৬০ বর্ষ ৪২ সংখ্যা / ২ জুন, ২০২৩ / ১৮ জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩০
কুস্তি সংস্থার কর্তার গ্রেপ্তারি চেয়ে কেন্দ্রীয় সরকারকে সময়সীমা বেধে দিলেন আন্তর্জাতিক পদকজয়ী কুস্তিগিররা
নিজস্ব সংবাদদাতাঃ যৌন হয়রানির প্রতিকার চাইতে গিয়ে নির্মম পুলিশি হিংস্রতার মুখে পড়েও নিজেদের অবস্থানে অনড় রয়েছেন দেশের পদকজয়ী কুস্তিগিররা। পুলিশি তদন্তের অবিলম্বে নিষ্পত্তি চান তাঁরা। যৌন হেনস্তার অভিযোগে বিদ্ধ জাতীয় রেসলিং (কুস্তি) ফেডারেশনের শীর্ষ কর্তা ব্রিজভূষণের গ্রেপ্তারির দাবি কার্যকর করতে তাঁরা কেন্দ্রীয় সরকারকে ৩০ মে থেকে পরবর্তী পাঁচ দিনের সময়সীমা বেঁধে দিয়েছেন। আন্তর্জাতিক পদক জয়ী সাক্ষী মালিক, বজরঙ পুনিয়া, বিনেশ ফোগটরা হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, দাবি পূরণ না হলে তাঁরা তাঁদের অর্জিত পদক ভাসিয়ে দেবেন গঙ্গায়। জানা গেছে, তাঁরা প্রতিবাদে আমরণ অনশনে বসতে পারেন।
দেশের প্রথম সারির ক্রীড়াবিদদের নজিরবিহীন বিক্ষোভ-অবস্থানের ঘটনাক্রমের প্রেক্ষিতে গোটা দেশ সহ আন্তর্জাতিক ক্রীড়ামহলের প্রবল নিন্দা ও সমালোচনার মুখে পড়েও অবশ্য নির্বিকার প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তিনি একটি শব্দও খরচ করেন নি অভিযুক্ত বিজেপি সাংসদ ব্রিজভূষণের সমালোচনায়। ২৮ মে মোদি একদিকে যখন হিন্দুত্বের ধ্বজা উঁচিয়ে নতুন সংসদ ভবন উদ্বোধন করে অভিযুক্ত সাংসদকে ওই সংসদে বসিয়ে তিনি ‘আজাদি কা অমৃত মহোৎসব’ পালন করছিলেন, তখন পুলিশ যৌন নির্যাতনের প্রতিকার চেয়ে বিচার চাওয়া অ্যাথলেটদের নির্মমভাবে মারছিল। টেনে হিঁচড়ে তাঁদের পুলিশের গাড়িতে তোলা হয়। গুলি করে মারার হুমকি দেওয়া হয় টুইটারে।
কুস্তিগীরদের এই লড়াইয়ে পাশে থাকার বার্তা দিয়েছেন রাজনীতিবিদ, ক্রীড়াবিদ থেকে দেশের বিভিন্ন অংশের বিশিষ্টরা। অলিম্পিক পদক জয়ী অভিনব বিন্দ্রা, দেশের প্রাক্তন অধিনায়ক অনিল কুম্বলে, জাতীয় ফুটবল দলের অধিনায়ক সুনীল ছেত্রি, পিটি উষা সহ অনেকেই প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছেন। কংগ্রেস সহ সমাজবাদী পার্টি নেতা অখিলেশ যাদব, বিএসপি নেত্রী মায়াবতী, আম আদমি পার্টি কুস্তিগিরদের আন্দোলন সমর্থন করেছেন, সমালোচনা করেছেন পুলিশের এই চূড়ান্ত দুর্ব্যবহারের। কুস্তিগিরদের দাবির প্রতি সংহতি জানিয়ে ২১ এবং ২২ মে ডিওয়াইএফআই দেশ জুড়ে স্বাক্ষর সংগ্রহ অভিযান সংগঠিত করেছে। ই-মেইল এবং পোস্টকার্ডের মাধ্যমে তারা কুস্তিগিরদের দাবির সমর্থনে ব্রিজভূষণ শরণ সিংয়ের অবিলম্বে পদত্যাগ এবং গ্রেপ্তারি দাবি করেছে। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে এসএফআই’র পক্ষ থেকে বিক্ষোভ দেখানো হয়েছে। প্রতিবাদ জানানো হয়েছে সিপিআই (এম)-র পক্ষ থেকেও।
প্রসঙ্গত, সরকারের সংবেদনহীনতায় তীব্র দুঃখ ও হতাশায় কুস্তিগিররা তাঁদের অর্জিত পদকগুলি হরিদ্বারের গঙ্গায় বিসর্জন দিতে গিয়েছিলেন ৩০ মে। তাঁরা যখন পদকগুলো গঙ্গায় ডুবিয়ে দিতে তৈরি সেই সময় কৃষক নেতা নরেশ টিকায়েত সহ অন্যান্য কৃষক নেতৃবৃন্দ তাঁদের বুঝিয়ে নিরস্ত করেন। তাঁরা বলেন, তাঁদের আন্দোলনের পাশে তাঁরা আছেন। কৃষক নেতৃত্ব জানান, ১ জুন উত্তরপ্রদেশের মুজফ্ফরপুরে মহাপঞ্চায়েত ডাকা হয়েছে সেখানে শুধু কুস্তিগিরদের বিষয়টি আলোচনা হবে।
ব্যাপক চাপে পড়ে যদিও কেন্দ্রীয় ক্রীড়ামন্ত্রী অনুরাগ ঠাকুর বলেছেন পুলিশি তদন্তের ওপর ভরসা রাখতে, কিন্তু জাত পাতের অঙ্কের হিসেবে অভ্যস্ত বিজেপি নেতৃত্বের হাবভাবে বেপরোয়া ভঙ্গি ধরা পড়ছে। ব্রিজভুষণ জানিয়েছেন পদত্যাগ করবেন না। তেমনই অন্যদিকে ব্রিজভূষণের সমর্থনে জনচেতনা মহার্যাজলি সংগঠিত হচ্ছে অযোধ্যায়, যেখানে বিজেপি নেতা এবং বিধায়করা জড়ো হচ্ছেন।
