E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৬০ বর্ষ ৪ সংখ্যা / ২ সেপ্টেম্বর, ২০২২ / ১৬ ভাদ্র, ১৪২৯

রাত পেরিয়ে আঁধার কাটলো কৈ

অলকেশ দাস


২০২০ সালের ১৪ সেপ্টেম্বরের এক ঘটনা উত্তরপ্রদেশের হাথরস জেলাকে কুখ্যাত করেছিল। মনীষা বাল্মীকি নামে ১৯ বছরের এক দলিত মেয়েকে চারজন উচ্চবর্ণীয় যুবক গণধর্ষণ করেছিল। মেয়েটির বাধাকে অতিক্রম করতে তার শিরদাঁড়া ভাঙা হয়েছিল এবং তার জিভ কেটে দেওয়া হয়েছিল। তিনবার হাসপাতাল বদল করেও তাকে বাঁচানো যায়নি। উত্তর প্রদেশের পুলিশ প্রথমে কোনো অভিযোগ নেয়নি। দশ দিন পর প্রথম অভিযোগ নথিবদ্ধ করেছিল। এই দশদিন ধর্ষকেরা ধরা পড়েনি। পুলিশের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগও আছে যে, বাড়ির লোককে না জানিয়েই পুলিশ মৃতদেহ পেট্রোল ঢেলে পুড়িয়ে দিয়েছিল। যোগী সরকারের উদাসীনতা,পুলিশের মদত ইত্যাদি বিষয়ে সারাদেশে জনমত গড়ে উঠেছিল। উচ্চবর্ণীয় ঠাকুরের হাতে দলিতের ধর্ষিত হওয়ার স্বাভাবিক ঘটনায়(!) উত্তেজনায় বিস্মিত হয়ে আরএসএস, উচ্চবর্ণীয় সংগঠন, সবর্ণ সমিতি ইত্যাদি রাস্তায় নেমে পড়ে। ধর্ষণেও ষড়যন্ত্র খুঁজতে থাকে। শেষ অবধি আবিষ্কার করে ফেলে মেয়েটির পরিবারের সঙ্গে ধর্ষকদের কারুর ফোনে কথোপকথনের কললিস্ট। উচ্চবর্ণের হাতে দলিতের গণধর্ষণের সাফাইয়ের অজস্র গল্প রচনা হতে থাকে।

হাথরসের স্থানীয় সাংসদের নাম রাজবীর ডিলার। দল বিজেপি। তিনিও দলিত বাল্মিকী সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত। ২০১৭-এ তপশিলিদের জন্য সংরক্ষিত ইগলাস বিধানসভা কেন্দ্রের বিধায়ক হন। ২০১৯-এ সাংসদ। মানুষ হিসাবে, একজন সাংসদ হিসাবে, সর্বোপরি একজন দলিত হিসাবে তিনি এই ঘটনার বিরুদ্ধে কার্যকরী ভূমিকা গ্রহণ করবেন - মানুষের এই প্রত্যাশা ছিল। সে প্রত্যাশা ধুলোয় মেশে।

বিজেপি’র এই রাজবীর যখন বিধানসভায় ভোটের প্রচারে যেতেন তখন পকেটে একটা গ্লাস রাখতেন। যখন কেউ চা খেতো তখন পকেট থেকে গ্লাস বার করে সেই চা নিতেন। অন্য পাত্র যাতে অপবিত্র না হয়! উচ্চবর্ণীয়দের খুশি করার জন্য। কম বয়সী উচ্চবর্ণীয়দেরও পায়ে হাত দিয়ে নমস্কার করতেন। ভোট বড়ো দায়। ওই বিধানসভায় নব্বই হাজার ভোট জাঠ জাতিগোষ্ঠীর। ওই কেন্দ্রে জয়ের মূল নির্ণায়ক তারাই। সেই জন্য নির্বাচনের সুবিধার অংকে মুখ বুঁজে থাকে ‘ভাংগীর বেটা’ হয়ে হাথরসের বিজেপি’র সাংসদ।

