৫৮ বর্ষ ৮ম সংখ্যা / ২ অক্টোবর ২০২০ / ১৫ আশ্বিন ১৪২৭
নয়া কৃষি আইনগুলি সম্পর্কে
বিপ্লব মজুমদার
কেন্দ্রীয় সরকার আনীত তিনটি কৃষি বিল সংসদে অত্যন্ত বেনজির দ্রুততা এবং যথেষ্ট আলোচনার সুযোগ না দিয়েই অনুমোদিত হবার পর এখন রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষরিত হয়ে আইনে পরিণত হয়েছে। দেশব্যাপী কৃষক ও অন্যান্য গণতান্ত্রিক শক্তির আবেদনকে অগ্রাহ্য করেই লকডাউন চলাকালীন ৫ মে, ২০২০ তারিখের কৃষি সংক্রান্ত তিনটি অর্ডিন্যান্স পেশ, সংসদে পাশ করানো এবং রাষ্ট্রপতির তরফে যথেষ্ট বিচার বিবেচনা ছাড়াই অনুমোদন - এই অতিদ্রুততার পিছনে মুখ্য উপভোক্তা কর্পোরেট দুনিয়ার তাগাদা সহজেই অনুমেয়। অন্তত কৃষকদের আগ্রহে এই দ্রুততা, তা বলা যাবে না। প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে বিজেপি দল তিন কৃষি আইনের পক্ষে দাঁড়িয়ে অসত্য ও অর্ধসত্য প্রচারে নেমেছে। বিভ্রান্তি সৃষ্টির এই অপকৌশল কৃষকদের সমর্থন পাচ্ছে না। উল্টে বিজেপি-র সবচেয়ে পুরানো শরিক শিরোমণি আকালি দলের এনডিএ ত্যাগ; কৃষি দপ্তরের রাষ্ট্রমন্ত্রীর পদত্যাগ, আরএসএস’র কৃষক শাখার এমএসপি আইন প্রণয়নের দাবিতে সোচ্চার হওয়ার ঘটনা এবং পাঞ্জাবের পর কর্ণাটক বন্ধ, ২৫ সেপ্টেম্বরের কৃষক বিক্ষোভে ব্যাপক সমর্থন নতুন রাজনৈতিক শক্তি বিন্যাসের ইঙ্গিতবাহী। এমন কি আছে এই তিন কৃষি আইনে?
প্রধানত, কৃষি ফসলের বাজারকে কেন্দ্র করে এই নতুন আইন। এই আইনগুলির মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো “The Farmers Produce Trade and Commerce (Promotion and Facilitation) Bill” verte (কৃষি পণ্য ব্যবসা ও বাণিজ্য ‘উন্নতিসাধন ও সুবিধা বিল ২০২০ বিল নং ১১৩সি ২০২০)। এই বিলের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, (১) কৃষক ও ব্যবসায়ী উভয়েই তাদের পছন্দ মতো উপায়ে কৃষিজ পণ্য বিক্রয় ও ক্রয় করতে পারবে। কৃষক মান্ডিতে না গিয়ে, ট্যাক্স না দিয়ে বিকল্প পথ ধরে লাভজনক মূল্য আদায় করতে সক্ষম হবে। (২) বিভিন্ন রাজ্য সরকারগুলি প্রণীত বর্তমান কৃষি বাজার আইনের বাইরে এসে দক্ষতা, স্বচ্ছতার সাথে এবং স্বাধীনভাবে রাজ্যের অভ্যন্তরে এবং অনান্য রাজ্যের সাথে ব্যবসায়িক লেনদেন করতে পারবে। (৩) বৈদ্যুতিন ব্যবসা বা ই-ট্রেডিং ব্যবস্থা গড়ে উঠবে এবং (৪) ২০২০ সালের ৫ জুন তারিখে যে দিন থেকে অর্ডিন্যান্স জারি হয়েছিল, সেই দিন থেকে আইন কার্যকর করা হবে বলা হয়েছিল। বিলের প্রথম অংশে কৃষক, কৃষি উৎপাদক সংগঠন, আন্তঃরাজ্য ব্যবসা, ব্যক্তি ইত্যাদি সম্পর্কে বলা