E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৬০ বর্ষ ৪২ সংখ্যা / ২ জুন, ২০২৩ / ১৮ জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩০

প্লাস্টিক দূষণের দায় কার

বাসব বসাক


প্লাস্টিক দূষণে অবরুদ্ধ হতে চলেছে সমুদ্র

বিজ্ঞানীরা হিসাব করে দেখেছেন বর্তমানে প্রতি বছর প্রায় ৯০ লক্ষ টন প্লাস্টিকের অন্তিম আশ্রয় সমুদ্র। আর এর বড়ো অংশই সমুদ্রে আসে দূষিত নদীগুলির মাধ্যমে। নদী বিশেষে বছরে ০.৮ থেকে ২.৭ মিলিয়ন টন হারে বি‌শ্বের ১,০০০টি নদী ফেলে দেওয়া প্লাস্টিক বর্জ্যের অন্তত ৮০ শতাংশ বয়ে নিয়ে যায় সমুদ্রে। ২০২২-এর হিসাব অনুযায়ী কেবল সে বছরেই কম ক’রে ২৫ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক বর্জ্য মিশেছে সমুদ্রে। এই মুহূর্তে আবিশ্ব সমুদ্রে জমে ওঠা প্লাস্টিকের আনুমানিক পরিমাণ ১৫০ মিলিয়ন টন। বিজ্ঞানীদের অনুমান ২০৪০ সালে সমুদ্রে গিয়ে পড়া প্লাস্টিক বর্জ্যের হার হবে বছরে ২৯ থেকে ৩৭ মিলিয়ন টন। তার মানে প্রতি মিনিটে প্লাস্টিক বোতলে বোঝাই একের বেশি অতিকায় ট্রাক নাগাড়ে আটলান্টিক সমুদ্রে ফেলবে প্লাস্টিক। আর এই ভাবে ২০৪০-এ সমুদ্রে মোট প্লাস্টিক বর্জ্যের পরিমাণ দাঁড়াবে ৬৪৬ মিলিয়ন টন; অর্থাৎ কিনা সামু্দ্রিক প্রাণীদের মোট ওজনের থেকেও হয়তো বা একদিন বেশি হয়ে দাঁড়াবে ফেলে দেওয়া প্লাস্টিকের ওজন। এই বিপুল পরিমাণ অক্ষয়, অভঙ্গুর প্লাস্টিকের বড়ো, ছোটো, এমনকী আণুবীক্ষণিক টুকরোর দূষণে একাধিক বিপন্ন প্রজাতি সহ প্রায় ২২৭০টি সামুদ্রিক প্রজাতি সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বছর পাঁচেক আগে ২০১৮ সালে এথেন্স কেন্দ্রিক পেলাগোজ কেটাসিয়ান রিসার্চ ইনস্টিটিউটের গবেষকরা গ্রিসের সমুদ্রে স্পার্ম হোয়েল প্রজাতির মৃত তিমিদের প্রায় প্রত্যেকের পাকস্থলীতে প্রচুর পরিমাণে প্লাস্টিক পেয়েছেন। যে সব সামুদ্রিক মাছ আমরা খাই, তারমাধ্যমে আমাদের দেহেও সবার অলক্ষ্যে প্রতিদিন ঢুকে পড়ছে আণুবীক্ষণিক প্লাস্টিক তন্তু। ইউ সি ডেভিস সম্প্রতি দেখিয়েছেন ইন্দোনেশিয়া ও ক্যালিফোর্নিয়ায় মাছের বাজারে বিক্রি হওয়া মাছের অন্তত ২৫ শতাংশের দেহে পাওয়া গেছে প্লাস্টিক অবশেষ। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে সমুদ্রের গভীরে জমে ওঠা মাইক্রোপ্লাস্টিকের মধ্যে নিজেদের নতুন জগৎ খুঁজে নিয়েছে এক দল অনুজীব যে জগতকে বিজ্ঞানীরা নাম দিয়েছেন ‘প্লাস্টিস্ফিয়ার’।