শিরদাঁড়াতে তফাতের এমপিও অবশ্য আছে। যেমন বিজেপি’র সাবিত্রী বাই ফুলে।বাহরাইখের সাংসদ। সে’সময় বিজেপি’র মনুবাদী দৃষ্টিভঙ্গি আর লুকিয়ে রাখা যায়নি। প্রিভেনশন অফ অ্যাটরোসিটিজ অ্যাক্ট অন এসসি, এসটি লঘু করে দেওয়ার পর্ব চলছে। সুপ্রিম কোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে সারাদেশ উত্তাল। বিজেপি’র কেন্দ্রের সরকার চুপ করে আছে। কেন সরকার পাল্টা সংসদে দাঁড়াবে না আইনকে অক্ষুণ্ণ রাখার কাজে এই নিয়ে মুখ খুলে ফেললেন সাবিত্রীবাই ফুলে। বললেন আমি সাংসদ পদ আঁকড়ে থাকার জন্য আসিনি। এসেছি সংবিধানের মর্মবস্তু এবং পবিত্রতা রক্ষা করার কাজে। উত্তরপ্রদেশের পুলিশের বিরুদ্ধে গর্জে উঠলেন। গর্জে ওঠার কারণ দলিতের উপর আক্রমণ যখন হয় পুলিশ তাদের পক্ষে না দাঁড়িয়ে তথাকথিত উচ্চ বর্ণীয় উৎপীড়কের পক্ষে দাঁড়ায়। মুখ খুলেছেন আর একজন বিজেপি’র সাংসদ ছোটেলাল খাড়োয়ার। রবার্টসগঞ্জের এমপি। ক্রমবর্ধমান দলিত তপশিলিদের উপর আক্রমণের ঘটনার বিষয়ে উদ্বিগ্ন সাংসদ দেখা করতে চেয়েছিলেন দু’বার মুখ্যমন্ত্রী আদিত্যনাথ যোগীর সঙ্গে। প্রত্যাখ্যাত হয়ে বিষোদগার করেছিলেন। উত্তরপ্রদেশে সেই সময় কেউ ভাবতে পারেনি বিজেপি-তে থেকে যোগীর বিরুদ্ধে এইরকম প্রতিবাদ করা যায়। তিনি অভিযোগ করেছিলেন, ন্যাশনাল কাউন্সিল ফর সিডিউল কাস্ট-এ পি ও এ অ্যাক্ট সংশোধনের বিরুদ্ধে। থেমে থাকেননি এটাওয়ার বিজেপি এমপি অশোক কুমার ডহরে। সরাসরি উত্তর প্রদেশের পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছিলেন যে তারা দলিত নির্যাতনের পক্ষে দাঁড়ায় - প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে। আর একজন বিজেপি’র এমপি নাগিনা থেকে নির্বাচিত যশবন্ত সিং। আঙুল তুলেছিলেন প্রধানমন্ত্রী মোদির দিকে। হিসাব চেয়েছিলেন তার প্রধানমন্ত্রীত্ব কালে তিনি দলিতদের জন্য কী কী করেছেন তার বিবরণ দিতে। এমনকী বিজেপি’র তপশিলিদের জন্য সংরক্ষণ নীতি সম্পর্কে বক্তব্যের প্রকাশ্য বিবৃতি চেয়েছিলেন। সম্প্রতি কংগ্রেসের রাজস্থানের একজন বিধায়ক দল ছেড়েছেন ইন্দ্র মেঘওয়ালের ঘটনার প্রতিবাদে। কেন কেবল জল তৃষ্ণা নিবারণের জন্য পাত্রের কারণে উচ্চবর্ণীয় প্রধান শিক্ষকের হাতে খুন হতে হবে দলিত ৯ বছরের ছাত্রকে? দেশে প্রতিবাদের এই ধরনের ঘটনাগুলি ব্যতিক্রমী। দক্ষিণপন্থী দলের বেশিরভাগ এমএলএ, এমপি-রা এমনকী তারা দলিত হলেও পিছিয়ে পড়া অংশের মানুষের অত্যাচারের ঘটনায় নীরব থাকেন। বর্ণবাদী সমাজব্যবস্থায় পুষ্ট এবং তাকে নীরবে সমর্থন করা দক্ষিণপন্থী দলগুলির মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন। ব্রাহ্মণত্ববাদের কার্যত একনিষ্ঠ সেবকের কাজ করেন।