হয়েছে। ব্যবসার এলাকা ও ব্যবসায়ীদের সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। দ্বিতীয় অংশে, কৃষকের উৎপন্ন দ্রব্যের ক্রয় বিক্রয় ও বাণিজ্যের সুবিধা, তৃতীয় অংশে, বিরোধ নিষ্পত্তির কথা, চতুর্থ অংশে এই আইন ভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে শাস্তির কথা বলা আছে। পঞ্চম অংশে অন্যান্য বিষয় সংযোজিত করা হয়েছে।
ব্রিটিশ আমলে আমাদের দেশে বারে বারে খাদ্যের অভাবজনিত দুর্ভিক্ষ দেখা দিত। সর্বশেষ দুর্ভিক্ষ ছিল বাংলায়। যুদ্ধের নামে ব্যবসায়ীদের খাদ্য মজুত তারই কুফল। এর পরিণামে যুক্ত বাংলার ২০ টি জেলার প্রায় ৫০ লক্ষ গরিব কৃষক, খেতমজুর, গ্রামীণ জনগণ খাদ্যের অভাবে মৃত্যুবরণ করতে বাধ্য হয়। এই ঘটনা গোটা দেশকে নাড়িয়ে দিয়েছিল । পরবর্তীতে স্বাধীনতার পরে খাদ্যশস্যের ব্যবসা নিয়ন্ত্রণের আইন করা হয়। মজুতদারি বন্ধ করার জন্য আইনটি যথেষ্ট না হওয়ায় ৭০-এর দশকের শুরুতে এপিএমসি (কৃষি পণ্য বাজার কমিটি) আইন নিয়ে আসা হয়। কৃষি রাজ্য তালিকাভুক্ত, ট্রেড বা ব্যবসা যুগ্ম তালিকায়। রাজ্যগুলি তাদের সুবিধামতো কৃষি পণ্যের বাজারের আইন তৈরি করে। বর্তমানে সারা দেশে এগুলিকেই কোনো কোনো জায়গায় মান্ডি, কোথাও নিয়ন্ত্রিত বাজার বলা হয়। উত্তর, মধ্য, পশ্চিম ও দক্ষিণ ভারতে এই মান্ডি প্রথা অনেক আগে থেকেই চালু ছিল। সেগুলিকে আইনের আওতায় আনা হয়। পশ্চিমবঙ্গে পানের আড়তে খানিকটা মান্ডি প্রথা চালু আছে। এখানে খুচরো হাট ও পাইকারি হাট প্রথা চলে আসছে। এপিএমসি আইন চালু থাকলেও তা কোনোদিনই কঠোরভাবে প্রয়োগ না হওয়ার অন্যতম কারণ হলো এরাজ্যে ভূমিকেন্দ্রিক আন্দোলনের বিকাশ ও গরিব ও ক্ষুদ্র চাষির ব্যাপক প্রাধান্য। আমাদের দেশে এখন ছোটো বড়ো মিলিয়ে প্রায় ২৮ হাজার মান্ডি আছে। দীর্ঘকাল ধরে দেশের বিভিন্ন রাজ্যে এই মান্ডিগুলি স্বাভাবিক নিয়মে গড়ে ওঠার ফলে ব্যবসায়ী ও কৃষকদের মধ্যে পারস্পরিক বিশ্বাস ও নির্ভরতার এক সম্পর্ক বিরাজ করছে। এই বিশেষ বৈশিষ্ট্য বিবেচনায় রাখতে হবে। অবশ্য তারই মাঝে ব্যবসায়ীদের মুনাফাও হয়। বড়ো বড়ো ব্যবসায়ী, মহাজন, ফড়িয়া তারা যাতে কৃষকদের ঠকাতে না পারে সেজন্য এই আইনে ব্যবস্থা করা হয়। মান্ডি বা এপিএমসি-র জন্য থাকে একটা নির্দিষ্ট এলাকা - কোথাও ব্লক, কোথাও সাব ডিভিশন, কোথাও থানা, বিভিন্ন রাজ্যে বিভিন্ন ধরনের হয়। ঐ সমগ্র এলাকার ফসলের ক্রয় বিক্রয়ের কেন্দ্র হিসাবে পাইকারি বাজার অর্থাৎ এই মান্ডিগুলিকেই একমাত্র অধিকার দেওয়া হয়, নিয়ম করা হয় সমস্ত শস্যই বিক্রয় করা হবে