E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৮ বর্ষ ৮ম সংখ্যা / ২ অক্টোবর ২০২০ / ১৫ আশ্বিন ১৪২৭

বিচারের নামে প্রহসন

বাবরি ধ্বংস মামলায় কারও সাজা হলো না


নিজস্ব সংবাদদাতাঃ বাবরি মস‍‌জিদ ধ্বংসের মামলায় অভিযুক্ত ৩২জনকেই বেকসুর খালাস করে দিয়েছে লক্ষ্ণৌয়ের সিবিআই-র বিশেষ আদালত। ৩০ সেপ্টেম্বর এই রায় ঘোষণা করতে গিয়ে বিচারপতি এস কে যাদব বলেছেন, অভিযুক্ত কারও বিরুদ্ধেই নাকি প্রমাণ মেলেনি, এমনকি ষড়যন্ত্র বা পরিকল্পনা হয়েছিল বলেও নাকি প্রমাণ পাওয়া যায়নি। ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর ‘কতিপয় দুষ্কৃতী’ বাবরি মসজিদের গম্বুজে উঠেছিল, শুধু এইটুকুই তিনি দেখতে পেয়েছেন!

কেন্দ্রে নরেন্দ্র মোদী নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকার এবং উত্তরপ্রদেশে চলছে যোগী আদিত্যনাথের বিজেপি শাসন। কেন্দ্র ও রাজ্যে চরম হিন্দুত্ববাদী শাসনে যে বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদবে - এটা এখন দস্তুর। সিবিআই-র আদালতের এই রায়কে বিচারব্যবস্থার প্রহসন বলে অ্যাখ্যা দি‍য়েছে সিপিআই(এম)। পার্টির পলিট ব্যুরোর এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আ‍‌‍বেদন করা উচিত সিবিআই-র। পলিট ব্যুরো বলেছে বিশেষ সিবিআই আদালতের এই রায় বিচারব্যবস্থার প্রহসন হয়ে দাঁড়িয়েছে। রায় ঘোষণা করতে আঠাশ বছর লাগলো, অথচ বিচার মিললো না। ঘটনাস্থলে বিজেপি-আরএসএস-র শীর্ষ নেতারা ছিলেন, অপরাধ সংঘটিত করার নির্দেশ দিয়েছিলেন, তাঁদেরই নির্দোষ ঘোষণা করা হয়েছে।

পলিট ব্যুরো বলেছে, ৮ নভেম্বরের রায়ে সুপ্রিম কোর্ট বলেছিল, বাবরি মসজিদ ধ্বংস আইন লঙ্ঘনের ভয়ঙ্কর ঘটনা। অথচ লক্ষ্ণৌয়ের আদালত জানালো অপরাধের মূল চক্রীরা কেউ দোষী নয়। এই রায়ে ভারতের সংবিধানসম্মত ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ভাবমূর্তিতে আঁচড় পড়েছে।

সিপিআই(এম)-র সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি এই রায়ের প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, মসজিদ ধ্বংসে অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রে দোষীদের নির্দোষ ঘোষণা করা হয়েছে। প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন সাংবিধানিক বেঞ্চ কিন্তু ঘটনাটিকে গুরুতর আইন লঙ্ঘন হিসাবে চিহ্নিত করেছিল। এই রায় লজ্জাজনক। সিপিআই’র সাধারণ সম্পাদক ডি রাজা এই রায়ে গভীর উদ্বেগপ্রকাশ করেছেন। তিনি বলেছেন, রথযাত্রা করে দেশজুড়ে প্রচার হয়েছিল, জড়ো করা হয়েছিল করসেবকদের। স্পষ্ট ষড়যন্ত্র হয়েছিল বাবরি মসজিদ ভাঙার।

সিপিআই(এমএল) লিবারেশন-এর সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্য এই রায়কে ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানে আরেকটি জোরালো আঘাত বলে বর্ণনা করেছেন।

কংগ্রেস দল প্রতিক্রিয়ায় জানিয়েছে, সুপ্রিম কোর্টের রায়ে উলটো বিচার হয়েছে সিবিআই আদালতে। দলের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, সুপ্রিম কোর্টের রায়ে বাবরি মসজিদ ধ্বংস গুরুতর অপরাধ বলেই বর্ণনা করা হয়েছিল। বিশেষ সিবিআই আদালত সেই অপরাধীদেরই নির্দোষ বলেছে।

তামিলনাড়ুর প্রধান বিরোধীদল ডিএমকে বিচার প্রক্রিয়ায় সিবিআই’র ভূমিকা নিয়েই প্রশ্ন তুলেছে। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি ছাড়াও সিবিআই আদালতের এই রায়ে সমাজের বিভিন্ন মহল থেকেও প্রশ্ন উঠেছে।

