E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৮ বর্ষ ৪৬ সংখ্যা / ২ জুলাই, ২০২১ / ১৭ আষাঢ়, ১৪২৮

রামদেবের মেকি আয়ুর্বেদ চর্চা ও নিষ্ক্রিয় সরকার

তপন মিশ্র


খোঁজ নিয়ে দেখলে বোঝা যাবে রামদেব এবং তার সঙ্গী বালকৃষ্ণের যেমন কোনো প্রথাগত আয়ুর্বেদ শিক্ষা নেই, তেমনই আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রতি কোনো সম্মানও নেই। আসলে এই দু'জনই হাতুড়ে এবং মেকি আয়ুর্বেদ চিকিৎসক এবং ফার্মাকোলজিস্ট। শুশ্রুত সংহিতার তৃতীয় অধ্যায়ের ৫২ নম্বর পঙক্তিতে উল্লেখ আছে, “Quacks arise if the King is incapable. Such quacks flourish and go only at the connivance of the King (administrator)", অনুবাদ (Acharya YT, Choukhmba Krisnadas Academy, 2004)। পাঠক বন্ধুরা নিশ্চয়ই পতঞ্জলির সঙ্গে যুক্ত হাতুড়ে আয়ুর্বেদ স্বঘোষিত গুরুদের সঙ্গে মেলাতে সক্ষম হচ্ছেন। চরক সংহিতায় প্রথম অধ্যায়ের ১২৭ নম্বর পঙক্তিতে (Acharya YT, Choukhmba Orientalia, 2004) উল্লেখিত আছে যে, "Imposters who wear the garb of physicians [who] walk the earth like messengers of death”। অর্থাৎ "চিকিৎসক নয় অথচ এমন মানুষ (হাতুড়ে চিকিৎসক) যারা চিকিৎসকের পোশাক পরে ঘোরে তারা সাক্ষাৎ মৃত্যুর বার্তাবাহক”। পরেই আবার লেখা হয়, ‘‘unlearned in scriptures, experience and knowledge of curative operations, but like to boast of their skills before the uneducated’’। অর্থাৎ এরা শাস্ত্রজ্ঞানহীন, অভিজ্ঞতা এবং নিরাময়মূলক ক্রিয়াকলাপ সম্পর্কে জ্ঞানহীন, কিন্তু এরা অশিক্ষিতদের সামনে তাদের দক্ষতা নিয়ে গর্ব করতে থাকে। সাধারণের প্রতি চরকের উপদেশ হলো, "should always avoid those foolish men who make a show of learning"। চরক বলছেন, "এই ধরণের মুর্খ ব্যক্তি যারা নিজেদের জ্ঞানী বলে মনে করে তাদের সঙ্গ ত্যাগ করতে হবে।" মনে হবে যেন রামদেব এবং তার সংস্থা আয়ুর্বেদের নামে মানুষের স্বাস্থ্য নিয়ে যে খেলা করছে, সেই কথা মাথায় রেখে চরকের এই উক্তি। সম্ভবত একারণেই পতঞ্জলির আয়ুর্বেদ সংক্রান্ত কোনো পুস্তিকায় চরকের উল্লেখ নেই। চরক সংহিতা এবং শুশ্রুত সংহিতা ছিল পার্চমেন্টের (পশুচর্মের কাগজ) ওপর ব্রাহ্মী লিপিতে লেখা। খ্রিস্টীয় ঊনবিংশ শতকে চরক সংহিতা ইংরেজি ভাষায় অনূদিত হয়। এই একবিংশ শতকেও এটি সমান জনপ্রিয় এবং কিয়োটো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক য়ামাশিতা এটির একটি ডিজিটাল সংস্করণও তৈরি করেছেন।

