E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৬০ বর্ষ ৪২ সংখ্যা / ২ জুন, ২০২৩ / ১৮ জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩০

পরিবেশ-সমস্যা মার্কস ও এঙ্গেলস

সত্যজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়


মানুষই একমাত্র প্রাণী যে উৎপাদন করতে পারে। অর্থাৎ মানুষ বেঁচে থাকার জন্য প্রকৃতিকে শুধু ব্যবহারই করে না, সেইসঙ্গে প্রকৃতির কাছ থেকে কিছু আদায় করে, অর্থাৎ উৎপাদন করে। মানুষ ও প্রকৃতির মধ্যস্থলে দাঁড়িয়ে আছে প্রযুক্তি। মানব সমাজ বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে, মানুষ আরও বেশি বেশি করে প্রাকৃতিক নিয়মাবলীকে জানতে পেরেছে, প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা অর্জন করেছে, প্রযুক্তির উন্নয়ন ঘটাতে পেরেছে, উৎপাদিকা শক্তির বিকাশ ঘটাতে পেরেছে। প্রকৃতির কাছ থেকে আরও বেশি করে আদায় করতে সক্ষম হয়েছে। জীবনযাপনের মান বৃদ্ধি পেয়েছে। সুখ স্বাচ্ছন্দ্য বেড়েছে, উন্নয়ন হয়েছে। কিন্তু উৎপাদনের উপকরণের ওপর ব্যক্তিগত মালিকানা সম্পদের সমবণ্টন হতে দেয়নি। উৎপাদনের চরিত্র সামাজিক, কিন্তু উৎপাদিত পণ্যগুলির মালিকানা ব্যক্তিগত - এই দ্বন্দ্বের অবসান ঘটেনি। ধনতন্ত্রে তা ঘটা সম্ভবও নয়। উৎপাদনের উপকরণের ওপর ব্যক্তিগত মালিকানা যতদিন থাকবে ততদিন এই দ্বন্দ্বের অবসান ঘটবেও না। উৎপাদনের লক্ষ্য যখন মুনাফা বৃদ্ধি, তখন মানুষ ভুলে যায় যে, মানুষ প্রকৃতির প্রভু নয়, প্রকৃতির অংশ মাত্র। মানুষকে এই বিষয়ে সচেতন করার জন্য বর্তমান বিশ্বে বারবার সহনযোগ্য উন্নয়ন বা সাসটেনেব্‌ল্‌ ডেভেলপমেন্ট-এর কথা উচ্চারিত হচ্ছে।

উৎপাদনের মধ্যে দিয়ে মানুষ প্রকৃতির পরিবর্তন করতে পারে। আবার এই পরিবর্তনগুলি মানুষের ওপরেও প্রভাব বিস্তার করে। প্রকৃতিতে বিচ্ছিন্নভাবে কিছু ঘটে না। প্রতিটি ঘটনা কার্যকারণ সম্পর্কের মধ্যে দিয়ে প্রকৃতি ও সমাজের বিভিন্ন উপাদানকে প্রভাবিত করে, আবার সেগুলিও একে অপরকে প্রভাবিত করে। মানুষ উৎপাদনের মাধ্যমে প্রকৃতির মধ্যে পরিবর্তন ঘটায়, নিজের প্রয়োজন মেটাবার উদ্দেশে প্রকৃতিকে কাজে লাগায়, প্রকৃতির ওপর প্রভুত্ব করে। যা মনুষ্যেতর প্রাণীরা পারে না। মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীদের এই চূড়ান্ত ও মৌলিক পার্থক্যটি ঘটিয়েছে শ্রম। এঙ্গেলস ‘বানর থেকে মানুষের বিবর্তনে শ্রমের ভূমিকা’ গ্রন্থে দেখিয়েছেনঃ প্রকৃতির ওপর এই জয়লাভে আমরা যেন খুব বেশি আত্মপ্রসাদ লাভ না করি। কারণ এইরকম প্রতিটি জয়লাভের জন্যই প্রকৃতি আমাদের ওপর প্রতিহিংসা গ্রহণ করে। একথা সত্য যে, প্রতিটি জয়ের ফলাফল সর্বাগ্রে আমাদেরই ধারণানুসারী। কিন্তু দ্বিতীয় ও তৃতীয় ক্ষেত্রে এর ফলাফল হয় সম্পূর্ণ পৃথক ও অভাবিতপূর্ব, আর বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তা প্রথমটিকে ব্যর্থ করে দেয়।

