৬০ বর্ষ ৪ সংখ্যা / ২ সেপ্টেম্বর, ২০২২ / ১৬ ভাদ্র, ১৪২৯
দুর্নীতি অপশাসনের বিরুদ্ধে মিছিল-সমাবেশে উত্তাল রাজ্য
পূর্ব মেদিনীপুরের নিমতৌড়িতে সিপিআই(এম)’র আইন অমান্যে জনস্রোত।
নিজস্ব সংবাদদাতাঃ এরাজ্যের তৃণমূল সরকারের সীমাহীন দুর্নীতি-অপশাসন ও নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে সিপিআই(এম) সহ বামপন্থীদল ও বিভিন্ন গণসংগঠনের ডাকে মিছিল-সমাবেশে উত্তাল রাজ্য। রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে এখন ‘চোর ধরো জেল ভরো’ - এই দাবিকে সামনে রেখে যেমন জেলায় জেলায় মিছিল-বিক্ষোভ-সমাবেশ ইত্যাদি সংগঠিত হচ্ছে, তেমনি পঞ্চায়েতে দুর্নীতি, ১০০ দিনের কাজের প্রাপ্য আদায় সহ পঞ্চায়েতের বিভিন্ন প্রকল্পের কাজ চালু করা এবং ন্যায্য দাবি-দাওয়ার ভিত্তিতে পঞ্চায়েত ও ব্লকস্তরে ডেপুটেশন, বিক্ষোভ, সমাবেশ ইত্যাদিতে ব্যাপক অংশের মানুষের ঢল নামছে। সম্প্রতি পূর্ব মেদিনীপুর জেলার নিমতৌড়ি, হাওড়ার সাকঁরাইল, উত্তরবঙ্গের শিলিগুড়ি, বর্ধমান, পুরুলিয়া সহ রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে এমন ছবিই দীপ্ত হয়েছে।
কেন্দ্রের জনবিরোধী ও সাম্প্রদায়িক নীতির অভিঘাতে এখন বিপর্যস্ত মানুষ। চরম দারিদ্র্য, বেকারি, কর্মসংস্থানহীনতার পাশাপাশি আকাশছোঁয়া দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির আঘাতে সাধারণ মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠছে। এই পরিস্থিতিতে পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেসের সরকার রাজ্যবাসীর স্বার্থের কথা বিন্দুমাত্র না ভেবে দুর্নীতি-কেলেঙ্কারিতে সীমা ছাড়িয়েছে। শুধুমাত্র শিক্ষাক্ষেত্রে দুর্নীতিতেই দেখা যাচ্ছে, তৃণমূলের একেবারে সর্বোচ্চ স্তর থেকে নিচুতলা পর্যন্ত নেতা, মন্ত্রী ও দলের মাতব্বররা চাকরি দেবার নাম করে কোটি কোটি টাকা অনৈতিকভাবে কামিয়ে নিয়েছে। লক্ষ করা যাচ্ছে, এই বিশাল দুর্নীতিতে প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরাও পুরোপুরিভাবে শাসকদলের দোসর হিসেবে কাজ করেছে।
এসবের বিরুদ্ধে বামপন্থীরা যেমন দীর্ঘদিন ধরে রাস্তায় লড়াই-আন্দোলন সংগঠিত করেছেন, তেমনি আইনি লড়াইও চালিয়ে যাচ্ছেন। এর ফলে ইতিমধ্যেই তৃণমূল দলের শীর্ষ নেতা-মন্ত্রীসহ অনেককে হাজতবাস করতে হয়েছে। রাজ্যে শাসকদলের নেতা-মন্ত্রীদের অনৈতিকভাবে আয় করা কোটি কোটি টাকা ও সম্পত্তির হদিশ মিলেছে। সিবিআই-ইডি’র তদন্তে প্রায় প্রতিদিনই শাসকদলের বিভিন্ন স্তরের নেতা-মন্ত্রীদের বেনামি সম্পত্তির খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে।
