E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৬০ বর্ষ ৪২ সংখ্যা / ২ জুন, ২০২৩ / ১৮ জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩০

সুন্দরবনঃ প্রকৃতি ও পরিবেশ

গোকুলচন্দ্র দাস


মানুষ প্রকৃতিরই অংশ। নিজের অস্তিত্ব রক্ষা ও সমৃদ্ধির জন্য প্রকৃতির সম্পদ ব্যবহারে তার পূর্ণ অধিকার। কিন্তু প্রকৃতিতে ভারসাম্য রক্ষার প্রয়োজনে এই অধিকারের একটি সীমা নির্ধারণ প্রয়োজন। এই সর্তকতা ও সীমা না থাকার ফলে অতীতের অনেক সভ্যতা কালের অতলে তলিয়ে গেছে। পৌনে তিনশ’ বছর আগে ইংরেজরা যখন বাংলাদেশের শাসন কর্তৃত্ব অধিকার করে তাদের নির্বিচার লোভের প্রথম শিকার হয়েছিল সুন্দরবন। সুপ্রাচীনকালে অধুনা সুন্দরবন নামে পরিচিত এই লবণাম্বু অরণ্যের বিস্তার ছিল উত্তরে চট্টগ্রাম থেকে দক্ষিণে ওডিশা রাজ্যের পুরী পর্যন্ত, উত্তর বঙ্গোপসাগরের উপকূল বরাবর। এই বিস্তৃতি কালপ্রবাহে ক্রমশ সংকুচিত হয়ে মুঘল আমলে সুন্দরবন সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছিল পশ্চিমে হুগলি থেকে পূর্বে মেঘনা নদীর অন্তর্বর্তী ভূখণ্ডে। সেই সময় এর বিস্তার ছিল পূর্ব পশ্চিমে ১৭০ মাইল বা ২৭৩.৫৩ কিমি এবং উত্তর-দক্ষিণে ৬০ থেকে ৮০ মাইল বা ৯৭-১২৩ কিমি।

স্বাধীনতার প্রাক্কালে দেশভাগের সময় অবিভক্ত সুন্দরবনের মোট আয়তন ছিল ৬,৫২৬ বর্গমাইল। বিভাজনের পর ভারতীয় সুন্দরবনের আয়তন দাঁড়ায় ১,৯৪১ বর্গমাইল (৭,৬১৭ বর্গকিমি)। বলা বাহুল্য, ভারতীয় সুন্দরবনের অবস্থিতি শুধু অবিভক্ত চব্বিশ পরগনা জেলার দক্ষিণাংশ জুড়ে, পশ্চিমে হুগলি নদী থেকে পূর্বে যমুনা ও কালিন্দী নদী পর্যন্ত। অতি সম্প্রতি এক গবেষকের দেওয়া তথ্য অনুসারে অবিভক্ত চব্বিশ পরগনায় সুন্দরবনের মোট আয়তন এখন ৪,২২৩.২২ বর্গকিমি মাত্র। এর মধ্যে জেলা ভাগের পর উত্তর চব্বিশ পরগনার ভাগে গিয়েছে ৪১.৭৫ বর্গকিমি। আর, সুন্দরবনের বৃহদংশ, ৪,১৮১.৪৭ বর্গকিমি বনাঞ্চল এখন দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণে।

ইংরেজদের আগমনকালে কলকাতার পূর্ব ও দক্ষিণে সমুদ্র পর্যন্ত বিস্তৃত সুন্দরবন ছিল জনবসতিহীন জলাজঙ্গলে পূর্ণ, হিংস্র বাঘ ও অন্যান্য জীবজন্তু এবং জলদস্যুদের নিরাপদ আশ্রয়। সামুদ্রিক জোয়ার ভাঁটার প্রভাবাধীন হওয়ায় এই নিম্নভূমির জল ও মাটি অতিশয় লবণাক্ত। এই কারণে গাঙ্গেয় ব-দ্বীপের সর্ব দক্ষিণের উপকূলবর্তী নিম্নশায়ী এই অঞ্চল মুঘল আমলের টোডরমলের রাজস্ব ব্যবস্থা এবং ঔপনিবেশিক আমলের সূচনা পর্বে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের অর্ন্তভুক্ত ছিল না। কিন্তু সুন্দরবনের গভীরে অনেকাংশে যে একদা সমৃদ্ধ জনপদের অস্তিত্ব ছিল তার প্রমাণ পাওয়া গেল ঔপনিবেশিক সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় আঠারো শতকের শেষে আবাদিকরণের জন্য জঙ্গলে জমির হাসিল প্রক্রিয়া শুরু হলে। জঙ্গল হাসিল, আবাদিকরণ ও প্রজাপত্তনের এই প্রক্রিয়া চলেছিল সমগ্র উনিশ শতক জুড়ে, এমনকী বিশ শতকের তৃতীয় দশক পর্যন্ত।

