E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৮ বর্ষ ৮ম সংখ্যা / ২ অক্টোবর ২০২০ / ১৫ আশ্বিন ১৪২৭

কৃষি বিলের কয়েকটি প্রসঙ্গে সরকার ও কৃষকের উদ্বেগ

বিশ্বম্ভর মণ্ডল


২০২০ সালের জুন মাসে কোভিড-১৯ ও তদ্‌জনিত লকডাউনের মতো বিরক্তিকর, উদ্বেগ, আতঙ্কে-ভরা সময়ে সরকার কৃষিক্ষেত্রে সংস্কারের উদ্দেশে তিনটি অধ্যাদেশ (অর্ডিন্যান্স) জারি করে। অধ্যাদেশকে আইনের চেহারা দিতে সরকার প্রথমে লোকসভায় পরে রাজ্যসভায় বিল পেশ ও পাশ করে তা রাষ্ট্রপতির সই হয়ে আইনে পরিণত হয়েছে। লোকসভা, রাজ্যসভাতে কি হয়েছে মানুষ দেখেছেন বা শুনেছেন বা পড়েছেন। যদিও সাধারণ সময়েই দেশের অনেকেরই খোঁজ রাখা সম্ভব হয় না, আইনসভায় তার কি সর্বনাশের বা আদরযত্নের ব্যবস্থা করে দেয় সরকার। আর অতিমারীর সময়ে কয়েক মাসের লকডাউনের মধ্যে নিশ্চয়ই তার ব্যতিক্রম হবার সম্ভাবনা খুবই কম। কারণ জেগে থাকলেই পেটের জ্বালায় ছুটতে হয় তাদের। তাদের কারুর সেই সময় থাকে না, কারুর সুযোগ থাকে না বা কারুর ইচ্ছেটাই থাকে না অথবা কারুর কারুর সময়-সুযোগ-ইচ্ছে কোনোটাই থাকে না। যে কোনো পরিবর্তনের সময়ে মানুষ যা যা শুনলে পছন্দ করবেন সব কিছু না হলেও সাদা চোখে অধিকাংশ খুঁজে পাবার সম্ভাবনা রয়েছে নিচের কৃষি সংক্রান্ত আইনের সম্পর্কে সরকারের দাবিগুলির মধ্যে। বাস্তবে বিশ্লেষণী চোখে খোলামনের বিশ্লেষণটাই প্রকৃত সত্যের কাছে পৌঁছাতে সাহায্য করে। সেটা মাথায় রেখেই কৃষিবিলের কয়েকটি প্রসঙ্গে সংক্ষিপ্ত পরিসরে সরকারি মত ও বিপরীত মত উল্লেখ ও আলোচনা করা হলো।

কৃষি আইন সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী বলেছেনঃ “ভারতীয় কৃষির ইতিহাসে মোড়ঘোরানো অধ্যায়”, “কৃষি, কৃষক এবং গ্রামই আত্মনির্ভর ভারতের ভিত”, কৃষকদের “মনোবলের উপর ভর করেই দেশ শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে”, “দেশের কৃষকরা স্বাধীনতা পেয়েছেন। তাঁরা এখন যেখানে ইচ্ছা সেখানেই ফসল বিক্রি করতে পারবেন”, “দেশের কৃষকদের আয় বাড়বে” ইত্যাদি ইত্যাদি। এছাড়াও সরকারের নানা মুখে যে সব বাণী প্রচারিত হয়েছে সচেতনতা নিয়ে খেয়াল না করলে তাও যথেষ্ট সুখানুভূতি জোগাতে পারে। যেমন - (১) কৃষকদের সার্বিক বিকাশ হবে, (২) মধ্যস্থতাকারীদের দাপট কমবে, (৩) কৃষকরা সরাসরি বিক্রির সুযোগ পাবে, (৪) ন্যূনতম সহায়ক মূল্য বাতিল হচ্ছে না, (৫) কৃষকদের দরকষাকষি করার ক্ষমতা বেড়ে যাবে, (৬) কৃষিক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন ঘটবে, (৭) কৃষকদের ক্ষমতায়ন ঘটাবে, (৮)কৃষকদের আয় দ্বিগুণ হবে, কারণ দালাল চক্রের হাতে বন্দি কৃষকসমাজ মুক্তি পাবে, (৯) অত্যাধুনিক প্রযুক্তি কৃষকদের কাছে সহজলভ্য হয়ে উঠবে, (১০) কৃষিতে বেসরকারি লগ্নি আসবে, (১১) কৃষিতে পরিকাঠামো তৈরি হবে, (১২) কর্মসংস্থান তৈরি হবে।

