৬০ বর্ষ ৪২ সংখ্যা / ২ জুন, ২০২৩ / ১৮ জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩০
অসাম্প্রদায়িক চেতনার বাতিঘর নজরুল
অমিত রঞ্জন দে
হাজার বছরের চর্চা ও অনুশীলনে বাঙালি সংস্কৃতি একটি বিভেদশূন্য, মানবিক ও সম্প্রীতির সংস্কৃতি হিসেবে গড়ে উঠেছে। যেখানে মানুষ সুখে-দুঃখে, হাসি-কান্নায়, দ্রোহ-প্রণয়ে একসাথে বসবাস করেছে। কখনো তা বিভেদের হিংস্রতায় উন্মত্ত হয়ে ওঠেনি। কখনো কখনো ব্যক্তি পর্যায়ের শাসন-শোষণ থাকলেও সেখানে মানবিকতার চর্চা ও বিকাশ ছিল লক্ষণীয়। কিন্তু এই উর্বর ও মানবিক সমাজের ছন্দপতন ঘটিয়েছে বহিরাগত শাসকগোষ্ঠী। তারা বাঙালিকে বিচ্যুত করেছে তার ঐতিহ্য থেকে। ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার বিষ ঢেলে কলঙ্কিত করেছে তার সৌন্দর্য। বহিরাগত এই শাসকগোষ্ঠীর অন্যতম ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ। তাদের শাসন আমলেই এর বিস্তার ঘটেছে সর্বাধিক। ক্রমান্বয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল বা শাসকগোষ্ঠীর পৃষ্ঠপোষকতায় সাম্প্রদায়িকতা সামাজিক রূপ লাভ করে। আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে সম্প্রদায়ের ভেতরে নানাধরনের সংকট তৈরি হয়েছে। ফলে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় শিক্ষা, কর্মসংস্থান সহ অর্থনীতির সকলক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়েছে, আর সকল সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেছে সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়। এই বৈষম্যের আড়ালে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সরকার বিভেদের বীজ বপন করেছে। প্রয়াস পেয়েছে বাংলার হিন্দু-মুসলিমের মধ্যেকার অসাম্প্রদায়িক চেতনার যে শাশ্বত রূপ তা বিনষ্ট করার।
সেই ব্রিটিশ ভারতে নজরুল ছিলেন বাঙালির অখণ্ড হৃদয়ের শোণিত ধারা। ছিলেন বাংলার মেহনতি মানুষের মুক্তিতে বিশ্বাসী স্বাধীনতা ও জাতীয় গণতান্ত্রিক সংগ্রামের কবি। তারুণ্যের দীপ্তিতে নজরুল যখন টগবগ করছেন সে সময়টা ছিল যুদ্ধ, বিপ্লব আর অভ্যুত্থানের যুগসন্ধিক্ষণ। এই সময়ে শত শত বছর ধরে বিদেশি শাসন-শোষণে নুয়ে পড়া বাঙালিকে মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াবার আহ্বান জানান নজরুল। তিনি স্বাধীন ও মুক্ত জীবনের গান শোনান লাঞ্ছিত-নিপীড়িত, দারিদ্র্যক্লিষ্ট মানুষকে। শোষণ-বঞ্চনার শিকার মানব-মানবীর জীবনের শৃঙ্খল ভেঙে মুক্তির স্বপ্ন দেখাতে চেয়েছিলেন। চেয়েছিলেন শোষণমুক্ত সমাজে এক মেঘমুক্ত নীলাকাশ রচনা করতে।
