৫৮ বর্ষ ৮ম সংখ্যা / ২ অক্টোবর ২০২০ / ১৫ আশ্বিন ১৪২৭
মোদী-মমতার চক্রান্তের শিকার মনরেগা
সুপ্রতীপ রায়
যত দিন যাচ্ছে সঙ্কট তত ঘনীভূত হচ্ছে। লকডাউনের আগেই ঘনীভূত হচ্ছিল অর্থনৈতিক সঙ্কট। করোনা উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সঙ্কট আরও তীব্র হয়েছে। কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের উদাসীনতা এর জন্য দায়ী। বর্তমান পরিস্থিতিতে মানুষকে সহায়তা দেবার বদলে অর্থনৈতিক আক্রমণ নামিয়ে আনা হয়েছে। এমনিতেই বেকারত্বের লাইন লম্বা হচ্ছিল। লকডাউনে গ্রাম-শহর উভয় ক্ষেত্রেই কাজহারা মানুষের সংখ্যা আরও বেড়েছে। মানুষের কাজ নেই। ক্রয় ক্ষমতা তলানিতে। এই অবস্থাতে মানুষের হাতে কাজ চাই। পরিস্থিতি মোকাবিলায় মনরেগা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারত। কিন্তু বিজেপি পরিচালিত কেন্দ্রীয় সরকার ১০০ দিনের কাজের প্রকল্পকে তুলে দিতে চায়। তৃণমূল এই প্রকল্পটিকে গুরুত্বহীন করে দিয়েছে।
কাজের অধিকারকে মৌলিক অধিকার হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি স্বাধীনতার পর থেকেই বামপন্থীরা তুলেছেন। কর্মসংস্থান ব্যতীত জীবনধারণের জন্য আর্থিক চাহিদা মেটানো সম্ভব নয়। ভারতীয় সংবিধানে রাজ্যের প্রতি নির্দেশমূলক নীতিতে সংবিধানের ৩৯(৪) ধারায় বলা হয়েছে, রাষ্ট্রের নীতি হলো প্রতিটি পুরুষ ও নারী জীবনধারণের জন্য যেন উপার্জনের সুযোগ পায়। ২০০৫ সালের সেপ্টেম্বরে কেন্দ্রীয় সরকার মনরেগা’র মাধ্যমে একে আইনি স্বীকৃতি দেয়। মনরেগা সবার জন্য না হলেও কমপক্ষে গ্রামীণ মানুষের জন্য যাঁরা দরিদ্রতর, তাঁদের জন্য কর্মসংস্থানের আংশিক গ্যারান্টি দিয়েছে। সমাজের হতদরিদ্র পরিবারগুলির সামাজিক সুরক্ষা প্রদানে রাষ্ট্রকে বাধ্য করিয়েছে বামপন্থীরা।
‘মনরেগা’কে গুরুত্বহীন করে দেওয়ার জন্য নানা নেতিবাচক কথা বলা হয়। কিন্তু নানা সমালোচনা সত্ত্বেও মহাত্মাগান্ধী গ্রামীণ কর্মনিশ্চয়তা আইন এক যুগান্তকারী আইন বলে প্রমাণিত হয়েছে। স্বাধীনতার পর এই প্রথমবারের মতো দরিদ্র জনসাধারণকে আত্মসম্মান বজায় রেখে জীবনধারণের উপযোগী অর্থ উপার্জনের ব্যবস্থা করেছে এই আইন। অবশ্যই বর্তমান আর্থিক পরিস্থিতিতে মজুরি বৃদ্ধি করতে হবে। জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় মজুরির দাবি জানানোর অধিকারকে এই আইন স্বীকৃতি দিয়েছে। ১০০ দিনের কাজের প্রতিশ্রুতিই এই আইনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
