৫৮ বর্ষ ৮ম সংখ্যা / ২ অক্টোবর ২০২০ / ১৫ আশ্বিন ১৪২৭
নতুন কৃষি আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ মুখর দেশ
উলুবেড়িয়ায় জাতীয় সড়ক অবরোধ কৃষকদের।
নিজস্ব সংবাদদাতাঃ কেন্দ্রের নতুন কৃষি আইনের বিরুদ্ধে দেশজুড়ে প্রতিবাদ বিক্ষোভ আন্দোলন তীব্র হয়ে উঠেছে। সংসদে বিরোধীদের মতামতকে অগ্রাহ্য করে গায়ের জোরে ফারমার্স প্রোডিউস ট্রেড অ্যান্ড কমার্স (প্রোমোশন অ্যান্ড ফেলিসিটেশন) বিল ২০২০, ফারমার্স (এমপাওয়ারমেন্ট অ্যান্ড প্রোটেকশন) এগ্রিমেন্ট অন প্রাইস অ্যাসুরেন্স অ্যান্ড ফার্ম সার্ভিসেস বিল ২০২০ এবং এসেনসিয়াল কমোডিটিস (সংশোধনী) বিল পাশ করায় মোদী সরকার। কৃষি ও কৃষক বিরোধী এই তিনটি বিলের বিরুদ্ধে দেশজুড়ে প্রতিবাদের মধ্যেই ২৭ সেপ্টেম্বর তিনটি বিলে সম্মতি জানিয়ে স্বাক্ষর করেছেন রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ। এদিকে এই বিলের প্রতিবাদ জানিয়ে আগেই মোদী সরকারের মন্ত্রীসভা থেকে পদত্যাগ করেছেন আকালি দলের হরসিমরাত কাউর বাদল। এছাড়া এই বিলের প্রতিবাদ জানিয়ে কেন্দ্রের এনডিএ জোট ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে শরিক শিরোমণি আকালি দল। তারা এখন বিরোধীদের সঙ্গে রাজপথে আন্দোলনে শামিল হয়েছে।
এদিকে কেন্দ্রের কৃষক বিরোধী তিন আইনের বিরুদ্ধে সর্বভারতীয়স্তরেও আন্দোলনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সারা ভারত কৃষক সংঘর্ষ সমিতি।
কৃষকদের মিছিল চন্দ্রকোনায়।
এই তিনটি বিলে কর্পোরেটদের জন্য কৃষিপণ্যের বাজার খুলে দেওয়া হয়েছে। কৃষিপণ্যের ব্যবসা-বাণিজ্য আইন সংশোধন করা হয়েছে। এতে সরকারিভাবে ফসল কেনার যে পরিকাঠামো তা তুলে দেবার ব্যবস্থা হয়েছে। আরেকটি বিলে ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য ঘোষণার আইনি ব্যবস্থাকে তুলে দেওয়া হয়েছে। খাদ্যপণ্য মজুত করার ক্ষেত্রে নিত্যপ্রয়োজনীয় আইনে যে বিধিনিষেধ ছিল তা বিলোপ করা হয়েছে। এর ফলে কৃষিপণ্যে কালোবাজারি অবাধ করে দেওয়া হয়েছে।
এদিকে ১৮টি বিরোধী দল রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করে এই বিল যে অগণতান্ত্রিকভাবে পাশ করানো হয়েছিল, তা জানিয়ে দেয়। এই উদ্যোগ সংবিধান বিরোধী বলে উল্লেখ করে এই বিল তিনটিতে স্বাক্ষর না করার জন্য রাষ্ট্রপতিকে আবেদন জানায়। কিন্তু রাষ্ট্রপতির তরফে এই আবেদনে কোনো আমলই দেওয়া হয়নি। তবুও বিরোধীরা এর বিরুদ্ধে সর্বাত্মক লড়াই চালিয়ে যাবার সংকল্প ঘোষণা করেছেন।
২৭ সেপ্টেম্বর রাতে রাষ্ট্রপতি তিনটি কৃষি বিলে স্বাক্ষর করায় তা আইনে পরিণত হয়ে যাওয়ার পর দিন ২৮ সেপ্টেম্বর সকালে নয়াদিল্লির ইন্ডিয়া গেটের সামনে প্রতিবাদকারীরা একটি ট্রাক্টর পুড়িয়ে দেয়। কৃষি আইনের বিরুদ্ধে স্লোগানের সঙ্গে সঙ্গে ওই ট্রাক্টরে প্রতীক হিসাবে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। এই ঘটনায় পাঞ্জাবের পাঁচজন কংগ্রেস কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়। পাঞ্জাবের যুব কংগ্রেস সভাপতি এই ঘটনার দায়িত্ব স্বীকার করে বলেছেন, প্রতীকী প্রতিবাদ করা হয়েছে। পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী অমরিন্দার সিং এই প্রতিবাদকে সমর্থন করে বলেছেন, মানুষের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। তিনি নিজেও ২৮ সেপ্টেম্বর শহিদ ভগৎ সিংয়ের পিতৃপুরুষের গ্রাম খটকার কানালে কৃষকদের ধরনা, অবস্থানে যোগ দেন।