এঙ্গেলস মেসোপটেমিয়া, গ্রিস, এশিয়া মাইনর, ইতালির আল্পস, ইত্যাদি অঞ্চলের উদাহরণ দিয়ে দেখিয়েছেনঃ মানুষ কর্তৃক প্রকৃতির পরিবর্তন ও প্রকৃতির পাল্টা প্রতিক্রিয়া - এই দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়া কীভাবে প্রকৃতির ধ্বংসসাধন করছে। প্রকৃতি ও মানুষের সম্পর্ক হয়ে উঠেছে বিজয়ী জাতি (মানুষ) যেমন বিজিত জাতির (প্রকৃতি) উপর আধিপত্য বিস্তার করে অনেকটা তেমন। এঙ্গেলস ১৮৭৬ সালেই স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেনঃ আমরা কোনোভাবেই প্রকৃতির বাইরে দাঁড়িয়ে প্রকৃতির ওপর প্রভুত্ব করি না। পক্ষান্তরে রক্ত, মাংস, আর মস্তিষ্ক নিয়ে আমরা প্রকৃতির অন্তর্ভুক্ত। মানুষের একটি সুবিধা হলো, সে অন্য সমস্ত জীবের তুলনায় প্রকৃতির নিয়মাবলীকে ভালোভাবে জানতে, আয়ত্ত করতে ও সেগুলিকে নির্ভুলভাবে প্রয়োগ করতে সক্ষম। কিন্তু সেখানেও মনে রাখা দরকার, আমরা প্রকৃতির প্রভু নই, আমরা প্রকৃতির অংশমাত্র। এঙ্গেলস-এর এই সতর্কবার্তার প্রাসঙ্গিকতা আমরা প্রবলভাবে অনুভব করছি বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে জলবায়ুর নানা ধরনের অমেয় পরিবর্তনের দিকে তাকিয়ে। তাই বারবার সামনে আসছে সহনযোগ্য উন্নয়নের বা সাসটেনেব্‌ল্‌ ডেভেলপমেন্ট-এর ভাবনা।

ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় প্রকৃতি ও সমাজের মধ্যে বিভিন্ন জৈব ও অজৈব বস্তুর স্বাভাবিক আবর্তন বা বিপাক বা মেটাবলিজম্‌-এর ভাঙনের প্রক্রিয়া প্রকৃতির সহনশীলতার ওপর প্রবল আঘাত নামিয়ে এনেছে। অথচ প্রকৃতির সহনশীলতার ওপরেই জীবনের বিকাশ ও পুনরুৎপাদন নির্ভরশীল। প্রকৃতির সহনশীলতাকে উপেক্ষা করার অর্থ প্রকৃতি কর্তৃক মানবসমাজের অস্তিত্বের ওপর আরোপিত শর্তসমূহকে উপেক্ষা করা। ধনতন্ত্র শুধু মাটির পুষ্টিকারক উপাদানগুলির ওপর ডাকাতিই করেনি, পাশাপাশি শহর ও গ্রামের মধ্যে প্রবল দ্বন্দ্বও সৃষ্টি করেছে। মাটি থেকে পুষ্টিকারক উপাদানগুলিকে অপসারণ করে ধনতন্ত্র উৎপাদন করেছে খাদ্য ও তন্তু। তারপরে সেগুলিকে পাঠিয়েছে শহরে। খাদ্য ও তন্তুগুলি শহরে দূষণের কারণ হয়েছে। তারা ধ্বংস করেছে শহরের বর্জ্য-নিষ্কাশন ব্যবস্থাকে। ক্যাপিটাল-এর তৃতীয় খণ্ডে মার্কস দেখিয়েছেন, সাড়ে চার মিলিয়ন মানুষের বর্জ্য পদার্থ প্রতিদিন টেমস নদীকে দূষিত করছে, তার অনেক মূল্য দিতে হবে। আবার এঙ্গেলস তার দ্য হাউজিং কোয়েশ্চেন-এ দেখিয়েছেনঃ ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় শহর ও গ্রামের বৈপরিত্যের অবসানের ভাবনা ঠিক ততটাই ইয়োটোপিয় ভাবনা, যতটা ইয়োটোপিয় ভাবনা হলো পুঁজিপতি ও মজুরি-শ্রমিকের মধ্যে বৈপরিত্যের অবসান। লিবিখ-কে স্মরণ করে এঙ্গেলস দেখিয়েছেনঃ তাঁর কৃষি-রসায়ন বিষয়ক রচনাবলিতে সবসময়েই পয়েলা নম্বর দাবি ছিলঃ মানুষ জমি থেকে যতটা গ্রহণ করছে ততটাই তার জমিতে ফিরিয়ে দেওয়া উচিত। তা না হবার কারণে বড়ো বড়ো শহরের অস্তিত্বই সংকটের মুখে পড়ছে। এঙ্গেলস বলেছেনঃ লন্ডন শহরে প্রতিদিন বিপুল অর্থব্যয়ে যে পরিমাণ মলমূত্র ও বর্জ্য পদার্থ সমুদ্রে ফেলে দেওয়া হয়, তা সাকসানি রাজ্যের উৎপন্ন মলমূত্র ও বর্জ্য পদার্থের চাইতেও বেশি। গোটা লন্ডন শহর যাতে এই মলমূত্র ও বর্জ্য পদার্থে বিষাক্ত না হয়ে যায় তার জন্য যে বিশাল নির্মাণব্যবস্থা প্রয়োজন তা দেখলেই শহর ও গ্রামের বৈপরিত্য অবসানের স্বপ্ন যে একটা ইয়োটোপিয়া তা স্পষ্ট বোঝা যায়। এমনকী তুলনায় অনেক কম গুরুত্বপূর্ণ বার্লিন শহরেও তার নিজস্ব আবর্জনার কারণে দুর্গন্ধে প্রায় শ্বাসরোধের উপক্রম হয়েছে। অবশ্যই পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থার অবসানের ভিত্তিতেই - সারা দেশে যতটা সম্ভব সমানভাবে জনসংখ্যার বিন্যাস, কৃষি ও শিল্প উৎপাদনের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সংযোগ এবং তার জন্য প্রয়োজনীয় যানবাহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রসার হলেই গ্রামীণ সমাজকে সেই বিচ্ছিন্নতা ও হতবুদ্ধিতা থেকে মুক্ত করা সম্ভব - যার মধ্যে সে হাজার হাজার বছর রোমন্থন করে কাটিয়েছে। শহর ও গ্রামের মধ্যে বৈপরিত্যের অবসান হলেই কেবল অতীত-ইতিহাস যে শৃঙ্খল নির্মাণ করে তুলেছে তা থেকে মানুষ মুক্তি পাবে - এই ধারণা পোষণ করা কোনো ইয়োটোপিয়া নয়। পক্ষান্তরে ইয়োটোপিয়া তখনই শুরু হয়, যখন কেউ বর্তমান সমাজের কোনো একটা বৈপরিত্যের অবসান ঘটাতে অগ্রসর হন ‘প্রচলিত ব্যবস্থার মধ্যে’। (মার্কস ও এঙ্গেলস, রচনা সংকলন, দ্বিতীয় খণ্ড, ন্যাশনাল বুক এজেন্সি, ২০১০, পৃষ্ঠা-৩০০)

‘কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো’-তে মার্কস ও এঙ্গেলস দেখিয়েছিলেনঃ আগের সমস্ত যুগের তুলনায় বুর্জোয়া যুগের বৈশিষ্ট্যই হলো উৎপাদনে অবিরাম বিপ্লবী পরিবর্তন, সমস্ত সামাজিক অবস্থার অনবরত নড়চড়, চিরস্থায়ী অনিশ্চয়তা ও উত্তেজনা। নিজের প্রস্তুত পণ্যের জন্য অবিরত বর্ধমান এক বাজারের তাগিদ বুর্জোয়া শ্রেণিকে সমগ্র বিশ্বে দৌড় করিয়ে বেড়ায়। সর্বত্র তাকে ঢুকতে হয়, সর্বত্র গেড়ে বসতে হয়, সর্বত্র যোগসূত্র স্থাপন করতে হয়। বুর্জোয়া শ্রেণি বিশ্ববাজারকে কাজে লাগাতে গিয়ে প্রতিটি দেশেরই উৎপাদন ও উপভোগে একটি বিশ্বজনীন চরিত্র দান করেছে। দেশজ উৎপন্নে যা মিটত তেমন সব পুরনো চাহিদার বদলে দেখছি নতুন চাহিদা যা মেটাতে দরকার সুদূর দেশ-বিদেশের নানা আবহাওয়ায় উৎপন্ন পণ্য। শিল্প বিপ্লবের সময়ে গুজরাট থেকে শুধুই কটন বা তুলা-ই লুণ্ঠন করে নিয়ে যাওয়া হয়নি, সেইসঙ্গে এদেশের মাটি থেকে জল ও খনিজ লবণগুলিও লুণ্ঠন করে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। যেগুলি আর এদেশের মাটিতে ফিরে আসেনি। যে দেশে বা যে অঞ্চলে যা উৎপন্ন হলো সেগুলি সেই দেশে বা অঞ্চলেই কনজিউমড্‌ হয়ে গেল - ধনতন্ত্রে তা হয় না। তুলা, জল ও খনিজ লবণ লুণ্ঠন হবার ফলে একদিকে যেমন ভারতের মাটি ও সম্পদ রিক্ত হলো, অন্যদিকে তেমনি ম্যানচেস্টারে পরিবেশ দূষণ ঘটল।

