E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৬০ বর্ষ ৪২ সংখ্যা / ২ জুন, ২০২৩ / ১৮ জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩০

মোদি সরকারের হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্রগঠনের সুপরিকল্পিত ভাবনাই প্রকাশ পেল নতুন সংসদ ভবন উদ্বোধনের কার্যকলাপে


নিজস্ব সংবাদদাতাঃ পুরোপুরি অগণতান্ত্রিক কায়দায়, সংসদীয় রীতি-নীতি লঙ্ঘন করে এবং সংবিধানকে নস্যাৎ করে ২৮ মে নতুন সংসদ ভবন উদ্বোধন হলো। পুরনো রাজতন্ত্রে রাজ্যাভিষেকের মতো হিন্দুত্বের ‘সম্রাট’ বা ‘রাজা’ হিসেবে রাজদণ্ডরূপী ‘সেঙ্গোল’ (সোনার লাঠি) হাতে নিয়ে এই সংসদ ভবন উদ্বোধন করলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। উপেক্ষিত রইলেন দেশের সাংবিধানিক প্রধান রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু। তাঁকে এদিন আমন্ত্রণই জানানো হয়নি। অনুপস্থিত ছিলেন বিরোধী দলের সমস্ত সাংসদ। এদিন এক ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে বৈদিক আচার সংহিতা অনুযায়ী পুজোপাঠ করে, তামিলনাডুর মঠ থেকে আসা সন্ন্যাসীদের নিয়ে লোকসভার অধ্যক্ষের পাশে ‘সেঙ্গোল’ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষতার চরিত্রকেও ভূলুণ্ঠিত করা হয়েছে।

আরও লক্ষণীয় বিষয় হলো, হিন্দুত্ববাদী আদর্শের অন্যতম উদ্‌গাতা বিনায়ক দামোদর সাভারকরের জন্মদিন এবং তাঁরই রচিত বই ‘হিন্দুত্ব’ প্রকাশ সাল (১৯২৩)-কে মাথায় রেখেই এই দিনটিকে বেছে নেওয়া হয়েছিল নতুন সংসদ ভবনের উদ্বোধনের দিন হিসেবে। সব কিছু মিলিয়ে এই নতুন সংসদ ভবনের উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে নরেন্দ্র মোদি সরকারের হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্র গঠনের সুপরিকল্পিত ভাবনাই প্রকট হয়ে উঠেছে।

এছাড়া আর‍‌ও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এদিন নতুন সংসদ ভবনের সামনে কুস্তিগিরদের ‘মহাপঞ্চায়েত’ অনুষ্ঠিত করার লক্ষ্যে এগিয়ে যেতেই রাস্তায় ফেলে দিল্লি পুলিশ সাক্ষী মালিক, বজরং পুনিয়া, স‌ঙ্গীতা ফোগট, বিনেশ ফোগটদের যে নির্দয়ভাবে মারধর করে আটক করেছে, যন্তরমন্তরে তাঁদের ধরনামঞ্চকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছে, তাতে কেন্দ্রের আরএসএস-বি‍‌জেপি সরকারের ফ্যাসিস্টধর্মী চরিত্রই ফুটে উঠেছে। দেশের হয়ে আন্তর্জাতিক স্তরে পদকজয়ী এই কুস্তিগিররা বিজেপি সাংসদ তথা রেসলিং ফেডারেশন অব ইন্ডিয়ার প্রধান ব্রিজভূষণ শরণ সিংয়ের বিরুদ্ধে যৌন হেনস্তার অভিযোগ এনে তার বিরুদ্ধে উপযুক্ত শাস্তির দাবিতে যন্তরমন্তরে ধরনা-অবস্থান চালাচ্ছিলেন। এই দাবিতেই এদিন তাঁরা পা বাড়িয়েছিলেন নতুন সংসদ ভবন অভিমুখে। এক সময়ে যাঁরা আন্তর্জাতিক স্তরের প্রতিযোগিতায় পদক এনে ভারতের মুখ উজ্জ্বল করেছিলেন, ভারতকে গৌরবান্বিত করেছিলেন, এদিন তাঁদের উপর শারীরিক আক্রমণ নামিয়ে এনে দেশকে কলঙ্কিত করলো মোদি সরকার। যখন দিল্লির রাজপথে দিল্লি পুলিশ নির্দয়ভাবে পদকজয়ী কুস্তিগিরদের উপর আক্রমণে মত্ত, তখন সেই অভিযুক্ত সাংসদ ব্রিজভূষণ পরিপাটি সাজগোজ করে সংসদের মধ্যে খোশ মেজাজে অন্যদের সঙ্গে আলাপচারিতায় মগ্ন। হিন্দুত্ববাদী-ফ্যাসিস্টধর্মী কেন্দ্রের সরকার যে গণতন্ত্রকে নির্দ্বিধায় অবদমিত করতে পিছপা নয়, তা তারা এই ঘটনার মধ্য দিয়ে আবারও প্রমাণ করে দিয়েছে।