এদিকে ২৮ সেপ্টেম্বর কর্ণাটকে কৃষক সংগঠনগুলির ডাকে বনধে ভালো সাড়া পড়ে। রাজ্যের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে জীবনযাত্রা ব্যাহত হয়। পাঞ্জাবে রেল ও সড়ক অবরোধ, ধরনা-বিক্ষোভ অব্যাহত রয়েছে। পাঞ্জাবের কৃষকরা তাঁদের আন্দোলনের মাত্রাকে আরও তীব্র করতে কর্পোরেট কৃষি বাণিজ্যের প্রকল্পগুলি অবরোধ-ঘেরাও শুরু করেছেন। মোগায় ডাগরু গ্রামে আদানি এগ্রি লজিস্টিক গ্রুপের সিলো বা গুদাম ঘেরাও করে। কৃষক সংগঠনগুলি ঠিক করেছে, আদানি, ওয়ালমার্ট, মেট্রোর গুদাম ও দোকান ঘেরাও করবে। এছাড়াও তারা বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা পরিচালিত টোল প্লাজা ও বিদ্যুৎ সংস্থাও ঘেরাওয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ১ অক্টোবর থেকে ৩১টি সংগঠনের ডাকে পাঞ্জাবে সমস্ত জায়গায় রেল অবরোধ হবে।
জলন্ধর স্টেশনে রেল অবরোধ কৃষকদের।
২৮ সেপ্টেম্বর সকালে আহমেদাবাদে বিধানসভা ভবনের সামনে কংগ্রেস কর্মীরা প্রতিবাদ জানান, কৃষি আইনের বিরুদ্ধে স্লোগান দেন। কংগ্রেস সভাপতিসহ শতাধিক কংগ্রেস কর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। লক্ষ্ণৌয়ে বিধানসভা ভবনের সামনে কংগ্রেসসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল প্রতিবাদ বিক্ষোভ জানায়। হরিয়ানায় চণ্ডীগড়ে কংগ্রেসের বিক্ষোভ হয় ও বিধানসভা অভিযানে পুলিশ বাধা দেয়।
২৮ সেপ্টেম্বর পাঞ্জাবসহ বিভিন্ন রাজ্যে প্রতিবাদকারীরা শহিদ ভগৎ সিং-এর জন্মদিনে মোদী সরকারের কৃষক বিরোধী আইন বাতিলের দাবিতে প্রতিবাদ আন্দোলন তীব্র করার ডাক দেন। এদিন পাঞ্জাবের খটকার কানালে জন্মদিন পালনের অনুষ্ঠানে পাঞ্জাবের কংগ্রেস সরকারের মুখ্যমন্ত্রী অমরিন্দর সিং বলেছেন, তিন কৃষি আইনের প্রয়োগ ঠেকাতে যা কিছু করবে সরকার। এ বিষয়ে আইনি পথে এগোবেন বলে জানিয়েছে মুখ্যমন্ত্রী। এদিন এই চুক্তিচাষ অবাধ করার আইনটিকে অসাংবিধানিক আখ্যা দিয়ে সুপ্রিম কোর্টে বাতিলের আরজি জানিয়েছেন কংগ্রেসের এক সাংসদ।
তামিলনাডুতে কৃষি আইনের বিরোধিতায় পথে নেমেছে বিরোধীরা। ডিএমকে দল এই আইনের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে যাবার হুঁশিয়ারি দিয়েছে। ডিএমকে প্রধান স্ট্যালিন বলেছেন, এই আইনে শেষ পর্যন্ত জমিও হারাতে হবে কৃষকদের। পাশের রাজ্য কেরালার বাম গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট সরকার এই আইনের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে যাবার কথা বলেছে। তাহলে তামিলনাডু সরকার কেন যাবে না। এই তিনটি কৃষি আইনের বিরুদ্ধে চেন্নাই, কোয়েম্বাটোর, মাদুরাই, তিরুচিরাপল্লি সহ রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় বিক্ষোভ হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায়ও প্রতিবাদ বিক্ষোভ সংগঠিত হয়েছে।