লক্ষণীয় দিক হলো, কেন্দ্রীয় সংস্থার তদন্তে কেবল শিক্ষাক্ষেত্রে দুর্নীতির মাধ্যমেই নয়, গোরু ও কয়লা পাচার চক্রের সঙ্গেও তৃণমূলের নেতা-মন্ত্রীদের প্রত্যক্ষ সংযোগের প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। এমনকী দলের সর্বময়ী নেত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রী এবং তাঁর ভাইপো-দলের শীর্ষ নেতারও এই সমস্ত দুর্নীতির সঙ্গে যোগসূত্র রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এই সমস্ত ঘটনা সূত্রে এটাই প্রকট হয়ে উঠেছে যে, গোটা তৃণমূল দল ও সরকার দুর্নীতির পাঁকে জড়িয়ে রয়েছে। সিবিআই-ইডি কখন কাকে তলব করে - এখন গোটা তৃণমূলের অভ্যন্তরে এই আতঙ্কই তাড়া করে বেড়াচ্ছে।
এই সমস্ত ঘটনাকে সামনে রেখেই প্রতিবাদী মিছিল-বিক্ষোভ সমাবেশে এখন রাজ্য জুড়ে লালঝান্ডার প্লাবন বইছে। গত ২৩ আগস্ট সিআইটিইউ, সারা ভারত কৃষক সভা ও খেতমজুর ইউনিয়নের ডাকে ‘চোর ধরো জেল ভরো’ - এই স্লোগানের ভিত্তিতে পূর্ব মেদিনীপুর জেলা শাসকের দপ্তর অভিযান ও আইন অমান্য কর্মসূচি সংগঠিত হয়। এই কর্মসূচিতে জেলার বিভিন্ন প্রান্তের হাজার হাজার শ্রমজীবী ও কৃষিজীবী মানুষের মিছিলে উত্তাল হয় রাজপথ। এদিনের এই দীর্ঘ মিছিল আটকাতে পুলিশ ব্যারিকেড তৈরি করে জল কামান নিয়ে আক্রমণাত্মক ভূমিকা নিলেও অকুতোভয় হাজারো প্রতিবাদী মানুষের তীব্র প্রতিরোধে পুলিশ পিছু হটে। মিছিল আটকাতে পুলিশকর্মীরা ইটের টুকরো ছোড়ে। আহত হন প্রায় ৫০ জনেরও বেশি শ্রমজীবী মানুষ। পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ও জলকামান দিয়েও মিছিলকে ছত্রভঙ্গ করতে চেষ্টা করে। কিন্তু তারা ব্যর্থ হয়।
এদিনের এই কর্মসূচির জেরে হলদিয়া-মেচেদা ১১৬ নম্বর জাতীয় সড়ক এক ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। মিছিলে অংশ নেন সিপিআই(এম) নেতা সুজন চক্রবর্তী, অনাদি সাহু, নিরঞ্জন সিহি, হিমাংশু দাস সহ বিভিন্ন গণসংগঠনের নেতৃবৃন্দ।
এদিনের এই কর্মসূচির আগে এক সভায় সুজন চক্রবর্তী বলেন, এই যা চুরি, দুর্নীতি চলছে রাজ্যে, তার মূল মাথা কালীঘাটের টালির চালায় রয়েছে। সেই মাথাকে গ্রেপ্তার করা পর্যন্ত এই লড়াই চলবে। তিনি বলেন, এমন একটা সরকার চলছে, যে সরকারের মন্ত্রীরা দুর্নীতির দায়ে জেলে রয়েছে। এমন দিন বাংলা দেখেনি।
অনাদি সাহু বলেন, দেশের বিজেপি সরকার ও রাজ্যে তৃণমূল সরকারের সময়ে ব্যাপক মূল্যবৃদ্ধি, বেকারত্ব, সীমাহীন দুর্নীতি চলছে। দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত সম্পদ বিক্রি করে দিচ্ছে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার। লক্ষাধিক শূন্যপদে নিয়োগ হচ্ছে না। এরাজ্যের সরকার বেকারদের কর্মসংস্থানের কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ না করে দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দিচ্ছে। এই অবস্থার পরিবর্তন করতে হবে।
নিরঞ্জন সিহি তাঁর বক্তব্যে পূর্ব মেদিনীপুর জেলায় জেলা শাসক এবং বিডিও কীভাবে শাসকদলকে বিভিন্ন স্তরে দুর্নীতিতে মদত দিচ্ছে তার উল্লেখ করেন। খেতমজুর ইউনিয়নের নেতা হিমাংশু দাসের সভাপতিত্বে এই সভায় অন্যান্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন সিআইটিইউ-র জেলা সম্পাদক সুব্রত পন্ডা, কৃষক সভার জেলা সম্পাদক সত্যরঞ্জন দাস।