মান্ডিতে। বিক্রিত কৃষি পণ্যের দামের উপরে একটা লেভি থাকে। মান্ডির বাজারের বাইরে কৃষিপণ্যে কেনাবেচা হলে জরিমানা করার ব্যবস্থা আছে। সরকার ঘোষিত ন্যূনতম সহায়ক মূল্য মেনে সরকার মান্ডিতে ফসল কিনে থাকে। মান্ডি কমিটি বাজার পরিচালনা করে; যাতে করে কৃষকরা বঞ্চিত না হয় এবং ফসল কেনাবেচার মধ্য দিয়ে অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি না ঘটে, তা দেখার জন্য সরকারি প্রতিনিধির দায়িত্ব থাকে। এই আইনের উদ্দেশ্য হিসাবে বলা হয়েছিল, একদিকে কৃষক যেমন ফসলের দাম পাবে, অপরদিকে খুচরো ক্রেতা সাধারণ যেন অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির ফাঁদে না পড়ে। এপিএমসি আইনে যা বলা ছিল তা কার্যকর করার জন্য এসডিও পর্যায়ের সরকারি আধিকারিকদের নিয়ন্ত্রণে কমিটি কাজ করে। ওই নিয়ন্ত্রিত বাজার ও মান্ডি কমিটির অধীনে কিছু কর্মচারী কাজ করে। কৃষকের ফসলের ক্রয় বিক্রয়ের উপরে যে লেভি বা ট্যাক্স ধার্য হতো তা থেকে এই ব্যবস্থার খরচ নির্বাহ করা, বাজারে যাওয়ার রাস্তাঘাটের উন্নতি করা, বাজারের পরিকাঠামো উন্নয়ন, কর্মচারীদের বেতন দেওয়া হয়। নতুন আইনে মান্ডিতে ফসল বিক্রয় কমে গেলে মান্ডি উঠে যাবে। মান্ডি চালানোর খরচ তো সরকার দেবে না। এই ব্যবস্থা দীর্ঘ প্রায় ৫০ বছর ধরে চালু আছে। অন্যান্য আইনের মতোই এপিএমসি বা মান্ডি আইনের যথাযথ প্রয়োগ সরকারের সদিচ্ছার উপর নির্ভরশীল। এই আইন প্রয়োগেও অনিয়ম-বেনিয়ম, দুর্নীতি, পরিকাঠামোগত সমস্যা, গণতান্ত্রিক পরিচালনার অভাব পরিলক্ষিত হয়। সরকারের দায়িত্ব হচ্ছে আইন প্রয়োগের অভিজ্ঞতা থেকে মাঝে মাঝে আইনগুলি সংশোধন করা। কিন্তু নতুন আইনে পুরানো আইনের দুর্বলতাগুলিকে সংশোধন করার বদলে এগুলিকে অজুহাত হিসাবে দেখিয়ে আইনটিকে অকেজো করে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। এপিএমসি আইনে বড়ো ব্যবসায়ীদের মান্ডি ও বাজারে কৃষিপণ্যের ব্যবসা করার লাইসেন্স দেওয়া হতো না। এটা আটকানো ছিল। ২০২০ সালের নতুন আইনে যে কোনো ব্যক্তি যে কোনো ছোটো মাঝারি কোম্পানিকে যেকোনো জায়গার ফসল ক্রয় করা, গোডাউনে মজুত করে রাখা, যে কোনো দামে বিক্রি করার অধিকার এবং ট্যাক্স ছাড় সহ নানা সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে। বড়ো বড়ো পুঁজির মালিকরা যারা এতদিন নিয়ন্ত্রিত বাজার আইনের বাধার ফলে কৃষকের ফসল ক্রয় করে ব্যবসার সুযোগ থেকে বঞ্চিত ছিল বর্তমান আইনে সেই বাধা তুলে দেওয়া হলো। বলা হলো বড়ো বড়ো পুঁজিপতি কোম্পানিগুলির এজেন্ট বা দালালরা মাঠ থেকেই ফসল কিনে নিতে পারবে, বা