৬০ বর্ষ ৪ সংখ্যা / ২ সেপ্টেম্বর, ২০২২ / ১৬ ভাদ্র, ১৪২৯
মূল্যবৃদ্ধি, বেকারি ও সাধারণ মানুষের বেঁচে থাকা
ঈশিতা মুখার্জি
সর্বশেষ পাওয়া সরকারি তথ্যে জানা যাচ্ছে যে, ২০২১ সালের থেকে এবছরের এপ্রিল মাসে দেশে পাইকারি পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির হার বেড়েছিল ১৫.০৮ শতাংশ যা গত ১৬ বছরে রেকর্ড। দেশের মানুষ যে দামে তাঁদের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যগুলি কেনেন, তার জন্য যে খুচরো বাজার সেখানে মূল্যবৃদ্ধির হার ২০২২ সালের প্রথম আট মাসেই সহ্যশক্তির বাইরে চলে গেছে। এই সহ্যশক্তির পরিমাপ কিন্তু দেশের রিজার্ভ ব্যাঙ্ক বেঁধে দিয়েছে - তা হলো ৬ শতাংশ হারে বৃদ্ধি। চলতি বছর শুরু হতেই দেশের মূল্যবৃদ্ধির হার এই সহ্যশক্তির বাইরে চলে গেছে। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক নিজেই জানিয়েছে যে, দেশের মূল্যবৃদ্ধি এই সহ্যশক্তির বাইরে চলে গেছে। দেশের রিজার্ভ ব্যাঙ্ক নিজেই তাদের প্রকাশিত রিপোর্টে জানিয়েছে যে, এই মূল্যবৃদ্ধির বেশিরভাগটাই খাদ্য এবং জ্বালানি তেল অর্থাৎ পেট্রল, ডিজেলের জন্য। এই তথ্য কিন্তু সবটাই সরকারি তথ্য; দেশের বিজেপি-আরএসএস সরকারের এই তথ্যকে অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। এই তথ্য তো স্পষ্টই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে যে, দেশের সাধারণ মানুষের বেঁচে থাকা বর্তমানে খুবই কঠিন। এই তথ্য তো পরিষ্কার করে জানাচ্ছে যে, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যগুলি বাজার থেকে কেনা সাধারণ মানুষের পক্ষে প্রতিদিন আরও কঠিন হয়ে উঠছে। এর সাথে রয়েছে রেকর্ড হারে বেকারি। তাহলে দেশের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা, বাজার থেকে পণ্য কেনার সামর্থ্য মারাত্মকভাবে আক্রান্ত হয়েছে। দেশের মানুষের জীবনযাত্রার মান ক্রমাগত নিচে নামছে, বলা যেতে পারে সহ্যশক্তি অতিক্রম করে যাচ্ছে।
দেশের প্রধানমন্ত্রী আস্ফালন করে বলছেন যে, দেশ অর্থনৈতিকভাবে এগোচ্ছে। কিন্তু দেশের মানুষের কেনার ক্ষমতা যদি কমে যায়, তাহলে জিনিষপত্রের চাহিদা বাড়বে কী করে? চাহিদা না বাড়লে পণ্য কী আদৌ উৎপাদন হবে? বিক্রি কমলে পণ্য উৎপাদন হওয়া সম্ভব? এই সব প্রশ্নের উত্তর দেশের মানুষ জানলেও তা সোচ্চারে অস্বীকার করছে বিজেপি আরএসএস সরকার। এই চাহিদা কমার জন্য শিল্পপণ্য উৎপাদন কমে আসছে। এর ফলে বেকারি আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে। চাহিদা আরও আরও কমে যাচ্ছে। ক্রমাগতই নিচের দিকে টানছে দেশের অর্থনীতিকে এই মূল্যবৃদ্ধির হার। এই মূল্যবৃদ্ধির কারণ মূলত খাদ্য ও পেট্রল-ডিজেলের দাম। সম্প্রতি পণ্য পরিষেবা করের হার পরিবর্তন করে এই খাদ্য, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে সরকার। সরকার যদি দেশের মানুষের জীবনযাত্রার মান নিয়ে চিন্তিত থাকত তাহলে এইভাবে এই হারে পণ্য পরিষেবা কর নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের উপর তারা বসাতো না। এর ফলে জিনিষপত্রের দাম আরও বাড়ছে। পণ্য পরিষেবা কর বা জিএসটি হারের সর্বশেষ পরিবর্তন এই বিপজ্জনক দিকেই এগিয়েছে। এর ফলে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যগুলি আরও বেশি করে সাধারণ মানুষের হাতের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে এবং চলে যেতেই থাকবে। এই ব্যবস্থা দেশের মানুষের বেঁচে থাকা দিনে দিনে দুঃসহ করে তুলছে। এই দুঃসহ করে তোলার যন্ত্রণা থেকে সামান্যতম স্বস্তির কথাও কোথাও নেই - এটাই সবচেয়ে ভয়াবহ কথা।
