৫৮ বর্ষ ৪৬ সংখ্যা / ২ জুলাই, ২০২১ / ১৭ আষাঢ়, ১৪২৮
কোভিড-১৯ ও বিপন্ন শিক্ষা
কৌশিক মুখোপাধ্যায়
কোভিডের দ্বিতীয় তরঙ্গের মাঝেই এ দেশের শ্রমজীবী মানুষের বিপন্নতার চিত্র উঠে এসেছে সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকনমির সমীক্ষায়। এক কোটির বেশি মানুষ দ্বিতীয় তরঙ্গের দু'মাসের মধ্যেই কাজ খুইয়েছেন, ৯৭ শতাংশ পরিবারেরই গতবছরের থেকে রোজগার কমেছে বলে চিহ্নিত। এ সত্য একেবারেই পরিষ্কার যে সামগ্রিক এই অর্থনৈতিক বিপন্নতার মুখোমুখি মূলত এ সমাজের নিম্ন মধ্যবিত্ত হতে দরিদ্র, অতি দরিদ্র শ্রেণি। কিন্তু শুধুমাত্র অর্থনৈতিক বিপর্যয়ই নয়, একইসাথে তার ফলশ্রুতিতে যে সামাজিক অভিঘাত আজ সৃষ্টি হয়েছে তার সুদুরপ্রসারী ফলাফল নিশ্চিতভাবেই আরও ভয়াবহ হতে চলেছে। বিশেষত, এই শ্রেণির আগামী প্রজন্মের যে ক্ষেত্রটি আজ সবথেকে বিপদসংকুল ও আক্রান্ত তা হলো শিক্ষা। বিগত প্রায় দেড় বছর দেশজুড়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হতে পরীক্ষাব্যবস্থা সম্পূর্ণ বন্ধ করে যেভাবে কার্যত সর্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থাকে লাটে তুলে দেওয়া হয়েছে,তা আগামীদিনে এক অপূরণীয় ক্ষতির সম্ভাবনাকে প্রতিমুহূর্তে আরো নিবিড় করছে। অনিবার্যভাবেই কোভিড-১৯-এর ভয়াবহতাকে ছাপিয়েও তার ভয়াল রূপ, বিবিধ সামাজিক সংকটের এক উদ্বেগঘন অসম চিত্র নানা সমীক্ষায় উঠে আসছে।
বিশ্বব্যাপী চিত্রঃ বিশ্বজুড়ে আর্থিক অবস্থার নিরিখে শিক্ষাক্ষেত্রে এক বিপুল অসমতার বিবিধ নিদর্শন নানা দেশে নানা প্রেক্ষিতে লক্ষণীয়। ইউনিসেফ-এর তথ্য অনুযায়ী ৩-১৭ বছর বয়সি প্রতি পাঁচজন শিশুর একজন স্কুলশিক্ষার বাইরে। প্রায় ৬১.৭ কোটি শিশু ও কিশোর-কিশোরী পড়তে ও গণিতে ন্যূনতম যোগ্যতামান পূরণ করতে অক্ষম। তথাকথিত এ মহামারী এই পরিস্থিতিকেই আরও সংকটপূর্ণ করে তুলেছে। সেভ দ্য চিলড্রেন ও ইউনিসেফ-এর দ্বারা প্রকাশিত তথ্যে দেখা যাচ্ছে মূলত উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এই মহামারীর কারণে অতিরিক্ত প্রায় ১৫ কোটি শিশু দরিদ্রতার শিকার হতে চলেছে। এ মহামারীর প্রভাবে এবং একইসাথে উপযুক্ত রাষ্ট্রীয় রক্ষাকবচের অভাবে দরিদ্র পরিবারগুলোতে বাস করা শিশুর সংখ্যা হতে চলেছে ৭২.৫ কোটি, যার ২/৩ ভাগই সাব-সাহারান আফ্রিকা ও দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর বাসিন্দা। কার্যত আধুনিক পৃথিবীর ইতিহাসে শিক্ষাক্ষেত্রে এটাই সর্বব্যাপী ও সবথেকে বড়ো বিপর্যয় রূপে চিহ্নিত হতে চলেছে।
