৬০ বর্ষ ৪ সংখ্যা / ২ সেপ্টেম্বর, ২০২২ / ১৬ ভাদ্র, ১৪২৯
স্বাধীনতা সংগ্রামে মুসলিমদের ভূমিকা (১৯২৬-৪৬)
সুপ্রতীপ রায়
আমাদের দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসের দিকে দৃষ্টিপাত করলে দেখা যাবে ১৯২০ সালের পর আন্দোলনের তীব্রতা বৃদ্ধি পেতে থাকে। যদিও হঠাৎ করে অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহৃত হওয়ার ফলে কিছুটা হতাশা তৈরি হয়েছিল। কিন্তু সেই হতাশা কাটিয়ে অচিরেই মানুষ ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রামে শামিল হয়েছিলেন। ভারতের সমস্ত ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মানুষ স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ নিয়েছিলেন।
আমাদের দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে মুজফ্ফর আহ্মদের ভূমিকা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণীয়। কানপুর ষড়যন্ত্র মামলায় তাঁকে আসামী করা হয়েছিল। মীরাট মামলায় অন্যতম প্রধান আসামী ছিলেন ‘কাকাবাবু’। ১৯২৯-৩৩ সাল পর্যন্ত প্রায় সাড়ে চার বছর অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে মামলা চলেছিল।
মাওলানা মহম্মদ আলি স্বাধীনতা সংগ্রামের একজন বিশিষ্ট নেতা ছিলেন। তিনি তাঁর ক্ষুরধার লেখনী ও জ্বালাময়ী বক্তৃতার মধ্য দিয়ে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে মনোভাব ব্যক্ত করেছিলেন। এই কারণে সরকার তাঁকে গ্রেপ্তার করে দিল্লির নিকটবর্তী মেহেরোলিতে অন্তরীণ করেছিল। পরে তাঁকে মধ্যপ্রদেশের ছিন্দওয়ারাতে স্থানান্তরিত করে। ১৯৩০ সালে লন্ডনে অনুষ্ঠিত প্রথম গোলটেবিল বৈঠকে তিনি অংশ নিয়েছিলেন। গোলটেবিল বৈঠকে তিনি বলেছিলেন - ভারত যদি মুক্তিলাভ না করে তাহলে তিনি আর জীবিত অবস্থায় স্বদেশে ফিরে যাবেন না।
ডাঃ মুখতার আহমদ আনসারি স্বাধীনতা সংগ্রামে একটি গুরুত্বপূর্ণ নাম। ১৯২৬, ১৯২৯, ১৯৩১, ১৯৩২ ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের এই উল্লেখযোগ্য সময়ে তিনি ছিলেন জাতীয় কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক। ১৯২৭ সালে তিনি মাদ্রাজে অনুষ্ঠিত জাতীয় কংগ্রেসের বার্ষিক অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেছিলেন। তিনি ওই অধিবেশনে সভাপতির ভাষণে বলেছিলেন, ‘‘যে স্বরাজের জন্য আমরা সংগ্রাম করছি, সে শাসন না হবে হিন্দু, না হবে মুসলিম সেটা হবে এক যৌথ শাসনব্যবস্থা।’’
মৌলনা ওবেদুল্লাহ সিন্ধী তীব্র ব্রিটিশ বিরোধী ছিলেন। তিনিই প্রথম পাঞ্জাবে ও যুক্তপ্রদেশে বৈপ্লবিক মতবাদ প্রচার করেছিলেন। সিন্ধী বেশ কয়েকজনকে বিপ্লবমন্ত্রে দীক্ষা দেন। বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তা জানতে পেরে বিদ্যালয় থেকে তাঁকে বহিষ্কার করেন। আর একজন শিক্ষক মৌলনা মাহমুদ হাসান ওবেদুল্লার সঙ্গে যোগ দেন।
আবদুল সামাদ খান জীবনের প্রথমার্ধে গান্ধীজির অহিংস নীতির সংস্পর্শে এসেছিলেন। ১৯২৮-২৯-এ তিনি উত্তর ভারতে ‘নওজোয়ান সভা’র সঙ্গে যুক্ত হন। বালুচিস্তানে রাজনৈতিক আন্দোলন পরিচালনা করার জন্য তিনি গ্রেপ্তার হন। ১৯৪২ সালে তিনি জাতীয় আন্দোলনে অংশ নিয়ে কারাবরণ করেন।
১৯২৯ সালে গঠিত হয় ন্যাশনালিস্ট মুসলিম পার্টি। এই পার্টি ভারতে মুসলিমদের মধ্যে দেশপ্রেমিক মনোভাব সঞ্চার ও সাম্প্রদায়িকতার ঊর্ধ্বে উঠে স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ নিতে উদ্বুদ্ধ করেন। মওলানা আব্দুল কালাম আজাদ, ডাঃ এম এ আনসারি ও তোসাদক আহম্মদ খান সেরোয়ানি এই দলের সভাপতি, কোষাধ্যক্ষ ও সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন। এই দলটি সাইমন কমিশনের বিরোধিতা করে ও মুসলিমদের আইন অমান্য আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নিতে সহায়তা করেন।
মুসলিম লিগের নীতির বিরোধিতা করে পাঞ্জাবে মুসলিম লিগ থেকে পদত্যাগ করে বেশ কিছু মুসলিম ১৯২৯ সালে মওলানা হাবিবুর রহমান লুধিয়ানির নেতৃত্বে মজলিস-ই-আহরর গঠন করে। এই দলটি মুসলমানদের কংগ্রেসের নেতৃত্বে স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ নেওয়ার আহ্বান জানায়। মজলিস-ই-আহরর আহ্বানে সাড়া দিয়ে হাজার হাজার মুসলমান আইন অমান্য আন্দোলনে যোগ দিয়ে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন।
১৯২৯ সালে নিখিল ভারত শিয়া সম্মেলন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ১৯৩০ সালে লক্ষ্মৌতে অনুষ্ঠিত হয়েছিল প্রথম অধিবেশন। শিয়া সম্মেলন ১৯৩৫ সালে রচিত ভারত সরকারের আইনকে বাতিল করে ভারতের ধনী, দরিদ্র ও সমস্ত সম্প্রদায়ের জন্য একটি গঠনতন্ত্র তৈরির আবেদন করেছিল। এই সম্মেলন পূর্ণ স্বাধীনতার প্রস্তাব গ্রহণ করেছিল। ১৯৩০ সালে আইন অমান্য আন্দোলনে সীমান্ত প্রদেশের পাঠানেরা যে ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন তা ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। আইন অমান্য আন্দোলনের সময় খান আব্দুল গফ্ফর খান জেলবন্দি থাকলেও সীমান্ত প্রদেশ আইন অমান্য আন্দোলন থেকে পিছিয়ে ছিল না।
মওলানা হাবিবুর রহমান লুধিয়ানির স্বাধীনতা সংগ্রামে বিশিষ্ট ভূমিকা ছিল। তিনি ১৯২৯ সালে ‘মজলিস-ই-আহরর’ পার্টি গঠন করেন। উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, পাঞ্জাব, বিহার ও বাংলায় এই পার্টিটি মুসলিমদের মধ্যে খুবই জনপ্রিয় ছিল। মসলিস-ই-আহরের প্রথম বার্ষিক সম্মেলনে সভাপতি চৌধুরী আবদুল হক বলেছিলেন, ‘‘আমরা আমাদের দেশবাসীর জন্য এমন স্বাধীনতা চাই, যাতে সাধারণ গরিব লোকেরা সুখে শান্তিতে বসবাস করতে পারেন।’’ মওলানা হাবিবুর রহমান তাঁর বক্তব্যে বলেছিলেন, ‘‘বর্তমান ধনতান্ত্রিক সরকারের পরিবর্তে আমাদের গরিবের সরকার গঠন করে তুলতে হবে।’’ মসলিস-ই-আহররের আহ্বানে সাড়া দিয়ে হাজার হাজার মুসলমান আইন অমান্য আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন। ১৯৩০ সালের আইন অমান্য আন্দোলনে মওলানা হাবিবুর রহমান লুধিয়ানির উদ্যোগে কাশ্মীর, কার্পুরথালা, বাহওয়ালপুর, কাদিয়ান প্রভৃতি রাজ্যে আইন অমান্য আন্দোলন পরিচালিত হয়েছিল। ১৯৪০ সালে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত ‘মজলিস্-ই-আহররের’ প্রাদেশিক সম্মেলনে গৃহীত প্রস্তাবে পুনরায় উল্লেখ করা হয় - ভারতের পূর্ণ ও সর্বাঙ্গীণ স্বাধীনতা লাভই এই প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য।
ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে আব্দুস সামাদ খান আচকজাই একটি গুরুত্বপূর্ণ নাম। গান্ধীজির অসহযোগ আন্দোলনে তিনি অংশ নিয়েছিলেন। এই সময় তিনি বেলুচিস্তানের গণ্ডি ছাড়িয়ে সর্বভারতীয় রাজনীতিতে অংশ নিয়েছিলেন। আব্দুল সামাদ খান জাতীয় কংগ্রেসে যোগ দিয়েছিলেন ও তাঁর আঞ্জুমান-ই-বতন নামক প্রতিষ্ঠানটি জাতীয় কংগ্রেসের অনুমোদন লাভ করেছিল। তিনি উত্তর ভারতের নওজোয়ান ভারত সভার সংস্পর্শে এসেছিলেন। ১৯২৯ সালের ডিসেম্বর মাসে তিনি জাতীয় কংগ্রেসের লাহোর অধিবেশনে যোগ দিয়েছিলেন। ১৯৩০ সালে আব্দুস সামাদ খান ও তাঁর দুই ভ্রাতাকে গ্রেপ্তার করে কোয়েটায় নিয়ে আসা হয়। তাঁরা দুই বৎসর কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন। সৈয়দ হাসান ইমাম ১৯৩০-র আইন অমান্য আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন। ১৯২৭ সালে ভারতে আগত সাইমন কমিশনকে বয়কট আন্দোলনে তাঁর সক্রিয় ভূমিকা ছিল। ১৯৩০-৩২-র লবণ সত্যাগ্রহ আন্দোলনের সময় জাতীয় নেতৃত্ব কারারুদ্ধ হলে ইউসুফ জাফর মেহেরালি নেতৃত্ব দিয়ে প্রচুর স্বেচ্ছাসেবক নিয়ে সরকারের দমননীতির বিরোধিতা করেছিলেন। পরবর্তীতে কংগ্রেস সোস্যালিস্ট পার্টিতে যোগ দিয়ে কারারুদ্ধ হন।
ডান্ডি অভিযাত্রীদের মধ্যে মুসলিম সম্প্রদায়ের লোকও ছিলেন। মহাত্মা গান্ধীকে গ্রেপ্তার করা হলে আইন অমান্য আন্দোলনে যাঁরা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে আববাস তায়েবজি, ইমাম সাহেবও ছিলেন। আব্দুল কালাম আজাদ দৃঢ় ভূমিকা নিয়েছিলেন। পাঞ্জাবে অনেক মুসলমান রমণীও আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন। আইন অমান্য আন্দোলনে ব্রিটিশ পুলিশের নির্যাতন ও অত্যাচারের মধ্যেও যাঁরা বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন তাঁদের মধ্যে আবদুল আহমদ, আব্দুল জলিল, আবদুল্লা, আবদুল, রসুল প্রমুখ উল্লেখযোগ্য ছিলেন।
মুফতি কিয়াফেত উল্লাহ্ ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস পরিচালিত আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিলেন। ১৯৩১ সালে দিল্লিতে আইন অমান্য আন্দোলন পরিচালনার দায়িত্ব তাঁর উপর পড়েছিল। আইন অমান্য আন্দোলন পরিচালনার অভিযোগে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। ১৯৩০-৩২ সালে আইন অমান্য আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণের জন্য দৌলতুন্নেসা খাতুনকে কারাদণ্ড ভোগ করতে হয়েছিল। দৌলতুন্নেসার মায়ের নাম ছিল নুরুন্নেসা বেগম। তিনি ‘গাইবাঁধা মহিলা সমিতি’ নামে একটি সেবা সঙ্ঘ স্থাপন করেছিলেন। তিনি মহিলাদের নিয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরে দেশপ্রেম প্রচার করতেন।
