৬০ বর্ষ ৪ সংখ্যা / ২ সেপ্টেম্বর, ২০২২ / ১৬ ভাদ্র, ১৪২৯
রাজনৈতিক প্রতিহিংসা ও ষড়যন্ত্রের দীর্ঘ পথ পার হয়ে কারামুক্ত ফুল্লরা মণ্ডল
কমিউনিস্ট আন্দোলনের এক উজ্জ্বল উদাহরণ
সুশান্ত ঘোষ
জেল থেকে মুক্ত হওয়ার পর। ফুল্লরা মণ্ডলকে নিয়ে মিছিল, সংবর্ধনা।
২০১১ সালের ৭ জানুয়ারি তৎকালীন অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলার লালগড় থানার অন্তর্গত কাঁসাই নদীর কোলে অবস্থিত নেতাই গ্রামে মাওবাদী এবং তৃণমূল কংগ্রেসের যৌথ পরিকল্পনায় পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট সরকার উৎখাত করার জন্য যে কুখ্যাত ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল এবং সেই ষড়যন্ত্রের ঘটনা ঘটার সাথে সাথে সংবাদমাধ্যম এবং তথাকথিত পরিবর্তনপন্থী ভাড়াটে বুদ্ধিজীবীদের ভয়ঙ্কর রকমের বামবিদ্বেষী আক্রমণ, কুৎসা এবং অপপ্রচারে প্রকৃত ঘটনার বিষয়টি মানুষের কাছে পৌঁছায়নি। যা পৌঁছায় তা হলো - ‘‘এই মৃত্যুর জন্য দায়ী একমাত্র সিপিআই(এম)’’। যথারীতি আদালতে মামলা হলো, মামলায় অভিযুক্ত ২০ জনের মধ্যে একমাত্র মহিলা নেত্রী কমরেড ফুল্লরা মণ্ডল। সেই মামলার তদন্তভার প্রথমে গেল সিআইডি’র হাতে। তদন্তের প্রথম অবস্থায় এলাকার সাধারণ পার্টি কমরেডরা গ্রেপ্তার হলেন, নেতৃত্বের সকলেই আত্মগোপনে চলে যেতে বাধ্য হলেন। এমতাবস্থায়, সিআইডি’র তদন্তের ওপর ভরসা করা যায় না বলে তৃণমূল কংগ্রেস উচ্চ আদালতে গেল সিবিআই তদন্তের দাবিতে। মনে রাখা দরকার, তৃণমূল নেত্রী তখন সিবিআই-এর চরম ভক্ত। উচ্চ আদালত তদন্তভার তুলে দিল সিবিআই-এর হাতে। পরবর্তীতে ২০১৪ সালে আমাদের পার্টির নেতৃত্ব অর্থাৎ অনুজ, ডালিম সহ সকলেই গ্রেপ্তার হলেন। কিন্তু কমরেড ফুল্লরাকে সিবিআই গ্রেপ্তার করতে পারেনি। পরে পার্টির সিদ্ধান্তেই আদালতে আত্মসমর্পণ করলেন কমরেড ফুল্লরা।
ফুল্লরা মণ্ডলের রাজনৈতিক জীবন শুরু হয়েছিল নেতাই গ্রামে মহিলা সংগঠন ও পার্টি সংগঠনে সাধারণ একজন কর্মী হিসেবে। একেবারেই সাধারণ কৃষক পরিবারের সন্তান কমরেড ফুল্লরা, কৃষিকাজই ছিল পরিবারের একমাত্র জীবিকা। পারিবারিক আর্থিক অস্বছলতার মধ্যেই লেখাপড়ায় একটা জায়গায় নিজেকে পৌঁছে নিয়ে গেছিলেন ফুল্লরা। তাঁর যা শিক্ষাগত যোগ্যতা ছিল, সেই সময় যে কোনো চাকরি পাওয়া অসম্ভব ছিল না। কিন্তু চাকরি, নিশ্চিত ভবিষ্যৎ জীবন এবং পরিবারের আর্থিক স্বচ্ছলতা - এসব কোনো পিছুটানই তাঁকে পার্টি সংগঠন করার জন্য আটকে রাখতে পারেনি। এই লেখা তাঁর ব্যক্তিগত প্রচারের জন্য নয়। নিজের প্রচেষ্টা এবং কঠোর পরিশ্রমেই তিনি একদিকে যেমন জেলা পরিষদের প্রশাসকের দায়িত্ব পালনের