অর্থনৈতিক দিক থেকে পিছিয়ে থাকা দেশগুলোতে সংকটজনক শিক্ষা ব্যবস্থা বর্তমান পরিস্থিতিতে আরো জটিল হয়েছে। বিকল্প অনলাইন শিক্ষার সুযোগ উচ্চবিত্ত বা উচ্চমধ্যবিত্তদের কাছে সুলভ হলেও সাধারণ দরিদ্র পরিবারগুলো পক্ষে তা সম্ভবপর নয়। ইউনিসেফ-এর তথ্যও বলছে, আজকের পৃথিবীতে প্রতি তিনজন শিশুর একজন অর্থাৎ প্রায় ৪৬.৩ কোটি শিশু দূরশিক্ষার নানা প্রকরণ হতে বঞ্চিত। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে দেশে ইন্টারনেট সংযোগ যত কম সে সমস্ত দেশে স্কুল বন্ধ থাকার সময়সীমাও তত দীর্ঘায়িত হয়েছে। ইউনিসেফ ও ইন্টারন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন ইউনিয়নে'র যৌথ সমীক্ষা অনুযায়ী দেখা যাচ্ছে বিশ্বের প্রায় ২২০ কোটি অর্থাৎ ২/৩ ভাগ শিশু ও তরুণের (যাদের বয়স ২৫ বছর বা তার কম) বাড়িতে কোনো ইন্টারনেট সংযোগ নেই।
ফলত, বিগত এক বছরের বেশি সময় ধরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো আংশিক ও সম্পূর্ণ বন্ধ থাকার কারণে সর্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা সমগ্র বিশ্বেই এক চূড়ান্ত অসম সংকট তৈরি করেছে। এ মহামারীর প্রভাবে আমাদের দেশেও সর্বজনীন শিক্ষা ক্ষেত্রের প্রায় সম্পূর্ণ স্তব্ধ হয়ে যাওয়ার মলিন বাস্তবতার বিবিধ সামাজিক লক্ষণ নানা সমীক্ষা ও গবেষণায় আজ প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে।
ভারতের চিত্রঃ স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রকের ২০১৯ সালের রিপোর্টের নিরিখে দেখা যাচ্ছে, দেশের ৩৪.৭ শতাংশ শিশু কাঙ্ক্ষিত উচ্চতার নয় এবং ৩৩.৪ শতাংশ শিশুর ওজন নির্ধারিত ন্যূনতম মাত্রার থেকে কম। স্কুলে ভরতির আগেই এদেশের ৪১ ভাগ শিশু, স্কুলে যায় এমন ২৪ ভাগ ও বয়ঃসন্ধিকালীন ২৮ ভাগ শিশু রক্তাল্পতার শিকার। আর মেয়েদের মধ্যে বিশেষত ১৫-১৯ বছর বয়সিদের ক্ষেত্রে রক্তাল্পতার মাত্রা প্রায় ৫৪ শতাংশ।
এমন নানা তথ্য হতে এ সত্যই স্পষ্ট যে, এদেশে স্কুল শিক্ষার গণ্ডির আঙিনায় থাকা বা আসতে চলা বিপুল অংশের শিশু, কিশোর-কিশোরীদের ন্যূনতম শিক্ষার অধিকারের ক্ষেত্রে তাদের মৌলিক স্বাস্থ্যের সংকটই অন্যতম প্রধান অন্তরায়। এমন প্রেক্ষিতে এই মহামারীর ফলে অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র ও মিড-ডে-মিল প্রকল্পের মাধ্যমে রান্না করা খাবার দেওয়ার ব্যবস্থা পুরোপুরি ভেঙে পড়ার কারণে শিশুদের স্বাস্থ্য ও পুষ্টির প্রশ্নে এক দীর্ঘকালীন নেতিবাচক প্রভাব তৈরি হতে চলেছে। পাশাপাশি এক বিপুল অংশের শিশু শুধুমাত্র ‘ডিজিটাল ডিভাইডের’ কারণে আজ শিক্ষাক্ষেত্রের বাইরে। ইন্টারনেট ব্যবহারের তথ্য তালাশ করলে ২০১৯ সালের সরকারি নথিই বলে দিচ্ছে গোটা দেশে মাত্র ২৪ শতাংশ পরিবারে তা ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে। আর গ্রামীণ ভারতের অবস্থা অতি শোচনীয়, সেখানে তা মাত্র ৪ শতাংশ। ইউনিসেফ-এর সাম্প্রতিক এক তথ্যের নিরিখে ভারতের স্কুলে যাওয়া শিশুদের ক্ষেত্রে বাড়িতে ইন্টারনেটের ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে মাত্র ৮.