৫৮ বর্ষ ৮ম সংখ্যা / ২ অক্টোবর ২০২০ / ১৫ আশ্বিন ১৪২৭
উত্তরপ্রদেশে ধর্ষিতা দলিত কন্যার মৃত্যু
প্রতিবাদ বিক্ষোভ দেশজুড়ে
নিজস্ব সংবাদদাতাঃ যোগী আদিত্যনাথের নেতৃত্বে বিজেপি সরকারের শাসনে নারী নির্যাতনের ঘটনা এবং তার প্রতি উদাসীনতার ধারাবাহিকতায় কোনো ছেদ পড়ছে না উত্তরপ্রদেশে। ২৯ সেপ্টেম্বর হাথরস জেলার এক নির্যাতিতা দলিত তরুণীর মৃত্যুতে আরও একবার বিষয়টি সামনে এলো। নৃশংস অত্যাচারের শিকার ধর্ষিতা ওই তরুণীর মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়তেই সফদরজঙ্গ হাসপাতাল চত্বর সহ দিল্লির বিভিন্ন জায়গা এবং উত্তর প্রদেশের সর্বত্র প্রবল বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। ক্ষোভে ফেটে পড়ে দেশ। প্রসঙ্গত, পুলিশকে দেওয়া জবানবন্দীতে ধর্ষিতা ধর্ষণের অভিযোগ করলেও নির্লজ্জ বিজেপি সরকার ধর্ষণ এবং অত্যাচারের কথাই অস্বীকার করতে চাইছে। হাথরস এবং আলিগড় - দুই জেলার পুলিশ সুপারকে দিয়ে যোগী প্রশাসন বলিয়েছে, ধর্ষণের কোনও চিহ্ন পাওয়া যায়নি। তরুণীর জিভ কেটে নেওয়া এবং শিরদাঁড়া ভেঙে দেওয়ার অভিযোগ মিথ্যা। এই দলিত কন্যার দলবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনার তীব্র নিন্দা করেছে সারা ভারত গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতি (এআইডিডব্লুএ)। এক বিবৃতিতে দলবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনাটিকে বর্বরোচিত বলে অভিহিত করে দোষীদের উপযুক্ত শাস্তি দাবি করা হয়েছে এআইডিডব্লুএ’র পক্ষ থেকে। উত্তরপ্রদেশে বারবার এই ধরনের ঘটনা ঘটার প্রেক্ষিতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে দেশজুড়ে অন্যান্য মহিলা সংগঠনগুলির সঙ্গে যৌথভাবে প্রতিবাদ কর্মসূচি সংগঠিত করার ডাক দিয়েছে এআইডিডব্লুএ।
গত ১৪ সেপ্টেম্বর উত্তর প্রদেশের হাথরস জেলায় নিজের গ্রামেই ভয়াবহ নির্যাতনের শিকার হন ১৯ বছরের ওই দলিত তরুণী। তারপরেই অভিযোগ ওঠে, ধর্ষণে অভিযুক্ত সন্দীপ, রামু, লবকুশ এবং রবি চারজনই তথাকথিত উঁচু জাতির হওয়ায় উঁচুজাতির হওয়ার কারণেই পুলিশ ব্যবস্থা নিতে চাইছে না এবং তরুণীর চিকিৎসারও যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। দেশজোড়া উদ্বেগের মধ্যেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২৯ সেপ্টেম্বর ভোররাতে মৃত্যু হয় দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার ওই দলিত তরুণীর।
এর আগে পুলিশকে দেওয়া জবানবন্দিতে তিনি জানিয়েছেন, মা এবং ভাইয়ের সঙ্গে জমিতে ঘাস কাটছিলেন তিনি। তখনই তাকে ওড়না গলায় পেঁচিয়ে টেনে নিয়ে যায় দুষ্কৃতীরা। পরপর ধর্ষণের পর শ্বাসরোধ করে হত্যার চেষ্টাও করে। বাধা দেওয়ায় তরুণীর জিভ কেটে নেয় দুর্বৃত্তরা। নির্যাতনের ঘটনার পরে আলিগড়ের জওহরলাল নেহরু মেডিক্যাল কলেজে তিনি চিকিৎসাধীন ছিলেন। অবস্থার ক্রমশ অবনতি হচ্ছিল। হাত, পা পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে অসাড় হয়ে পড়েছিল। অভিযোগ, ইচ্ছাকৃত দেরি করে ২৮ সেপ্টেম্বর তাঁকে পাঠানো হয় দিল্লির সফদরজঙ্গ হাসপাতালে।
সারা ভারত গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতি ওই বিবৃতিতে ঘটনার তীব্র নিন্দা করে বলেছে, ধর্ষণের জেরেই ওই তরুণীর মৃত্যু হয়েছে। গুরুতর আহত অবস্থায় থাকা প্রশাসনের উচিত ছিল ওই তরুণীকে উপযুক্ত চিকিৎসার জন্য দ্রুত অন্যত্র স্থানান্তরিত করা। কিন্তু প্রশাসন ধর্ষিতার বাবার অনুরোধে উপযুক্ত চিকিৎসার জন্য অনেক পরে দিল্লিতে স্থানান্তরিত করে। বিবৃতিতে আরও অভিযোগ করা হয়েছে, পুলিশ ধর্ষণের চার-পাঁচদিন পরেও অভিযোগ নথিভুক্ত করে নি। বলা হয়েছে, উত্তরপ্রদেশে যেভাবে অপহরণ ধর্ষণ এবং খুনের ঘটনা ঘটে চলেছে তা কার্যত জঙ্গল