মানুষের শরীরে বিষ ছড়াচ্ছে প্লাস্টিক-কণা

শুধু সমুদ্রই নয়, কৃষিজমি থেকে জলসেচ, এমনকী পানীয় জল পর্যন্ত আজ প্লাস্টিক দূষণের কবলে। ২০১৭'র সেপ্টেম্বরে আমেরিকার মিনেসোটা বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক কাম্পালা, দিল্লি, জাকার্তা, ইয়োরোপের সাতটি ও মার্কিন মুলুকের একাধিক শহর থেকে মোট ১২৯টি কলের জলের নমুনা পরীক্ষা করে ৮৩ শতাংশ নমুনাতেই ৫ মিলিমিটারের কম ব্যাস যুক্ত প্ল্যাস্টিকের অতিক্ষুদ্র আণুবীক্ষণিক মাইক্রোপ্লাস্টিক চিপসের অস্তিত্বের প্রমাণ পান। ২০১৯-এ এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি নামক জার্নালে প্রকাশিত একটি রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে বছরে ৩৯০০০ থেকে ৫২০০০ মাইক্রোপ্লাস্টিক কণা বিভিন্ন খাদ্য এবং লিপবাম বা লিপস্টিকের মতো প্রসাধনী সামগ্রীর মাধ্যমে আমাদের শরীরে প্রবেশ করছে। প্রশ্বাসের সঙ্গে ঢুকে পড়া প্লাস্টিক কণাকে হিসাবে ধরলে পরিমাণটা দাঁড়াবে ৭৪০০০ থেকে ১২১০০০। ২০২১-এ আমেরিকার ফুড অ্যান্ড এগ্রিকালচার অর্গানাইজেশনের এক রিপোর্টে উদ্বেগ জানিয়ে লেখা হয়েছে কৃষিক্ষেত্রে যেভাবে প্লাস্টিক দূষণ ঘটে চলেছে তার মাত্রা সমুদ্র দূষণের থেকেও অনেকাংশে বেশি এবং তা রীতিমতো আশঙ্কাজনক। ওই সংস্থার সহ উপনির্দেশক মারিয়া হেলেনা সেমেডো আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছেন, “আমাদের খাদ্য শৃঙ্খলে জমে ওঠা মাইক্রোপ্লাস্টিক খাদ্য নিশ্চয়তা, খাদ্য নিরাপত্তা ও আমাদের স্বাস্থ্যের পক্ষে অত্যন্ত বিপজ্জনক হয়ে উঠতে চলেছে’। দেহে অপর্যাপ্ত মাইক্রোপ্লাস্টিক জমে ওঠার কারণে প্রাণীদের আচরণগত সমস্যা থেকে শ্বাসকষ্ট এমনকী জিনগত মারাত্মক ত্রুটির আশঙ্কা করছেন বিজ্ঞানীরা। রাষ্ট্রপুঞ্জের পরিবেশ কর্মসূচির ২০২১ সালের এক রিপোর্টে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে যে, ‘এই মাইক্রোপ্লাস্টিক মানুষের স্বাস্থ্যের গুরুতর সমস্যার কারণ, মস্তিষ্কের বিকাশ, জিনগত অভিব্যক্তি এবং শ্বসন হারের বদল ইত্যাদি প্রশ্নে বিশেষত মহিলাদের ক্ষেত্রে এর অভিঘাত মারাত্মক’। মনে রাখা ভাল বিভিন্ন প্লাস্টিকে প্রায় ১৩০০ রকম রাসায়নিক থাকে যার বড়ো অংশই অত্যন্ত ক্ষতিকর। প্লাস্টিকের দহনে নির্গত ফিউরান গ্যাসও ভীষণ ক্ষতিকর।