তাদের নিজস্ব ব্যবসা কেন্দ্র খুলে ক্রয় করতে পারবে ও মজুত করতে পারবে। তার ফলে মান্ডিতে কৃষক যে দামে ফসল বিক্রয় করে তার চেয়ে নাকি বেশি দাম পাবে। কেন্দ্রীয় সরকারের এই আশ্বাসের কোনো বাস্তব ভিত্তি নেই। কেবল সরকার সব ফসল কেনে না, কেনে গণবন্টনের প্রয়োজন মতো। অন্যদিকে গণবণ্টন ব্যবস্থা সবার জন্য নয়। কেন্দ্রীয় সরকার ফসলের ন্যূনতম দাম নির্ধারণ করার আজও কোনো আইন আনেনি। বছর বছর সরকারি আদেশনামা জারি করা হয়। যে কোনো সময়ে এই আদেশনামা জারি নাও হতে পারে। কেন্দ্রীয় সরকার নিযুক্ত সান্তা কুমার কমিটির রিপোর্ট অনুযায়ী সর্বনিম্ন সহায়ক মূল্যে উৎপাদিত ফসলের মাত্র ৬ শতাংশ বিক্রয় হয়। সহজেই অনুমেয়। বাদবাকি ৯৪ শতাংশ ফসল কৃষককে বাণিজ্যিক দরে বিক্রয় করতে হয়। যা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সরকার ঘোষিত মূল্যের চেয়ে অনেক নিচে নেমে গেলে সরকার ক্রয় করে না। আসলে কৃষকরা পদে পদে সরকারি প্রতারণার শিকার। স্বামীনাথন কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী ফসলের দেড়গুণ দাম কৃষককে দেওয়া হবে বলে আশ্বাস দিয়ে মোদী সরকারে এসেছিলেন। তাই কৃষকদের মূল দাবি কৃষকদের কৃষি ফসলের জন্য ন্যূনতম সহায়কমূল্য দেবার আইন করতে হবে, যাতে অভাবী বিক্রি বন্ধ হয়। কিন্তু তথাকথিত কৃষক দরদী সরকার সে কথায় ঘাড় পাতছে না। ৬ বছরের বঞ্চনার অভিজ্ঞতায় প্রমাণিত বিজেপি সরকার কৃষকদের প্রতারণা করেছে। আবার সরকার ঘোষিত দাম রাজ্যে রাজ্যে কৃষকরা পান না। যেমন ১ কুইন্টাল ধানের সর্বনিম্ন সহায়ক মূল্য ১,৮১৫ টাকা হলেও পশ্চিমবঙ্গে কৃষকেরা বিক্রয় করতে বাধ্য হচ্ছেন মাত্র ১,৪০০ টাকায়। তার উপর ৫ থেকে ৭ কেজি বাড়তি দিতে হয়, যার দাম পাওয়া যায় না। এপিএমসি আইন অকার্যকর বা দুর্বল হয়ে গেলে বৃহৎ বা একচেটিয়া পুঁজির মালিকদের সাথে প্রতিযোগিতায় গরিব, মাঝারি কৃষক লোকসানে ফসল বিক্রয় করতে বাধ্য হবে। কেননা কৃষিজ উৎপন্নগুলি বেশিরভাগই পচনশীল, কৃষকদের নিজস্ব গোডাউন নেই। এই সব বিবেচনা করে কৃষক বাধ্য হবে বড়ো কোম্পানির নির্দেশিত দামে তাঁর ফসল ছেড়ে দিতে। অভিযোগ থাকলে কৃষক আপিল কমিটির কাছে যেতে পারে। এই আপিল কমিটির কর্তারা তাদের শ্রেণিগত অবস্থানের কারণে বড়ো বড়ো পুঁজির মালিকদের পক্ষে রায় দেবেন - এটাই কৃষকদের অভিজ্ঞতা। দেশের কৃষকের জন্য পাতা ফাঁদটির তুলনা নেই।