রাজ। সেখানে অপরাধীরা রাজনৈতিক প্রশ্রয় পুষ্ট। উন্নাওয়ের ধর্ষণের ঘটনার পর প্রশাসনিক গাফিলতির দিকে ইঙ্গিত করে বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ওই ঘটনায় অভিযুক্ত আইপিএস এবং আইএএস আধিকারিকদের কর্তব্যে গাফিলতি এবং ত্রুটির জন্য শাস্তি দেওয়া উচিত ছিল। তা হলে পরিস্থিতির এতো অবনতি হতো না। তা না হওয়ায় ওই ঘটনার পরেই পরোক্ষে বার্তা যায় যে মহিলাদের বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধকে গুরুত্ব দেবার দরকার নেই। এই প্রেক্ষিতে অবিলম্বে ধর্ষিতার পরিবারের উপযুক্ত সুরক্ষা এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে বিবৃতিতে।
ঘটনার সাফাই গাইতে গিয়ে আলিগড়ের পুলিশের আই জি পীযূষ মোরদিয়া বলেছেন, মেডিক্যাল পরীক্ষায় ধর্ষণ সংক্রান্ত কিছু পাওয়া যায়নি। আমরা ফরেনসিক তদন্তের রিপোর্ট চেয়েছি। ...দ্রুত রিপোর্ট পেয়ে যাব। এদিকে দেশজুড়ে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ার পরে হাথরসের পুলিশ সুপার বিক্রান্ত বীর জানিয়েছেন, ধর্ষিতার জিভ কেটে নেওয়ার কথা মিথ্যা। শ্বাসরোধ করে হত্যার চেষ্টা করায় তিনি নিজেই নিজের জিভ কামড়ে কেটে ফেলেছেন। আমরা নির্যাতিতার বয়ান নথিভুক্ত করেছি। তার শিরদাঁড়া ভাঙার কথাও মিথ্যা। তাঁর ঘাড়ে আঘাত লেগেছে কারণ তাকে ফাঁস দিয়ে হত্যার চেষ্টা হয়েছিল। অর্থাৎ এতো কিছুর পরেও বিজেপি সরকারের পুলিশ ধর্ষণ নয়, ঘটনাটিকে শুধুই হত্যার চেষ্টা প্রমাণে ব্যস্ত।
বিজেপি’র সরকার হওয়ার পরে মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ ঘোষণা করেছিলেন, অপরাধীদের প্রশ্নে তার সরকার ‘জিরো টলারেন্স’ দেখাবে। কিন্তু এইসব বাগড়ম্বরকে উড়িয়ে উত্তর প্রদেশে মহিলাদের উপর বর্বরতা সমস্ত নজির ভেঙেছে। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর হিসাব অনুযায়ী, উত্তর প্রদেশে ২০১৬ সালের তুলনায় ২০১৯ সালে মহিলাদের বিরুদ্ধে অত্যাচারের ঘটনা ২০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। আগের অখিলেশ সরকারের সময়ে মহিলাদের উপর অত্যাচারের ঘটনা ভোটপ্রচারে এনে বেশি সরব ছিলেন যোগী এবং মোদীরা। ওয়াকিবহাল সমাজতাত্বিকদের পর্যালোচনা, হিন্দুত্ব এবং উঁচুজাতির শ্রেষ্ঠত্বের বাগাড়ম্বর এবং প্রকাশ্যে তার চর্চা করা মুখ্যমন্ত্রীর রাজত্বে মহিলা, দলিত, আদিবাসী এবং সংখ্যালঘুরা সবথেকে সঙ্কটজনক অবস্থায় এবং আতঙ্কে রয়েছেন।
এদিন মৃত্যুর পরেই নির্যাতিতার পরিবার হাসপাতালেই ধরনায় বসে পড়ে। ভীম আর্মি নেতা চন্দ্রশেখর আজাদ সমর্থকদের নিয়ে সফরদরজঙ্গ হাসপাতালের সামনে বিক্ষোভ দেখান। যোগী সরকারকে আক্রমণ করে তিনি বলেন, এই মৃত্যুর জন্য রাজ্যের বিজেপি সরকারও সমানভাবে দায়ী। দিল্লির বিজয় চকে বিক্ষোভ দেখায় কংগ্রেস। রাতের দিকে সফদরজঙ হাসপাতালের সামনে প্রতিবাদ ক্রমশ বাড়তে থাকে। বহু মানুষ সমবেত হন। কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী এবং প্রিয়াঙ্কা গান্ধী ব্যাপক আক্রমণ করেন কেন্দ্র ও রাজ্যের বিজেপি সরকারকে। বিএসপি নেত্রী মায়াবতী, সমাজবাদী পার্টিনেতা অখিলেশ যাদব এই ঘটনার নিন্দা করে বিবৃতি দিয়েছেন।
দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার দলিত তরুণীর মৃত্যুর খবর আসতেই সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রতিবাদে মুখর হন বিভিন্ন বর্গের মানুষ। প্রশ্ন ওঠে, কেন প্রধানমন্ত্রী এই বিষয়ে চুপ করে রয়েছেন। যখন ভারতীয় ক্রিকেট দলের অধিনায়ক বিরাট কোহলি থেকে স্বরা ভাস্কর সহ অন্যান্য শিল্পী ও বিশিষ্টরা প্রতিবাদে সরব হয়েছেন। অভিনেতা ফারহান আখতার, অক্ষয় কুমার, রিচা চাড্ডা, ইয়ামি গৌতম প্রমুখ এই ঘটনায় তীব্র ক্ষোভ জানিয়ে অপরাধীদের শাস্তি দাবি করেছেন।