প্লাস্টিকময় দুনিয়া

সাধারণভাবে পেট্রোরসায়ন থেকে সংশ্লেষিত উচ্চ আণবিক ওজন সম্পন্ন জৈব পলিমারই হলো প্লাস্টিক। মনুষ্যসৃষ্ট প্রথম প্লাস্টিক সম্ভবত নাইট্রো-সেলুলোজ ধর্মী ‘পার্কেসিন’ যার উদ্ভাবক ছিলেন বার্মিংহামের আলেকজান্ডার পার্কস। ১৮৫৬ সালে পার্কস সাহেব এটির পেটেন্ট নেন। তবে এরও প্রায় ৫০ বছর পর ১৯০৭ সালে সম্পূর্ণ কৃত্রিম উপায়ে প্রথম প্লাস্টিক সংশ্লেষ করার কৃতিত্ব বেলজিয়ামের রসায়নবিদ লিও বেকল্যান্ডের। তাঁরই নামে সেটি ‘বেকেলাইট’ নামে পরিচিতি লাভ করে। কৃত্রিম প্লাস্টিক উৎপাদন শিল্প সেই অর্থে বেগবান হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে। গত শতাব্দীর বিশের দশকের শেষভাগ থেকে একের পর এক আবিষ্কৃত হতে থাকে পলিভিনাইল-ক্লোরাইড বা পি ভি সি, পলিস্টাইরিন, পলিথিলিন, পলিপ্রোপিলিন ইত্যাদি হরেক কিসিমের কৃত্রিম প্লাস্টিক। তবে প্যাকেজিং শিল্পে ব্যাপক হারে প্লাস্টিকের ব্যবহার শুরু হয় কার্যত গত শতাব্দীর পাঁচের দশক থেকে। ১৯৫০ থেকে ১৯৭০ - এই সময়কালে প্লাস্টিক বর্জ্যের পরিমাণ ছিল অতি নগণ্য। কিন্তু পরবর্তী বিশ বছরে প্লাস্টিক উৎপাদন ও বর্জ্যের পরিমাণ লাফিয়ে বেড়ে যায় তিন গুণ। কিন্তু তারপর ২০০০ সালে পৌঁছে কেবলমাত্র এক বছরেই প্লাস্টিক বর্জ্যের পরিমাণ বাড়ে তার আগের ৪০ বছরে যা বেড়েছিল তার থেকেও বেশি। আর এখন আমরা গড়ে বছরে ৪০০ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপাদন ক’রে চলেছি, যা আগামী ২০৫০-এর মধ্যে ১১০০ মিলিয়ন টনে পৌঁছানোর প্রবল আশঙ্কা। বর্তমানে যত রকম প্লাস্টিক উৎপাদন হয় তার ৩৬শতাংশই ব্যবহৃত হয় প্যাকেজিং শিল্পে এবং এদের বড়ো অংশটাই মাত্র একবার ব্যবহার ক’রে ফেলে দিতে হয়; তা সে পলি ইথিলিন টেট্রাথ্যালেটের বোতল হোক অথবা হাই ডেনসিটি পলি ইথিলিনের শ্যাম্পুর পাউচ কিংবা ক্রিমের কৌটো হোক বা পলিপ্রপিলিনের পোটাটো চিপসের প্যাকেট, বোতলের ছিপি কি ফেস্ মাস্ক হোক কিংবা পলিস্টাইরিনের কাপ, প্লেট, চামচ বা থার্মোকলের প্লেট হোক অথবা সেলুলোজ অ্যাসিটেট তন্তুর সিগারেটের ফিলটারই হোক। এক দু’দিন ব্যবহার ক’রে ফেলা দেওয়া এই সব জিনিসের ৮৫শতাংশই যায় জমিতে; তারপর বৃষ্টির জলে ধুয়ে নদী বাহিত হয়ে পৌঁছায় সমুদ্রে। বিশ্বে বর্তমানে প্রতি মিনিটে ১০ লক্ষ প্লাস্টিক বোতল বিক্রি হয়। আর পৃথিবী জুড়ে বছরে ৫ লক্ষ কোটি প্লাস্টিক ব্যাগ ব্যবহৃত হয়। বছরে সারা বিশ্বে ১০০ কোটি মানুষ গড়ে ৬ লক্ষ কোটি সিগারেট পান ক’রে থাকে। এই বিপুল সংখ্যক সিগারেটের ফেলে দেওয়া ফিল্টার মাটিতে ও সমু্দ্রে মাইক্রোপ্লাস্টিকের অন্যতম উৎস। ২০২০-র রাষ্ট্রসঙ্ঘের পরিবেশ কর্মসূচির রিপোর্ট অনুযায়ী সমুদ্রে ডাঁই হওয়া মাইক্রোপ্লাস্টিকের ৯শতাংশ আসে পলিয়েস্টার, নাইলন, অ্যাক্রিলিক ইত্যাদি উপাদানে তৈরি পোশাক থেকে; কেননা বিশ্বের বয়ন শিল্পে ৬০শতাংশই এই ধরনের কৃত্রিম তন্তু ব্যবহৃত হয়ে থাকে। প্লাস্টিক স্যুপ ফাউন্ডেশন তাদের সাম্প্রতিক সমীক্ষা রিপোর্টে দেখিয়েছে ১৩৮ টি স্যানিটাইজার ও হ্যান্ড জেল নির্মাণকারী ব্র্যান্ডের উৎপাদিত পণ্যের ৮৩শতাংশতেই পাওয়া গেছে অতিক্ষুদ্র প্লাস্টিক কণা, মাইক্রোবিডস্। ভাবতে অবাক লাগে, ওয়ার্লড ইকনমিক ফোরামের হিসাব অনুযায়ী প্যাকেজিং-এর জন্য ব্যবহৃত প্লাস্টিকের প্রায় ৯৫ শতাংশ অর্থমূল্যই (৮০-১২০ বিলিয়ন ডলার) মাত্র একবার ব্যবহারের পর নস্যাৎ হয়ে যায়।

