৫৮ বর্ষ ৪৬ সংখ্যা / ২ জুলাই, ২০২১ / ১৭ আষাঢ়, ১৪২৮
কোভিডবিধি মেনেই খোলা হোক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান
সুপ্রতীপ রায়
এটা ঠিক ২০২০ সালের মার্চ মাস থেকে আমরা অস্বাভাবিক পরিবেশের মধ্যে আছি। মাঝে মাঝে অনেক কিছু বন্ধ হয়েছে আবার চালু হয়েছে। কোভিডের মধ্যেই বিভিন্ন রাজ্যের নির্বাচন হয়েছে, সমাবেশ হয়েছে,ঘটা করে রাম মন্দিরের শিলান্যাস হয়েছে। কিন্তু ২০২০’র মার্চের শেষ দিক থেকে টানা বন্ধ স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়।
শিশু, কিশোর-কিশোরীদের নিত্য আনাগোনায় যে বিদ্যালয়গুলি প্রাণে ভরপুর থাকত, আজ সেগুলি মৃতপ্রায়। বিরাট বিরাট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভবন গ্রামের বা শহরের মাঝে দাঁড়িয়ে আছে কিন্তু সেগুলি প্রাণহীন। কতদিন বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হয় না ছাত্র-ছাত্রীদের। ভাববিনিময় হয় না কারণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ। মিড-ডে মিল একসঙ্গে খাওয়ার আনন্দটাই ছিল আলাদা। বাংলার মুখ্যমন্ত্রী রাজ্যের ফাঁকা বিধানসভা আসনগুলিতে দ্রুত উপনির্বাচনের দাবি জানান। কিন্তু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান (কোভিডবিধিকে মান্যতা দিয়ে) খোলার বিষয়ে নিরুত্তাপ। এ পরিস্থিতিতে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কী পরিমাণ ক্ষতি হচ্ছে তা ভাবলে গা শিউরে উঠছে। এ ক্ষতিপূরণ হবার নয়।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা বন্ধ, পরীক্ষা বন্ধ। এক চরম অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মধ্যে ছাত্র-ছাত্রীরা। অনেকেই মানসিক অবসাদে ভুগছেন। টানা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি বন্ধ থাকার কারণে বড়ো অংশের ছাত্র-ছাত্রীরা লেখাপড়ার জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। আমাদের দেশের ছাত্র-ছাত্রীদের বড়ো অংশই আসেন অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া অংশ থেকে। কোভিডে গরিব মানুষ আরও গরিব হয়েছেন। গরিব অংশের মানুষকে নিয়ে ভাববার সময় রাষ্ট্রের নেই। চরম আর্থিক সঙ্কটের কারণে অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল অংশের ছাত্র-ছাত্রীদের বড়ো অংশই পড়াশোনার জগৎ থেকে ছিটকে যাবে, বাড়বে ড্রপআউট। যদিও দেশে শাসকদল অতিমারীর সুযোগে মুকেশ আম্বানিকে পৃথিবীর এক নম্বর ধনী ব্যক্তিতে পরিণত করতে চান, গৌতম আদানিকে সামনের সারির বিনিয়োগকারীতে রূপান্তরিত করতে চান, অনিল আম্বানির ধসে পড়া ব্যবসা চাঙা করতে চান।