এদিনের এই জনস্রোত আগামীদিনে জেলা জুড়ে আরও তীব্র গণ-আন্দোলন গড়ার বার্তা দেয়।
২৫ আগস্ট হাওড়ার সাঁকরাইলের এক বিশাল সমাবেশে সিপিআই(এম) রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম বলেছেন, বিজেপি এবং তৃণমূল এই দুই ফুল মিলে মানুষের জীবনে যে বিপর্যয়, সংকট নামিয়ে এনেছে তার বিরুদ্ধে লাল ঝান্ডার নিচে মানুষকে একত্রিত করে লাগাতার লড়াই-আন্দোলন চালাতে হবে, যাতে দুই সরকারই পিছু হটতে বাধ্য হয়।
মাত্র চারদিন আগে যেখানে সিপিআই(এম) কর্মীদের পথসভা বানচাল করতে তৃণমূল এবং পুলিশ যৌথভাবে হামলা চালিয়েছিল, সেখানেই পার্টির ডাকে এদিন বিরাট সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। তৃণমূল বিধায়ক প্রিয়া পালের নেতৃত্বে দুষ্কৃতী বাহিনীর হামলায় আহত হয়েছিলেন সিপিআই(এম) এরিয়া কমিটির সম্পাদক সমীর মালিক সহ অন্যান্য কর্মীরা। এর প্রতিবাদে পথ অবরোধ করলে পুলিশ সিপিআই(এম) কর্মীদের ওপর হামলা চালিয়েছিল।
২৫ আগস্ট সেখানেই কয়েক হাজার মানুষের সমাবেশে মহম্মদ সেলিম বলেছেন, দলদাসে পরিণত পুলিশ চোর, খুনি, তৃণমূল নেতাদের নিরাপত্তায় ব্যস্ত। তারা বলছে চুরি করো, কিন্তু চোর ধরার দাবিতে সভা করা যাবে না। কিন্তু জনগণের সমাবেশ প্রমাণ করছে, মানুষের প্রতিবাদ পুলিশ দিয়ে দমন করা যাবে না।
সিপিআই(এম) হাওড়া জেলা কমিটির ডাকে ডেল্টা জুট মিল খোলার দাবিসহ পার্টিকর্মীদের ওপর আক্রমণকারীদের গ্রেপ্তার ও শাস্তির দাবিতে এবং দুর্নীতির প্রতিবাদে সাঁকরাইলের সারেঙ্গার পোলে এই প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। ব্যাপক জনসমাগম হয়েছিল এদিনের সভায়। পার্টির জেলা সম্পাদক দিলীপ ঘোষের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এদিনের সভায় অন্যান্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন পার্টি নেতা পরেশ পাল, নন্দলাল মুখার্জি, অপর্ণা দত্ত, সমীর মালিক প্রমুখ।
তৃণমূলের দুর্নীতি ও অপশাসনের বিরুদ্ধে ২৬ আগস্ট শিলিগুড়ি কর্পোরেশন অভিযানে অগণিত মানুষ অংশ নিয়ে তাঁদের প্রতিবাদ-ক্ষোভ উগড়ে দিয়েছেন। সিপিআই(এম) দার্জিলিং জেলা কমিটির ডাকে এদিনের এই কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে ব্যাপক সারা পড়ে। পানীয় জল, নিকাশি নালা, রাস্তাঘাটসহ বিভিন্ন পরিষেবা ও উন্নয়নের প্রশ্নে এই শিলিগুড়ি কর্পোরেশন এলাকার সর্বস্তরের মানুষের মিছিলে উত্তাল হয় শহর। ‘ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করো শিলিগুড়িকে’ _এই দৃপ্ত স্লোগানে এয়ারভিউ মোড় থেকে হিলকার্ট রোড ধরে কর্পোরেশন অভিমুখে লাল পতাকার উত্তাল মিছিল যত এগিয়েছে, ততই সাড়া মিলেছে মানুষের।