পুঁজিবাদী বাজার ব্যবস্থাতে বর্তমান আইনের চেয়ে এপিএমসি আইন ক্রটি-দুর্বলতা সত্ত্বেও অনেকটাই কৃষকদের সহায়ক। কারণ মান্ডি কেবল বিকল্প বাজার নয়, সেখানে কৃষক জোট বেঁধে লড়াই করতে পারে এবং করেও থাকে। কিন্তু লগ্নিপুঁজির মালিকদের সাথে গরিব কৃষক কিছুতেই এককভাবে লড়াই করতে পারবে না। এই লড়াই বাঘের সাথে ছাগ শিশুর লড়াইয়ের মতো। তাই দীর্ঘদিন ধরে কৃষক বঞ্চিত হতে হতে শেষে বিক্ষোভ দেখাচ্ছে। ইতিমধ্যে বিজেপি সরকার ২০১৬ সালের ই-মার্কেটিং ব্যবস্থার নামে এপিএমসি আইনকে অকার্যকর করার ব্যবস্থা চালু করেছিল। ই-মার্কেটিং ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতার কারণে এই বর্তমান আইন নিয়ে আসা হয়েছে। বিজেপি পরিচালিত রাজ্যগুলি গত মে মাসেই কোভিড-১৯ এর অজুহাতে তাদের রাজ্যের কৃষি বাজার আইন সংশোধন করে বর্তমান কেন্দ্রীয় আইনগুলি কার্যকর করার পথ তৈরি করে রেখেছে।
দ্বিতীয় আইনটির পোশাকি নাম The Farmers (Empowerment and Protection) Agreement on Price Assurance and Farm Services Bill, 2020 অর্থাৎ চুক্তিবদ্ধ কৃষি ব্যবস্থা সম্পর্কিত বিল, (কৃষকের ক্ষমতায়ন, স্বার্থ রক্ষা, মূল্য নিশ্চয়তা দানের বিল)। চারটি চ্যাপ্টারে ২৫টি ধারায় এই আইন নিয়ে আসা হয়েছে। এখানে চাষ সম্পর্কিত চুক্তি, বিরোধ নিষ্পত্তি আর কেন্দ্রীয় সরকার এবং নানা আধিকারিকদের ক্ষমতা এবং সিভিল কোর্ট অগ্রাহ্য ধারাসমূহ রাখা হয়েছে। এখানে বলা হয়েছে যে, একটা জাতীয়স্তরের কাঠামো তৈরি করা হবে, যা নাকি কৃষকদের শক্তি জোগাবে, রক্ষা করবে এবং উৎপন্ন ফসল নাকি কৃষকদের শক্তি জোগাবে, রক্ষা করবে এবং উৎপন্ন ফসল লাভজনক দামে বিক্রি করার পারস্পরিক চুক্তি করা হবে, যার মধ্যে স্বচ্ছতা থাকবে ইত্যাদি বড়ো বড়ো কথা। যার কোনো ভরসা নেই। কৃষি ফসলের “মূল্য নিশ্চয়তা’’ দেওয়ার কথা বলা হলেও আসলে এটা হলো কৃষি বাণিজ্য ব্যবসায় হাত পাকানো বড়ো বড়ো কোম্পানির স্বার্থ রক্ষার আইনি ক্ষমতা দানের ব্যবস্থা। পারস্পরিক বোঝাপড়ার ভিত্তিতে চুক্তির মাধ্যমে কৃষকদের ক্ষমতাবান করা হবে। কৃষি বাণিজ্য কোম্পানি, পাইকারী রপ্তানীকারক বড়ো বড়ো খুচরা ব্যবসায়ী সংস্থার সঙ্গে কৃষক চুক্তি করবে, এর মধ্যে সমস্ত ধরনের খাদ্যশস্য, পশুখাদ্য ও তুলো উৎপাদন এবং বিক্রয়ের বিষয়গুলিও থাকবে। কোম্পানিগুলির তৈরি করা কৃষি উপকরণগুলি চাষিকে কিনতে বাধ্য করা হবে এবং এর জন্য নগদ দাম দিতে হবে। কৃষিপণ্যের যে দাম কোম্পানি ঠিক করবে কৃষক বাধ্য হবে সেই দামে বিক্রি করতে। আবার ফসল ওঠার পরে নানা অজুহাত দেখিয়ে কোম্পানিগুলি শস্য ক্রয় নাও করতে পারে, বা দাম কমিয়ে দিয়ে কৃষককে সর্বস্বান্ত করতে পারে। পেপসি কোম্পানির সাথে লোভনীয় চুক্তিতে আবদ্ধ পাঞ্জাবের টম্যাটো চাষি, হাওড়ার আলু চাষিদের