জলবায়ু পরিবর্তনে প্লাস্টিকের অভিঘাত

অন্যদিকে প্লাস্টিক দূষণের প্রত্যক্ষ প্রভাবে বদলে যাচ্ছে জলবায়ুও। মনে রাখা দরকার ৯৮ শতাংশ প্লাস্টিকই উৎপাদিত হয় জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে। ২০১৯-এ প্রকাশিত একটি রিপোর্টে দেখা যাচ্ছ, প্লাস্টিক উৎপাদন ও দহনের ফলে ৮৫০ মিলিয়ন টন কার্বন ডাই অক্সাইডের সম পরিমাণ গ্রিন হাউজ গ্যাস বাতাসে যুক্ত হওয়ার আশঙ্কা। প্লাস্টিক বর্জ্যের কারণে যে বিপুল পরিমাণ গ্রিন হাউস গ্যাস সৃষ্টি হয়, তার কারণে ক্ষতির মূল্যমান এখনই প্রায় ৪০ বিলিয়ন ডলার। বর্তমানে যা প্রবণতা তাতে আগামী ২০৩০-এর মধ্যে গড়ে বছরে প্লাস্টিকের কারণে কার্বন উদ্‌গিরণের পরিমাণ হতে চলেছে ১৩৪ বিলিয়ন টন আর ২০৫০-এ এই কারণে নির্গত গ্রিন হাউজ গ্যাসের পরিমাণ দাঁড়াতে চলেছে বছরে ৫৬ বিলিয়ন টন, যা কিনা পৃথিবীর মোট অবশিষ্ট কার্বন বাজেটের ১৪ শতাংশ। তবে মনে রাখতে হবে প্লাস্টিক নয়, কাপড়ের ব্যাগ ব্যবহার করো বললেই শুধু হবে না। মুক্ত হতে হবে সর্বগ্রাসী বাজারের মোহ থেকে। কেননা একখানা বড়োসড়ো কাপড়ের ব্যাগ বানানোর পরিবেশগত অভিঘাত ২০০০০ প্লাস্টিক ক্যারিব্যাগ বানানোর অভিঘাতের সমান। এই সব কারনেই ২০১৮’র পর এ বছরও বিশ্ব পরিবেশ দিবসের মূল ভাবনায় আবারও উঠে এসেছে প্লাস্টিক দূষণ প্রতিরোধের আর্তি।

বিপুল প্লাস্টিক বর্জ্যের দায় কার?