এই সময় সুন্দরবনের বিভিন্ন প্রান্তে আবিষ্কৃত হয়েছিল পোড়া ইটের তৈরি বাসগৃহ, মন্দির, স্নানঘাটের ধ্বংসাবশেষ, পাথর ও ধাতুনির্মিত দেবদেবীর মূর্তি, হাতিয়ার, অলঙ্কার, মানব সভ্যতার বিভিন্ন পর্যায়ের মৃৎপাত্র ও নিত্যব্যবহার্য তৈজসপত্র। এরপর বিগত শতকে চন্দ্রকেতুগড়, হরিনারায়ণপুর এবং অতি সম্প্রতি ধোসা ও তিলপিতে প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখননের ফলে পাওয়া গিয়েছে প্রাচীন স্থাপত্য, ভাস্কর্য, বৌদ্ধস্তূপ, ধাতু গলানোর কারখানা ও বিপুল অন্যান্য প্রত্নবস্তু। এইসব বিশ্লেষণ করে পণ্ডিতেরা এখন প্রায় একমত হয়েছেন যে, দূর অতীতে, অন্তত পক্ষে চতুর্থ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে দ্বাদশ শতক পর্যন্ত, এই অঞ্চলে উন্নত সংস্কৃতির অধিকারী বহু সমৃদ্ধ জনপদের ধারাবাহিক অস্তিত্ব ছিল। আদি-মধ্যযুগে, সুলতানি আমলেও সেই জনপদগুলির কয়েকটি যে তাদের অস্তিত্ব বজায় রেখেছিল, তারও প্রমাণ পাওয়া যায় সমকালের সাহিত্যে, বিশেষত মঙ্গলকাব্যে।

তাই যদি হয়, তাহলে সুন্দরবনের ভূ-ভাগ আজকের মতো এতটা নিম্নশায়ী ছিল না। অন্তত উত্তরের অনেকটা অংশই পূর্ব সুন্দরবনের সমান উচ্চতায়, জোয়ার সীমার ঊর্ধ্বে অবস্থিত ছিল। ফলে এই ভূ-ভাগের মৃত্তিকা ও জলের লবণাক্ততা আজকের মতো এত অসহনীয় মাত্রায় ছিল না। গঙ্গা-ভাগীরথীর শাখা নদীগুলি, যেগুলি পশ্চিম সুন্দরবনের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে সাগরে পড়ত, সেগুলিতে স্বাদু জলের প্রবল প্রবাহ ছিল। মোট কথা, তখন পশ্চিম তথা চব্বিশ পরগনায় সুন্দরবনের মানুষের স্থায়ী বসতি ও উন্নত সংস্কৃতি চর্চার একটি স্বাভাবিক অনুকূল পরিবেশ ও পরিস্থিতি ছিল। কেন, কী পরিস্থিতিতে এবং কোন সময় থেকে কলকাতার দক্ষিণে হুগলি নদীর পূর্বতীর বরাবর কিছু সংকীর্ণ অঞ্চল ছাড়া অবশিষ্ট বিশালায়তন চব্বিশ পরগনার দক্ষিণাংশ জনশূন্য হয়ে কালক্রমে সুন্দরবন নামে পরিচিত লবণাম্বু অরণ্যে ঢেকে গেল তাই হবে আমাদের পরবর্তী আলোচ্য বিষয়।