জায়গায় পৌঁছেছিলেন, তেমনি লড়াই আন্দোলনের পথ বেয়ে অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলায় পার্টির জেলা কমিটির সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। পশ্চিমের বিস্তীর্ণ জঙ্গল এলাকায় পার্টি সংগঠন শক্তিশালী করার জন্য যে ক’জন মহিলা নেত্রী সামনের সারিতে ছিলেন তার মধ্যে প্রধানতম ছিলেন কমরেড ফুল্লরা। ওই বিস্তীর্ণ এলাকায় বাম জমানার দীর্ঘ ৩৪ বছর ধরেই বামপন্থীদের সংগঠন ছিল শক্ত ভিতের ওপরে দাঁড়িয়ে। এই শক্ত ভিতকে ভেঙে ফেলার জন্যই ২০০০ সাল থেকেই আজকের শাসকদল যারা ছিল তৎকালীন বিরোধী দল, তাদের নেতৃত্বে সকল বামবিরোধী দলকে একজোট করা হলেও, সেই কাজে তারা সফলতা লাভ করতে পারেনি। উলটে গোটা রাজ্যে নিজেরাই কোণঠাসা হয়ে যায়। কিন্তু পরবর্তীকালে কৌশল পালটে আরও হিংস্র প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির ভাড়াটে বাহিনী হিসেবে তথাকথিত মাওবাদী সংগঠনের সাথে বর্তমান শাসকদল চুক্তিবদ্ধ হয় সেই একটাই উদ্দেশ্যে - যে কোনোপ্রকারে বামফ্রন্ট সরকারের উৎখাত। এই সমঝোতা, যোগাযোগ এবং গোপন চুক্তি সবকিছুর ক্ষেত্রেই আজকের বিরোধী দলনেতা ছিলেন তখন তৃণমূল কংগ্রেসের মূল কাণ্ডারি। চুক্তি অনুযায়ী শুরু হলো জঙ্গল এলাকায় খুনের রাজনীতি - দিনে তৃণমূল আর রাতে মাওবাদী। জঙ্গল এলাকায় কিছু অনুন্নয়নের ঘটনাকে কেন্দ্র করে পরিকল্পিতভাবে বামপন্থীদের বিরুদ্ধে প্রচার সংগঠিত হয়। প্রচারে বলা হয় - সারা রাজ্যের আর্থিক অবস্থার চেয়ে বিস্তীর্ণ জঙ্গল এলাকা অনেক পিছিয়ে এবং এর জন্য অবশ্যই দায়ী সিপিআই(এম)। এমতাবস্থায় জঙ্গল এলাকার মানুষদের তাই একমাত্র মাওবাদীদের ওপরেই ভরসা করতে হবে। এই ঘৃণ্য পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই কিষেনজির মতো ভিন রাজ্যের মাওবাদী নেতার এই রাজ্যে প্রবেশ ঘটে। প্রথমে মাওবাদীদের নামে সাধারণ মানুষকে জড়ো করা সহজ হচ্ছিল না। তাই মুখোশ পরে আসরে নামে জনসাধারণের কমিটি। সেই কমিটির নেতা ছত্রধর মাহাত বর্তমানে রাজ্যের শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেসের রাজ্য সম্পাদক এবং সিপিআই(এম) কর্মী কমরেড প্রবীর মাহাতকে খুনের দায়ে এনআইএ-র দ্বারা জেলবন্দি। এই ছত্রধর মাহাত’র মোটর সাইকেলে বসেই বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী সেই সময়ে বহু সফর করেছেন জঙ্গল এলাকায়।