কেমন আছেন দেশের মানুষ এই পরিস্থিতিতে এই বিষয় জানার জন্য লোকাল সার্কেল নামে একটি সামাজিক মাধ্যম গত মে মাসে দেশের গ্রাম শহরে ২৩,৫০০ জনের উপর একটি সমীক্ষা করেছিল। সেই সমীক্ষায় জানা যায় যে, ৯২ শতাংশ দেশের মানুষ জানিয়েছে যে, গত তিন মাসে তাদের সংসার চালানোর মাসিক খরচ বেড়ে গেছে। ৭০ শতাংশ মানুষ জানিয়েছে খরচ বেড়েছে ১০ শতাংশ। মাত্র ২ শতাংশ মানুষ জানিয়েছে যে, এই মূল্যবৃদ্ধি তাদের দুশ্চিন্তার কারণ নয়। বোঝাই যায় যে এই ২ শতাংশ হলো ধনী বা অতি ধনী পরিবারগুলি। আয়ের বৈষম্য এত বৃদ্ধি পেয়েছে যে ধনী এবং অতি ধনীর আর্থিক উন্নতি অশ্লীলভাবে চোখে পড়ার মতো দেশের সাধারণ মানুষের আর্থিক বিপন্নতার পাশাপাশি। সরকার তো পণ্য পরিষেবা করের হার পরিবর্তন করেছিল তাদের রাজস্ব আয়ের জন্য। সদ্য গজিয়ে ওঠা ধনী এবং অতি ধনীদের উপর কি প্রত্যক্ষ করের হার বাড়িয়ে সে রাজস্ব আয় করা যেত না? সিপিআই(এম) সহ বামপন্থী দলগুলি অতিমারীর সময় থেকে বার বার সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছে যে, সাধারণ মানুষের উপর করের বোঝা যেমন পণ্য পরিষেবা কর ইত্যাদি না চাপিয়ে রাজস্ব আয় করার জন্য ধনী ও অতি ধনীদের উপর কর চাপালে দেশের সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায় কিছুটা স্বস্তি আসে। কিন্তু সরকার সে পথে হাঁটেনি। পণ্য পরিষেবা কর কমিশন যে নতুন সিদ্ধান্তগুলি নিল একমাত্র রাজস্ব আয়ের কথা মাথায় রেখে এবং আর কোনো কিছু মাথায় না রেখে তাতে বেশ কয়েকটি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম তো নতুন করে বাড়লই, তার উপর যে সব পণ্যে জিএসটি ছাড় ছিল সেই পণ্যগুলিকেও জিএসটি’র আওতায় নিয়ে আসা হলো। প্যাকেট করা চাল, গম, আটা, চিনি সব কিছুর উপর বসে গেল ৫ শতাংশ কর! ছোটো দোকানে প্যাকেট করা আটা, মুড়ি, দই, লস্যি, দানাশস্য, ডাল এরকম সবকিছুই বিভিন্ন ব্র্যান্ডের অর্থাৎ কোম্পানি থেকে উৎপন্ন খাদ্যপণ্যের মতো সমানহারে কর চালু হয়ে গেল। চামড়া, জুতো ইত্যাদির উপর করের হার ৫ শতাংশ থেকে ১২ শতাংশ করা হলো। লেখার কালি, পেনসিল কাটার কল, ছুড়ি, চামচ, ধাতব পদার্থের ইলেকট্রিক সার্কিট এই সব কিছুর উপর করের হার ১২ শতাংশ থেকে বেড়ে ১৮ শতাংশ হলো। এলইডি আলো, সৌর চুল্লি, বায়ো মেডিক্যাল বর্জ্য নিরোধক প্রযুক্তি, এ সব কিছুরই ১২শতাংশ থেকে ১৮ শতাংশ করের আওতায় নিয়ে আসা হলো। ৫০০০ টাকার বেশি আইসিইউ ছাড়া হাসপাতালের ঘরের উপর চেপে গেল ৫ শতাংশ কর, যা কীনা অতীতে করের আওতার বাইরে ছিল। এভাবেই জিএসটি’র আওতার বাইরের পণ্যগুলিকে একে একে ছাড়ের থেকে বাইরে নিয়ে এল সরকার এবং করের বোঝা চাপিয়ে দিল। কর বসল ১৮ শতাংশ হারে ব্যঙ্কের চেক বইয়ের উপর, চেকের পাতার উপর। যে পরিষেবাগুলি এই করের আওতায় চলে এল, তা হলো রাস্তা, ব্রিজ, রেল, মেট্রো পরিবহণ এবং শ্মশানের চুল্লি। কর বসল ১৮ শতাংশ হারে। অথচ পেট্রল, ডিজেলকে এই পণ্য পরিষেবা করের আওতার বাইরে রাখা হলো। মূল্যবৃদ্ধির উপরে এই হারে পণ্য-পরিষেবা কর বসালে মানুষের জীবন যে দুঃসহ হয়ে উঠবে এ কথা কি সরকারের উপদেষ্টা, মন্ত্রীবর্গ কেউ বুঝতে পারেনি? নিশ্চয়ই বুঝেছে। তাহলে যে দেশে বেকারত্ব দিনে দিনে বাড়ছে, নতুন বেকার তৈরি হচ্ছে, সেই দেশে এই নীতি পৃথিবীর কোনো দেশ নিয়েছে?