মনরেগা’র অন্যতম উদ্দেশ্য গ্রামীণ এলাকায় স্থায়ী সম্পদ সৃষ্টি করা এবং গ্রামীণ এলাকার দরিদ্র জনসাধারণের জীবিকা অর্জনের জন্য প্রয়োজনীয় সুযোগের ভিত্তিগুলিকে আরও শক্তিশালী করা। অর্থাৎ যাঁরা কাজ চাইবেন তাঁদের এমনভাবে কাজ দিতে হবে যাতে সেই কাজ থেকে স্থায়ী সম্পদ তৈরি হয়। এই স্থায়ী সম্পদগুলি এমনভাবে তৈরি করতে হবে, যাতে তা ব্যবহার করে মানুষের জীবিকা অর্জনের সুযোগ আরও বৃদ্ধি করা যায়। এককথায় গ্রামের দরিদ্র পরিবারগুলির জন্য সামাজিক পরিকাঠামো এবং অর্থনৈতিক সম্পদ গড়ে তোলা এবং তার মাধ্যমে দারিদ্র্য দূরীকরণই এই কর্মসূচির অন্যতম লক্ষ্য। মনরেগা’র মাধ্যমে মজুরিভিত্তিক নিয়োগ প্রথাটি ভারতীয় অর্থনীতির প্রেক্ষিতে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। ২০০৬ সাল থেকে এই আইন কার্যকর হয়েছে। এই আইন প্রণয়নে বামপন্থীদের অবদান স্মরণীয়। সংসদে যখন বিলটি পেশ করা হয়েছিল তখন বিলটি ছিল ত্রুটিতে ভরা। এটিকে গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রকের সংশ্লিষ্ট সংসদীয় স্ট্যান্ডিং কমিটির কাছে পাঠানো হয়। ওই স্ট্যান্ডিং কমিটির একজন সদস্য হিসাবে হান্নান মোল্লা অনেকগুলি সংশোধনী পেশ করেন। এছাড়া কমিটির কাছে বিভিন্ন বামপন্থী গণসংগঠন, বামপন্থী বুদ্ধিজীবীরা বক্তব্য পেশ করেন। অর্থাৎ এই আইন তৈরিতে বামপন্থীদের হস্তক্ষেপ ছিল। যদিও বামপন্থীদের সব দাবি গ্রাহ্য হয়নি। ফলে আইনে বেশ কিছু দুর্বলতা আছে।
দুর্বলতা যাই থাকুক গ্রামীণ কর্মসংস্থান নিশ্চয়তা আইনের ফলে গ্রামে ১০০ দিন কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করতে সরকারকে বাধ্য রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে। যদিও ১০০ দিন কাজ দেওয়া হচ্ছে না। এই আইনে কর্মসংস্থানের পরিধি বাড়ানো হয়। পঞ্চায়েতকে এই প্রকল্প রূপায়ণে বেশি দায়িত্ব দেওয়া হয়। ঠিকাদারদের এই দায়িত্বে রাখা হয়নি আইন করেই।
‘মনরেগা’ আইনে যে বিষয়গুলি উল্লেখ আছে তা পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার ও কেন্দ্রীয় সরকার সচেতনভাবে লঙ্ঘন করে চলেছে। কাজ না দিয়ে মানুষকে ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। অথচ আইনে বলা আছে - যাঁরা অদক্ষ শ্রমে ইচ্ছুক, নাম নথিভুক্ত করার জন্য স্থানীয় গ্রাম পঞ্চায়েতে লিখিত বা মৌখিক আবেদন করতে পারবেন। গ্রাম পঞ্চায়েত কর্মনিযুক্তির জন্য এই আবেদনের একটি তারিখ সমেত রসিদ দেবে। এই রসিদের তারিখের ১৫ দিনের মধ্যে গ্যারান্টি কার্যকর হবে। অন্যথায় নগদ বেকারভাতা দিতে হবে রাজ্য সরকারকে। গ্রামের পাঁচ মাইলের মধ্যে কাজ দিতে হবে - অন্যথায় অতিরিক্ত মজুরি দিতে হবে। মজুরি দিতে হবে সাপ্তাহিক ভিত্তিতে, বড়োজোর পাক্ষিক ভিত্তিতে, তার বেশি নয়। আইনে বলা আছে এই কাজের কমপক্ষে এক-তৃতীয়াংশ পাবে মহিলারা। কাজের জায়গায় ক্রেশ, পানীয় জল ও ছাউনির সুবিধা রাখতে হবে। প্রকল্প গ্রামসভাকে তৈরি করতে হবে। অর্ধেক কাজ রূপায়ণের ভার থাকবে গ্রাম পঞ্চায়েতের উপর। পঞ্চায়েত পরিকল্পনা ও রূপায়ণের মুখ্য ভূমিকায় থাকবে। সব কাজে মজুরি ও মালপত্র বাবদ ব্যয়ের অনুপাত হবে ৬০:৪০। গ্রামসভাকে সামাজিক হিসাব নিরীক্ষার দায়িত্ব পালন করতে হবে। রূপায়ণ পদ্ধতিকে দায়বদ্ধ করার জন্য নালিশ-নিষ্পত্তির ব্যবস্থা রাখতে হবে।