বর্তমানে যারা ফড়েদের ভূমিকা গ্রহণ করে তাদেরকে সামলাতে গিয়ে কৃষকরা হিমসিম খাচ্ছেন, ন্যায্যমূল্যের ছিটেফোঁটা পাচ্ছেন; তাহলে বর্তমানের ফড়েদের সরিয়ে যারা আগামীতে ফড়ের ভূমিকা গ্রহণ করতে আসছে তারাতো আরও শক্তিশালী কর্পোরেট হাঙর। এদের মুখের সামনে কৃষকদের ঠেলে দিয়ে আর যাই হোক “দালাল চক্রের হাতে বন্দি কৃষকসমাজ মুক্তি পাবে”, বা “কৃষকদের ক্ষমতায়ন ঘটবে’’ বা “কৃষকদের দরকষাকষি করার ক্ষমতা বেড়ে যাবে” বা “মধ্যস্থতাকারীদের দাপট কমবে” এমন কোনো ঘটনাই ঘটবে না—এসত্য নাবালকেও বোঝে। সর্বস্বান্ত হবে কৃষক। কারণ তারা তাদের ফসলের যথাযথ দাম পাবেন না। কারণ অধিকাংশ কৃষকের শস্য হিমঘরে মজুত রাখার ক্ষমতা নেই। মাল নিয়ে বিক্রির জন্য পৌঁছে যাবার পরে দরদাম না পোষালে সেটা বাড়ি ফিরিয়ে আনার ক্ষমতা তাদের নেই। ফলে কৃষকদেরকে বেকায়দায় ফেলে ফড়েরা যেমন অল্প দামে এখনো কেনে, আগামীতেও কিনবে। “বিশ্বায়ন” যুগের অভিজ্ঞতা ও শিক্ষা থেকে এটাই বারবার উপলব্ধিতে আসছে যে, বর্তমানের আইনের সুযোগে নতুন যে ফড়েরা চাষিদের মালপত্র কিনবে তাদের ঠকানোর কায়দাকানুন অনেকবেশি চতুর ও আক্রমণাত্মক হবে।

সরকারের নানা ধরনের বিবৃতিতে বলা হয়েছে যে, ন্যূনতম সহায়ক মূল্য নিয়ে চিন্তার কিছু নেই। ওগুলো তো তো আছেই। এই বিষয়ে পাল্টা মত যেটা উঠে এসেছে তা হলো বিলে ন্যূনতম সহায়ক মূল্য নিয়ে একটি শব্দ নেই কেন তাহলে? কিছু লিখতে বারণ ছিল বুঝি! অতীত অভিজ্ঞতা থেকে মানুষ দেখেছে, বারবার গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে এই সরকার নীরব থেকে নিজের অ্যাজেন্ডাকে এগিয়ে নিয়ে যাবার অন্যতম একটা কৌশল হিসাবে ব্যবহার করে (যেটা আন্দোলন থিতিয়ে গেলে বা অন্য একটা ইস্যুতে মানুষের মগজটা ব্যস্ত হয়ে পড়লে ঝোলা থেকে বেড়াল বের হয়)। পাশাপাশি, ১৯৯০-৯১ সালের পর থেকে সংস্কারের গৌরবগাথা, বাস্তব প্রয়োগ ও তার ফলাফল দেখে দেখে “সংস্কার” নিয়ে ভক্তি সাধারণ মানুষের মধ্যে উবে যাবার জোগাড় যদিও।

“দেশের কৃষকদের আয় বাড়বে” প্রসঙ্গে যে মতটা আকাশে বাতাসে ঘুরে বেড়াচ্ছে তা হলো - ২০১৬ সাল পর্যন্ত কৃষক আত্মহত্যার হার এই সরকারের আমলে ৪২ শতাংশ বেড়ে গিয়েছিল কেন তার জবাব কে দেবে। আর ২০১৬ সাল থেকে কৃষক আত্মহত্যার সরকারি পরিসংখ্যান প্রকাশ বন্ধ কেন? জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যারা অতিমারীর সময়েও উৎপাদন বৃদ্ধি করল, তাদের জন্য ফসলের লাভ সুনিশ্চিত করতে সরকারের অনীহা কেন? এদেশের কৃষককে কেন বারবার “অভাবী বিক্রি” করতে বাধ্য হতে হবে? কেন বারবার কৃষককে সুদখোর মহাজনের দ্বারস্থ হতে হবে? কেন বারবার কোটিপতি শিল্পপতিদের ঋণমকুব হয়? এইসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে খুঁজতে মানুষকে সমস্যার সমাধানের পথের সন্ধান করে নিতে হবে একদিকে, অন্যদিকে সমাধানের পথের সন্ধান করতে মানুষকে সাহায্য করলে শেষপর্যন্ত মানুষ সেই রাজনীতির পাশেই থাকে এটাই ইতিহাস বলে।