১৯৭১-এর ২২ এপ্রিল দ্বিতীয় বসুন্ধরা দিবসের প্রাক্কালে আমেরিকান ক্যান কোম্পানি বহু অর্থ ব্যয় করে হলিউডের বিখ্যাত অভিনেতা আয়রন কোডিকে দিয়ে সে দেশের দূরদর্শনের জন্য একটি মহার্ঘ্য বিজ্ঞাপন তৈরি করে; যেখানে দেখা যায় প্লাস্টিকের ফেলে দেওয়া আবর্জনায় অবরুদ্ধ এক নদীর বাঁকে আটকে যাওয়া নৌকায় দাঁড়িয়ে ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে যন্ত্রণাক্লিষ্ট মুখে নাটকীয় ঢঙে কোডি বলছেন, ‘‘কিছু মানুষের আজও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের প্রতি গভীর ও অনুরাগপূর্ণ শ্রদ্ধা আছে, যা এক সময় এই দেশে ছিল। কিন্তু কিছু মানুষের তা নেই। মানুষই দূষণ শুরু করে। মানুষই পারে তাকে রুখে দিতে”। ব্যাস। সবটুকু দায় দিব্যি চাপিয়ে দেওয়া গেল মানুষের ওপর। কিন্তু আদতে কি তাই! দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকার ১৮ মে, ২০২১ সংখ্যায় সান্ড্রা লাভিল দেখিয়েছেন, বিশ্বের ২০ টি বহুজাতিক সংস্থা মাত্র একবার ব্যবহার ক’রে ফেলে দেওয়ার মতো প্লাস্টিকের ৫৫ শতাংশ উৎপাদন ক’রে থাকে। ২০১৯-এ মিনডেরু ফাউন্ডেশন, ওয়ার্ড ম্যাকেঞ্জি, লন্ডন স্কুল অব ইকনমিক্স ও স্টকহোম এনভায়রনমেন্ট ইনস্টিটিউটের এক যৌথ সমীক্ষায় দেখা যায়, সব থেকে বেশি প্লাস্টিক উৎপাদন করে এক্সন-মোবিল, বছরে প্রায় ৫.৫ মিলিয়ন টন। তার পরেই ৫.৩ মিলিয়ন টন উৎপাদন ক’রে দ্বিতীয় স্থানে আছে ডাও কেমিক্যাল। মুশকিল হলো ২০২১-এর নতুন আইন মোতাবেক গত ২০২২-এর জুলাই থেকে ভারতে কান খোঁচানির প্লাস্টিক কাঠি থেকে থার্মোকল এবং ৩১ ডিসেম্বর থেকে ১২০ মাইক্রনের থেকে কম ব্যাসের প্লাস্টিক প্যাকেটের মতো একাধিক পণ্য কাগজে কলমে নিষিদ্ধ হয়েছে বটে, তবে মনে রাখা ভাল পূর্বোক্ত রিপোর্ট অনুযায়ী ৩.১ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক উৎপাদন ক’রে উৎপাদক কোম্পানিগুলির মধ্যে অষ্টম স্থানে আছে ভারতের রাষ্ট্র পরিচালকদের আশীর্বাদ ধন্য রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজ। এছাড়া উৎপাদক কোম্পানি হিসাবে যথাক্রমে ০.৭ ও ০.৬ মিলিয়ন টন উৎপাদনের নিরিখে ৩৪তম ও ৪০ তম স্থানে আছে আমাদের গেইল ইন্ডিয়া ও ইন্ডিয়ান অয়েল। অন্যদিকে বছরে জনপ্রতি গড় প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপাদনেও শীর্ষে আছে উন্নত দেশগুলিই। ২০১৯-এর হিসাব মোতাবেক অস্ট্রেলিয়ায় একজন মানুষ গড়পরতা বছরে প্লাস্টিক বর্জ্য তৈরি করে ৫৯ কেজি; আমেরিকায় ৫৩ কেজি, ইংল্যান্ডে ৪৪ কেজি অথবা খুব কম ধরলে ইতালিতে ২৩ কেজি। সেখানে ভারতের জনপ্রতি বাৎসরিক প্লাস্টিক বর্জের পরিমাণ মাত্র ১৫ কেজি। ২০২১-এর হিসাবে ভারতে মোট প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপাদিত হয়েছে ৩.৪ মিলিয়ন টন, যেখানে আমেরিকা সে বছর উৎপাদন করেছে প্রায় ৪০ মিলিয়ন টন। ওদিকে বিশ্বের তাবড় ব্যাঙ্কগুলি দেদার টাকা ঢেলে চলেছে প্লাস্টিক উৎপাদক শিল্পের পিছনে। জানুয়ারি, ২০১১ থেকে ডিসেম্বর, ২০২০ পর্যন্ত পলিমার প্রস্তুতকারী সংস্থাগুলি বার্কলেজ ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ পেয়েছে ৫.৩ বিলিয়ন ডলার, এইচএসবিস থেকে ৩.১ বিলিয়ন ডলার, ব্যাঙ্ক অব আমেরিকা থেকে ২.৯ বিলিয়ন ডলার।