তামিলনাডুর কাল্লাকুরিচির এদুথাভৈনাথম গ্রামের পঞ্চায়েত সভাপতি সুধা ভি প্রজাতন্ত্র দিবসে এবং স্বাধীনতা দিবসে প্রত্যক্ষ করেন যে, তাকে দেশের জাতীয় পতাকা তুলতে দেওয়া হচ্ছে না তিনি দলিত বলে। তার আগে অন্য গ্রামের সাধারণ জাতিভুক্ত ১০ জন গ্রাম পঞ্চায়েত সভাপতি পতাকা তুলেছেন। ওই গ্রামে দলিতদের মন্দিরে ঢুকতে দেওয়া হয় না। ভয় হচ্ছে জাতীয় পতাকা তুলতে দেওয়া হলে দলিতদের তাহলে মন্দিরে ঢুকতে দিতে হবে। তাহলে সর্বনাশের আর শেষ থাকবে না!

উপরের ঘটনার সত্যতা প্রমাণ করে যখন এবছর স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে তামিলনাডুর মুখ্যসচিব সরকারি বিজ্ঞপ্তি জারি করেন জেলাশাসকদের প্রতি। বিজ্ঞপ্তিতে লেখা থাকে- ‘‘কোনো নির্বাচিত স্বশাসিত সংস্থার সভাপতিকে যেন জাতের কারণে জাতীয় পতাকা তুলতে বাধা না দেওয়া হয়’’।

তামিলনাডু আনটাচেবিলিটি ইরাডিকেশন ফ্রন্ট (টিএনইউইএফ) সম্প্রতি এক সমীক্ষা প্রতিবেদন পেশ করেছে। ২৪ জেলার ৩৮৬ গ্রামে ৪০০ জন স্বেচ্ছাসেবক ঘুরেছেন।২২টি অস্পৃশ্যতা সম্পর্কিত প্রশ্নগুলির তথ্য সংগ্রহ করেছেন। সমীক্ষায় যে যে তথ্য বেরিয়ে এসেছে - ১. পঞ্চায়েত অফিসের চাবি দলিত প্রধানের কাছে থাকে না। ২. দলিত প্রধান চাইলেই সরকারি কোনো কাগজ পান না। ৩. পঞ্চায়েত সম্পর্কীয় কোনো সভায় তাদের কথা বলার কোনো জায়গা নেই। ৪.সাধারণভাবে সভার পরিচালনা অন্য উচ্চবর্ণীয় মানুষের হাতে থাকে। ৫. দলিত প্রধানের ডাকা সভাতে উচ্চবর্ণীয় মানুষেরা সম্মানের দোহাই দিয়ে আসেন না। ৬. উপপ্রধান উচ্চবর্ণের মানুষ হলে তার জন্য আলাদা কক্ষ করা হয়। ৭. দলিত প্রধানদের প্রতি সরকারি অফিসাররা জাতিভেদে ব্যাপক বৈষম্য করেন। ৮. দলিত প্রধান যদি মহিলা হন তাহলে তার ক্ষেত্রে বৈষম্য আরও প্রকট। ৯. যে ৩৮৬টি গ্রামের সমীক্ষা করা হয় তার মধ্যে ২২টির প্রধান দলিত। তাদের জন্য চেয়ার নির্দিষ্ট নেই।

কাল্লাকুরুচি জেলার চিন্নাসালেম পঞ্চায়েত প্রধান অভিযোগ করেছিলেন, তাকে চেয়ারে বসতে দেওয়া হয় না, মেঝেয় তাকে বসতে হয়। পঞ্চায়েতের বোর্ডে যেখানে প্রধানদের নাম লেখা থাকে সেখানে তার নাম নেই, সে দলিত বলে। পঞ্চায়েত অফিসের বাইরে প্রধানের কোনো নেমপ্লেট নেই, সে দলিত বলে।