মাধ্যমিক-উচ্চ-মাধ্যমিক পরীক্ষা ছাড়াই ফলাফল প্রকাশিত হবে। অনলাইন পরীক্ষার মাধ্যমে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর স্তরের মূল্যায়ন হচ্ছে। এক চরম অরাজকতা। শিক্ষা মানে কি শুধু ডিগ্রি? শিক্ষার প্রধানতম উদ্দেশ্য স্ব-ক্ষম পূর্ণমানব তৈরি করা। বিবেকানন্দের ভাষায়,‘মানুষের অন্তর্নিহিত পূর্ণতার বিকাশ সাধনের নাম শিক্ষা’। মেঘনাদ সাহা বলেছিলেন, ‘শিক্ষা না পেলে মানুষের কার্যকরী শক্তি জেগে উঠতে পারে না, মানুষ সমাজের সেবায় লাগবার উপযুক্ত হয় না’।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শিক্ষক ছাড়া শিক্ষাদান প্রক্রিয়া চলতে পারে না। আর শিক্ষার তো নির্দিষ্ট লক্ষ্য থাকে। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায়, ‘জীবনের কোনো লক্ষ্য নাই অথচ শিক্ষা আছে, ইহার কোনো অর্থই নাই’। শিক্ষা মানে তো শুধু মোটা মোটা বই মুখস্থ বা অঙ্ক কষা নয়। শিক্ষা এক বৃহত্তর ব্যাপার - যা অভ্যাস, মানসিকতা, মেলামেশার প্রকৃতি, সোজা কথায় মানবিক গুণাবলির বিকাশের প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত। আর এই প্রক্রিয়াটি সবচেয়ে ভালোভাবে বিকশিত হয় বিদ্যালয়ে। শিক্ষার মাধ্যমে শরীর ও মনে একজন গোটা মানুষের আত্মপ্রকাশ ঘটে। আর এই আত্মপ্রকাশের প্রক্রিয়ায় শিক্ষক-শিক্ষিকা, শিক্ষাকর্মী, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অভিভাবক ও স্বায়ত্বশাসন প্রতিষ্ঠানগুলির ভূমিকা অতীব গুরুত্বপূর্ণ।
শিক্ষা প্রসঙ্গে প্রাচীন ভারতীয় প্রবাদে আছে - শিক্ষা ব্যতীত একজন মানুষ প্রকৃতপক্ষে শিং ও লেজহীন একটি পশু। আরও স্পষ্ট করে বলা যায় যে, শিক্ষা ব্যতীত একজন মানুষ পৃথিবীতে বোঝা মাত্র এবং সমাজের বুকে পরনির্ভরশীল বা পরজীবী ছত্রাকের মত। স্বামী বিবেকানন্দের ভাষায়, ‘খালি বই পড়া শিক্ষা হইলে চলিবে না। যাহাতে চরিত্র গঠন হয়, মনের শক্তি বাড়ে, বুদ্ধির বিকাশ হয়, নিজের পায়ে দাঁড়াইতে পারে - এই রকম শিক্ষা চাই’। আসলে শিক্ষা মানুষকে সামাজিক মানুষ হিসাবে বিকশিত করে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখে একাজ সম্ভব নয়।
দীর্ঘদিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার ঘটনা উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তা বৃদ্ধি করছে। শিক্ষার যথাযথ উন্নতি ব্যাহত হওয়ার ফলে সমাজ পিছিয়ে পড়ছে। এর ফলে মানব সম্পদের যথাযথ বিকাশ সম্ভব হবে না। শিক্ষাই সমাজকে এগিয়ে নিয়ে চলে। সামাজিক যে কোনো সমস্যার মোকাবিলার ক্ষেত্রে শিক্ষা খুবই কার্যকর হাতিয়ার। শিক্ষার অভাবে দেশের ক্ষতি হয়। ফলে দীর্ঘদিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের মধ্যে দিয়ে গভীর ক্ষত তৈরি হয়েছে।
অনলাইন-নির্ভর শিক্ষা ব্যবস্থা কখনই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বিকল্প হতে পারে না। অতিমারীর সময়ে অনলাইন ক্লাস কতটা কার্যকর হচ্ছে? শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আসলে একটি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক প্রতিষ্ঠান - সুনাগরিক তৈরির কারখানা। ছাত্র-ছাত্রীর শারীরিক, মানসিক, বৌদ্ধিক, নৈতিক, সাংস্কৃতিক উৎকর্ষ সাধিত হয়। ছাত্র জীবনে নিজের গড়ে তোলার জন্য চাই প্রশংসা, উদ্দীপনা, নিরপেক্ষতা, ভালবাসার পরিবেশ। এটা সুনিশ্চিত করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।