কাশ্মীরে জাতীয়তাবাদী শক্তিগুলিকে যাঁরা শক্তিশালী করে তুলেছিলেন তাঁদের মধ্যে তিন-চতুর্থাংশেই মুসলিম ছিলেন। ১৯৩২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় দ্য কাশ্মীর মুসলিম কনফারেন্স। এর প্রতিষ্ঠাতা সেখ মহম্মদ আবদুল্লাহ জাতীয়তাবাদী চেতনার মানুষ ছিলেন। তাঁর লড়াই ছিল দেশের মুক্তির জন্য। আবদুল্লাহ দ্বিজাতি তত্ত্বকে খারিজ করে দিয়েছিলেন। তিনি ভারত ভাগের বিরোধী ছিলেন।
ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে খান আব্দুল গফ্ফর খানের ভূমিকা চিরউজ্জ্বল। তিনি ‘সীমান্ত গান্ধী’ নামে পরিচিত ছিলেন। উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের মানুষ খান আবদুল গফ্ফর খানের নেতৃত্বে ‘খুদাই খিদমতগার’ দেশপ্রেমিক ও সামাজিক আন্দোলনে নেতৃত্বে দিয়েছিলেন। ১৯৩০ সালে আইন অমান্য আন্দোলনে আবদুল গফ্ফর খানের নেতৃত্বে সংগঠিত ‘খুদাই খিদমতগার’ বা লালকোর্তা বাহিনী ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিল। দলটি তৈরি হওয়ার দু-বছরের মধ্যে সদস্য সংখ্যা দু লক্ষ ছাড়িয়ে গিয়েছিল।
১৯২৯ সালে লাহোরে অনুষ্ঠিত কংগ্রেসের অধিবেশন বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কারণ এই অধিবেশনে পূর্ণ স্বাধীনতার প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়েছিল। পূর্ণ স্বাধীনতার প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার ফলে খান আবদুল গফ্ফর খান ও অন্যান্য মুসলিম নেতারা উৎসাহিত হয়েছিলেন। ১৯৩০ সালের ২৩ এপ্রিল খান আবদুল গফ্ফর খান তাঁর নিজের গ্রাম উৎমনতে অনুষ্ঠিত এক বিশাল জনসভায় সবাইকে আইন অমান্য অংশ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন।
ভারত ভাগের বিরুদ্ধে ছিল ‘খুদাই খিদমতগার’। এই কারণে দেশভাগ সীমান্তগান্ধী মানতে পারেননি। প্রসঙ্গত, প্রথমে স্থির ছিল মুসলিম লিগ ১৯৪৬ সালের সাধারণ নির্বাচনে যেভাবে প্রদেশে জয়লাভ করেছিল তাদের নিয়েই পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠিত হবে। অন্যান্য প্রদেশগুলি ভারতের সঙ্গে সংযুক্ত থাকবে। অর্থাৎ উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ ভারতে থাকার কথা ছিল। কিন্তু মুসলিম লিগ হঠাৎ করে দাবি তোলে সীমান্ত প্রদেশের মানুষ ভারত বা পাকিস্তান কোন রাষ্ট্রে যোগ দেবে তা নির্ধারণ করার জন্য সীমান্ত প্রদেশে গণ-ভোট গ্রহণ করতে হবে। কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি এই অন্যায় দাবি মেনে নিয়েছিল। সীমান্ত গান্ধী মানতে পারেননি। প্রতিবাদ করেছিলেন ফল হয় নি। ১৯৪৭ সালের ১৪ ও ১৫ আগস্ট পাকিস্তান ও ভারত স্বাধীন হলো, কিন্তু সীমান্ত প্রদেশের পাঠান ও বালুচরা এই স্বাধীনতাকে যথার্থ বলে মেনে নিতে পারলেন না।
আব্দুল গনিদার ১৯৩০-এ লবণ সত্যাগ্রহে যোগদান করেন। ১৯৩২-এ ব্রিটিশ বিরোধী বক্তব্য রেখে, ১৯৪২-এ ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে যোগ দিয়ে গ্রেপ্তারবরণ করেছিলেন। ১৯৩০ সালে আইন অমান্য আন্দোলনে যোগ দিয়ে আসফ আলীকে কিছুকালের জন্য জেলে যেতে হয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর গান্ধীজির নেতৃত্বে যে যুদ্ধ বিরোধী আন্দোলন পরিচালিত হয়েছিল সেই আন্দোলনেও তাঁর বিশিষ্ট ভূমিকা ছিল। ভারত ছাড়ো আন্দোলনের শুরুতেই তিনি গ্রেপ্তার হয়েছিলেন।
আল্লা বখশ সিন্দেয় একজন বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ। তিনি দুবার প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। ব্রিটিশ সরকারের দমননীতির প্রতিবাদে তিনি ‘খান বাহাদুর’ এবং ‘ওবিই’ খেতাব ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। আল্লা বখশ ছিলেন ভারতের প্রথম প্রাদেশিক প্রধানমন্ত্রী যাঁকে তাঁর পদ থেকে বরখাস্ত করা হয়েছিল। চার্চিল ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও ভারত ছাড়ো আন্দোলন নিয়ে এক বক্তব্যে আবমাননাকর মন্তব্য করেছিলেন। এর প্রতিবাদে তিনি ব্রিটিশ প্রদত্ত সমস্ত খেতাব ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। ১৯৪২-র ১৯ সেপ্টেম্বর ভাইসরয় লিনলিথগোকে লেখা চিঠিতে ‘খানবাহাদুর’ ও ‘অর্ডার অফ ব্রিটিশ এম্পায়ার’ উপাধি দুটি বর্জনের কথা লিখেছিলেন।তিনি মুসলিম লিগের পাকিস্তান প্রস্তাব ও দ্বিজাতি তত্ত্বের বিরোধিতা করেছিলেন।
’৪২-র ‘ভারতছাড়ো’ আন্দোলনের শুরুতেই যাঁরা গ্রেপ্তার হয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে আবুল কালাম আজাদ, আসফ আলি ছিলেন। ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনে অংশ নিয়ে যাঁরা শহিদ হয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে বাংলাদেশের আজিমবক্স, আবদুল সেখ, আলাউদিন সেখ, বিহারের আবদুল শুকুর, আব্দুল রহিম প্রমুখ ছিলেন। আবদুল সামাদও গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। ’৪২-র আন্দোলনের সময় ডঃ সৈয়দ মাহমুদ কারারুদ্ধ হয়েছিলেন।
সিঙ্গাপুরে নেতাজির হাতে মহম্মদ হাবিব নামে এক ব্যবসায়ী এক কোটিরও বেশি টাকা তুলে দিয়েছিলেন। হাবিব রেঙ্গুনের বিখ্যাত ধনী ব্যক্তি ছিলেন। আজাদ হিন্দের প্রথম গভর্নমেন্টের মধ্যে আজিজ আহম্মদ (ফৌজের প্রতিনিধি), শাহ্নওয়াজ (ফৌজের প্রতিনিধি), করিম গনি (উপদেষ্টা), ডি এম খান (উপদেষ্টা) ছিলেন। দিল্লির লালকেল্লায় আজাদ হিন্দ বাহিনীর যে তিন বড়ো অফিসারের বিরুদ্ধে বিচার শুরু হয়েছিল তার মধ্যে অন্যতম ছিলেন শা’নওয়াজ খান। দিল্লির লালকেল্লায় আজাদ হিন্দ বাহিনীর বন্দি সৈনিকদের বিচারের জন্য সামরিক আদালত বসেছিল। ১৯৪৬ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি ক্যাপ্টেন রসিদ আলিকে দীর্ঘমেয়াদি কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। ১৯৪৪ সালে নেতাজি এক ওয়ার কাউন্সিল গঠন করেছিলেন। সেই কাউন্সিলের সদস্যদের মধ্যে হবিবুর রহমান, কর্নেল আজিজ আমেদ, কর্নেল হবিবুর রহমান, কর্নেল শা’নওয়াজ খাঁ ছিলেন।