বঙ্গীয় ব-দ্বীপ গঠনের সূচনাকাল থেকেই এই অঞ্চলের ভূপৃষ্ঠ উত্তর-পশ্চিম থেকে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে ক্রমশ ঢালু হয়ে নেমে গিয়েছে। ভূ-তত্ত্ববিদদের মতে গঙ্গার মূল প্রবাহটি এই ঢাল বেয়ে প্রবাহিত হওয়ার সময় অতীতে হাজার হাজার বছর ধরে নতুন নতুন ব-দ্বীপ গঠনের জন্য নিত্য বিপুল পরিমাণ পলি জমা করত। কিন্তু পঞ্চদশ-ষোড়শ শতকের কোনো এক সময় প্রচণ্ড শক্তিশালী ভূ-কম্পন, অথবা পৃথিবীর কেন্দ্রের কঠিনতম আবরণের সঞ্চলনের (tectonic movement) জন্য এই প্রধান প্রবাহটি বর্তমানের হুগলি-ভাগীরথীর প্রাচীন খাত বর্জন করে উত্তরে রাজমহলের নিচে পূর্বদিকে অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র শাখা নদী, পদ্মার খাতে সরে যায়। উত্তর-পশ্চিমবাংলার ক্রমশ উচ্চতা বৃদ্ধি, বঙ্গীয় অববাহিকার ভূপৃষ্ঠের পূর্বদিকে ঝুঁকে যাওয়া এবং ভূ-অবনমনের মতো ভূ-প্রাকৃতিক বিপর্যয়গুলি সম্মিলিতভাবে গঙ্গাকে পশ্চিম অববাহিকা থেকে সরে যেতে বাধ্য করেছিল বলে অনুমান হয়।

গাঙ্গেয় পশ্চিম অববাহিকায় ভূমি গঠন প্রক্রিয়া অসম্পূর্ণ রেখে গঙ্গার এই যে পূর্বাভিমুখী অভিসরণ, নিম্ন পশ্চিম ব-দ্বীপের সমৃদ্ধ অঞ্চলের উপর প্রায় চূড়ান্ত আঘাত হেনেছিল। গড়াই, যমুনা, বিদ্যাধরী ও পিয়ালীর মতো গঙ্গার যে শাখা নদীগুলির মধ্য দিয়ে পশ্চিম সুন্দরবন বিপুল পরিমাণ স্বাদু জলের জোগান পেত, এই ঘটনার পর সেগুলি গঙ্গার সঙ্গে সংযোগ হারিয়ে ক্রমশ শুকিয়ে যেতে শুরু করে। এবং লবণাক্ত সমুদ্র ঢেউ জোয়ারের সময় এই নদীগুলির মরা খাত বেয়ে অবাধে উপরের দিকে বহুদূর পর্যন্ত উঠে যায় এবং দু’কূল ছাপিয়ে নদী তীরবর্তী কৃষি ও বসতি এলাকা লোনাজলে প্লাবিত করে। ‘সেই সময় যখন গঙ্গার স্বাদুজল পশ্চিম সুন্দরবনের মধ্য দিয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়ত’ মেজর স্মিথ লিখেছেন, ‘কৃষির বিস্তার ছিল সমুদ্র পর্যন্ত, কিন্তু নদী সমূহের শীর্ষদেশ পলি পড়ে রুদ্ধ হওয়ার ফলে নদীগুলি জলশূন্য হয়ে পড়েছিল এবং সমুদ্রের জোয়ার ও ভাঁটা এবং ফলশ্রুতি হিসেবে লবণাক্ত জল উত্তরে অনেকদূর প্রসারিত হয়েছিল। মরা নদীর উভয়দিকের জোয়ার-বাহিত লোনা জলের প্লাবন এলাকাগুলি এর ফলে ক্রমে জনশূন্য হয়ে গিয়েছিল এবং সেই স্থানগুলিতে দ্রুত মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিল লোনা জলের জঙ্গল যা পরে বর্তমান সুন্দরবনের চরিত্র লাভ করে।’