এদিকে ৩১ মে এক বার্তায় পুনিয়া, সাক্ষী ও ফোগটদের পাশে দাঁড়িয়ে আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটি আন্দোলনকারী মহিলা কুস্তিগিরদের ওপর দিল্লি পুলিশের দুর্ব্যবহারের ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। বার্তায় বলা হয়েছে, আমরা কুস্তিগিরদের নিরাপত্তা ও শারীরিক সুস্থতা নিয়ে উদ্বিগ্ন। কুস্তি ফেডারেশনের প্রধানের বিরুদ্ধে তদন্ত আরও দ্রুততর হোক। পক্ষপাতহীনতার ঊর্ধ্বে উঠে তদন্ত এবং প্রচলিত আইনের ভিত্তিতেই অপরাধীকে শাস্তি দানের উপর জোর দেওয়া হয়েছে ওই বার্তায়।
একইভাবে সংযুক্ত বিশ্ব কুস্তি সংস্থার পরিচালন বোর্ড ব্রিজভূষণকে শাস্তিদানের ক্ষেত্রে সরকারি অবহেলার তীব্র নিন্দা করেছে। ইন্ডিয়ান অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনকে তারা বলেছে, কুস্তি ফেডারেশনের নির্বাচন আগামী ৪৫ দিনের মধ্যে করতে হবে।
দিল্লিতে কুস্তিগিরদের পুলিশি হেনস্তার প্রতিবাদ কলকাতায়।
৩০ মে শিয়ালদা থেকে মৌলালি পর্যন্ত কুস্তিগিরদের হেনস্তার প্রতিবাদ মিছিলে শামিল হন সারা ভারত গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতির কর্মী ও সমর্থকরা। মিছিলে অংশ নেন সংগঠনের সর্বভারতীয় নেত্রী অঞ্জু কর, রাজ্য সভানেত্রী জাহানারা খান, সম্পাদিকা কনীনিকা ঘোষ সহ সংগঠনের নেত্রীবৃন্দ।
ব্রিজভূষণ সিং’র বিরুদ্ধে যৌন হেনস্তার অভিযোগ বেশ পুরনো। বহু মহিলা কুস্তিগির ব্রিজভূষণের ‘শিকার’ হয়েছেন বলে অভিযোগ। পুলিশ প্রথমে এই বিজেপি সাংসদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নিতে চায়নি। পরে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে কুস্তিগিররা অভিযোগ থানায় নথিবদ্ধ করতে পারেন। গত ১৮ জানুয়ারি থেকে প্রতিকার চেয়ে কুস্তিগিররা মোদি-শাহ’র হস্তক্ষেপ দাবি করেছিলেন কিন্তু কোনো ফল মেলেনি। অভিযোগের প্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক পদক জয়ী বক্সার মেরি কম-এর নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠিত হয় অভিযোগের সারবত্তা জানতে। কিন্তু তিন মাস অপেক্ষার পরও কুস্তিগিরদের সামনে ওই কমিটির রিপোর্ট পেশ করা হয়নি। জানা গেছে, রিপোর্টে বলা হয়েছে ফেডারেশনের এই ধরনের অভিযোগের সুরাহার জন্য কোনো নেই। তবে কুস্তিগিরদের সঙ্গে যোগাযোগের ক্ষেত্রে আরও স্বচ্ছতা আনা দরকার। এই ফলশ্রুতিতে সরকারি তদন্তে আস্থা হারিয়ে ফেলেন ভুক্তভোগীরা।
এই পরিস্থিতিতে কুস্তিগিররা এপ্রিল মাসের ২৩ তারিখ থেকেই যন্তরমন্তরে ধরনায় বসেন। তাঁদের নানাভাবে হেনস্তা করা হয়। দেশের কৃষক আন্দোলনের নেতৃত্ব এই কুস্তিগিরদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। হরিয়ানা সন্নিহিত রাজ্যগুলিতে কুস্তিগিরদের রমরমা হওয়ায় এই আন্দোলনরত কুস্তিগিরদের শুনতে হয়েছে তারা খালিস্তানি এই অভিযোগও। এসব প্রচারকে পাত্তা না দিয়ে অলিম্পিক, কমনওয়েলথ গেমস, এশিয়ান গেমসের পদকজয়ী এই কুস্তিগিরদের সমর্থনে বহু মানুষ চলে আসেন যন্তরমন্তরে। পুলিশের ব্যারিকেড গড়ে তাঁদের পরোক্ষে চাপ দেওয়া হতে থাকে ধরনা তুলে নেওয়ার জন্য। এরপর দ্রুত প্রতিকার চেয়ে ২৮ মে রাস্তায় মিছিল করার সময় আক্রান্ত হন কুস্তিগিররা। তাঁদের প্রতি সংহতি জানাতে চেয়ে মিছিলে আসতে চাওয়া হরিয়ানা-রাজস্থানের কৃষকদের আটকে দেওয়া হয় দিল্লি সীমান্তে।