৫% শতাংশের। ফলত, দেশজুড়ে মহামারীর এ সময়কালে প্রায় ১৫ লক্ষ বিদ্যালয়ের যে ৩২ কোটি ছেলেমেয়েদের স্কুল-কলেজে যাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে তাদের এক বড়ো অংশের ক্ষেত্রেই দূরশিক্ষা বা ডিজিটাল শিক্ষার পথও কার্যত রুদ্ধ হয়ে গেছে। যতটুকু শিক্ষার সুযোগ মহামারীর এ সময়কালে দেশের ছাত্রছাত্রীদের কাছে উন্মুক্ত থেকেছে সেখানেও গ্রাম-শহর ভেদে, অর্থনৈতিক অবস্থা ভেদে, লিঙ্গ ভেদে এক ভয়ানক বৈষম্যের চেহারাই প্রকট। সর্বজনীন শিক্ষার মৌলিক অধিকারের প্রশ্নে এক্ষেত্রেও যথারীতি রাষ্ট্র তার সমস্ত দায়কে অস্বীকার করে এ সংকটকেও বাজারের হাতে তুলে দিতে ব্যস্ত। শিক্ষার বাজারিকরণের প্রবণতার সাথে সামঞ্জস্য রেখেই এমন পরিস্থিতির মধ্যেও সংসদ ও কার্যত সমস্ত আলাপ-আলোচনাকে এড়িয়ে নয়া জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। এই নীতি অনুযায়ী সাধারণ শিক্ষা কাঠামোর পাশাপাশি অনলাইন শিক্ষাতেও ব্যাপকভাবে জোর দেবার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। কোভিড-১৯ আবির্ভাবের আগেই কেপিএমজি ও গুগলের যৌথ উদ্যোগে সংগঠিত এক সমীক্ষায় প্রকাশ পেয়েছে আগামী দিনে ভারতে অনলাইন শিক্ষার বাজার প্রায় ১.৯৬ বিলিয়ন ডলার বা ১৪,৮৩৬ কোটি টাকা বাড়তে চলেছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে স্বাভাবিকভাবেই এদেশে প্রযুক্তিনির্ভর এই বাজার বহুগুণে বাড়তে চলেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরে ভারতেই ম্যাসিভ ওপেন অনলাইন কোর্সের দ্বিতীয় বৃহত্তম বাজার হতে চলেছে। এ দেশের সামগ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থায় বাণিজ্যিক প্রভাব বৃদ্ধি আগামী দিনে নিশ্চিতভাবেই শিক্ষাক্ষেত্রকে আর্থসামাজিকভাবে দুর্বল অংশের মানুষের কাছে আরো অনিশ্চিত করে তুলতে চাইছে।
দিল্লির এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা - চাইল্ড ফান্ড ইন্ডিয়া কর্তৃক বিহার, ছত্রিশগড়, দিল্লি, ঝাড়খণ্ড, মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, ওডিশা, রাজস্থান, উত্তরপ্রদেশ, পশ্চিমবঙ্গের পিছিয়ে পড়া ২০টি জেলায় চালানো সমীক্ষার ভিত্তিতে দেখা যাচ্ছে, এই সমস্ত এলাকার প্রায় ৬১ শতাংশ শিশুই আশঙ্কিত যে বর্তমান পরিস্থিতিতে অতিরিক্ত সহায়তা না পেলে আগামীদিনে তাদের পক্ষে পড়াশোনা চালানো অসম্ভব। গ্রামীণ ভারতে ইতিমধ্যেই কোথাও কোথাও স্কুলছুটের হার পৌঁছে গেছে প্রায় ৭০ শতাংশে। জীবন-জীবিকার অনিশ্চয়তা আজ অনিবার্যভাবেই এ সমাজের অন্তরে লালিত দীর্ঘকালীন নানা সামাজিক সংকটকেও পুনরুজ্জীবিত করছে। লিঙ্গগত অসমতার প্রভাব বর্তমান সময়ে ভয়ংকরভাবে বাড়ছে। সমাজের দুর্বলতম অংশ, বিশেষত নারীদের শিক্ষার আঙিনার বাইরে চলে যাওয়ার প্রবণতা বেড়েছে ভয়ানকভাবে। রাইট টু এডুকেশন ফোরাম’র জানুয়ারি, ২০২১-এর রিপোর্ট অনুযায়ী আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে, কোভিড-১৯-এর প্রভাবে সেকেন্ডারি স্তরে প্রায় ১ কোটি মেয়েরা স্কুল ড্রপ-আউটের শিকার হতে চলেছে। স্বাভাবিকভাবেই কোভিডজনিত বর্তমান পরিস্থিতিতে এদের বেশিরভাগই বাল্যবিবাহ, অসময়ে প্রসব, নারী পাচার, চূড়ান্ত দরিদ্রতা সহ নানা সামাজিক ব্যাধির সহজ শিকার হতে চলেছে।