প্রাথমিক শিক্ষা শিক্ষাজীবনের প্রথম ধাপ। প্রাথমিক স্তরেই একজন শিশু প্রথম হাঁটতে শেখে। শিশুর মানসিক খিদে মেটে। এক্ষেত্রে বিদ্যালয় শিক্ষার ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
শিক্ষাদানের উপাদানগুলির মধ্যে বিদ্যালয় অন্যতম। বিদ্যালয় মানে কেবল একটি ইট-কাঠ-পাথরের তৈরি সুবিশাল ভবন নয়। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের প্রতিদিনের যাতায়াতে স্কুল বাড়ি প্রাণ পায়। ছাত্ররা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের হৃদপিণ্ড আর শিক্ষকরা বিবেক। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছাত্র-ছাত্রীদের স্ব-পাঠে উৎসাহিত করে, জাতপাত-ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে সচেতন করে, আচার আচরণ বিনীত করে, শৃঙ্খলার পাঠ দেয়, ছাত্র-ছাত্রীদের গুণগত মানের শিক্ষাদানের লক্ষ্যে কর্মসূচি নির্ধারণ করে, একঘেঁয়েমি দূর করে। বিদ্যালয় শিক্ষা কেবলমাত্র অক্ষর বা সংখ্যা পরিচয়ে সীমিত থাকে না। সুস্থ সবল জীবনের ভিত গড়া হয় স্কুলের নিত্যদিনের কার্যকলাপে। পরিচ্ছনতার অভ্যাস গড়ে তোলে বিদ্যালয়।
মিড-ডে মিল খাওয়ার আগে ও পরে সাবান দিয়ে হাত ও থালা ধোওয়া ছাত্র-ছাত্রীদের শিখিয়েছে বিদ্যালয়। এই নিয়ম শুধুমাত্র বিদ্যালয়ের চার দেওয়ালের গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে শিশুদের বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। প্রার্থনা সঙ্গীতের সমাবেশের মধ্যে দিয়ে শৃঙ্খলাবোধ তৈরি হয়।
কোনো স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকারা চিরস্থায়ী নন। কিন্তু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরিবর্তন হয় না। আসলে এটি স্থানীয় মানুষদের নিজস্ব সম্পদ। এখান থেকে ছাত্র-ছাত্রীরা ভাল গুণগুলি আয়ত্ত করে সমাজকে ভাল পথে চালিত করে। মানুষের অভ্যাস, রুচি-নীতির পরিবর্তন ঘটাতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা অপরিসীম। ছাত্র-ছাত্রীদের সুঅভ্যাস রপ্ত করানোর জায়গায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। ছাত্র-ছাত্রীরা বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয় বা বিশ্ববিদ্যালয়ে যা শেখে তা বাড়িতেও করতে চায়। এর ইতিবাচক প্রভাব পরিবারের সদস্যদের মধ্যে পড়ে। লাভবান হয় সমাজ।