সংবিধানকে লঙ্ঘন করে সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিক কায়দায় সংসদ ভবন উদ্বোধনের তীব্র নিন্দা করেছে দেশের বিরোধী দলগুলি। কংগ্রেস দল বলেছে, আত্মগরিমায় আচ্ছন্ন এক স্বৈরাচারী প্রধানমন্ত্রী সংসদীয় রীতিনীতির তোয়াক্কা না করে নতুন সংসদ ভবন উদ্বোধন করেন।

কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গে বলেছেন, গণতন্ত্র কোনো ভবনের জন্য সচল থাকে না। বরং জনগণের কণ্ঠের মাধ্যমে গণতন্ত্র সচল থাকে।

কেন্দ্রকে কটাক্ষ করে সিপিআই(এম)’র সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি বলেছেন, ভারতের রাষ্ট্রপতি, উপ রাষ্ট্রপতি এবং বিরোধী দলগুলির অনুপস্থিতিতে মোদির ‘নতুন ভারত’ ঘোষিত হলো! বর্তমান ভারত গঠিত রাষ্ট্র এবং নাগরিকদের নিয়ে। মোদির নতুন ভারতে থাকছেন শুধুই রাজা এবং প্রজা!

এদিন বিজেপি-আরএসএস সরকারের ভূমিকার নিন্দা করে সীতারাম ইয়েচুরি টুইট বার্তায় বলেছেন, সংসদে মোদি ‘সেঙ্গোল’ স্থাপন কর‍‌লেন। সামন্ততান্ত্রিক যুগের রাজরাজরাদের প্রতীক এসব। ভারতের জনসাধারণ অনেক আগেই এসব বাঁধন ছুঁড়ে ফে‍‌লে দিয়েছেন। তার পরিবর্তে এমন এক ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক সাধারণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছেন, যেখানে প্রত্যেক নাগরিকই সমান। যে গণতন্ত্রে জনগণ সরকারকে নির্বাচিত করে সেখানে সেঙ্গোলের কোনো ভূমিকাই নেই।

মোদি আমলে সংসদের ক্রমাগত অবনমনের তথ্য দিয়ে ইয়েচুরি টুইটে উল্লেখ করেছেন, সংসদের ইতিহাসে সবচেয়ে কম অধিবেশন হয়েছে ২০২২ সালে, মাত্র ৫৬ দিন! প্রথম দু’দশকের গড় ১২১ দিন। বাজেট, কৃষি আইন, শ্রম কোডের মতো অধিকাংশ গুরুত্বপূর্ণ বিলই কোনো আলোচনা ছাড়াই সংসদে পাশ করিয়ে নেওয়া হয়েছে মোদি আমলে! তিনি আরও জানান, মোদি আমলে সবচেয়ে কম সংখ্যক বিল সংসদীয় কমিটিগুলির কাছে পাঠানো হয়েছে, মাত্র ১৩ শতাংশ! অথচ ইউপিএ আমলে এই হার ছিল ৭১ শতাংশ! লোকসভায়‌ দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকা সত্ত্বেও মোদির সময়েই সর্বাধিক সংখ্যক অর্ডিন্যান্স জারি করা হয়েছে। সংসদের কার্যবিবরণী থেকে বিরুদ্ধমত বাদ দেওয়া হয়েছে। বিরোধী সাংসদদের সাসপেন্ড করা হয়েছে। এভাবেই সংসদীয় গণতন্ত্রকে ধ্বংস করে চলেছে বিজেপি-আরএসএস সরকার।

কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী টুইটারে লিখে‍ছেন, সংসদ দেশবাসীর কণ্ঠস্বর। সংসদ ভবনের উদ্বোধনী পর্বকে প্রধানমন্ত্রী নিজের রাজ্যাভিষেক হিসেবে মনে করেছেন।

সিপিআই সাংসদ বিনয় বিশ্বম কটাক্ষ করে বলেছেন, কুস্তিগিরদের পিটিয়ে সেঙ্গোলকে স্বাগত জানালেন সাভারকর অনুগামী প্রধানমন্ত্রী।

এনসিপি‍‌ নেতা শারদ পাওয়ার বলেছেন, কেন্দ্রের বর্তমান সরকার কীভাবে দেশকে পিছনের দিকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে, তা সংসদের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে স্পষ্ট হয়েছে।

নতুন সংসদ ভবন উদ্বোধনে কেন্দ্রের সরকারের ভূমিকার তীব্র নিন্দা করেছে আরজেডি, সমাজবাদী দল, শিবসেনা (ইউবিটি), জেডি(ইউ)’র মতো দলগুলিও।

প্রসঙ্গত, ২০২০ সালে দেশ যখন করোনা সংক্রমণের ভয়ংকর আঘাতে বিপন্ন, গোটা দেশের জনজীবন স্তব্ধ, গরিব শ্রমজীবী মানুষ, পরিযায়ী শ্রমিকদের জীবন বিধ্বস্ত-বিপন্ন, সেই ভয়াবহতার আবহে মোদি সরকারের তুঘ‍‌‍‌লকি ফতোয়ায় এই সেন্ট্রাল ভিস্তা প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। দেশবাসীর স্মরণে আছে, সেই সময়ে দেশের সমস্ত পরিবহণ ব্যবস্থা, অফিস-আদালত-শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি বন্ধ থাকলেও কেন্দ্রের নির্দেশে বিশেষ তদারকিতে চলেছে এই নির্মাণের কাজ। অথচ তখন দেশে ভীষণভাবে জরুরি ছিল করোনা আক্রান্তদের উপযুক্ত চিকিৎসা, সংক্রমণ প্রতিরোধে উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ, হাসপাতালগুলিতে প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো নির্মাণ, আকস্মিকভাবে কাজ হারানো, বিপন্ন, অসহায় মানুষদের পাশে দাড়ানো, খাদ্যসামগ্রী, ত্রাণ, নগদ অর্থ ইত্যাদি তুলে দেওয়া। কিন্তু সেসব দিকে গুরুত্ব না দিয়ে মোদি সরকার মত্ত থাকে এই প্রকল্প নির্মাণে। দেশে স্বয়ংসম্পূর্ণ সংসদভবন থাকা সত্ত্বেও ২০ হাজার কোটি টাকা খরচ করে এই নতুন সংসদ ভবন নির্মাণের যৌক্তিকতা কী - তা নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠেছে। প্রশ্ন উঠেছে এই ভবন দেশের সাধারণ মানুষের স্বার্থে কোন্‌ উপকারে লাগবে।

২৮ মে নতুন সংসদ ভবন উদ্বোধনকে ঘিরে যে সমস্ত ক্রিয়াকলাপ হয়েছে, তাতে ধন্দ লাগবে - ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক ভারতে নতুন ভবন উদ্বোধন হয়েছে, নাকি বিশাল কোনো মন্দিরে ধর্ম মহোৎসব সংঘটিত হয়েছে! এদিন সংসদের নতুন সংসদ ভবন উদ্বোধনে যেসব কাণ্ডকারখানা হয়েছে তাতে স্বৈরাচারী শাসকের আত্মঅহংকার ও একাধিপত্যের রূপই প্রকট হয়েছে। ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের চরিত্র, সংবিধানের মর্যাদা মলিন হয়ে সেদিন যেন সামন্ততান্ত্রিক রাজতন্ত্রের প্রতিভূ হিসেবে হিন্দুত্ববাদী রাজতন্ত্রের রাজদণ্ড হাতে রাজার রাজ্যাভিষে‍কের ছবি ফুটে উঠেছে। এর মধ্য দিয়ে ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের আদর্শ, চিরন্তন ঐতিহ্য-সংস্কৃতিকে বিপন্নতার দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে।