E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৬০ বর্ষ ৪ সংখ্যা / ২ সেপ্টেম্বর, ২০২২ / ১৬ ভাদ্র, ১৪২৯

ত্রিপুরার চিঠি

ত্রিপুরার রাজনীতির গতি প্রকৃতি ও অভিমুখ

নরেশ জমাতিয়া


ত্রিপুরার রাজ্য রাজনীতিতে আমরা দ্রুত নাটকীয় পরিবর্তন লক্ষ করছি। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী যিনি ২০৪৭ সাল পর্যন্ত স্বপদে থাকার স্বগর্ব ঘোষণা করেছিলেন তিনি হঠাৎ করেই অপসারিত হলেন। নতুন একজনকে মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হলো। এই ঘটনা বিগত ৪ বছরের রাজ্যের ঘটনাবলি থেকে বিচ্ছিন্ন কোনো বিষয় নয়। বিজেপি-আইপিএফটি জোট সরকারের অপশাসনে রাজ্যের ব্যাপক অংশের মানুষ বীতশ্রদ্ধ ও ক্ষুব্ধ। ফলশ্রুতিতে রাজ্য রাজনীতিতে বিভিন্ন শ্রেণি ও দলের পারস্পরিক সম্পর্ক ও শক্তির ভারসাম্যে দ্রুত পরিবর্তন ঘটে চলেছে। এই ধরনের প্রেক্ষাপটে সরকারের পতনকে রোখার জন্য মুখ্যমন্ত্রী বদল করা হলো।

রাজ্যে ফ্যাসিস্টসুলভ সন্ত্রাস ও সীমাহীন দুর্নীতির রাজত্ব চলছে। এ ধরনের ফ্যাসিস্টসুলভ সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াই করার অভিজ্ঞতা রাজ্যবাসীর আছে। ১৯৮৮ সাল থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত আরেকটি আধা ফ্যাসিস্ট সন্ত্রাসের রাজত্বকে পরাস্ত করে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের অভিজ্ঞতার আলোকে আমি বলতে চাই যে, মুখ্যমন্ত্রী বদল হলো জোট সরকারের অন্তর্জলি যাত্রা। এই সরকারকে আর বাঁচানো যাবে না। রাজ্য রাজনীতির গতির অভিমুখ যে অবধারিত পালা পুনর্বদলের দিকেই এগিয়ে যাচ্ছে তা এখানে তুলে ধরার চেষ্টা করছি।

জনকল্যাণে সরকার সম্পূর্ণ ব্যর্থ

বর্তমান জোট সরকার প্রতিষ্ঠার পর অচিরেই মানুষ বুঝতে পারে যে, বিজেপি’র ভিশন ডকুমেন্ট আসলে প্রতারণার দলিল ছাড়া অন্য কিছু নয়। তাদের প্রতিশ্রুতি রূপায়ণে এই সরকার সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হলো। ফলে এই সরকার ব্যাপকভাবেই জনসমর্থন হারাতে থাকে। রাজ্যের ট্রাইবেল অংশের জনগণের মধ্যে সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষোভ বেশি পুঞ্জিভূত হতে থাকে। তিপ্রাল্যান্ডের দাবি নিয়ে বিজেপি’র ভণ্ডামি এবং ভাঁওতাবাজি জোট শরিক আইপিএফটি’র নেতা-কর্মীদের একটা অংশকে ভীষণভাবে ক্ষুব্ধ করে তোলে। ওই সময়ে কেন্দ্রীয় সরকারের সিএএ আইন প্রণয়ন আগুনে ঘি ঢালার কাজ করে। জিরানীয়াতে ট্রাইবেল যুবক-যুবতী সিএএ আইনের বিরোধিতা করে রাস্তা অবরোধ করে। সেখানে জোট সরকারের পুলিশ নির্বিচারে গুলি বর্ষণ করে। কয়েকজন গুরুতরভাবে আহত হয়। ফলশ্রুতিতে ট্রাইবেল এলাকায় ক্ষোভের আগুন জ্বলে ওঠে। ওই সময়ে প্রদ্যুৎ কিশোর মাণিক্য বেশ কয়েকজন রিটার্নিজ নেতাদের সঙ্গে নিয়ে খুমলুঙয়ে ট্রাইবেলদের বিক্ষোভ সমাবেশে গিয়ে ‘পৌইলা জাতি, উল’ পার্টি’ (প্রথমে জাতি, পরে পার্টি) স্লোগান তোলেন। তিনি ছিলেন কংগ্রেসের রাজ্য প্রেসিডেন্ট। তিনি কংগ্রেস ত্যাগ করে ‘তিপ্রা মথা’ দল গঠন করেন। যারা আইপিএফটি দলে থেকে ২০১৮ সালে অক্লান্ত পরিশ্রম করে জোট সরকার এনেছিল তাদের বড়ো অংশই এই ‘তিপ্রা মথা’তে যোগ দেয়। বিজেপি জোট সরকারের বিরুদ্ধে ট্রাইবেল অংশের জনগণের ক্ষোভ এত গভীর ও তীব্র ছিল যে, এডিসি নির্বাচনে শাসক জোট সর্বশক্তি নিয়োগ করেও পরাজিত হয়।