অস্পৃশ্যতা আর বর্ণ বৈষম্য যে কেবল গ্রামাঞ্চলে সীমাবদ্ধ নয় তা অনেক উপরে তার বিস্তৃতির পরিচয় পাওয়া গিয়েছিল ২০০৭-এ শুকদেও থোরাট কমিটির রিপোর্টে। অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অব মেডিকেল সায়েন্স, দিল্লি(এইমস) সংক্রান্ত সেই প্রতিবেদনে শুখদেও থোরাট লেখেন যে, রাজধানীতে এইরকম উচ্চমর্যাদা সম্পন্ন চিকিৎসা সংস্থাতে ছাত্রদের হোস্টেলে তপশিলি ও দলিতদের পৃথক খাওয়ার ব্যবস্থা থাকে। খেলাধুলা সহ সকল ইভেন্টেই এইরকম পৃথকীকরণের ব্যবস্থা। উচ্চবর্ণীয় ছাত্ররা বেছে বেছে তপশিলি ছাত্রদের তাদের ঘরে ডেকে পাঠিয়ে তাকে প্রশ্ন করে যে - কোন ১০টি কারণের জন্য তপশিলিদের সংরক্ষণের অবসান ঘটানো হবে। এত জাতিবৈষম্য এবং অস্পৃশ্যতা দেখে প্রাক্তন ইউজিসি চেয়ারম্যান শুকদেও থোরাট এইমসের মধ্যে ‘ইক্যুয়াল অপরচুনিটি অফিস’ খোলার কথা বলেন। সংসদের কমিটি অনএসসিএসটি ওয়েলফেয়ার, যার মাথায় একজন বিজেপি সাংসদ কিরীত প্রেমজি ভাই সোলাঙ্কি। সম্প্রতি দিল্লির এইমস এ সংক্রান্ত এক প্রতিবেদন পেশ করেছেন। তিনি সুপারিশ করেছেন, যেন এইমসে পরীক্ষায় উত্তরপত্রে ছাত্রদের নাম না লেখা থাকে। শুধু এক্সামিনেশন কোড নাম্বার থাকে। তিনি সুস্পষ্ট অভিমত ব্যক্ত করেছেন যে, সেখানে জাতির বৈষম্যের ভিত্তিতে পিছিয়ে পড়া অংশের ছাত্রদের ফেল করানো হয়। এর অর্থ অধ্যাপকদের মধ্যে ব্যাপকভাবে জাতি বৈষম্য এবং অস্পৃশ্যতা ক্রিয়াশীল যার ভুক্তভোগী তপশিলি এবং দলিত ছাত্রছাত্রীরা।

ডঃ বি আর আম্বেদকর সংবিধানে ১৪ নম্বর ধারা অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন সম অধিকারের জন্য। ১৫ নম্বর ধারা ছিল যাবতীয় বৈষম্যের বিরুদ্ধে।১৬ নম্বর ধারা ছিল পিছিয়ে পড়া অংশের যথেষ্ট প্রতিনিধিত্ব বিষয়ক। সেখানেই তপশিলি জাতি আদিবাসীদের সংরক্ষণের ব্যবস্থা । ১৭ নম্বর ধারা ছিল সমস্ত ধরনের অস্পৃশ্যতামূলক আচরণের অবসান সংক্রান্ত। কিন্তু আইন থাকলে হয় না। তাকে প্রয়োগ করার রাজনৈতিক সদিচ্ছার প্রয়োজন হয়। সরকারের মনোভাব যদি উল্টো হয় তাহলে প্রতিবিধানও বিপরীত হয়। তাই নিজের গ্রামে পুকুর থাকা সত্ত্বেও দলিতের সেখানে অধিকার নেই বলে দলিতকে গ্রামের পর গ্রাম পেরিয়ে জল আনতে যেতে হয়। এখনো তাকে কাটাতে হয় পশুর মতো জীবন। ৭৫ বছর আগে স্বাধীনতার সকালে এই স্বপ্ন সে দেখেনি। এখনো জাতের গণ্ডি পেরিয়ে পেশা নির্বাচনের স্বাধীনতা পুরোপুরি তার হাতে নেই। গুজরাটে মুচির কাজ করা একজন দলিত পেশা ছেড়ে এক সংস্থায় কাজ করতে শুরু করেছিল। কিন্তু তাহলে কী হবে, সেই সংস্থার লোকেরা মনে করত - যে কোনো সময় তাকে দিয়ে মুচির কাজ করিয়ে নেওয়াটা অন্যায় নয়। এমনকী তার নিজের গ্রামেও তাই। ছেলেটাকে তাই করতে হয়। কারণ মনের মধ্যে তার ভয় থাকে সামাজিক বয়কটের। যা গ্রামের উচ্চবর্ণীয়রা যেকোনো সময় জারি করে দিতে পারে তার বিরুদ্ধে। যেমন মুদিখানা, বাজার নিষিদ্ধ ইত্যাদি।