একদিকে সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসী শক্তিসমূহের আধিপত্য বিস্তারের নানা কুট কৌশল, অন্যদিকে সাম্প্রদায়িক উন্মাদনা। সে উন্মাদনার মাঝেও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি অটুট রাখার বিষয়টিকে অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে চিন্তা করেছিলেন। আজকে যারা নজরুলকে খণ্ডিত করতে চায়, অহেতুক টানা হেঁচড়া করতে চায়, বিভেদ রচনা করতে চায় তাদের জন্য তাঁরই দেওয়া শেষ অভিভাষণটিই যথেষ্ট। সেখানে তিনি সুস্পষ্ট করেই বলেছেনঃ
‘‘কেউ বলেন আমার বাণী যবন, কেউ বলেন, কাফের। আমি বলি ও দুটোর কিছুই নয়। আমি মাত্র হিন্দু-মুসলমানকে এক জায়গায় ধরে এনে হ্যান্ডশেক করাবার চেষ্টা করেছি, গালাগালিকে গলাগলিতে পরিণত করার চেষ্টা করেছি।’’ [১]
যারা ধর্মে ধর্মে বিভেদ রচনা করে মানুষের সামনে বিভিন্ন বিধি-নিষেধ আরোপ করে থাকে নজরুল তাদের উপহাস করেছেন, ব্যক্ত করেছেন হিন্দু-মুসলমানের মিলনাকাঙ্ক্ষা। কিন্তু নজরুলের সে আকাঙ্ক্ষাকে তৎকালীন হিন্দু বা মুসলিম রক্ষণশীল সমাজ স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করতে পারেনি। হিন্দু রক্ষণশীলরা নানাভাবে তাঁর লেখার প্রতিবাদ করেছে, মুসলিম রক্ষণশীলরাও করেছে তীর্যক ভাষায় আক্রমণ। এমনকী মুসলিম রক্ষণশীলদের পক্ষ থেকে তাঁকে ‘ধর্মদ্রোহী কুলাঙ্গার’ রূপে আখ্যায়িত করা হয়েছে। সেদিন যারা নজরুলকে গালি দিত এবং যে ভাষায় তাঁকে হেয় প্রতিপন্ন করত সে ভাষার স্বরূপ এবং তাদের চরিত্র ‘আমার কৈফিয়ত’ কবিতায় তিনি অত্যন্ত নিখুঁতভাবে তুলে ধরেছেন -
‘‘সব ছেড়ে দিয়ে করিলাম বিয়ে, হিন্দুরা ক’ন, ‘আড়ি চাচা!’
যবন না আমি কাফের ভাবিয়া খুঁজি টিকি দাড়ি, নাড়ি কাছা!
মৌ-লোভী যত মৌলবী আর ‘মোল্-লা’রা ক’ন হাত নেড়ে’,
‘দেব-দেবী নাম মুখে আনে, সবে দাও পাজিটার জাত মেরে!’’
নজরুল কখনো ধর্মে ধর্মে বিভেদ রচনা করতে চাননি। তিনি সব সময় আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতি রচনা করতে চেয়েছেন। যার প্রকৃষ্ট উদাহরণ তার ‘সাম্যবাদী’ কবিতাগুচ্ছ। যেখানে মানবপ্রেম ও সম্প্রদায় নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ ঘটেছে। তিনি তাঁর কবিতায় সকল ধর্মের মানুষকে একই আসনে বসিয়েছেন। সাম্যবাদী কবিতায় তাঁর সে দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন দেখতে পাই নিচের চরণগুলির মধ্য দিয়ে -
‘‘গাহি সাম্যের গান -
যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান,
যেখানে মিশিছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলিম-ক্রীশ্চান।’’
নজরুল মানুষকে হিন্দু-মুসলিম, বৌদ্ধ-খ্রিস্টান হিসেবে দেখেননি, দেখেছেন মানুষ হিসেবে। তাই তিনি সব ভেদাভেদ ভুলে মানুষে মানুষে ঐক্যের আহ্বান জানিয়েছেন। সংগ্রামের সাথে সুন্দরের সম্মিলন ঘটাতে চেয়েছেন। তিনি সুস্পষ্টভাবেই বলেছেন, মসজিদ-মন্দির-গির্জা যেখানেই যাওনা কেন, আর যত বেশি বেশি বেদ-বাইবেল-গীতা-কোরান-ত্রিপিটক পাঠ কর না কেন, মনের কালিমা যদি দূর