান্তিপূর্ণভাবেই বিক্ষোভ দেখান। ওয়াজিরপুরে আটক কৃষকদের কাছ থেকে লেফটেন্যান্ট গভর্নরের সচিব স্মারকলিপি নিতে বাধ্য হন।
দিল্লিতে বিক্ষোভে শামিল হন ছাত্র, যুব, মহিলা ও শ্রমিক সংগঠনগুলি। এখানেও পুলিশ বাধা দেয় এবং বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করে।
কর্ণাটকের বেঙ্গালুরু, উত্তরাখণ্ডের দেরাদুন, তেলেঙ্গানার হায়দরাবাদ, মধ্যপ্রদেশের ভোপালে কৃষকদের রাজভবন যেতে বাধা দেওয়া হয়। উত্তরপ্রদেশের লক্ষ্ণৌয়ে রাজভবনে স্মারকলিপি দেওয়া হয়েছে। মহারাষ্ট্র ও হিমাচলপ্রদেশে রাজ্যপালের হাতেই স্মারকলিপি তুলে দেন কৃষকরা। পাটনা, ভুবনেশ্বর, কলকাতা, আগরতলা, জয়পুর, রাঁচি, চেন্নাইয়ে রাজভবনের সামনে কৃষকরা সমাবেশ করেন। তামিলনাডুর তিরুচি সহ নানা জায়গায় বড়ো সমাবেশ হয়েছে। রাজ্যগুলির রাজধানী ছাড়াও স্থানীয় স্তরেও প্রতিবাদ কর্মসূচি হয়েছে।
পশ্চিমবঙ্গে বিক্ষোভ কর্মসূচি
দেশের অন্যান্য প্রান্তের মতো এরাজ্যেও ‘কৃষি বাঁচাও, গণতন্ত্র বাঁচাও’ দিবসকে কেন্দ্র করে কৃষক, খেতমজুর সংগঠনের ডাকে বিক্ষোভ-অবস্থান হয়েছে। সারা ভারত কৃষক সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির পশ্চিমবঙ্গ শাখার ২১টি সংগঠনের ডাকে কলকাতায় রাজভবনের পূর্ব গেটের সামনে ডেকার্স লেনের দিকে দু’ঘণ্টা ধরে বিক্ষোভ চলে। এই কর্মসূচির প্রতি সংহতি জানাতে ট্রেড ইউনিয়নের নেতৃবৃন্দও উপস্থিত ছিলেন। এদিন বিক্ষোভ কর্মসূচি থেকে কেন্দ্রের তিন কৃষক বিরোধী আইন, বিদ্যুৎ বিল বাতিলের দাবি জানানো হয়েছে। এ রাজ্যের আন্দোলনকারীদের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রপতির কাছে স্মারকলিপিও পাঠানো হয়েছে।
ধর্মতলায় কৃষক সংগঠনগুলির প্রতিবাদ-অবস্থান। রয়েছেন অমল হালদার, মদন ঘোষ, তুষার ঘোষ, হরিপদ বিশ্বাস, পরেশ পাল প্রমুখ।
এদিন কলকাতায় বেলা ১১টা থেকে ১টা পর্যন্ত রাজভবনের সামনে বিক্ষোভ চলে। কয়েকশো কর্মী এখানে প্ল্যাকার্ড - ফেস্টুন নিয়ে শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে বিক্ষোভে শামিল হন। উপস্থিত ছিলেন সারা ভারত কৃষক সংগ্রাম সমন্বয় সমিতির পশ্চিমবঙ্গ শাখায় আহ্বায়ক অমল হালদার, সম্পাদক কার্তিক পাল, সারা ভারত খেতমজুর সমিতির রাজ্য সভাপতি তুষার ঘোষ, এআইকেএম-র জয়তু দেশমুখ, অগ্রগামী কিষান সভার হরিপদ বিশ্বাস, জয় কিষান সংগঠনের কল্যাণ সেনগুপ্ত, পশ্চিমবঙ্গ কিষান কো-অর্ডিনেশন সংগঠনের নেতা তেজেন্দ্র সিং, চেতন সিং, পিডিএস নেতা সমীর পূততুণ্ড, এআইকেএমএস-র সুশান্ত ঝাঁ, সিআইটিইউ নেতা অনাদি সাহু, আইএনটিইউসি নেতা কামারুজ্জমান কামার, এআইটিইউসি নেতা অতনু চক্রবর্তী প্রমুখ। এছাড়াও উপস্থিত ছিলেন সারা ভারত কৃষক সভার নেতা মদন ঘোষ, পরেশ পাল, সংযুক্ত কিষান সভার নেতা সুভাষ নস্কর, এআইকেএস নেতা দিলীপ পাল, এমকেপি'র কুশল দেবনাথ, এআইসিসিটিইউ নেতা প্রবীর দাস প্রমুখ। এদিন বিক্ষোভকারীরা মহামারী মোকাবিলায় সর্বজনীন টিকাকরণের দাবির পাশাপাশি সুন্দরবন রক্ষা ও স্থায়ী বাঁধ নির্মাণের দাবিও সোচ্চারে তুলে ধরেছেন।
এদিন কলকাতার পাশাপাশি বিভিন্ন জেলায় এই কর্মসূচিতে শামিল হন কৃষকরা। বিভিন্ন গণসংগঠনের কর্মীরাও এই কর্মসূচিতে অংশ নেন। জেলাগুলির বাজার এলাকায়, প্রশাসনিক ভবনের সামনে, গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে কোভিড বিধি মেনে প্ল্যাকার্ড-ফেস্টুন নিয়ে বিক্ষোভ-অবস্থান কর্মসূচিতে সংগঠিত হয়।