চরক সংহিতা এবং শুশ্রুত সংহিতা কেবল আয়ুর্বেদ শাস্ত্রের নয় আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থারও পথ প্রদর্শক। খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে আত্রেয়ী পুনর্বসু দ্রব্য গুণের উপর নির্ভর করে চিকিৎসা পদ্ধতি শুরু করেন। তাঁর প্রায় ৪০০ বছর পর অর্থাৎ খ্রিস্টীয় প্রথম শতকে এই আদিম চিকিৎসা শাস্ত্রকে বিকশিত করে চরক ‘চরক সংহিতা’ রচনা করেন। চরকের সম্পাদনাটি এতই উৎকৃষ্ট ছিল যে মূল লেখক না হওয়া সত্ত্বেও এই গ্রন্থটিকে চরক সংহিতা বলা হতে থাকে। এখানেই প্রথম ‘আয়ুর্বেদ’ শব্দটির প্রচলন শুরু হয়। এই ৮ খণ্ডের বইটির ইংরেজি সংস্করণ ৪টি খণ্ডে পাওয়া যায়। বইটিতে চিকিৎসা পদ্ধতি ছাড়াও চিকিৎসা শাস্ত্রের বিভিন্ন দিক যেমন - মানবদেহের গঠন, সুষম খাদ্য, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ইত্যাদি অনেক বিষয়ে আলোচনা করা আছে। সুশ্রুত সংহিতার রচনাকাল খ্রিস্টপূর্ব ৬০০ শতাব্দী বলে মনে করা হয়। কেউ কেউ মনে করেন যে, এই উভয় গ্রন্থই গুপ্ত যুগে লিখিত হয়। চরক সংহিতা, সুশ্রুত সংহিতা এদেশের প্রাচীন চিকিৎসা বিজ্ঞান চর্চার অংশ বিশেষ। কিছু সময় পর আরও প্রাঞ্জল করে দ্রব্য বা বস্তু নির্ভর চিকিৎসা ব্যবস্থাকে অষ্টাঙ্গ সমগ্র ও অষ্টাঙ্গ হৃদয় (খ্রিস্টীয় অষ্টম-নবম শতাব্দী) নামে গ্রন্থ রচনা করেন ভাগবত। আচার্য পি সি রায়-এর মতে, আনুমানিক অষ্টম কি নবম শতাব্দীতে যখন আয়ুর্বেদের বিকাশের পথ প্রায় রুদ্ধ হয়ে এসেছে, ঠিক সেই সময় ভাগবত অষ্টাঙ্গ সমগ্র এবং অষ্টাঙ্গ হৃদয় রচনা করেন [P. C. Ray: History of Chemistry in Ancient and Medieval India, Indian Chemical Society, Calcutta, 1956]। লক্ষ করে দেখবেন যে, পতঞ্জলির প্রতিষ্ঠাতা রামদেব এবং বালকৃষ্ণ আমাদের দেশের প্রাচীন চিকিৎসা বিজ্ঞানের এই উজ্জ্বল ঐতিহ্যের প্রতি কোনো সম্মান তাঁদের কোনো প্রকাশনা বা ওয়েবসাইটে দেখাননি।

তৎকালীন সমাজে আয়ুর্বেদ ছিল প্রগতিশীল

প্রাচীন আয়ুর্বেদ চিকিৎসা পদ্ধতি প্রচলনের আগে মন্ত্র, তন্ত্র, পূজা ইত্যদির মধ্যে চিকিৎসা ব্যবস্থা আবদ্ধ ছিল। চরক এবং সুশ্রুত এই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে দ্রব্য বা পদার্থ ব্যবহার করে চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রচলন করেন। এর মধ্য দিয়ে যা প্রতিষ্ঠিত হয় তা হলো বস্তুই নিরাময়ের একমাত্র উপায়। এভাবেই প্রথম চিকিৎসা ব্যবস্থা (অন্ধ)বিশ্বাস-নির্ভরতা থেকে যুক্তিনির্ভরতায় উত্তরণ ঘটে। ভাববাদী চিকিৎসা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে চরক এবং সুশ্রুতের প্রয়াস অত্যন্ত সবিস্তারে দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় তাঁর বিভিন্ন গ্রন্থে আলোচনা করেন।

এদেশে আয়ুর্বেদ চিকিৎসা পদ্ধতির যে যে ঐতিহ্য রয়েছে, সেই ঐতিহ্যকে পাথেয় করে দীর্ঘিদিন ধরে আমদের দেশে আয়ুর্বেদ চিকিৎসা বিজ্ঞানে স্নাতক (Bachelor’s degree in ayurvedic medicine and surgery, BAMS) এবং তার পর স্নাতকোত্তর শিক্ষার ব্যবস্থা আছে। যদি কেউ আয়ুর্বেদ ঔষধ তৈরি বা পরীক্ষা নিরীক্ষা, গবেষণা করতে চান তাহলে তাকে শুরু করতে হয় B. Pharm অর্থাৎ ফার্মাকোলজির স্নাতক হতে হয়। কিন্তু রামদেব বা এবং বালকৃষ্ণ কারও এই ধরনের কোনো শিক্ষার সঙ্গে যোগ নেই অর্থাৎ যোগ্যতা নেই। পৃথিবীতে এমন অনেক মানুষ আছেন যাদের প্রথাগত শিক্ষা না থাকলেও বিভিন্ন ক্ষেত্রে স্বনামধন্য হয়েছেন। কিন্তু এই ভ্রান্ত চিকিৎসা-ব্যবসায়ীরত্ন যুগলের প্রতারণা করাই একমাত্র প্রতিভা।