২০১০ সালে নভসার্জন ট্রাস্ট গুজরাটে এক সমীক্ষা করে। ১৫৮৯ গ্রাম জুড়ে। দেখা যায় যে, সেখানে একজন দলিতকে ৯৮ ধরনের বিভিন্ন অস্পৃশ্যতার সম্মুখীন হতে হয়। একজন দলিতকে গ্রামের স্কুলে আলাদা বসতে হয়, গ্রামের মধ্যে তাদের বসবাস নিষিদ্ধ। গ্রামের প্রান্তিক অঞ্চলে তারা বাস করে। রাস্তার ধারের চায়ের দোকানে তাদের জন্য আলাদা পাত্র থাকে।

জোমাটোর ডেলিভারি বয়ের নাম ছিল বিপিন রাওয়াত। খাবার দিতে যাওয়ার সময় বাড়ির লোক জিজ্ঞাসা করে তার জাতের পরিচয়। দলিত শুনেই তাকে গালাগালি আর মারধরের পর্ব শুরু হয়ে যায়। কোনো গল্প নয় বাস্তব। এ বছরের ২৪ জুনের ঘটনা। দলিত ছেঁড়া কাটা জামা পড়বে। কেন সে আধুনিক ফ্যাশনের জামা পড়বে এই অভিযোগ করে ১৮ বছরের দলিত পবন কুমারকে খুন হতে হয়েছে উচ্চবর্ণীয়দের হাতে। মদ বিক্রি করে বলে নয় তার অতিরিক্ত অপরাধ সে দলিত সেই জন্য তাকে পিটিয়ে খুন করার অধিকার ফলায় পুলিশ। তথাকথিত নিম্নজাতির স্নাতকদের মধ্যে বেকারি বেশি। তার কারণ ইন্টারভিউ বোর্ডে অ্যাডমিট কার্ড বা মার্কসিটে লেখা পদবীর দিকে ইন্টারভিউয়ারের নজর পড়লে জাতি বৈষম্যের প্রতিফলন ঘটে। এরকম অভিজ্ঞতা প্রায় সিংহভাগ দলিত, তপশিলি, আদিবাসীর।

২০১২ সালে আই এইচ ডি এস এক সমীক্ষা করেছিল মূলত দুটি প্রশ্নকে কেন্দ্র করে। আপনার বাড়িতে কেউ অস্পৃশ্যতাকে মান্যতা দেয় কীনা? আপনার রান্নাঘরে যদি কোনো তপশিলি প্রবেশ করে এবং বাসনপত্র ছোঁয় তাহলে আপনার কোনো সমস্যা হবে কীনা?