তিক্ত অভিজ্ঞতা রয়েছে। একজন তৃতীয় পক্ষ হিসাবে অনুসন্ধানকারী নিয়োগ করার বিধি রাখা আছে। পুঁজির শাসনে অবশ্যই কৃষকের বিরুদ্ধেই রায় যাবে। এই চুক্তি অনুযায়ী গুণগতমান বজায় রাখার অজুহাতে সমস্ত বা বেশিরভাগ কৃষি উপকরণ যথা সার, বীজ, কীটনাশক প্রভৃতি ঐ নির্দিষ্ট কোম্পানির থেকে ক্রয় করতে কৃষক বাধ্য থাকবে, এমনকি ফসল নির্বাচন, চাষ পদ্ধতি ওরাই স্থির করবে। এর ফলে গ্রামে-গঞ্জে যে ছোটো বড়ো মাঝারী সমবায়গুলি গড়ে উঠেছে সেগুলি ধুঁকতে থাকবে বা উঠে যাবে। বর্তমানে কর্মরতদের একটা অংশ আবার বেকার হয়ে যাবে। নগদ অর্থের বিনিময়ে জমি বন্ধক রেখে কৃষককে ওইসব কোম্পানির কাছে বা তাদের নির্দেশ মতো সংস্থার কাছে ধারও করতে হতে পারে। এই বন্ধকি মহাজনও ওই চুক্তিবদ্ধ কোম্পানি হবেন এতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই। কোম্পানির দালালরা সদা সক্রিয় থাকে। এখন যদি চুক্তি সম্পর্কিত কোনো বিরোধ দেখা দেয় তাহলে নানা জায়গায় মামলা হবে। সে চাষ করবে নাকি মামলা মোকদ্দমায় ব্যস্ত থাকবে। শস্য পালনের যা কিছু দায়িত্ব সব থাকবে কৃষকের ঘাড়ে তা প্রাকৃতিক বিপর্যয় হোক বা পোকামাকড়ের আক্রমণ হোক। এই আইনে একটি মূল্য ‘‘বিমা” রাখার ব্যবস্থা হয়েছে। তবে তা কোম্পানির জন্য, চাষীর জন্য নয়। ব্রিটিশ আমলে বাধ্যতামূলক নীল চাষের আদলে। বর্তমান বিজ্ঞাপনের প্রভাবে আপাতত লোভনীয় চুক্তি চাষে কৃষককে মোহবন্দী করে ফেলার শেষ অঙ্কে কেন্দ্রীয় সরকারের আইনটি বড়ো বড়ো ব্যবসায়ীদের খুবই প্রয়োজন। কৃষি ও কৃষকের উন্নয়নের জন্য কৃষি গবেষণা, শিক্ষা, উন্নত বীজের গবেষণা, কীট-পোকা দমনের যাবতীয় সরকারি দায়দায়িত্ব থেকে সরকার নিজেকে মুক্ত করার সুদূর প্রসারী পরিকল্পনার অঙ্গ হিসাবে চুক্তি চাষের আইনটির প্রবেশ । অর্থাৎ সরকার দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ, তা পালন করবে নাকি ব্যবসায়ীরা। শেয়ালের কাছে কুমির ছানার শিক্ষা ভার দেওয়া। দীর্ঘ দুই দশকের চেষ্টার ফল এবার কর্পোরেটরা পাবে।
সর্বশেষ যে আইনটি পাশ হয়েছে তার নাম The Essential Commodities (Amendment) Bill, 2020। পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে কোন্ পরিস্থিতিতে এই আইন করা হয়েছিল। ১৯৫৫ সালে এই আইনটি তৈরি হয়েছিল। বর্তমানে তারই সংশোধন করা হয়েছে। পুরানো আইনে মজুতদারি ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বেশ কিছু শক্ত বিধানের কথা বলা ছিল। বর্তমান আইনে সেগুলিকে বাতিল করার চেষ্টা হয়েছে। ব্যবসায়ীদের লাইসেন্স পাওয়ার ক্ষেত্রে একটি