অবৈজ্ঞানিক চিকিৎসা শাস্ত্র

আমাদের দেশে প্রতিষ্ঠিত আয়ুর্বেদ চিকিৎসকরা পতঞ্জলির এই প্রতারণার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন। তাঁদের অনেকের মতে হাইপার টেনসন (উচ্চ রক্তচাপ) এর চিকিৎসার কোনো নিরাময়ের পদ্ধতি নেই। পতঞ্জলির “দিব্য মুক্ত বটি এক্সট্রা পাওয়ার” নামে যে উচ্চ রক্ত চাপের ঔষধের কথা বলা হচ্ছে তা চিকিৎসাবিধিসম্মত নয়। পতঞ্জলির ওয়েবসাইটে লেখা আছে এই ঔষধ তৈরি হয়েছে, “successfully experimenting with millions of patients” অর্থাৎ লক্ষ লক্ষ মানুষের উপর পরীক্ষা নিরীক্ষার পর। ভারতে বা যেকোনো দেশে কোনও নূতন ঔষধের আবিস্কার এর পর মানব দেহে পরীক্ষা নিরীক্ষার জন্য Clinical Trial Registry India নামে একটি ব্যবস্থা আছে। সমস্ত ধরণের চিকিৎসা ব্যবস্থার জন্য এই trial বা পরীক্ষা প্রযোজ্য। কিন্তু এই দিব্য বটির জন্য মাত্র ৫০ জনের উপর ট্রায়ালের অস্বচ্ছ তথ্য তারা দিচ্ছেন, যদিও মুখে বলছেন যে লক্ষ লক্ষ মানুষের উপর পরীক্ষা হয়েছে। করোনিল নামে করোনা চিকিৎসার ঔষধটি মাত্র ১০০ জন লক্ষণবিহীন (asymptomatic) রুগীর উপর ট্রায়ালের কথা বলা হয়েছে। ট্রায়ালের জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক কিছু নিয়ম আছে, যার ধারে কাছেও পতঞ্জলি পৌঁছাতে পারেনি। তাই রামদেবকে কেউ যদি আয়ুর্বেদের প্রতিভূ ভাবেন তাহলে কিছুদিন পর মানুষের কাছে আয়ুর্বেদ গ্রহণযোগ্যতা হারাবে।

তাও প্রতিবাদ নেই কেন?

কিন্তু এত সবের পর সরকার কী করছে? এই দুর্নীতির বিরুদ্ধে শাস্তি বিধান তো দূর বরং দেশের আয়ুশ (Ayurveda, Yoga and Naturopathy, Unani, Siddha and Homoeopathy) মন্ত্রক পতঞ্জলিকে সহযোগিতা করছে। ২০০৫ সালে সিপিআই(এম)-এর পলিটবুরো সদস্য বৃন্দা কারাতের আনা নিরামিষ খাদ্যের প্রবক্তা রামদেবের ঔষধে গোপনে মানুষের খুলির হাড়, উদবেড়াল (Otter)-এর অণ্ডকোষ এবং হরিণের শিঙের গুঁড়ো মেশানোর অভিযোগ আলোচনায় আসে। এই সময়ে রামদেবের দিব্য যোগ মন্দির ট্রাস্ট ১১৫ জন কর্মচারীকে ছাঁটাই করে। ২০০৬ সালের জানুয়ারি মাসে এই অভিযোগগুলি প্রমাণিত হয়। পরীক্ষাগারে প্রমাণিত হয় যে, মৃগীরোগ (epilepsy) এবং যৌন ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য রামদেবের তৈরি তথা কথিত হারবাল ঔষধ (herbal medicine)-এ মানুষ এবং প্রাণীর ডিএনএ (deoxyribonucleic acid) আছে। কিন্তু তৎকালীন সরকার কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।