নজর ঘোরানোর নয়া ফিকির

নজর ঘোরানোর আরও একটা ফিকির হলো পুনর্নবীকৃত প্লাস্টিক বা রিসাইকেলড্ প্লাস্টিক। এই মুহূর্তে কোকাকোলা কোম্পানি বছরে ১০০ বিলিয়ন একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক বোতল উৎপাদন ক’রে চলেছে যা কিনা ইউনিলিভার, প্রোক্টর অ্যান্ড গ্যাম্বেল, ইউনিলিভার, নেসলের মতো নরম পানীয় প্রস্তুতকারক সংস্থাগুলির সম্মিলিত উৎপাদনের এক-চতুর্থাংশেরও বেশি। কোকাকোলা যদিও ২০২০-র মধ্যে বোতল তৈরিতে অন্তত ৫০ শতাংশ পুনর্নবীকৃত প্লাস্টিক ব্যবহারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তবু ২০২২-এর শেষেও তারা সেই ঘোষিত লক্ষ্যমাত্রার ধারেকাছেও পৌঁছাতে পারে নি। রিসাইক্লিং-এর পরিবর্তে বরং বিপুল পরিমাণ প্লাস্টিক-বর্জ্য গরিব দেশগুলোতে পাঠিয়ে দেওয়াতেই তাদের আগ্রহ বেশি। নিনা শ্রাঙ্ক ‘দ্য মিথ অব রিসাইক্লিং’ নিবন্ধে দেখিয়েছেন, ২০২০ সালে ইংল্যান্ডে পুননর্বীকৃত হিসাবে দেখানো হয়েছে সেই সব প্লাস্টিক ব্রর্জ্য যা তারা আসলে পাঠিয়েছে ভিন দেশে এবং ২০২০-তেও দেশের মোট প্লাস্টিক বর্জ্যের অর্ধেকই এইভাবে গরিব দেশে পাঠিয়ে দিয়ে দেখানো হয়েছে পুনর্নবীকৃত হিসাবে। ভারতেও ৬০ শতাংশ পুনর্নবীকৃত প্লাস্টিক ব্যবহার করা হয় বলে যতই দাবি করুক সরকার, সম্প্রতি সেন্টার ফর সায়েন্স অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট দেখিয়েছে এদেশে পুনর্নবীকৃত হয় বড়োজোর ১২ শতাংশ প্লাস্টিক। এই প্রসঙ্গে ২০১৭-র আগস্টে খাদ্য-অপচয়রোধী প্রচার সংস্থা ফিডব্যাকের অধিকর্তা শ্রীমতী ক্যারিনা মিলস্টোন যথার্থই বলেছেন, ‘কোকাকোলার মতো সম্পদ শোষণকারী ভোগনির্ভর বহুজাতিক ব্যবসার মডেল মূলগতভাবেই এই গ্রহের প্রয়োজনের সঙ্গে খাপ খেতে পারে না’। একবার মাত্র ব্যবহার যোগ্য প্লাস্টিকের ব্যবহার কমিয়ে আনার উদ্যোগের পাশাপাশি লেইজের আলুভাজা থেকে বোতলবন্দি ঠান্ডা পানীয়ের হাতছানিকে উপেক্ষা করতে শেখানোর সংস্কৃতিকেও রপ্ত করতে হবে আমাদের। বাজারের হাতে ছেড়ে দেওয়া যাবে না আমাদের চেতনার বিনির্মাণের ভার।

আইনের আড়ালে অন্য অভিসন্ধি?

আমাদের দেশেও যাবতীয় দূষণের দায় চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে প্রান্তিক ব্যবহারকারীর ওপর। ভারত সরকার ২০১৬-র আইন বদলে প্রণয়ন করেছে প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিধি, ২০২১; যার বলে ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিকের বেধ ৫০ মাইক্রোন থেকে বাড়িয়ে করা হয়েছে ১২০ মাইক্রোন। কিন্তু এই নতুন আইনে যত দোষ নন্দ ঘোষের মতো সমস্ত দায় চাপানোর চেষ্টা হয়েছে অন্তিম ব্যবহারকারীর ওপরেই। রাস্তার হকারদের ওপর চাপানো হয়েছে চড়া হারে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ফি; যা শুধু অন্যায়ই নয়, অবাস্তবও বটে। ‘সারা ভারত প্ল্যাস্টিক উৎপাদক অ্যাসোসিয়েশনে'র সম্পাদক হরেন সাঙ্ঘভি যথার্থই দাবি করেছেন, উৎপাদকের বর্ধিত দায়িত্ব পলিমার উৎপাদনকারী ছোটো ছোটো শিল্পইউনিটগুলির ওপর না চাপিয়ে, চাপানো উচিত বহুজাতিক ব্রান্ড মালিকদের ওপরেই। তা না হলে পলিমার প্রস্তুতকারী ক্ষুদ্র শিল্প একদিন উঠে যাবে এবং বাজারের একচ্ছত্র দখল নেবে বহুজাতিক কোম্পানিগুলি। বর্তমানে ভারতে ৪৯৫৩টি নথিবদ্ধ ও ৮২৩টি অনথিবদ্ধ পলিমার কারখানা আছে। কে বলতে পারে, এই নয়া বিধির আড়ালে ভারত সরকারের গোপন অ্যাজেন্ডা হয়তো এদেশে সম্ভাবনাময় পলিমার বাজারের পথ বহুজাতিকদের জন্য সুগম করে দেওয়া!