আন্তর্জাতিক নারী দিবসের দিন ইউনিসেফ দ্বারা প্রকাশিত হয়েছে Covid-19: A threat to progress against child marriage নামাঙ্কিত এক রিপোর্ট, যেখানে বর্তমান পরিস্থিতিতে বাল্যবিবাহ সংক্রান্ত নানা তথ্যে এ সংকটের বাস্তব চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। যদিও শেষ দশ বছরে বাল্যবিবাহের হার ১৫ শতাংশ কমেছে, কিন্তু শুধুমাত্র কোভিড-১৯-ই বর্তমানে প্রায় ২.৫ কোটি এমন বিবাহের সম্ভাবনাকে বাড়িয়ে দিয়েছে। আমাদের দেশের পরিস্থিতিও ভয়াবহ। বিশ্বজুড়ে ৬৫ কোটি বাল্যবিবাহের শিকার হওয়া মহিলাদের অর্ধেকই বাস করেন ৫টি দেশে - ভারত, বাংলাদেশ, নাইজেরিয়া, ইথিওপিয়া ও ব্রাজিল। স্বাভাবিকভাবেই স্কুল বন্ধ থাকার কারণে বন্ধুদের থেকে দূরত্ব, সহায়তা প্রদানকারী কেন্দ্র ও প্রকল্পগুলো বন্ধ থাকা, ক্রমবর্ধমান দারিদ্র্য, বেকারি ও কর্মচ্যুতি বর্তমান পরিস্থিতিতে আমাদের দেশে বাল্যবিবাহের সম্ভাবনাকে আরো বাড়িয়ে তুলেছে। বিজু জনতা দলের রাজ্যসভার সাংসদ আমন পট্টনায়েকের মহিলা ও শিশু বিকাশ মন্ত্রকের কাছে দায়ের করা আরটিআই-এর ভিত্তিতে দেখা যাচ্ছে, আগস্ট ২০১৯-এর তুলনায় আগস্ট, ২০২০-তে দেশে বাল্যবিবাহ বেড়েছে প্রায় ৮৮ শতাংশ । তেলেঙ্গানার নারী উন্নয়ন ও শিশু বিকাশ দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী এপ্রিল, ২০২০ হতে মার্চ, ২০২১, এক বছরে বাল্যবিবাহ বেড়েছে প্রায় ২৭ শতাংশ।
বিগত এক বছরের বেশি সময় ধরে বাল্যবিবাহের ঘটনা বৃদ্ধির ভয়ানক প্রবণতা যেমন প্রকট হয়েছে, তারই পাশাপাশি ছোটো ছোটো ছেলেদের কায়িক শ্রমে যুক্ত করার মাত্রাও লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে। ২০১১ সালের জনগণনার তথ্যানুযায়ী প্রায় সাড়ে তিন কোটি শিশু শ্রমিক (৫-১৮ বছরের) দেশের নানা প্রান্তে নানা অসংগঠিত কাজে অতি কম মজুরিতে নিযুক্ত। ২০১৬ সালের তথ্য বলছে, রাজ্যে রাজ্যে থাকা ১০ কোটি পরিযায়ী শ্রমিকের প্রায় ২০-২৫ ভাগই শিশু। রাষ্ট্রপুঞ্জের সাম্প্রতিক এক রিপোর্টে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে, কোভিডের প্রভাবে ২০২২ সালের মধ্যে অতিরিক্ত প্রায় ৯০ লক্ষ শিশু নতুন করে শ্রমিক হতে চলেছেন। এমন আপৎকালীন পরিস্থিতিতে যদি বিপর্যয়ের মুখে দাঁড়িয়ে থাকা পরিবারগুলোকে ন্যূনতম সামাজিক সুরক্ষা না দেওয়া হয় তাহলে অতিরিক্ত শিশু শ্রমিকের সংখ্যা পৌঁছে যেতে পারে প্রায় ৪.