প্রসঙ্গত, ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ঘটনার পর লিবেরহান কমিশন গঠিত হয়েছিল। স্থানীয় আদালত থেকে এই মামলা গড়িয়েছে হাইকোর্ট পর্যন্ত। বাবরি মসজিদ ধ্বংসের মামলা ২০১৭-র আগে পর্যন্ত লক্ষ্ণৌয়ের রায়বেরিলিতে দু’টি পৃথক আদালতে চলছিল। ২০০১ সালে কেন্দ্রে বিজেপি সরকার থাকার সময়ে মামলা থেকে ফৌজদারি ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তুলে নিয়েছিল সিবিআই। সুপ্রিম কোর্ট হস্তক্ষেপ করে ২০১৭-র এপ্রিলে এই ধারা পুনরায় যুক্ত করার নির্দেশ দেয়। দু’বছরের মধ্যে বিচারের প্রক্রিয়া শেষ করার নির্দেশও দিয়েছিল শীর্ষ আদালত। কালক্ষেপ চলতে থাকায় এবছরের ৩১ আগস্টের মধ্যে মামলা শেষ করার নির্দেশ দেওয়া হয়। সেই অনুযায়ী ৩০ সেপ্টেম্বর রায় ঘোষণা করা হয়।

এই মামলায় অভিযুক্তদের মধ্যে ছিলেন লালকৃষ্ণ আদবানি, মুরলীমনোহর যোশী, কল্যাণ সিং, উমা ভারতী, বিনয় কাটিয়ার প্রমুখ ৪৮ জন। এঁদের মধ্যে ১৬ জন প্রয়াত হওয়ায় ৩২ জন ছিলেন তালিকায়। তাদের মধ্যে ২৬ জন উপস্থিত ছিলেন আদালতে।

বিচারপতি এস কে যাদবের এটিই ছিল শেষ রায়। গতবছরের ৩০ সেপ্টেম্বর তাঁর অবসর নেওয়ার কথা থাকলেও, এই মামলার জন্য তা একবছর বাড়িয়ে দেওয়া হয়। এদিন ২৬০০ পৃষ্ঠার রায়ে বিচারপতি শুধু বিজেপি নেতাদের অভিযাগমুক্তই করেননি, আরএসএস এবং বিশ্ব হিন্দু পরিষদের নাম করে তিনি জানিয়েছেন, তারা এই ঘটনায় যুক্ত ছিল না। তিরি আরও জানিয়েছেন, সিবিআই যে ভিডিয়ো হাজির করেছে, তার সত্যতা প্রমাণ করা যাচ্ছে না। ভিডিয়ো অস্পষ্ট। অভিযোগ ঠিকমতো শোনা যাচ্ছেনা। ভাষণও ঠিকমতো শোনা যাচ্ছে না। সুতরাং এসবের ওপর ভরসা করা যাচ্ছে না। সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনও গ্রাহ্য করেননি বিচারপতি।

এদিন এই রায়ের পরেই প্রশ্ন উঠেছে, বাবরি মসজিদ কারা ভাঙলো? বিরোধী নেতা সহ অনেকেরই কটাক্ষ - মসজিদ কি নিজেই ভেঙে পড়লো? সুপ্রিম কোর্টের মতে যা ‘মারাত্মক অপরাধ’ - তার জন্য কেউ দোষীসাব্যস্ত হলো না কেন - এই প্রশ্নই এখন ঘুরে-ফিরে আসছে। এদিন সিবিআই’র বিশেষ আদালতের এই রায়ের প্রতিক্রিয়ায় কলকাতায় এক সাংবাদিক সম্মেলনে সিপিআই(এম) পলিট ব্যুরো সদস্য মহম্মদ সেলিম বলেছেন, ক্ষমতাসীনদের তুষ্ট করে যেভাবে অপরাধীদের রেহাই দেওয়া হলো, তাতে আদালত ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলির ওপর থেকে দেশবাসীর ভরসা নষ্ট করে দেওয়া হচ্ছে। আইনের শাসন ধবংস করা হচ্ছে। তিনি বলেছেন, আমরা আদৌ তাজ্জব হইনি, কারণ দেশের সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে ক্ষমতাশালীরা কুক্ষিগত করে এই দিকেই নিয়ে যাচ্ছে। সংবিধানের নির্দেশিত দৃষ্টিভঙ্গি নয়, সংকীর্ণ রাজ‍‌নৈতিক ও ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি‍তে ঘোলাটে করে দেওয়া হচ্ছে প্রতিষ্ঠানগুলির দৃষ্টিকে। সেই কারণেই সুপ্রিম কোর্ট ৮ নভেম্বর বাবরি মসজিদ ভাঙার ঘটনাকে গুরুতর অপরাধ বলে চিহ্নিত করার পরেও লক্ষ্ণৌয়ের নিম্ন আদালত অপরাধীদের খুঁ‍জেই পেলো না। আমরা দাবি করছি, সিবিআই লক্ষ্ণৌ আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্ট অথবা সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করুক। অপরাধীদের শাস্তিদানে কেন্দ্রীয় সরকার কতটা সৎ, বোঝা যাবে।

মসজিদ ধ্বংসে অভিযুক্তদের স্পষ্ট ভূমিকা থাকলেও, যেভাবে তাদের রেহাই দেওয়া হয়েছে তাতে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় নিযুক্ত আদালত ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলির ওপর দেশবাসীর ভরসা নষ্ট হয়ে যাবে বলে মন্তব্য করে মহম্মদ সেলিম ব‍‌লেছেন, যা হলো তা ন্যায় বিচারের নামে প্রহসন।