এই আইনে বলা আছে প্রতিবন্ধীদের তাদের সুবিধামতো কাজ দিতে হবে। জনসাধারণের জ্ঞাতার্থে কোথায়, কোন্ কাজে,কতজন শ্রমিককে, কতদিন কাজ দেওয়া হয়েছে তার বিবরণ সংবলিত নোটিশ গ্রামপঞ্চায়েত কার্যালয়ে টাঙাতে হবে। মজুরি প্রদানকারী প্রত্যেক রূপায়ণকারী সংস্থাই মাস্টার রোলের মাধ্যমে টাকা দেবে। টাকা ও মজুরির মোট দিবস জব কার্ডে লিখে দিতে হবে। মজুরি প্রদানের হিসাব মূল জব কার্ড, নিবন্ধীকরণ ও কর্মসংস্থান রেজিস্টারে রাখতে হবে। এই আইনে আরও বলা আছে, আবেদনকারী যেদিন কাজ চাইবেন সাধারণভাবে তার ১৫ দিনের মধ্যে দরখাস্তকারীকে কাজ দিতে হবে। কাজ দিতে না পারলে ১৬তম দিন থেকে তিনি বেকারভাতা পাওয়ার যোগ্য হবেন। বেকারভাতার জন্য আলাদা করে দরখাস্ত করতে হবে। উপরের কথাগুলি উল্লেখ করলাম এই কারণে যে, আমাদের দেশের সরকার ও পশ্চিমবঙ্গ সরকার আইনগুলিকে লঙ্ঘন করে গ্রামীণ গরিব মানুষকে চরম বিপদের মধ্যে ফেলে চলেছে। মানুষের কাজের সুযোগ সংকুচিত হচ্ছে। এটাই পুঁজিবাদী বিশ্বায়নের পরিণাম। যার মূল কথা ‘জবলস গ্রোথ’। মোদী সরকার দ্রুততার সঙ্গে নয়া-উদারবাদী নীতি রূপায়ণ করে চলেছে। নয়া-আর্থিক উদারনীতি রূপায়ণের দায়বদ্ধতা থেকেই কর্মসংস্থান নিশ্চয়তা সৃষ্টির আইনি উদ্যোগকে সংকুচিত ও সীমাবদ্ধ করে চলেছে বর্তমান বিজেপি সরকার।
যাঁরা আমাদের মুখে খাদ্য তুলে দেন, সেই কৃষক ও কৃষিজীবী মানুষ এবং গ্রামীণ জনগণকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছে বিজেপি সরকার। লকডাউনে বিপন্নতা আরও বেড়েছে। লকডাউন পর্বে দিকভ্রান্ত কৃষক চরম লোকসানে ফসলের অভাবী বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন। পশ্চিমবাংলার অবস্থা আরও করুণ। তৃণমূলের আমলে আত্মঘাতী কৃষকের সংখ্যা বাড়ছে।
উদারনীতির জমানায় কৃষিকাজই হয়ে উঠেছে চরম অনিশ্চয়তার পেশা। বিভিন্ন সমীক্ষা থেকে পাওয়া পরিসংখ্যান অনুযায়ী কৃষিজীবী পরিবারের মাসিক গড় আয় কমছে। লক্ষ লক্ষ কৃষক কৃষি কাজ ছেড়ে দিচ্ছেন। মনরেগা’কে কার্যকরভাবে ব্যবহার করা গেলে এই অবস্থার কিছুটা মোকাবিলা করা যেতো। সঠিকভাবেই দাবি উঠেছে এই প্রকল্পে ২০০ দিনের কাজ ও ৬০০ টাকা মজুরি দিতে হবে এবং এই প্রকল্পকে শহরাঞ্চলে সম্প্রসারিত করতে হবে।