শর্ত ছিল কোন্ জিনিস কত পরিমাণ গোডাউনে রাখতে পারবে। যানবাহন ইত্যাদি করে বিভিন্ন জিনিস পরিবহণের সীমা বেধে দেওয়া ছিল এবং কৃষি পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা ঐ পুরানো আইনে ছিল। এখন ব্যক্তিগত পুঁজি নিয়োগের অজুহাত দেখিয়ে কৃষি বাণিজ্য ও পরিকাঠামোর ক্ষেত্রে বিনিয়োগ বৃদ্ধির লক্ষ্যে এই আইনটি আনা হয়েছে। এই আইনটি আনার ক্ষেত্রে কোভিড-১৯ অতিমারীকে অজুহাত হিসাবে দাঁড়ো করানো হয়েছে। বলা হচ্ছে, এই আইনটি সংশোধনের ফলে কৃষিপণ্যের বাণিজ্যের ক্ষেত্রে প্রচুর অর্থ বিনিয়োগ হবে, প্রতিযোগিতা বাড়োবে, কৃষকের আয় বাড়োবে এবং নতুন কর্মসংস্থান হবে। মাঝে মাঝে মজুতদারের বিরুদ্ধে জনমতের চাপে বিভিন্ন সরকার বর্তমান সময়ে যে সমস্ত পুলিশি অভিযান পরিচালিত করতো বর্তমান আইনে বড়ো বড়ো ব্যবসায়ীদের তা থেকে মুক্তি দেওয়া হলো। একমাত্র যুদ্ধ বা দুর্ভিক্ষজনিত পরিস্থিতি, গুরুতর ধরণের প্রাকৃতিক বিপর্যয় এবং অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকার এই আইনের উপর হস্তক্ষেপ করতে পারবে বলে এই আইনে একটি বিধান রাখা হয়েছে। বিজেপি-র মতো বৃহৎ ব্যবসায়ীকূলের মিত্র সরকার আপৎকালীন অবস্থায় কতটা হস্তক্ষেপ করবে তা নিয়ে সন্দেহ থাকাটা স্বাভাবিক।
এই আইন কার্যকর হলে কোনো নাগরিক মজুতদারদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থার জন্য আদালতে যেতে পারবেন না। কারণ, যথেচ্ছ মজুত করার ক্ষমতা, যে কোনো মূল্যে শস্য বিক্রি করার অধিকার এই আইনে দেওয়া হয়েছে; অর্থাৎ আবার ৫০-এর দশকের মন্বন্তরের মতো ঘটনা ঘটলেও অসহায় জনগণ আকাশের দিকে তাকিয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়োতে বাধ্য হবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো অত্যাবশ্যকীয় পণ্য তালিকা থেকে চাল, ডাল, আলু, পেঁয়াজ, ভোজ্য তেলের নামগুলি বিদায় দেওয়া হলো। এর ফলে ব্যবসায়ী সংস্থাগুলি পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় খাদ্যশস্য ও ভোজ্য তেলের দাম দেড়োগুণ বৃদ্ধি করতে পারবে। আলু, পেঁয়াজের দাম বৃদ্ধি করতে পারবে দু’গুণ। একইভাবে ফল ও সবজির দামও বৃদ্ধি করা যাবে। খোলাখুলি মজুতদারী ও কালোবাজারিদের লাইসেন্স দেওয়ার আইন ছাড়া আর কি সংজ্ঞা হতে পারে এই নতুন আইনের। কৃষক এবং সাধারণ উপভোক্তা, উভয়কেই যথেচ্ছ লুঠ করার আইনসম্মত অধিকার এই আইনে দেওয়া হলো।