যান্ত্রিকতামুক্ত শিক্ষার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যবস্থার বিকল্প কিছু নেই। খেলাধুলার ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে ছাত্র-ছাত্রীরা যেমন আনন্দ অনুভব করে, তেমনি শরীর ও মনের গঠন হয়। সাংস্কৃতিক কার্যাবলির মধ্যে দিয়ে পিছিয়ে পড়া শিশু ও কিশোরদের উৎসাহিত করার মধ্যে দিয়ে পড়াশোনায় মনোযোগী করার কাজটি বিদ্যালয় করে। বিদ্যালয় জীবনে শৃঙ্খলা স্থাপনের মধ্যে দিয়ে দেশ গঠনের কাজটি হয়।
২০২০ সাল থেকে ছাত্র-ছাত্রীরা শ্রেণিকক্ষের বাইরে। কারণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ। ছাত্র-ছাত্রীর কাছে শ্রেণিকক্ষ খুবই গুরুত্বপূর্ণ জায়গা। শিক্ষার তিনটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান - শিক্ষক, সিলেবাস ও শিক্ষার্থী। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মধ্যে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ শ্রেণিকক্ষেই গড়ে ওঠে। উন্নত শ্রেণি শিখনই শিক্ষার্থীর শিক্ষার মানকে উন্নত করে। শ্রেণি শিখনের উৎকর্ষতা বিভিন্ন বিষয়ের প্রতি শিক্ষার্থীর আগ্রহ বৃদ্ধি করে। বর্তমান পরিস্থিতিতে উজ্জ্বলতর শ্রেণি শিখন থেকে বঞ্চিত হচ্ছে ছাত্র-ছাত্রীরা। আত্মশিক্ষা ও শ্রেণি শিখনের গুরুত্ব আজ ব্যাহত। যদিও শ্রেণি শিখনই বিদ্যালয় ব্যবস্থার মেরুদণ্ড।
শিক্ষকরা শ্রেণি শিখনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকেন। উন্নত শ্রেণি শিখন ছাত্র-ছাত্রীদের বিদ্যালয়মুখী করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। শিক্ষার্থীর মানসিক চাহিদা ও আবেগ উপলব্ধি করে শ্রেণি শিখন পদ্ধতি নির্ধারিত হয়। শ্রেণি শিখনের ক্ষেত্রে এমন বিষয় ও পদ্ধতি নির্বাচিত হয় যার মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীর চাহিদাগুলির প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে পূরণ হয়।
শ্রেণিকক্ষ ছাড়া অংশগ্রহণমূলক শিখন প্রক্রিয়ার প্রয়োগ ঘটবে কী করে? শ্রেণিকক্ষেই সমস্ত শিক্ষার্থীর শিখনগত মান অনুযায়ী কয়েকটি উপদলে ভাগ করে শেখানো হয়। শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মধ্যে স্বাভাবিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে শ্রেণিকক্ষে। শ্রেণিকক্ষে উন্নত শিক্ষাদান পদ্ধতিই শিক্ষার্থীকে পাঠগ্রহণে আগ্রহী ও মনোযোগী করে। এরফলে শিক্ষার মানোন্নয়ন ঘটে - যা গড়ে তোলে শিক্ষিত ভবিষ্যৎ নাগরিক। শ্রেণিকক্ষে উন্নত পাঠদানের ফলে শিক্ষার্থী সমস্যা সমাধানে ক্ষমতা অর্জন করে, দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার সাহস সঞ্চয় করে। অর্জিত জ্ঞানের তাৎক্ষণিক প্রয়োগে নিজস্বতাকে ব্যাপ্ত করে।
শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থী কেবলমাত্র জ্ঞানই অর্জন করে না, তার মধ্যে তৈরি হয় মূল্যবোধ, দক্ষতা। উজ্জ্বলতর শ্রেণি শিখনের মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীর সামঞ্জস্যপূর্ণ ব্যক্তিত্ব গড়ে ওঠে। শ্রেণি শিখনের মাধ্যমে শিক্ষক-শিক্ষিকারা শিক্ষার্থীদের পঠন পাঠনের সুষ্ঠু ব্যবস্থা করেন। শ্রেণিকক্ষ সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা, সুদক্ষ পরিচালনার মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থী বিদ্যালয়ে আসতে আগ্রহী হন। অনেক ক্ষেত্রে ছাত্র-ছাত্রীরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে কখন তাদের প্রিয় শিক্ষক বা শিক্ষিকা শ্রেণিকক্ষে আসবেন। শ্রেণিকক্ষে বিজ্ঞানভিত্তিক শ্রেণি শিখন যেমন-প্রশ্নোত্তরপর্ব, পাঠের পূর্বালোকন, মতামত বিনিময় প্রভৃতির মাধ্যমে পাঠ্য বিষয় অধিকতর সহজ ও মনোগ্রাহী হয়ে ওঠে। এসব কিছু থেকে বঞ্চিত হচ্ছে ছাত্র-ছাত্রীরা।
বিদ্যালয়ের শ্রেণি কক্ষগুলিতে সামাজিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয় ও মেধাস্তর-বিভিন্নতা সম্পন্ন শিক্ষার্থী থাকেন। এই বিভিন্নতা যাতে বিভেদ সৃষ্টি না করে তা দেখেন শিক্ষক-শিক্ষিকারা। অর্থাৎ শ্রেণিকক্ষে শিক্ষকের ভূমিকা শিক্ষার্থীদের মধ্যে সাম্য ও ভ্রাতৃত্ববোধ সঞ্চারে সহায়তা করে। শ্রেণিকক্ষে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্ক স্থাপনের উপর গড়ে ওঠে ভবিষ্যৎ শিক্ষাজীবনের বুনিয়াদ। শ্রেণিকক্ষে গড়ে ওঠে শৃঙ্খলা। শ্রেণিকক্ষের শিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থীর মনে জাতীয় ঐক্যের ভাব গড়ে ওঠে।
শ্রেণিকক্ষে বর্ধিত ছাত্র সংখ্যা ও ভিন্নমেধার ছাত্রের উপস্থিতির কারণে ‘সঙ্গীশিখন’ পদ্ধতি শ্রেণি শিখনে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। এর ফলে শিক্ষার্থীদের সক্রিয় করা সম্ভব। কিন্তু এসব কিছু থেকে আজ ছাত্র-ছাত্রীরা অনেক দূরে।
২০২০ সালের মার্চ মাসের পর ছাত্র-ছাত্রীরা কার্যত তাদের শিক্ষক-শিক্ষিকাদের সান্নিধ্য পাচ্ছে না। আবার শিক্ষক-শিক্ষিকারা তাঁদের স্নেহের ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে মিলিত হতে পারছেন না। এ যন্ত্রণা কি আমাদের দেশের রাষ্ট্রনায়কেরা এবং রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বোঝেন। শিক্ষকতা শুধুমাত্র একটি পেশা নয় - এটি একটি ব্রতও। ছাত্রছাত্রীদের জীবনকে সুন্দর করে গড়ে তুলতে শিক্ষা দেন শিক্ষক। অভিজ্ঞ শিক্ষাবিদদের মতে, ‘শিক্ষকই ছাত্রের শূন্যতা ভরাট করে তোলেন’। সার্বিক দৃষ্টিকোন থেকে শিক্ষককে বলা হয় মানুষ গড়ার কারিগর।
দেশের ভবিষ্যৎ নাগরিকদের গড়ে তোলেন শিক্ষক সমাজ। ছাত্রছাত্রী শিক্ষক-শিক্ষিকাকে অনুসরণ করে, তাঁদের আচার-আচরণের দ্বারা প্রভাবিত হয়। শিক্ষক কি কেবলমাত্র জ্ঞান বিতরণ করেন? শিক্ষক-শিক্ষিকারা তাদের কাজের মাধ্যমে শিক্ষার্থীর নৈতিক, বৌদ্ধিক ও মানসিক বিকাশকে সম্ভব করে তোলেন। শিক্ষার্থীর কাছে শিক্ষকরাই আদর্শ মডেল। শাসন-স্নেহ, সমবেদনা, সহানুভূতি ও বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যবহারের মধ্যে দিয়ে ছাত্রছাত্রীকে গড়ে তোলেন। তাই একজন শিক্ষক হয়ে ওঠেন ‘Friend, Philosopher and Guide’।