এই নীতি কি দেশকে কখনো এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে? দেশের সরকার যাই ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখাক না কেন, ব্লুমবার্গ আন্তর্জাতিক সংস্থা গত জুলাই মাসে জানিয়েছে, ভারতের পরিষেবা কর্মকাণ্ড পিছিয়ে পড়েছে ভীষণভাবে। বিদ্যুতের ব্যবহার, কয়লার ব্যবহারে ঘাটতি হচ্ছে, অর্থাৎ শিল্পে উৎপাদন নিচের দিকে নামার পথে। মূল্যবৃদ্ধি দেশকে আর্থিকভাবে পিছনে টানছে।
সম্প্রতি পাওয়া রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে যে, দেশের গড় মূল্যবৃদ্ধির হার ৬.৮ শতাংশ অর্থাৎ সহনীয় হারের চেয়ে সামান্য উপরে হলেও ১৪টি রাজ্যে এই হার অনেক বেশি। এর মধ্যে রয়েছে পশ্চিমবঙ্গ। পশ্চিমবঙ্গে ভোগ্যপণ্যের মূল্যসূচক ৮.০৬ শতাংশ। মূল্যবৃদ্ধির হারে সমস্ত রাজ্যের মধ্যে এ রাজ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ মূল্যবৃদ্ধির হার। রাজ্যে মজুতদার এবং ফাটকাবাজের বাড়বাড়ন্তও এই হারের জন্য দায়ী। মূল্যবৃদ্ধি হলেও একদিকে কৃষক, অন্যদিকে ছোটো শিল্পোদ্যোগী কেউই কিন্তু দাম পায় না। মাঝখানে দাম পেয়ে যায় অসাধু ব্যবসায়ীরা যার বাড়বাড়ন্ত এই রাজ্যে।
এই মূল্যবৃদ্ধির হার ৬ শতাংশ হলে সহনীয় বলেছে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক। কিন্তু এই তীব্র বেকারির মধ্যে আসলে সহনীয় হার আরও অনেক কম। দেশে ২০-২৪ বছর বয়স্ক যুবদের মধ্যে বেকারির হার ৪২ শতাংশ। আমাদের দেশের কর্মক্ষম যুবদের মধ্যে ৬১.২ শতাংশ আর কাজ খোঁজে না - কেন্দ্রীয় পরিসংখ্যান দপ্তর এরকমই জানাচ্ছে। গত আট বছরে সরকারি চাকরি করে এই সংখ্যা এইরকম চাকরিপ্রার্থীদের মাত্র ০.৩৩ শতাংশ। সরকারি শূন্য পদের চাকরির বিজ্ঞাপন হয়নি বহুদিন। বেসরকারিকরণের ঢেউতে চাকরি সংকুচিত। সেনাবাহিনীতে চালু হলো অগ্নিবীর প্রকল্প যেখানে মাত্র চার বছরের জন্য কর্মসংস্থান নিশ্চিত এবং তার বাকি জীবনের জন্য চাকরি অনিশ্চিত। এরকমভাবেই রূপান্তরিত হয়ে যাচ্ছে সরকারি চাকরি। এই স্বল্প চাকরি, বেকারির পরিপ্রেক্ষিতে মূল্যবৃদ্ধি অসহনীয়। বাড়ছে অভুক্ত মানুষ, বাড়ছে অপুষ্টি, বাড়ছে অসুস্থতা। কীভাবে এগোবে এই দেশ? পুঁজিবাদী দেশ পর্যন্ত তার নিজের দেশের নাগরিকের দারিদ্র্যকে এক সহনীয় মাত্রার মধ্যে ধরে রাখে পুঁজির মুনাফা লুটে নেওয়ার জন্য। কিন্তু আমাদের দেশে ফ্যাসিবাদী অর্থনীতি একমুখীভাবে কোটিপতি করপোরেটের পায়ের তলায় নিজেকে সঁপে দিয়েছে। তাই কোনভাবেই সাধারণ মানুষের দিকে তার তাকানোর কোনো পরিকল্পনা, অ্যাজেন্ডাই তাদের নেই।
এই অর্থনীতি দেশদ্রোহিতার অর্থনীতি। এই অর্থনীতি আমাদের সার্বভৌমত্ব ভুলিয়ে দেওয়ার অর্থনীতি। এই অর্থনৈতিক নীতির মতো জনবিরোধী নীতি দেশ স্বাধীন হওয়ার পর গৃহীত হয়নি। দেশের বেশিরভাগ মানুষকে বাঁচতে হলে এই নীতি বদল করতেই হবে।