ভারতের কোনো স্বীকৃত রাজনৈতিক দল মাওবাদীদের মতো এরকম নিষিদ্ধ ও হিংস্র দলের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করেনি। ব্যতিক্রম তৃণমূল কংগ্রেস। কেন এই ব্যতিক্রম? লেখাকে দীর্ঘায়িত না করেও কিছু ঘটনার কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন। ২০০৪ সালে লোকসভা নির্বাচনে বামপন্থীদের শক্তির সর্বোচ্চ বিকাশ ঘটে এবং ৬২ জন সাংসদ হিসেবে জয়যুক্ত হন, ফলে দিল্লির সরকার গঠনে বামপন্থীদের গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা নিতে হয়। অন্যদিকে বামেদের এই উত্থান দেখে বুর্জোয়া ও বৃহৎ পুঁজিপতিরা কখনই চুপ করে বসে থাকতে পারেনা। প্রতিক্রিয়াশীল সমস্ত শক্তিই প্রমাদ গুনতে থাকে। এক অভিন্ন লক্ষ্যে তারা একজোট হয় যে, দেশে বামপন্থীদের দুর্বল করতে হবে আর এই কাজ শুরু করতে হবে বামপন্থীদের সবচেয়ে শক্ত ঘাঁটি বাংলা থেকেই। এই পরিকল্পনায় সবসময়েই মুখ্য সংগঠকের ভুমিকা পালন করেছে আরএসএস। এমনিতেই তাদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতায় তৃণমূল কংগ্রেসের জন্ম। ২০০৭ সাল থেকেই জঙ্গল এলাকায় শুরু হয় খুনের রাজনীতি। সমাজের সব অংশের মানুষ তখন খুনের তালিকায় - ছাত্র থেকে শিক্ষক, কৃষক থেকে মজুর সকলেই। মানুষকে আতঙ্কিত করতে খুনের পর মৃতদেহের প্রদর্শনীও শুরু হলো জঙ্গল এলাকায়। পুরুলিয়ার পার্টির নেতা রবীন্দ্রনাথ কর ও তাঁর স্ত্রীকে নৃশংসভাবে পুড়িয়ে মারা হলো। ছবি মাহাতকে ধর্ষণ করে খুন করা হলো। ছাত্রনেতা অভিজিত মাহাতকে খুন করা হলো। শালকু সরেনকে কুপিয়ে খুন করে তার দেহ দিনের পর দিন ফেলে রাখা হলো। কেউ কি বলতে পারবেন স্বাধীন ভারতে কোনো রাজ্যে এরকম ঘটনা কখনও ঘটেছে? শুধুমাত্র বামফ্রন্টকে উচ্ছেদ করতেই এইসব ঘৃণ্য নৃশংস বর্বর ঘটনা বছরের পর বছর ঘটানো হয়। বদলা নয় বদলের স্লোগান দিয়ে ক্ষমতায় এসেই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী তাঁর একান্ত অনুগত পুলিশ অফিসারকে পশ্চিম মেদিনীপুরের সুপার করে আরও ভয়াবহ আক্রমণ নামিয়ে আনলেন পার্টি ও পার্টিকর্মীদের ওপরে। সেই পুলিশ সুপার নির্লজ্জভাবে প্রশাসনিক সভায় মুখ্যমন্ত্রীকে জঙ্গলমহলের মা বলে ডাকতেন, অথচ বর্তমানে মায়ের সেই মেয়ে অন্য দলে নাম লিখিয়েছে। গোটা জঙ্গল এলাকা জুড়ে বর্তমান বিরোধী দলনেতা এবং তৎকালীন তৃণমূল কংগ্রেসের কাণ্ডারি সগর্বে ঘোষণা করেছিলেন, লাল পতাকা ধরার আর লোক থাকবে না, অথচ তিনিও পরে নিজের পতাকাই পালটে ফেলেছেন। গোটা জঙ্গল এলাকায় প্রায় ৩০০ কমরেডের খুনের দায় বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী এবং বর্তমান বিরোধী দলনেতা দু’জনেরই। মানুষ এদের নিজেদের অভিজ্ঞতা দিয়েই চিনেছেন।