করতে না পার, মানুষ হয়ে মানুষকে ভালোবাসতে না পারো, তাহলে তোমার সবকিছু ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে। কারণ মানুষের মধ্যে রয়েছে সব ধর্ম, সব যুগাবতার বা সব শক্তির উৎস। সুতরাং মানুষে মানুষে যারা বিভেদ রচনা করে, তারা কখনো প্রকৃত ধার্মিক হতে পারে না। তারা মানুষের শত্রু, মানবিকতার শত্রু। নজরুল এই সব শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। তাঁর এই যুদ্ধ পরাধীনতার গ্লানি থেকে, শৃঙ্খল থেকে মুক্তির। তিনি বিশ্বাস করতেন, এই মুক্তি আসা কেবল তখনই সম্ভব যখন আমরা ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধ হতে পারব। তাই তিনি হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সবাইকে কাছে টানতে চাইতেন, ধর্ম ও সম্প্রীতির ঊর্ধ্বে ‘মানুষ’ পরিচয়কেই মুখ্য হিসেবে দেখতে চাইতেন। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় ক্ষতবিক্ষত জাতির কাছে প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন ‘কাণ্ডারী হুঁশিয়ার’ কবিতার মধ্য দিয়ে -
‘‘কাণ্ডারী! আজ দেখিব তোমার মাতৃমুক্তি-পণ,
হিন্দু না ওরা মুসলিম? ওই জিজ্ঞাসে কোন জন?
কাণ্ডারী! বলো ডুবিছে মানুষ সন্তান মোর মার!’’
নজরুল সম্প্রদায় নয় অখণ্ড মানবতায় আস্থা স্থাপন করেছিলেন এবং সেই আস্থার ভিত্তি ছিল সম্প্রীতি। তাই আজকে যখন সম্প্রীতির বন্ধন বিনষ্ট করে সাম্প্রদায়িক শক্তির আস্ফালন দেখি, তখন নজরুলই আমাদের সামনে শক্তি ও প্রেরণার উৎস হিসেবে হাজির হন। নজরুল সব সময় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিকে অটুট রাখার আহ্বান জানিয়ে গেছেন। হিন্দু-মুসলিমের ঐক্য ও তাদের পারস্পরিক সম্প্রীতি কামনা করে গেছেন। নজরুলের গানসমূহ তার জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত। তাঁর গানে সম্প্রীতির বন্ধনের প্রতিচ্ছবি যেমনটা পাওয়া যায় তেমনটা সমকালের আর কারোর মধ্যে পাওয়া যায় না। তিনি লিখেছেন -
‘‘মোরা এক বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু-মুসলমান।
মুসলিম তার নয়ন-মণি, হিন্দু তাহার প্রাণ।’’
নজরুল তাঁর চিন্তা ও কর্মে সর্বতোভাবে সব ধর্মের মানুষকে মেলাতে চেয়েছেন। তিনি নিজেকে কখনো কোনো এক বিশেষ ধর্মের প্রতিনিধি হিসেবে উপস্থাপন করেননি। তিনি সকল সময় নিজেকে সকল ধর্মের মানুষ হিসেবেই পরিচয় করিয়েছেন। যা ১৯৪১ সালে দেওয়া তাঁর শেষ অভিভাষণেও আরো সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। তিনি সেখানে বলেছেন -
‘‘যদি আপনাদের প্রেমের প্রবল টানে আমাকে আমার একাকিত্বের পরম শূন্য থেকে অসময়েই নামতে হয় তাহলে সেদিন আমায় মনে করবেন না আমি সেই নজরুল। সে নজরুল অনেক দিন আগে মৃত্যুর খিড়কি দুয়ার দিয়ে পালিয়ে গেছে। সেদিন আমাকে কেবল মুসলমানের বলে দেখবেন না - আমি যদি আসি, আসব হিন্দু-মুসলমানের সকল জাতির উর্ধ্বে যিনি একমেবাদ্বিতীয়ম্ তাঁরই দাস হয়ে।’’ [২]