‘মনরেগা’ প্রকল্পকে আরও কার্যকরভাবে ব্যবহার করার পরিবর্তে তুলে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে কর্মসংস্থানের জন্য আইন প্রণয়নের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। ‘মনরেগা’ প্রকল্পকে সঠিকভাবে চালু রাখার ক্ষেত্রে রাষ্ট্র তার দায়বদ্ধতা পালন করছে না। আসলে মোদী সরকার নয়া-উদারবাদী নীতির এবং বাজার অর্থনীতির ঘোরতর সমর্থক। মোদী সরকারের সিদ্ধান্ত, রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে কোনো আর্থিক, উৎপাদন বা পরিষেবা সংস্থা রাখা হবে না। কর্পোরেটদের হাতে সব তুলে দেওয়া হবে। সরকার তার সামাজিক দায়বদ্ধতাকে পুরোপুরি বাতিল করতে চাইছে। সে আত্মসমর্পণ করছে কর্পোরেট দায়বদ্ধতার কাছে। মোদী সরকার ভারতকে বেসরকারি পুঁজির দাসে পরিণত করার খেলায় নেমেছে। ফলে ‘মনরেগা’ প্রকল্পকে মোদী তুলে দেবার চেষ্টা করবেন এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই।
মোদী ক্ষমতাসীন হওয়ার পর প্রতিটি সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পই বিপদের মুখে। এই সরকারের অর্থনৈতিক নীতি ও পরিকল্পনায় নাগরিকদের প্রতি কোনো দায়বদ্ধতা প্রকাশ পাচ্ছে না। আসলে বিজেপি’র দায়বদ্ধতা উচ্চবিত্ত মানুষের কাছে। মোদী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর অর্থনীতির ক্ষেত্রেও দক্ষিণমুখী প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। এই সরকার খোলাখুলিভাবে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সরকারি ভরতুকি প্রত্যাহার করে নিয়েছে। ফলে গ্রামীণ গরিব মানুষদের জন্য ১০০ দিনের কাজের গুরুত্ব কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। বলাবাহুল্য মোদী’র আমলে দেশের গরিব ও সাধারণ মানুষ প্রচলিত সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্প থেকে ক্রমেই বঞ্চিত হয়ে চলেছেন।
বাজেট কেবলমাত্র সরকারি হিসাব নয়। বাজেট বরাদ্দের মধ্যে দিয়ে সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি ও লক্ষ্য স্পষ্ট হয়। বাজেটের মধ্যে দিয়ে বোঝা যায় সরকার কোন্ শ্রেণির জন্য কাজ করতে চায়। মোদী আমলের বাজেটগুলির দিকে তাকালেই পরিষ্কার হয়, কেন্দ্রীয় সরকার ১০০ দিনের কাজের প্রকল্পকে গুরুত্বহীন করতে চায়।
মোদী সরকার এমজিএনআরইজিএ ছেঁটে ফেলতে তৎপর। আসলে গ্রামীণ গরিব মানুষের পক্ষে অত্যন্ত কার্যকর এই কর্মসংস্থান প্রকল্প তুলে দিতে চায় বিজেপি সরকার। এই সরকারের আমলে গ্রামীণ গরিবের অধিকার এবং জীবন-জীবিকার ওপর ধারাবাহিক আক্রমণ চলছে। গরিব মানুষের মজুরি প্রতিদিন কমেছে, খরচ বেড়েছে জীবনধারণের। গ্রামের পর গ্রামে খেতমজুরদের কাজ নেই, ১০০ দিনের কাজও সর্বত্র শুরু হয়নি। কেন্দ্রীয় সরকার প্রতিটি বাজেটে ১০০ দিনের কাজের প্রকল্পে বরাদ্দ ছাঁটাই করেছে। ফলে জীবন যন্ত্রণা আরও বাড়বে।
গ্রামে ১০০ দিনের কাজের আইন প্রকল্পে দলিতদের কাজ পাওয়ার পরিমাণ কমছে। বলা বাহুল্য, ভূমিহীন মানুষ এই সামাজিক অংশে অনেক বেশি। মোদী আমলে ১০০ দিনের কাজ পাওয়া তফশিলি জাতি ও আদিবাসীদের সংখ্যা কমছে। আবার দলিত আদিবাসীদের জন্য পরিকল্পনা খাতে সরকারি বরাদ্দ কমেছে। আমাদের রাজ্যে তৃণমূলের আমলে এই প্রকল্প মুখ থুবড়ে পড়েছে। তৃণমূলের আমলে রাজ্যে কৃষির সঙ্কট বেড়েছে, চাষে উৎসাহ হারাচ্ছে কৃষক, কাজ কমেছে ভূমিহীনদের। এই অবস্থায় রেগায় কাজ না মেলায় গ্রামাঞ্চলের সঙ্কট আগামীদিনে মহামারীর আকার নেবে।
তৃণমূল রাজ্যের পঞ্চায়েত ব্যবস্থাকে পঙ্গু করে দিয়েছে। এই কারণেই রেগার কাজে তৈরি হয়েছে নৈরাজ্য। এই প্রসঙ্গে স্মরণীয় ২০০৫ সালে এমজিএনরেগা আইনে পঞ্চায়েতকেই কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালনের অধিকার দেওয়া হয়েছে। তৃণমূল সরকারের সৌজন্যে এরাজ্যে রেগা প্রকল্পের অন্তর্গত শ্রমদিবস কমছে। পশ্চিমবাংলায় ‘রেগা’ তালিকা থেকে এই কয়েক বছরে প্রচুর নাম বাদ দেওয়া হয়েছে। বিরামহীনভাবে গরিবের নাম রেগা তালিকা থেকে কেটে দেওয়া হচ্ছে। জব কার্ড ছাঁটাইয়ের এই কর্মসূচি বিজেপি সরকারের। এই কাজে সেরা পশ্চিমবঙ্গ। এমন অনেকের নাম বাদ গিয়েছে, যাঁরা আদৌ ‘ভুয়ো’ নয়। তৃণমূলের সমর্থক নন বলে রেগায় কাজ পাননি এই সংখ্যাটি অনেক। আবার একই আধার কার্ডে দুই তিনটি জব কার্ড করা হয়েছে। তৃণমূলের আমলে প্রচুর ভুয়ো জব কার্ড তৈরি হয়েছে। এই ভুয়ো জব কার্ডগুলি দিয়ে রেগার টাকা লুট হচ্ছে।
মনরেগা প্রকল্পের কাজে পশ্চিমবাংলায় ব্যাপক দুর্নীতি চলছে। ভুয়ো জব কার্ড, কাজ না করেই টাকা লুট হচ্ছে। অনেকক্ষেত্রে যে সমস্ত শ্রমিককে কাজ দেওয়া হয়েছে বলে তালিকায় নাম রয়েছে সেই নামের ব্যক্তির কোনো অস্তিত্বই নেই। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ করলেও তদন্তের বদলে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা হয় প্রশাসনিক স্তরে। এখনও অভিযোগ পাওয়া যায় - যে জব কার্ডগুলি ব্যবহার করা হয়েছে, বিভিন্ন জেলা শাসকের দপ্তরে অভিযোগ জমা পড়ার পর সেগুলি সার্ভার থেকেও সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন পেমেন্ট ডিটেলস ঘাটলে দেখা যায়, একটি নামকেই বারবার বিভিন্ন পরিবারের সদস্য হিসাবে দেখানো হয়েছে। মাস্টার রোলের অসংগতি ধরা পড়ছে বিভিন্ন জেলায়। এখান থেকেই পরিষ্কার হয়, কোনো কাজ না করেই আত্মসাৎ করা হয়েছে বরাদ্দের টাকা।
সবচেয়ে বড় সমস্যা - কাজ অনুযায়ী সম্পূর্ণ মজুরি দেওয়া হচ্ছে না। অনেক ক্ষেত্রেই তা বকেয়া থেকে যাচ্ছে। অনেকে তাঁদের প্রাপ্য মজুরি পান না। কোথাও ১৫ দিনের বাকি পড়ছে আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে তিন মাস পর্যন্ত মজুরি বাকি থাকছে। আইনে, “প্রত্যেকটি অদক্ষ, অর্ধদক্ষ এবং দক্ষ শ্রমিক আইন অনুযায়ী নির্দিষ্ট হারে মজুরি পাবেন” বলা থাকলেও তা অনেক ক্ষেত্রে কার্যকর হচ্ছে না।