সাম্প্রতিক হলোসিন কালপর্বে নিম্ন দক্ষিণবঙ্গের ভূপ্রকৃতিতে এরকম গুরুতর বিপর্যয় অবশ্য কালক্রমে সহনীয় হয়ে উঠেছিল এলাকার অবশিষ্ট মানুষের কাছে। যথেষ্ট বেগবতী না হলেও ঔপনিবেশিক শাসনের সূচনাপর্বে নিম্ন দক্ষিণবঙ্গে গঙ্গার শাখা নদীগুলিতে স্বাদু জলের প্রবাহ কম হলেও অব্যাহত ছিল। বাদাবন বা সুন্দরবনকে ঘিরে অরণ্যনির্ভর নতুন এক গ্রামীণ অর্থনীতির জন্ম হয়েছিল। দক্ষিণবঙ্গের সমূহ জ্বালানি, গৃহনির্মাণের প্রয়োজনীয় কাঠ ও আসবাবপত্র, যাতায়াত ও যোগাযোগের জন্য সে সময়ের অপরিহার্য বাহন, নৌকার কাঠ অপর্যাপ্ত জোগান দিত সুন্দরবন। তাছাড়া এই অঞ্চলের নদীনালা ছিল বাঙালির অপরিহার্য খাদ্য মাছের অফুরন্ত ভাণ্ডার। এই অরণ্য কৃষি বহির্ভূত অতিরিক্ত আয়ের অনন্য সুযোগ এনে দিয়েছিল কৃষকদের। চাষের কাজ ছাড়া মরসুমি ও আংশিক সময়ের পেশা হিসেবে তারা জঙ্গল থেকে কাঠ ও মধু সংগ্রহ করত। নদী থেকে মাছ-কাঁকড়া ধরত এবং গঞ্জ-শহরে বিক্রি করে অতিরিক্ত উপার্জন করত। এত সম্পদ আহরণ সত্ত্বেও প্রাক্‌-ঔপনিবেশিককালে সুন্দরবনের সঞ্চিত সম্পদের তুলনায় তা ছিল নগন্য। বাদাবনের অবাধ ও অপর্যাপ্ত ব্যবহারের কিছু বাস্তব, আবার কিছু মনস্তাত্ত্বিক বাধাও ছিল সেই সময়। জেলে, মৌলে, কাঠুরেরা যে নৌকা ব্যবহার করত, সেগুলি ছিল ছোটো। অরণ্যে প্রবেশের সময় ছিল সীমিত, প্রধানত শীতকালে। হিংস্র বাঘের আক্রমণের আতঙ্ক ছিল। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যা, নিজেদের প্রয়োজনের অতিরিক্ত সম্পদ আহরণ করে তারা বন দেবতাদের রোষের কারণ হতে চাইত না। গঙ্গার আনুকূল্য থেকে বঞ্চিত হলেও তাই এই বাদাবনের স্বাস্থ্য ও সমৃদ্ধির অনুকূল একটি ভূ-প্রাকৃতিক পরিবেশ, অন্তত ১৮০০ সাল পর্যন্ত এই ভূভাগ প্রায় অটুট ছিল। কিন্তু আঠারো শতকের শেষভাগে এই প্রদেশে ইংরেজ শাসন প্রবর্তনের পর থেকে সেই সূক্ষ্ম ভারসাম্য দ্রুত ভাঙতে শুরু করে। কেন, কিভাবে - এ বিষয়েই আমাদের পরবর্তী আলোচনা।