নজরুল জাতিতে জাতিতে বিদ্বেষ, হানাহানি দূর করে অসাম্যের বিরুদ্ধে সাম্য প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন, সকলের বাঁচার মধ্যদিয়ে নিজে বেঁচে থাকতে চেয়েছিলেন। যা তিনি তাঁর শেষ অভিভাষণের আরেক জায়গায় সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন -
‘‘হিন্দু-মুসলমানে দিনরাত হানাহানি, জাতিতে জাতিতে বিদ্বেষ, যুদ্ধ-বিগ্রহ। মানুষের জীবনে এক দিকে কঠোর দারিদ্র্য-ঋণ-অভাব; অন্যদিকে লোভী অসুরের ব্যাংকে কোটি কোটি টাকা পাষাণ স্তূপের মত জমা হয়ে আছে। এ অসাম্য ভেদজ্ঞান দূর করতেই আমি এসেছিলাম।’’ [৩]
নজরুল যখন এ বক্তব্য দিচ্ছেন তখন ভারত জুড়ে দেখা দেয় মন্বন্তর। মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে পড়ে। সর্বাত্মক ধ্বংসের কিনারায় গিয়ে পৌঁছায় গোটা দেশ ও সমাজ। যে সমস্ত কবি-সাহিত্যিক দেশ এবং দেশের মানুষের কথা ভাবে, চিন্তা করে তাঁরা সমাজের গতিপ্রকৃতি আগে থেকেই বুঝতে পারেন। নজরুল তৎকালীন সমাজ অনুশীলনের মধ্যদিয়ে যে আভাস পাচ্ছিলেন তারই অনুরণন তোলেন তাঁর শেষ অভিভাষণে। আজ যখন নজরুলকে স্মরণ করছি তখনও বিশ্বব্যাপী বিরাজ করছে যুদ্ধাবস্থা, আসন্ন খাদ্য ঘাটতির আশংকা। তখনও সিংহভাগ সম্পদের মালিক মুষ্টিমেয় কিছু মানুষ। এ ঘোর অমানিশায় নজরুলের কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে বলতে চাই -
‘‘প্রার্থনা ক’রো - যারা কেড়ে খায় তেত্রিশ কোটি মুখের গ্রাস,
যেন লেখা হয় আমার রক্ত-লেখায় তাদের সর্বনাশ!’’
জীবনব্যাপী নজরুল কেবলই মানুষের মুক্তিচিন্তা করে গেছেন। তাঁর জীবনবোধ ও চিন্তাধারায় তার প্রতিফলন ঘটেছে ভিন্নমাত্রায়। তাঁর কবিতা, গান, প্রবন্ধ, গল্প, উপন্যাস ও নাটকে মানুষের রাজনৈতিক মুক্তির ছবি ভেসে ওঠেছে। তাঁর সাহিত্যে তৎকালীন ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণের জাঁতাকল থেকে বেরিয়ে আসার আকুতি যেমন ফুটে উঠেছে, তেমনি সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক সকল ক্ষেত্রে মুক্তি আকাঙ্ক্ষা প্রতিবিম্বিত হয়েছে। তাঁর লক্ষ্য মানুষের প্রকৃত স্বাধীনতা এবং সর্বাত্মক মুক্তি। ‘বিদ্রোহী’ কবিতা তাঁর সেই মুক্তি আকাঙ্ক্ষার নির্যাস। এই কবিতার মাধ্যমে তিনি ঘুমন্ত জাতিকে আত্মপরিচয়বোধে জাগ্রত করতে চেয়েছেন। উদ্বুদ্ধ ও ধাবিত করতে চেয়েছেন দেশাত্মবোধের মহান আদর্শের পানে। ভেঙে ফেলতে চেয়েছেন অন্যায়-অত্যাচার, কুসংস্কার, ধর্মান্ধতার বেড়াজাল। চেয়েছেন সকল ধরনের বন্ধন ও শৃঙ্খল ভেঙে স্বাধীনতা ও মুক্তির অনুরণন সৃষ্টি করতে। আর তাই ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় তাঁর দৃপ্ত উচ্চারণ -
‘‘আমি দুর্বার,
আমি ভেঙে করি সব চুরমার!