কমরেড ফুল্লরা মণ্ডলকে লড়তে হয়েছে এই পৈশাচিক শক্তির বিরুদ্ধেই। দীর্ঘ আট বছরেও বেশি জেল জীবন, তার আগে পাঁচ বছর আত্মগোপন। রাজ্যের প্রধানের নামের বিপরীত শব্দ ‘নির্মমতা’ই প্রয়োগ হয়েছে কমরেড ফুল্লরার প্রতি। আত্মগোপনকালে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে ছিলেন ফুল্লরা, আমার সাথে যোগাযোগ ছিল প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ দু’ভাবেই। আমি জেল থেকে ছাড়া পাবার পরে আত্মগোপনপর্বের সময়েই জোর করেই এমএলএ হোস্টেলে এসেছিলেন ফুল্লরা। আমার হাত ধরে কেঁদেছিলেন সেদিন। ফুল্লরা সেদিন আমায় বলেছিলেন - এখন আপনি বাইরে আছেন, তাই আমরা জেলে গেলেও আমাদের চিন্তা নেই। আমি তার উত্তরে বলেছিলাম - ভরসা কখনও কোনো ব্যক্তি নয়, ভরসা হলো পার্টি। আমাদের আদর্শ আনুগত্য একমাত্র লাল ঝান্ডার প্রতিই। কমরেড ফুল্লরার জামিনের জন্য পার্টিগতভাবে প্রচেষ্টা গ্রহণ করা হলেও জামিন পাওয়া যায়নি। নানা অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়েছে বারেবারে। রাজ্য নেতৃত্ব থেকে জেলা নেতৃত্ব সকলেই বিষয়টা নিয়ে অবগত। এরই মধ্যে সুপ্রিম কোর্টের বিচারাধীন বন্দিদের নিয়ে নতুন নতুন কিছু নির্দেশ আশা জাগায়। এই ব্যাপারে আইনের লড়াইয়ে আমাদের পার্টির রাজ্যসভার সাংসদ ও আইনজীবী বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য ও তাঁর সহযোগী আইনজীবীদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। গত মার্চে কলকাতা হাইকোর্টে জামিনের আবেদন প্রথমে খারিজ হয়। হাইকোর্টে জামিনের আবেদন খারিজ হলেও বিকাশদার পরামর্শে অতি দ্রুততার সঙ্গেই দেশের সর্বোচ্চ আদালতে পিটিশন ফাইল করা হয় এবং তাঁরা জামিন দিতে গিয়ে পরিষ্কার ভাষায় বলেছেন - আট বছরের বেশি বিচারাধীন বন্দি থাকা অবস্থাতেও অভিযুক্তের বিরুদ্ধে মাত্র এক চতুর্থাংশ সাক্ষীর সাক্ষ্যদান সম্ভব করতে পারেনি সিবিআই। ফলে সহজেই অনুমেয় এই মামলা আগামী দশ বছরেও শেষ হবে না। এইভাবে তো চলতে পারেনা, অল্প কিছু শর্ত সহ মহামান্য আদালত ফুল্লরার জামিন মঞ্জুর করেন গত ২১ আগস্ট।
ফুল্লরা মণ্ডল লড়াই সংগ্রামের এক উজ্জ্বল প্রতীক। জেল থেকে ছাড়া পাবার দিন সাধারণ মানুষ পার্টিকর্মী, সমর্থক দরদিদের আবেগ আবারও সেটা বুঝিয়ে দিয়েছে। এমনকী সমস্ত সংবাদমাধ্যমও সেটা দেখাতে বাধ্য হয়েছে। বর্তমান সরকার যে কতটা প্রতিহিংসাপরায়ণ হতে পারে তার উদাহরণ হচ্ছে - জেলে থাকাকালীন ফুল্লরার মা এবং দাদা মারা গেলেও তাঁকে প্যারলে মুক্তি দেওয়া হয়নি আইনশৃঙ্খলা নষ্ট হবে এই অজুহাতে। জেলে থাকাকালীন তাঁর জন্য জরুরি জীবনদায়ী ওষুধ পর্যন্ত পৌঁছাতে দেওয়া হয়নি। তবু ফুল্লরা মণ্ডল হারেননি, সাচ্চা কমিউনিস্ট মতাদর্শে দীক্ষিত ফুল্লরা মণ্ডলরা কখনও হারেন না, হারতে জানেন না।