বলা হয়ে থাকে যে, ইংরেজ শাসিত বাংলার প্রথম কালেক্টর জেনারেল ক্লড রাসেলই প্রথম কলকাতা সংলগ্ন সুন্দরবনের হাসিলের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তখন তাঁর ঘোষিত উদ্দেশ্য ছিল পূর্ব ভারতে ইংরেজদের প্রধান ঘাঁটি কলকাতার স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা সুনি‍‌শ্চিত করা। কিন্তু শীঘ্রই তাঁদের উপলব্ধি হয়েছিল যে, সুন্দরবনের গভীরে কৃষির বিস্তার ঘটিয়ে অতিরিক্ত ও বিপুল রাজস্ব সংগ্রহ এবং এর নদীনালার মধ্য দিয়ে পূর্ববঙ্গ ও আসামের সঙ্গে অপেক্ষাকৃত কম দূরত্বের নতুন বাণিজ্যপথ প্রবর্তন করে কলকাতা বন্দরের রপ্তানি বাণিজ্য বৃদ্ধি সম্ভব। এ যাবৎ নিরুপদ্রব আদিম অরণ্যে ঔপনিবেশিক সরকারের আগ্রাসী হস্তক্ষেপের এই দ্বিমুখী নীতি কালক্রমে সুন্দরবনের ভূমি ব্যবস্থা, বাস্তু সংস্থান ও জীববৈচিত্র্যের উপর গভীরতর প্রভাব ফেলেছিল। চব্বিশ পরগনায় সুন্দরবনের দ্বীপসমূহের অবস্থান গড় জোয়ার উচ্চতার নিচে, তাই জঙ্গল হাসিলও ভূমি খণ্ডগুলিকে আবাদি করতে গেলে জোয়ারের সময় লোনা জলের প্লাবন রোধের জন্য সেগুলির চারপাশে উপযুক্ত উচ্চতার বাঁধ তৈরি আবশ্যিক ছিল। ও স্যালির মতে ১৯১৪ সালে সুন্দরবনের সরাসরি বিক্রিত অথবা দীর্ঘস্থায়ী বন্দোবস্তকৃত মোট জঙ্গলে জমির পরিমাণ ছিল ৭১৭ বর্গমাইল। আর, এই বিস্তৃত জমির চারপাশে নির্মিত বাঁধের দৈর্ঘ্য ছিল ২১২ মাইল। এত দীর্ঘ বাঁধ নির্মিত হওয়ায় সুন্দরবনের নদীগুলি তাদের স্বাভাবিক প্লাবন এলাকা হারিয়ে জোয়ারের সময় সমুদ্র থেকে তুলে আনা বালি ও পলি আপন আপন খাতেই জমা করতে বাধ্য হয়। এর ফলে একদিকে গঙ্গার আনুকূল্য থেকে বঞ্চিত চব্বিশ পরগনার নিম্নভূমির কালক্রমে উন্নত হওয়ার যে শেষ সুযোগটুকু ছিল, অপরিকল্পিত নদীবাঁধ তাকে তা থেকে চিরকালের‍‌ জন্য বঞ্চিত করেছে। অন্যদিকে নদীগর্ভ ক্রমশ উচ্চ হতে থাকায় ভরা কোটালের সময় দুই পাশের নিম্নভূমি প্লাবিত হওয়ার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়। প্রকৃতপক্ষে সুন্দরবনে এখন তাই-ই ঘটে। কোটাল কিংবা সামুদ্রিক ঝড়ের দাপটে প্রায়শই নদীবাঁধ ভেঙে বসতি ও আবাদি জমি লোনা জলে প্লাবিত হয়। মানুষের জীবন ও সম্পত্তির বিপুল ক্ষতি হয়। প্রাচীন প্লাবন এলাকায় প্রবেশাধিকার না পেয়ে সমুদ্রও তার সমূহ রোষ নিয়ে আছড়ে পড়ছে সুন্দরবন সংলগ্ন উপকূলভাগে। ফলে ভূমিক্ষয় বাড়ছে, হারিয়ে যাচ্ছে জঙ্গল, জমি ও জনপদ। লোহাচরা ও বেডফোর্ট দ্বীপ মানচিত্র থেকে মুছে গেছে। ঘোড়ামারা দ্বীপও বিপন্ন।

অন্যদিকে উনিশ শতকের শুরুতে পণ্যবাহী নৌকাগুলির জন্য পূর্ববঙ্গ ও কলকাতার মধ্যে একটি দীর্ঘ ও নিরবচ্ছিন্ন জলপথ উন্মুক্ত করতে কতকগুলি খাল কেটে সুন্দরবনের নদীগুলির সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়েছিল। এর ফলে সৃষ্টি হয়েছিল কলকাতা ও পূর্বদেশীয় খাল ব্যবস্থা-এর জন্য যে কৃত্রিম খালগুলি কাটা হয়েছিল সেগুলি হলো - টালির নালা, বেলেঘাটা খাল, নতুন কাটা খাল, ভাঙড় খাল ইত্যাদি। সুন্দরবনের মুমূর্ষু নদীগুলি এযাবৎ উত্তরে তাদের শীর্ষ দেশে যেটুকু মিষ্টিজলের সরবরাহ পেত, এর ফলে এই খালগুলি তা অন্যপথে টেনে নিয়ে কালক্রমে নদীগুলির মজে যাওয়ার প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করেছিল।