৬ কোটিতে। Child Labour: Global Estimates, 2020 Trends & The Road Format Report শীর্ষক আইএলও এবং ইউনিসেফ কর্তৃক প্রকাশিত সমীক্ষাতেও আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে যে, কোভিডের প্রভাবে অর্থনৈতিক চাপের কারণে ভারতে মারাত্মক হারে শিশুশ্রমিক বৃদ্ধির সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। ক্যাম্পেইন এগেইনস্ট চাইল্ড লেবার নামক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার দ্বারা শুধুমাত্র তামিলনাড়ুর ২৪টি জেলায় করা এক সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে কোভিডের প্রভাবে স্কুল বন্ধ থাকার কারণে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা ২৮.২ শতাংশ হতে বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ৭৯.৬ শতাংশ । এ সময়ে পারিবারিক দরিদ্রতা বাড়ার কারণেই যে তাদের কাজে যুক্ত হতে হয়েছে, তা স্বীকার করেছে ৯৪ শতাংশ বাচ্চাই।
সামাজিকভাবে, মানসিকভাবে গোটা প্রজন্মকে করোনা আতঙ্কে বিগত এক বছরের বেশি সময় ধরে কার্যত রুদ্ধ করে রেখে দেওয়া হলো। কেড়ে নেওয়া হলো তাদের শৈশব-কৈশোর, ছিনিয়ে নেওয়া হলো শিক্ষার মৌলিক অধিকার। অর্থনীতির ঘুরে দাঁড়াবার জন্য পরিকল্পনার কথা, কৃষককে সহযোগিতার কথা হতে শিল্প-কারখানাকে পুনরুজ্জীবনের চিন্তাভাবনা তবু শোনা গেল। কিন্তু শিক্ষাক্ষেত্রকে কীভাবে, কী প্রক্রিয়ায় চালু করা যেতে পারে, পরীক্ষাব্যবস্থাকে কীভাবে এমন পরিস্থিতিতে সংগঠিত করা যেতে পারে, সমাজের সবার জন্য নূন্যতম শিক্ষা কীভাবে পৌঁছে দেওয়া যেতে পারে, শিক্ষককুলকে শুধু চাল, ডাল দেবার জন্য স্কুলে পাঠানো ছাড়াও কীভাবে সব ছাত্র-ছাত্রীকে পড়াশোনার জন্য এমন পরিস্থিতিতে ব্যবহার করা সম্ভব তা নিয়ে ন্যূনতম চিন্তাভাবনাও কেন করা সম্ভব হলো না? জীবনহানির আশঙ্কা, ঝুঁকির নানান চিত্র প্রতি মুহূর্তে চিত্রায়িত করে শুধুমাত্র শিক্ষাক্ষেত্রকেই এমনভাবে সম্পূর্ণ স্তব্ধ করে রাখা এক প্রকার অপরাধই। মূল্যায়ন করা দরকার করোনা রোগের আপাত ক্ষতির তুলনায় এভাবে সুদীর্ঘ সময় ধরে বই-খাতা কেড়ে নিয়ে সুদূরপ্রসারী যে ক্ষতির দিকে এ প্রজন্মকে ঠেলে দেওয়া হলো; সামাজিক, আর্থিক ও মানসিকভাবে যে ক্ষয়ের শিকার এ দেশের শিশুরা হলো তার বাস্তবতা সত্যিই কতটা প্রাসঙ্গিক! সামগ্রিক পরিস্থিতির বিচারে, বৈজ্ঞানিক চেতনার নিরিখে এবং সর্বোপরি এদেশের শিশুদের সর্বজনীন শিক্ষার মৌলিক অধিকারকে মান্যতা দিয়ে কীভাবে, কী প্রক্রিয়ায় ধীরে ধীরে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যবস্থাকে পুনরায় সচল করা সম্ভব, তার প্রেক্ষিতে বিকল্প ভাবনা, বিকল্প পথের সন্ধান আমাদের করতেই হবে। যুক্তিহীন আবেগ আর কৃত্রিম আতঙ্কের বলি করে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে এভাবে শেষ করে দেওয়া কোনো সভ্য রাষ্ট্রে কাম্য হতে পারে না।