‘ক্যাপিটাল’-এর তৃতীয় খণ্ডে ‘জেনেসিস অফ গ্রাউন্ড রেন্ট’ অধ্যায়ে মার্কস দেখিয়েছেনঃ ধনতন্ত্র জমির প্রাণশক্তির শুধু শোষণ ও অপচয়ই করে না, সেইসঙ্গে অধিকার করে নেয় চিরকালীন সামূহিক সম্পত্তি হিসেবে জমির সচেতন ও সুবিন্যস্ত কৃষিকার্যের স্থান - যা মানবজাতির বংশ পরম্পরার অস্তিত্ব ও পুনরুৎপাদনের অপরিহার্য শর্ত। এই শর্তকে মান্যতা না দিলে মানবজাতির অস্তিত্ব ও পুনরুৎপাদন প্রক্রিয়া ধ্বংসের মুখে দাঁড়িয়ে যাবে। আবার ‘ক্যাপিটাল’-এর তৃতীয় খণ্ডেই ‘বিল্ডিং সাইট রেন্ট। রেন্ট ইন মাইনিং। প্রাইস অফ ল্যান্ড’ অধ্যায়ে মার্কস দেখিয়েছেনঃ সমাজের একটি উচ্চতর অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে, একক লোকেদের ভূমণ্ডলের ওপর ব্যক্তিগত মালিকানা যেমন সম্পূর্ণ অসম্ভব ব্যাপার, তেমনই অসম্ভব হলো একজন মানুষের ওপর আর একজনের ব্যক্তি মালিকানা। সেই কারণেই একইভাবে একটি গোটা সমাজ বা একটি গোটা জাতি বা একই সময়ে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে বিদ্যমান সমস্ত সমাজ সকলে একসঙ্গে মিলেও, গোটা ভূমণ্ডলের মালিক নয়। তারা কেবল অধিকারভোগী বা ভোগস্বত্বের অধিকারী এবং ‘boni patres familias’ (Good heads of the household)-এর মতো তাদের এই ভূমণ্ডলকে তুলে দিতে হবে পরবর্তী প্রজন্মের হাতে আরও উন্নত অবস্থায়। পরবর্তী প্রজন্মের জন্য উন্নততর একটি পৃথিবী রেখে যাবার লক্ষ্যেই উন্নয়নের জন্য প্রাকৃতিক সম্পদের যথেচ্ছ ব্যবহার না করে, সাসটেনেব্‌ল্‌ ডেভেলপমেন্টের দিকে নজর রেখে উন্নয়ন করতে হবে।

মার্কসের এই ভাবনা শ্রেণিগত কারণেই মুনাফার সন্ধানে অবিরাম দৌড়ে চলা ধনতান্ত্রিক উন্নয়ন পদ্ধতিতে পুরোপুরি উপেক্ষিত থেকেছে এবং পরিবেশের ভারসাম্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ও জলবায়ুর মনুষ্যসৃষ্ট ধ্বংসাত্মক পরিবর্তন ঘটেছে। শ্রম ও পুঁজির দ্বন্দ্ব যেমন অমীমাংসেয়, তেমনভাবেই পরিবেশ ও পুঁজিবাদের দ্বন্দ্বও অমীমাংসেয়। মুনাফা-বৃদ্ধির বাধ্যবাধকতা ধনতন্ত্রকে সাসটেনেব্‌ল্‌ ডেভেলপমেন্টের বিপক্ষে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।