এদিন প্রচণ্ড দাবদাহের মধ্যে দীর্ঘ আড়াই-তিন কিলোমিটার মিছিলের পথ অতিক্রম করে ছাত্র, যুব, মহিলা, শিক্ষক, কর্মী, বস্তি ও কলোনিবাসীসহ অগণিত মানুষ পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙে তৃণমূলের দুর্নীতির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখান। এদিনের এই কর্মসূচিতে শামিল ছিলেন সিপিআই(এম) নেতা অশোক ভট্টাচার্য, জীবেশ সরকার, পার্টির জেলা সম্পাদক সমন পাঠক, নুরুল ইসলাম, জয় চক্রবর্তী প্রমুখ।
৩১ আগস্ট পুলিশের আক্রমণকে রুখে দিয়েই বর্ধমান শহরে আইন অমান্য আন্দোলনে শামিল হন অগণিত মানুষ। এদিন ‘চোর ধরো জেল ভরো’ এই স্লোগানে মুখরিত দু’টি মিছিল শহরকে প্লাবিত করে। বর্ধমান স্টেশনের সামনে থেকে, অপরটি বড়োনীলপুর মোড় থেকে দু’টি সুবিশাল মিছিল জেলাশাসকের দপ্তর অভিমুখে যাত্রা করে। মিছিল কার্জন গেটের সামনে পৌঁছাতেই শুরু হয় পুলিশি আক্রমণ। টিয়ারগ্যাস, জল কামান ছুঁড়ে মিছিল আটকানোর চেষ্টা করে পুলিশ। এই প্রতিরোধ সত্ত্বেও ব্যারিকেড ভেঙে ফেলে বিক্ষোভকারীরা। পুলিশের লাঠির আঘাতে আহত হন অনেকে।
এদিনের মিছিলে পার্টিনেতা আভাস রায়চৌধুরী, অচিন্ত্য মল্লিক, অমল হালদার, জেলা সম্পাদক সৈয়দ হোসেন অঞ্জু কর সহ অনেকেই পা মেলান।
এদিনের এই কর্মসূচিতে উপস্থিত পার্টির রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম পুলিশের আক্রমণের তীব্র নিন্দা করে বলেছেন, যে পুলিশ চোরদের পাহারা দেয় এবং বেআইনি পাচারে সাহায্য করে সেই পুলিশই আজ গণতান্ত্রিক আন্দোলনে নৃশংস আক্রমণ চালিয়েছে। পুলিশের আক্রমণে আমাদের কয়েকশো বিক্ষোভকারী আহত হয়েছেন। বৃদ্ধ এবং মহিলাদেরও মারা হয়েছে। কার নির্দেশে বর্ধমানের পুলিশ এই ঘটনা ঘটিয়েছে? এর দায় কে নেবে?
এভাবে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে যখন তৃণমূল দল ও সরকারের বিরুদ্ধে মিছিল-সমাবেশে রাজ্যের উত্তাল পরিবেশে সিপিআই(এম) রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন - এক মাসের মধ্যে গ্রাম সংসদ সভা না বসালে মানুষই তা বসাবে। মানুষের ক্ষোভের পারদ চড়ছে বুঝে দুর্নীতির ফাসে আটকে শেষ পর্যন্ত গ্রাম সংসদ সভা করার উদ্যোগ নিচ্ছে রাজ্য সরকার। জানা গেছে, আগামী নভেম্বর মাসেই গোটা রাজ্যের ৩,৩৪১টি গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রতিটি সংসদে সভা অনুষ্ঠিত হতে চলেছে।
বর্তমানে দুর্নীতির ইস্যুতে তোলপাড় রাজ্য। শাসকদলের প্রথম সারির নেতা ও মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে কোটি কোটি টাকার দুর্নীতি ক্রমশ প্রকাশ্যে আসছে। ১০০ দিনের কাজ সহ অন্যান্য নানা প্রকল্পে পঞ্চায়েতে ব্যাপক দুর্নীতি হয়েছে। এখন আগামী পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে নিজেদের মুখ রক্ষা করতে গ্রাম সংসদ সভার জন্য প্রশাসনিক নির্দেশ জারি করতে বাধ্য হচ্ছে রাজ্য সরকার।
এই পরিপ্রেক্ষিতে মহম্মদ সেলিম বলেছেন, এতদিন পরে টনক নড়েছে রাজ্য সরকারের। এটা একধাপ এগোলো। আরও জোরদার করতে হবে আন্দোলনকে। মানুষের জন্য বরাদ্দ টাকার হিসেব দিতেই হবে।