কৃষকদের বিরুদ্ধে মামলা নিঃশর্ত প্রত্যাহারের দাবি
‘কৃষি বাঁচাও, গণতন্ত্র বাঁচাও’ দিবসে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে দায়ের করা সমস্ত মামলা অবিলম্বে এবং নিঃশর্তভাবে প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছে সংযুক্ত কিষান মোর্চা। ২৭ জুন এক বিবৃতিতে মোর্চার নেতৃবৃন্দ বলেছেন, ২৬ জুন বিভিন্ন রাজ্যে যেভাবে রাজভবনমুখী কৃষকদের ওপর প্রশাসনিক হামলা চলেছে তা স্পষ্টতই স্বৈরাচারী ও অগণতান্ত্রিক রাজত্বের প্রতিফলন। কৃষক নেতাদের বিরুদ্ধে দায়ের করা যাবতীয় এফআইআর অবিলম্বে এবং নিঃশর্তভাবে তুলে নিতে হবে। নতুবা আরও বড়ো প্রতিরোধ আন্দোলনের মুখে পড়তে হবে সরকারকে।
এদিকে ২৬ জুন দেশজুড়ে ‘কৃষি বাঁচাও, গণতন্ত্র বাঁচাও’ আন্দোলনে বিপুল সাড়া দেওয়ার জন্য কৃষক, শ্রমিক এবং অন্যান্য গণসংগঠনের কর্মী-সংগঠকদের অভিনন্দন জানিয়েছে সারা ভারত কৃষক সভা। ২৭ জুন এক বিবৃতিতে কৃষক সভার সভাপতি অশোক ধাওয়ালে এবং সাধারণ সম্পাদক হান্নান মোল্লা বলেছেন, নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে বিজেপি-আরএসএস সরকারের অঘোষিত জরুরি অবস্থার মতো পরিস্থিতির নিন্দা করে এবং চলতি ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলনের সাত মাস পূর্তি উপলক্ষে ২৬ জুন সারা দেশে ‘কৃষি বাঁচাও, গণতন্ত্র বাঁচাও’ দিবসের ডাক দিয়েছিল সংযুক্ত কিষান মোর্চা। কৃষকদের এই আন্দোলনে পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছিল কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলির যুক্ত মঞ্চ। বিভিন্ন রাজ্যের রাজভবন, জেলা ও তহশিল সদরে এমনকী লক্ষ লক্ষ শ্রমজীবী মানুষ এই আন্দোলনে অংশ নেন। লড়াইয়ের তীব্রতার কারণেই দেশের বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম এই খবর প্রকাশে বাধ্য হয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়াতেও এই খবর প্রচারিত হয়েছে। এই আন্দোলন সফল করে তুলতে সিআইটিইউ, সারা ভারত খেত মজুর সমিতি, সারা ভারত গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতি, ডিআইএফআই, এসএফআই এবং অবশ্যই সারা ভারত কৃষকসভা বিরাট ভূমিকা নিয়েছে। এজন্য বিবৃতিতে সকলকেই অভিনন্দিত করা হয়েছে। কৃষকসভা স্পষ্ট জানিয়েছে, মোদী সরকারের কর্পোরেটমুখী, জনবিরোধী, স্বৈরাচারী, সাম্প্রদায়িক এবং ফ্যাসিস্টসুলভ রাজত্বের বিরুদ্ধে জয় অর্জন না করা পর্যন্ত সারা দেশে বর্ধিত শক্তি নিয়ে লড়াই চলবে।
সংযুক্ত কিষান মোর্চার বিবৃতিতে এদিন বিজেপি নেতাদের কটাক্ষ করে বলা হয়েছে, একদিন আগেও যারা ১৯৭৫ সালের জরুরি অবস্থার নিন্দা করেছে, চব্বিশ ঘণ্টা পরে তারাই আবার কৃষকদের ওপর স্বৈরাচারী দমনপীড়ন চালালো! মোর্চা বলেছে, রাজভবনমুখী সব রাস্তায় ব্যারিকেড গড়ে, লাঠি চালিয়ে, জল কামান ছুঁড়ে বিভিন্ন রাজ্যে কৃষক মিছিলে হামলা চালানো হয়েছে। কৃষক সমাজ এই পরিস্থিতি মেনে নেবেনা। এদিন এই যৌথ বিবৃতি দিয়েছেন বলবীর সিং রাজেওয়াল, ডঃ দর্শন পাল, হান্নান মোল্লা, গুরুনাম সিং চাধুনি, জগজিৎ সিং দালেওয়াল, যোগীন্দার সিং উগ্রাহন, শিবকুমার শর্মা, যুধবীর সিং, যোগেন্দ্র যাদব প্রমুখ।