আমি অনিয়ম উচ্ছৃঙ্খল,
আমি দ’লে যাই যত বন্ধন, যত নিয়ম কানুন শৃঙ্খল।’’
নজরুল তাঁর ‘বিদ্রোহী’ কবিতার মধ্য দিয়ে সমাজের সব কুসংস্কার-অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন। আইন-কানুনের যত শৃঙ্খল রয়েছে, তার সবকিছুকেই তিনি ভেঙে ফেলতে বলেছেন। এমনকী তাতে যদি মৃত্যু আসে তবুও তিনি তাঁর সাথেও আপস করতে রাজি নন। তিনি সবকিছু ধ্বংস করে সেই ধ্বংসস্তুপে আবার সূর্যোদয় ঘটাতে চেয়েছেন। বঞ্চিত গৃহহারা পথবাসী পথিকের বুকে গতি সঞ্চার করতে চেয়েছেন। নজরুল এক শোষণমুক্ত শ্রেণিহীন সামাজ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামকে অগ্রসর করে নিতে চেয়েছেন। আর তাই তিনি অসীম সাহসে বলে উঠতে পেরেছেন -
‘‘আমি তাই করি ভাই যখন চাহে এ মন যা
করি শত্রুর সাথে গলাগলি, ধরি মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা
আমি উন্মাদ, আমি ঝঞ্ঝা!
আমি মহামারি আমি ভীতি এ ধরিত্রীর;
আমি শাসন-ত্রাসন, সংহার আমি উষ্ণ চির-অধীর।’’
আর এ কারণেই নজরুলকে কোনো সময়ের বা দেশের গণ্ডিতে আবদ্ধ রাখা যাবে না। আজও তিনি সমসাময়িক। আজও যখন উগ্র-ধর্মান্ধগোষ্ঠী গুজব ছড়িয়ে রামুর বৌদ্ধবিহারে হামলা চালায়, অগ্নিসংযোগ করে, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর, নড়াইলের হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘর ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগ করে, মন্দিরে কোরান রাখার মিথ্যে অভিযোগে প্রতিমা ভাঙচুর করে, তখনও নজরুল সাহিত্য আমাদের পথ দেখায়, সাহসী করে তোলে, প্রেরণা যোগায়। একইভাবে সাহস জোগায় যখন ভারতের গুজরাট, কাশ্মীর সহ বিভিন্ন এলাকায় মুসলিম ও খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের উপর নির্বিচারে হামলা চলে বা পাকিস্তানের উগ্রবাদী গোষ্ঠী যখন একের পর এক সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপাসনালয় ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণ ও নির্যাতন চালায় তখন। এভাবেই তিনি যুগ-যুগান্তর ধরে আমাদের পথ দেখাবেন, সাহস জোগাবেন এবং যুগে যুগে কালে কালে তিনি মানুষের জ্ঞাতি হয়েই রইবেন। আমরা যদি আমাদের প্রয়োজনেই তাঁকে অন্তরে ধারণ করতে পারি, তাহলে সাম্রাজ্যবাদ, সাম্প্রদায়িকতা, কায়েমি স্বার্থবাদিতা তথা যে-কোনো ধরনের অশুভ শক্তি আমাদের মাঝে আসন গাড়তে পারবে না। চারদিকে শ্বাপদকুল যে বিষ ছড়াচ্ছে, তা প্রতিহত করা সহজ হবে। দানবের সঙ্গে সংগ্রাম করার জন্য প্রতি ঘরে জন্ম নেবে দুর্বার-দুর্জেয় তারুণ্য।
সূত্রঃ
১) আব্দুল কাদির সম্পাদিত নজরুল রচনাবলী, চতুর্থ খণ্ড, নতুন সংস্করণ, ১৯৯৬, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, অভিভাষণ; পৃষ্ঠা-৯১।
২) প্রাগুক্ত, অভিভাষণ; পৃষ্ঠা-১২৭।
৩) প্রাগুক্ত, অভিভাষণ।
লেখকঃ বাংলাদেশের বৃহত্তর প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক সংগঠন 'উদীচী'র কেন্দ্রীয় সংসদের সাধারণ সম্পাদক।