শিক্ষক-শিক্ষিকারা কেবলমাত্র পাঠদান, পরীক্ষা গ্রহণ, খাতা দেখা ও ফলপ্রকাশের মধ্যেই তাঁর কাজ সীমাবদ্ধ রাখেন না। শিক্ষক যেমন জ্ঞানার্জনে শিক্ষার্থীদের সহায়তা করেন তেমনি ভালো অভ্যাস, চরিত্র গঠন, বিবিধ দক্ষতা অর্জনে ভূমিকা পালন করেন। শিক্ষক-শিক্ষিকাদের মিলিত প্রচেষ্টায় এক একটি স্কুল হয়ে ওঠে শিক্ষার্থীর কাছে স্বর্গরাজ্য।
একটি শিশুর জীবনকে সর্বাঙ্গীণভাবে উজ্জ্বল করার ক্ষেত্রে শিক্ষকদের যথেষ্ট উদ্যোগ থাকে। ছাত্র-ছাত্রীদের প্রতিভাগুলিকে বিকশিত করার চেষ্টা করেন শিক্ষক-শিক্ষিকারা। শিক্ষক-শিক্ষিকাদের নিরলস প্রচেষ্টার ফলেই অনেক ছাত্রছাত্রী লজ্জা ও ভয় সরিয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সহজে শিখে যায়। কোভিডকে ঢাল করে সরকার ছাত্রছাত্রীদের এ সুযোগ কেড়ে নিয়েছে।
কতদিন ধরে মিড-ডে মিল বন্ধ। প্রান্তিক বাড়ির ছেলেমেয়েদের কাছে মিড-ডে মিলই ছিল দ্বিপ্রাহরিক আহার। এটা ঠিক মিড-ডে মিল চালু হওয়ার পর বিদ্যালয়ে উপস্থিতির হার বেড়েছে। কমেছে ড্রপ আউটের সংখ্যা। এখন মাসে একবার কিছু চাল, আলু, সোয়াবিন দেওয়া হয়। এতে ক’দিন বা চলে। কোভিড বিধি মেনেই রান্না করা খাবার ছাত্রছাত্রীদের বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দেওয়া যেত। মিড-ডে মিলের মাধ্যমে কিছুটা হলেও অপুষ্টি দূর হয়েছিল। মিড-ডে মিলের বরাদ্দকৃত অর্থের খরচ না হওয়া অংশটি কোথায় যাচ্ছে?
শাসক দলের অন্ধ সমর্থকরা বলছেন, অনলাইনে তো ক্লাস হচ্ছে। আসলে তো নয়া জাতীয় শিক্ষানীতিতে সাধারণের শিক্ষা ব্যবস্থা আক্রমণের মুখে। নয়া জাতীয় শিক্ষানীতিতে অনলাইন-নির্ভর শিক্ষা ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এই অনলাইন-নির্ভর শিক্ষার সুযোগ কতজন গ্রহণ করতে পারবে? ন্যাশনাল স্যাম্পল সার্ভের রিপোর্ট (২০১৭-১৮) অনুযায়ী শহরে মাত্র ২৩.৪ শতাংশ মানুষ ও গ্রামে মাত্র ৪.৪ শতাংশ মানুষের কাছে কম্পিউটার আছে। ইন্টারনেটের সুযোগ পান মাত্র ২৩.৮ শতাংশ মানুষ। অনলাইন এডুকেশনের একমাত্র শর্ত ইন্টারনেট কানেকশন, সেটা দেশের বেশিরভাগ মানুষের আয়ত্তে নেই।
মোদ্দা কথা, কোভিডের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি মেনে সরকার অফিস, আদালত, বাজার, দোকানপাট খোলা রাখতে পারলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গেটের তালা বন্ধ থাকবে কেন? দৈহিক দূরত্ব বজায় রেখেই একটি একটি শ্রেণিকে সপ্তাহে তিনদিন করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আসার ব্যবস্থা কেন করা যাবে না? স্ব স্ব বিদ্যালয়ে দৈহিক দূরত্ব বজায় রেখেই মাধ্যমিক, উচ্চ-মাধ্যমিক পরীক্ষা করা যেত। আওয়াজ উঠুক - কোভিডবিধি মেনেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গেটের তালা খোলা হোক।