একজন লোকের নামে একাধিক জব কার্ড - এমন অভিযোগের পাহাড় জমেছে। শ্রমিকরা কাজ করতে গিয়ে আঘাত পেলে তাঁদের চিকিৎসার কোনোরকম ব্যবস্থা করা হয় না। মাস্টার রোল ও জব কার্ড-এ শ্রমিক উপস্থিতির সংখ্যা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বাড়িয়ে লেখা হয়। অর্থাৎ যত শ্রমিক কাজ করেন তার থেকেও অনেক বেশি শ্রমিকের নাম তোলা হয়।
পোস্ট অফিসে অ্যাকাউন্ট খুলে দেওয়ার নামে অনেক শ্রমিকের কাছে ঘুষও নেওয়া হয়। কাজের জায়গায় কোনোরকম নোটিশ টাঙানো হয় না। প্রতিবন্ধীদের কাজ দেওয়া হয় না। মহিলাদের ক্ষেত্রেও ওই একই কথা প্রযোজ্য। বছরের পর বছর পেরিয়ে যাওয়ার পরও এমন বহু পরিবার আছে, যাঁদের জব কার্ড থাকা সত্ত্বেও কোনো কাজে নিযুক্ত করা হয়নি। এমনকি তাঁদের আবেদনপত্রও গ্রহণ করা হয়নি। যাদের বেকার ভাতা পাবার কথা তাদের সঙ্গে প্রতারণা করা হয়। বেশিরভাগ জব সাইটেই শ্রমিকদের জব কার্ড দালালদের কাছে গচ্ছিত থাকে।
অভিযোগ উঠে আসে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পরিবারের যিনি প্রধান সদস্য, তার নামই মাস্টার রোল-এ তোলা হয়। অথচ কাজ করেছেন পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা। তাঁদের কোনো উল্লেখ মাস্টার রোলে থাকে না। অনেক ক্ষেত্রে মহিলা শ্রমিকদের মজুরিও পরিবারের প্রধান সদস্যদের নামেই দেওয়া হয়। মাস্টার রোলে একই লোকের নাম একাধিকবার তোলার একাধিক দৃষ্টান্ত আছে।
মনরেগা প্রকল্পের কাজে ঠিকাদার নিয়োগ আইনত নিষিদ্ধ। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে ঠিকাদারদের দিয়ে কাজ করানো হয়। এই ঠিকাদাররা কাজের ক্ষেত্রে নানা কারচুপি করে। দুর্নীতির ঘটনা ঘটছে। এমনও দেখা যায়, নির্ধারিত মজুরির জন্য যে পরিমাণ কাজ করার কথা, ঠিকাদাররা সেক্ষেত্রে বেশি পরিমাণ কাজ করিয়ে নেয়। মজুরি কম দেয়। আবার ঠিকাদাররা মহিলাদের কাজ দিতে অনিচ্ছুক।
জাতীয় গ্রামীণ কর্মনিশ্চয়তা আইনে কর্মপ্রার্থীদের তালিকা প্রকাশ, জব কার্ডের নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ, সোশ্যাল অডিটের ব্যবস্থা থাকলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তা করা হয় না। সামাজিক নিরীক্ষণ বা সোশ্যাল অডিটের মতো হাতিয়ারকে অনেক ক্ষেত্রে অকার্যকর রাখা হয়।
আসলে মোদী এবং মমতা কেউই চান না এই প্রকল্পটি চলুক। জাতীয় গ্রামীণ কর্ম নিশ্চয়তা আইনকে ভিত্তি করে দরিদ্র জনসাধারণের ক্ষমতায়ন ঘটানো সম্ভব। ফলে ১০০ দিনের বদলে ২০০ দিনের কাজ এবং মজুরি বাড়ানোর দাবিতে আন্দোলন গড়ে উঠছে। করোনা উদ্ভূত পরিস্থিতিতে মানুষকে বাঁচানোর জন্য এই প্রকল্পকে শহরাঞ্চলেও প্রসারিত করা প্রয়োজন।