প্রথমত, যারা কোনও সংখ্যালঘু মানুষের টিফিন কৌটায় গোমাংসের গন্ধ পায়, তারাও নির্বিবাদে হাড়-মাংস যুক্ত এই নিরামিষ হারবাল ঔষধ গিলছে। আসলে পতঞ্জলির পণ্যের মধ্যে হিদুত্বের আফিম এতোটাই মেশানো আছে যে তার দোষ অনেকেই খুঁজে পান না।

দ্বিতীয়ত, আয়ুর্বেদ বিজ্ঞানের গবেষণার সুযোগ এদেশে অত্যন্ত সঙ্কুচিত। প্রখ্যাত কার্ডিওলজির শল্য চিকিৎসক (allopathic cardiologist), আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা ব্যবস্থার ইতিহাসকার, প্রাক্তন সভাপতি, ইন্ডিয়ান একাডেমি অফ সায়েন্স এবং গবেষক পদ্মবিভূষণ এম এস ভালিয়াথান (Dr. M. S. Valiathan)-এর অভিমত, এখনও এদেশে অনেক মানুষের আয়ুর্বেদের উপর ভরসা থাকলে 'হু' র পদ্ধতি মেনে খুবই স্বল্প ক্লিনিকাল ট্রায়াল এখানে হয়। ফলে তথ্যের অভাবে অনেক ক্ষেত্রেই এই চিকিৎসা ব্যবস্থা বিজ্ঞানসম্মত মনে করা যায়না। এই সুযোগ নিচ্ছে রামদেবের মতো মেকি আয়ুর্বেদের হাতুড়েরা। অন্য কথায় বললে এসব গাফিলতি তৈরি করে সুযোগ করে দেওয়া হচ্ছে ওই প্রতারকদের।

অতি সম্প্রতি রামদেবের অ্যালোপ্যাথি চিকিৎসা ব্যবস্থার উপর আক্রমণ এক অপরাধমূলক কাজ এবিষয়ে সন্দেহ নেই। বিজ্ঞাননির্ভর চিকিৎসা ব্যবস্থা হিন্দুত্ববাদীদের চক্ষুঃশূল হবে এটা আবার নূতন কি? এই ব্যবস্থাই বিভিন্ন সময়ে অতিমারী এবং মহামারী থেকে মানুষকে বাঁচিয়েছে। এই অতিমারীর সময়ে পৃথিবীর প্রায় ৯৯ শতাংশ মানুষ এই অ্যালোপ্যাথি ব্যবস্থার উপর নির্ভরশীল। আইএমএ (Indian Medical Association) বলছে যে, রামদেবের অভিযোগ হলো “Lakhs of patients have died after taking allopathic medicines.” আইএমএ আরও বলছে, “Ramdev should be booked under relevant sections of the Epidemic Diseases Act, 1987"। অ্যালোপ্যাথি চিকিৎসায় লক্ষ মানুষের মৃত্যুর কথা বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদের উপর আক্রমণ। তাই আইএমএ-র দাবি এপিডেমিক অ্যাক্ট ১৯৮৭ অনুযায়ী রামদেবকে গ্রেপ্তার করতে হবে।

রামদেবের এই মন্তব্যের পরে কেন্দ্রীয় সরকারের স্বাস্থ্যমন্ত্রী একটি চিঠি দেওয়া ছাড়া কোনো পদক্ষেপ নেননি। চিঠিতে কেবল রামদেবকে তার বিজ্ঞান বিরোধী মন্তব্য তুলে নিতে বলা হয়েছে। মন্তব্য না তুললে কী শাস্তি হতে পারে তার কোনো উল্লেখ চিঠিতে নেই। ফলে বুঝতে অসুবিধা হয়না যে, সরকার দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা, চিকিৎসক, বিজ্ঞান গবেষণা এবং যুক্তিবাদের উপর মানুষের আস্থাকে সম্মান করতে পারেনি বরং মানুষের আস্থাকে দুর্বল করার চেষ্টা করছে। যখন দেশ অতিমারীর বিরুদ্ধে লড়ছে, সেই সময়ে মানুষের একমাত্র আশ্রয় এই আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থার উপর বিষোদ্গারকে সরকার দেশদ্রোহিতা বলে মনে করেনা। কিন্তু আমাদের মতো দেশের আরও কোটি কোটি মানুষ রামদেব এবং তার সাকরেদদের দেশদ্রোহী ছাড়া অন্য কিছু মনে করতে পারেন না।