নিম্ন-দক্ষিণবঙ্গে নদী বিন্যাসের ভূ-প্রাকৃতিক পরিবর্তন ও ঔপনিবেশিক আমলে অবিবেচনা প্রসূত মানবিক হস্তক্ষেপ অচিরে বাদাবনের বৃক্ষবিন্যাস ও জীববৈচিত্র্যের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলেছিল। স্বাদুজলের ঝাপটার অভাবে প্রথমে সুন্দরী ও পরে পশুর ও গোলপাতা গাছ পশ্চিম তথা চব্বিশ পরগনা সুন্দরবন থেকে প্রায় বিলুপ্ত হয়ে যায়। সুন্দরী নৌকা নির্মাণের জন্য, পশুর আসবাবপত্র তৈরির জন্য ও গোলপাতা ঘরের ছাউনির জন্য কলকাতাসহ সমগ্র দক্ষিণবঙ্গে উনিশ শতক পর্যন্ত ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হতো। আবুল ফজলের বর্ণনা মতো সুন্দরবনে হাতির অস্তিত্বের কথা বাদ দিলেও, এই অঞ্চলে যে একদা, অন্তত উনিশ শতক পর্যন্ত এক শৃঙ্গবিশিষ্ট গণ্ডার ও ছোটো এক জোড়া বাঁকানো শিংযুক্ত অতিকায় বন্য মহিষের অস্তিত্ব ছিল সে বিষয়ে বিশেষজ্ঞ পণ্ডিতেরা সুনিশ্চিত। অলিভ টার্টল (Olive Turtle) নামে এক বিশেষ প্রজাতির কচ্ছপ আর আগের মতো ডিম পাড়ার জন্য চব্বিশ পরগনার সুন্দরবনে আসে না। অনেকটা ‘হাড়গিলা’র মতো দেখতে লম্বা সাদা রঙের লেজবিশিষ্ট ‘সদন্তক’ নামের পাখি এখন এই অঞ্চল থেকে উধাও। এইরকম অনেক প্রাণী - বিশেষ প্রজাতির হরিণ, কুমির, প্যাঙ্গোলিন, পাখি, সরীসৃপ ইত্যাদি কালক্রমে সুন্দরবনকে স্থায়ীভাবে পরিত্যাগ করেছে। এখন বিপন্ন এই বন্যপ্রাণীর তালিকার শীর্ষে আছে বাঘ - বিখ্যাত রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার, সুন্দরবনের স্বাভাবিক রক্ষক যার বাসভূমি হিসেবে সুন্দরবনের বিশেষ খ্যাতি এবং সুন্দরবন সম্পর্কিত যাবতীয় লোককথার সঙ্গে যার অপরিহার্য সম্পর্ক। শুধু এমন নয় যে, কতগুলি বৃক্ষগুল্ম বা পশুপাখির সংখ্যা পশ্চিম সুন্দরবনে দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে, অরণ্য সংযুক্তি বা অরণ্যের বিভিন্ন প্রজাতির বৃক্ষ সমূহের জটিল বিন্যাস প্রণালীও এখন অনেক শিথিল ও সহজ হয়ে গিয়েছে এবং গাছগুলির উচ্চতা ও বেড় ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে।

ভূ-প্রকৃতিতে যে স্বাভাবিক পরিবর্তন ঘটে তার প্রতিরোধ মানুষের সাধ্যাতীত। কিন্তু সুপরিকল্পিত ও সংগঠিত উদ্যোগের মাধ্যমে মানুষই এ‍‌ই পরিবর্তন প্রক্রিয়াকে স্তিমিত ও সহনীয় করে তুলতে পারে। সুন্দরবন বঙ্গোপসাগর উত্থিত ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে কলকাতা সহ নিম্ন দক্ষিণবঙ্গকে অনেকটা নিরাপদ রাখে। অতিরিক্ত অক্সিজেন জুগিয়ে বায়ুমণ্ডলকে নির্মল করে। মাছ, মধু, মোমের মতো প্রভূত অর্থকরী ফসল জোগান দেয়। সুতরাং, সুন্দরবনকে রক্ষা করাটা খুবই জরুরি। বিশ্ব উষ্ণায়নের কারণে সমুদ্রের জলস্তর যে হারে এখন বৃদ্ধি পাচ্ছে, তা অব্যাহত থাকলে কলকাতা সহ এই অঞ্চলের জলমগ্ন হওয়ার সম্ভাবনা। সুতরাং, এই পরিপ্রেক্ষিতে অন্তত সুন্দরবনে কংক্রিটের সুউচ্চ নদীবাঁধ নির্মাণের প্রকল্প দ্রুত রূপায়িত করা জরুরি প্রয়োজন। নতুন নতুন বনসৃজনের মাধ্যমে অতীতে ভুলের কিছুটা সংশোধনের চেষ্টা হতে পারে। সুন্দরবন এলাকায় কোথাও আস্ত নদী ঘিরে বা নদীর চর দখল করে যেভাবে যত্রতত্র বাঁধ দিয়ে অসংখ্য ফিশারি গড়ে উ‍‌ঠেছে তা প্রয়োজন মতো নিয়ন্ত্রণ করাও জরুরি। আর সর্বোপরি, সুন্দরবন এলাকার মানুষকে জল জঙ্গল রক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন করতে হবে। এবং সরকারি সংরক্ষণ পরিকল্পনায় তাদেরও শামিল করতে হবে।