হ্যাঁ বা না। বোঝাই যাচ্ছে উত্তর হ্যাঁ হলে ওই ব্যক্তি বা তার পরিবার অস্পৃশ্যতাকে গ্রহণ করেন বা মান্যতা দেন। এতে দেখা গিয়েছিল - ভারতে গ্রামের ত্রিশ ভাগ এবং শহরের কুড়ি ভাগ মানুষ এই অস্পৃশ্যতার তত্ত্বকে আঁকড়ে ধরে আছেন এখনো যখন সংবিধান তাকে বাতিল করে দিয়েছে আজ থেকে ৭৫ বছর আগে। গরিবের মধ্যে ৩২.৫৬ শতাংশ, ধনীতমদের মধ্যে ২৩.৩৫ ভাগ অস্পৃশ্যতাকে গ্রহণ করে। গরিবের মধ্যেও বিষের কাঁটা অনেক দূর অবধি বিস্তৃত। নিরক্ষরদের মধ্যে অস্পৃশ্যতা ডানা মেলে আছে ৩০ ভাগ, স্নাতকদের মধ্যে ২৪ ভাগ। মনুবাদী জাতি বৈষম্যের সমাজ যে অস্পৃশ্যতার পরম্পরা তৈরি করেছে তা অশিক্ষিতদের মধ্যেও যেমন তেমনি শিক্ষার আলো যেখানে প্রবেশ করেছে সেখানেও বিস্তৃত হয়ে রয়েছে। সেই জন্য আজকেও খবরের কাগজে পড়তে হচ্ছে দলিত ছেলের মৃত্যু হয়েছে উচ্চবর্ণের বাড়ির গাছের ফুল তোলার অপরাধে। দলিত ছেলে বা মেয়েকে নগ্ন করে গ্রামের রাস্তায় প্যারেড করানোর খবর কাগজে আসা নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা।দলিতকে ধর্ষণ ,ঘর জ্বালিয়ে দেওয়া, গণপিটুনি - এগুলোও প্রায় স্বাভাবিক। কিন্তু মধ্যপ্রদেশের ৫০টা দলিত পরিবার অর্থনৈতিক ও সামাজিক নিপীড়নের মধ্যে জীবন যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে সরকারের কাছে অনুমতি চাইছে আত্মহত্যা করার। এই ঘটনা কতখানি স্বাভাবিক? এইগুলো কী প্রমাণ করে নির্বাচনের আগে দলিতপ্রেমী দক্ষিণপন্থী দলগুলো রাজ্য এবং দিল্লির সরকারে বসার পর তারা দলিতদের পক্ষে ভূমিকা পালন করছে? ওই মধ্যপ্রদেশের সিঙরুলিতে একজন দলিত ছাত্র সামনের বেঞ্চে বসেছে বলে বিদ্যালয়েরই একজন উচ্চবর্ণীয় শিক্ষক তাকে প্রহার করেছে । সরকারের কোনো দায় নেই প্রতিবাদ করার। ছমাসের বাচ্চার ওষুধ জোগাড় করতে পারেনি মা। দলিত মায়ের নাম দুর্গাবাই। মেয়ের নাম রেখেছিল দেবতার নামে দেবাংশ। মেয়ের কষ্ট সহ্য না করতে পেরে নিজের মেয়েকে মেরে ফেলেছে তার মা। দোষ কার এই প্রশ্নের উত্তর যখন আমরা খুঁজব তখন লোকসভার হিসাব বলবে ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরো জানিয়েছে যে, ২০২০ সালে তপশিলিদের ওপর অপরাধের ঘটনা গত বছরের তুলনায় ৯.৪ শতাংশ বেড়েছে। আদিবাসীদের ক্ষেত্রে তা ৯.৩ শতাংশ। স্বাধীনতার ৭৫ বছর।

আম্বেদকর মনে রেখেছিলেন রবীন্দ্রনাথের কথা- ‘যারে তুমি নীচে ফেল সে তোমারে বাঁধিবে যে নীচে/ পশ্চাতে রেখেছ যারে সে তোমারে পশ্চাতে টানিছে।’ কয়েক হাজার বছরের জাতিভেদের সামাজিক বঞ্চনার নাগপাশে আবদ্ধের কারণে তৈরি হওয়া পশ্চাৎপদতা। তা কাটাতে তাদেরকে সমাজের মূল স্রোতে আনার জন্য স্বপ্ন দেখেছিলেন আম্বেদকর। তাঁর সেই স্বপ্ন অধরা রয়ে গেল স্বাধীনতার পঁচাত্তরে।