এই তিন আইনের সমন্বয়ের মূল লক্ষ্য হলো কেবলমাত্র কৃষকের উৎপাদিত ফসলটুকু নয়, কৃষকের দখলে থাকা জমি খণ্ডগুলি। রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প, খনি, বন, পরিবহণ পরিকাঠামো, রেল, বিমানবন্দর সব কিছু উপঢৌকন দেওয়ার পরে নজর পড়েছে কৃষকের জমির উপর। ২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার পরই নরেন্দ্র মোদী চেষ্টা করেছিলেন ভূমি অধিগ্রহণ আইনকে বাতিল করতে অর্ডিন্যান্স জারি করার। কৃষক আন্দোলনের জাগ্রত এবং ঐক্যবদ্ধ শক্তির কাছে নরেন্দ্র মোদীকে সেদিন মাথা নত করতে হয়েছিল। সেদিনই মোদীর গায়ে কৃষক বিরোধী তকমা লেগে যায়। তাই এবার অতিমারীর সময়ে জাতীয় বিপর্যয় আইনের আড়ালে কৃষকের ফসল ও তার শেষ সম্বল জমিটুকু কেড়ে নেওয়ার জন্য হাত বাড়ানো হয়েছে। বিগত ৬ বছরের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে বারে বারে প্রতারিত জনগণ খানিকটা সচেতন হয়ে উঠেছে। তার প্রতিফলন এই তিনটি আইনের বিরুদ্ধে গোটা দেশজুড়ে ঐক্যবদ্ধ কৃষক আন্দোলন গড়ে উঠেছে। তার পাশে শক্তি জোগাচ্ছে দেশের গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষ। ভাষা, ধর্ম, বর্ণ, প্রাদেশিকতার সমস্ত বিভাজন রেখা মুছে দিয়ে সারা ভারত কৃষক সংঘর্ষ সমন্বয় সমিতির পতাকা তলে সমবেত হয়েছে। দেশব্যাপী আচমকা লক ডাউন ঘোষণার একমাসের মধ্যে পরিযায়ী শ্রমিকরা এক উদীয়মান শক্তির মতো কেন্দ্রীয় সরকারের সমস্ত বাধাকে অগ্রাহ্য করে দুঃখ যন্ত্রণাকে বরণ করে নিয়ে বাড়ি ফিরে এসেছেন, এককথায় তা ছিল অভূতপূর্ব। আবার নতুন করে এই কৃষক আন্দোলন দেশের গণতন্ত্রপ্রিয় সমস্ত শক্তিকে উৎসাহ জুগিয়ে চলেছে। গত ২৬ সেপ্টেম্বর কিষান সংঘর্ষ সমিতির নেতৃত্ব সমগ্র দেশের আন্দোলনকারীকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। আগামীদিনে এই বৃহত্তর সংগ্রামের কর্মসূচি নিয়ে সকলকে শামিল হতে আহ্বান জানিয়েছে।
পূর্ববর্তী ব্যবস্থায় কৃষক, ছোটো ব্যবসায়ী ও জনসাধারণের জন্য তৎকালীন পরিস্থিতিতে শাসক-শোষক শ্রেণিগুলি যে সব সুযোগ সুবিধা দিতে বাধ্য হয়েছিল, বর্তমানে সাম্রাজ্যবাদের নির্দেশিত বিশ্বায়ন উদারীকরণের নীতির ব্যর্থতা সত্ত্বেও বিজেপি সরকার সেগুলি কেড়ে নিচ্ছে কেবলমাত্র দেশি বিদেশি বৃহৎ ও একচেটিয়া পুঁজির মালিকদের লুট করার মৃগয়া ক্ষেত্র বাধামুক্ত করে দিতে। অর্থাৎ শাসকশ্রেণিকে জনগণের অধিকার ও সুযোগ সুবিধাগুলি নির্মমভাবে কেড়ে নিয়ে লগ্নিপুঁজির বিনিয়োগ ও মুনাফার স্বার্থে এই তিন আইন পরিবর্তনের পথে নামতে বাধ্য হতে হলো। শোষণের নতুন পথ তীব্র বেদনাময় হলেও আখেরে শ্রমজীবী জনগণের শাসক দলগুলি সম্পর্কে মোহমুক্তির পরিবেশ সৃষ্টির সহায়ক - সমাজ বদলের চালিকা শক্তিগুলি তা বিবেচনায় রাখবে।