আজাদ হিন্দ বাহিনীর সে সমস্ত বীর সৈনিক শহিদ হয়েছিলেন তার সঠিক হিসাব পাওয়া যায় না। তার মধ্যেও যাঁদের নাম শহিদ হিসাবে পাওয়া গিয়েছে তাঁদের মধ্যে - বরকত (হিমাচল প্রদেশ), ইনায়েৎ উল্লা, আহমদ খাঁ (উত্তর পশ্চিম সীমান্ত), আব্দুল আজিজ (উত্তরপ্রদেশ) প্রমুখ মুসলিমরা ছিলেন। এছাড়া শহিদ হয়েছিলেন পাঞ্জাবের আবদুল আজিজ, আবদুল রহমান খাঁ, আজাইব সিং আখতার আলী আলতাফ হোসেন, হরিয়ানার অভীরাম আল্লাদীন, আমীন লাল, বখতার। বসির আইমদ ফতে মোহম্মদ, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের হাফিজুল্লা, ইনায়েৎ উল্লা, মহঃ ইউসুফ, আমির হায়াৎ প্রমুখ মুসলিমরা ছিলেন।
নৌ বিদ্রোহে অংশ নিয়ে যারা শহিদ হয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে তাজমহম্মদ, ফজলে মহম্মদ, সুলেমান, এব্রাহিম, জাকিউদ্দিন, সুলেমানজী, আব্দুল আলি, দীনমহম্মদ, মহম্মদ হুসেন প্রমুখ ছিলেন। ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রামে অংশ নেওয়ার জন্য ১৯৩১ সালের ১০ জানুয়ারি আহমদ কুরবান হোসেন, ১৯৪৩ সালের ১০ সেপ্টেম্বর মহম্মদ আব্দুল কাদেরের ফাঁসি হয়েছিল। সৌকতুল্লা আনসারি দেশপ্রেমিক মুসলিমদের আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তিনি দ্বিজাতি তত্ত্বের তীব্র বিরোধী ছিলেন।
স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে মুসলিম নারীদের অবদান অবিস্মরণীয়। বিক্রমপুরের সুবাসপুর গ্রামের ফুলবাহার বিবি, ময়মনসিংহের রাজিনা খাতুন ও হালিমা খাতুন, ঢাকার সামছুন্নেহা, রওসনআরা বেগম, রইসাবানু বেগম, বদরনেছা বেগম, কলকাতার হীরামন বিবি, হাজিমন্মেসা খাতুন, শহিদা খান, হোসেনারা বেগম প্রমুখ মুসলিম নারী আইন অমান্য আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিলেন।
কলকাতায় ‘মুসলিম মহিলা আত্মরক্ষা কমিটি’ গঠিত হয়েছিল। নাজি মুন্নেসা নামে এক মুসলিম মহিলার নেতৃত্বে প্রায় পাঁচ শতাধিক মুসলিম মহিলা শ্রমিক মহাত্মাজির মুক্তির দাবি করেছিলেন। ১৯৪৩ সালে জুলাই মাসে খুলনাতে মহিলাদের এক সভায় অনেক মুসলিম মহিলা অংশগ্রহণ করেছিলেন। ব্রিটিশ সরকার ১৯৪৪ সালে সরোজিনী নাইডুকে জনসভায় বক্তৃতা না দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিল। এর বিরুদ্ধে দিনাজপুরে এক নারী সম্মেলন হয়। এই সম্মেলনে শাহজাদি বেগমের নেতৃত্বে প্রচুর মুসলিম নারী অংশ নিয়েছিলেন।
ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসকে বিকৃত করতে চাইছে আরএসএস। স্বাধীনতা আন্দোলনে হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের ভূমিকা ছিল। মুসলিমদের ভূমিকা বাদ দিয়ে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাস লিপিবদ্ধ করা যায় না।