এখানে উল্লেখ্য যে, ১৯৮৮ সাল থেকে ১৯৯৩ সাল কংগ্রেস যুব সমিতির জোট জমানায় এডিসি নির্বাচনে শাসক জোট পরাজিত হয়নি, জোর জুলুম-রিগিং করেই তারা এডিসি দখল করেছিল। এবারের জোট সরকারও তাই করতে আপ্রাণ চেষ্টা করেছিল। কিন্তু ব্যর্থ হয়। শুধু পরাজয় নয়, শাসক জোটের কর্মীরা মার খেতেও শুরু করে। যারা ২০১৮ সালের পর শুধু মারতে অভ্যস্ত, সেই বিজেপি’র কর্মীরা অনেক ট্রাইবেল এলাকায় মার খেয়ে পালাতে বাধ্য হয়। বলা যায় এডিসি নির্বাচন থেকে এডিসি এলাকা অর্থাৎ রাজ্যের অর্ধেকের বেশি এলাকা শাসক জোটের হাতছাড়া হলো।

বিজেপি-তে অন্তর্কোন্দল ও ভাঙন

এটা অনস্বীকার্য যে, ২০১৮ সালের বিধানসভা নির্বাচনের আগে রাজ্যের প্রায় সকল কংগ্রেস এমএলএ এবং নেতা-কর্মী বিজেপি’তে যোগদান না করলে জোট সরকার গঠন সম্ভব ছিল না। এক সময়ের কংগ্রেসের শীর্ষ নেতা সুদীপ বর্মণ, আশিস সাহা, সুবল ভৌমিকরা জোট সরকার আনার জন্যে অক্লান্ত পরিশ্রম করেছিলেন। তারা আজ তাদের প্রতিষ্ঠিত শাসকদলে থাকতে পারছেন না, বিজেপি ত্যাগ করতে বাধ্য হলেন। নিজেদের গড়া সরকার ও শাসকদলের গুন্ডাদের হাতে তারা আজ আক্রান্ত হচ্ছেন। তাদের বিজেপি ত্যাগের সঙ্গে সারা রাজ্যের বিজেপি নেতা-কর্মীদের মধ্যে বিজেপি ত্যাগের প্রবণতা দারুণভাবে বাড়তে থাকে। ফলে জোট সরকারের পতনের সম্ভাবনা দেখা দেয়। সরকারের পতনকে রোখার জন্যে মুখ্যমন্ত্রী বদল করা হয়। কিন্তু রাজ্যবাসী প্রত্যক্ষ করেছেন যে, মুখ্যমন্ত্রী বদলের সময়েই বিজেপি’র অন্তর্কোন্দল কীভাবে আরও বেড়েছে, চেয়ার নিয়ে ছোড়াছুড়ির দৃশ্য মিডিয়ায় মানুষ প্রত্যক্ষ করেছেন।

যাদের দ্বারা এই জোট সরকার গঠিত হয়েছিল সেই সুদীপ বর্মণ, আশিস সাহা, সুবল ভৌমিকের মতো নেতারা আজ বিজেপি’তে নেই। তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে আরও বিজেপি বিধায়কের দলত্যাগের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

বিজেপি দল কত দুর্বল হয়ে যাচ্ছে তা গত বিধানসভার ৪টি আসনের উপনির্বাচনেও প্রকাশিত হয়েছে। উপনির্বচনে কয়েকটি কেন্দ্রের জয়-পরাজয়ে সরকার পরিবর্তন হয় না। ফলে মানুষ উপনির্বাচনে খুব বেশি ঝুঁকি নিতে চায় না। ফলে শাসকদলেরই জয়ের সুযোগ ও সম্ভাবনা বেশি থাকে। তথাপি গত উপনির্বাচনে একটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ আসনে বিজেপি হেরে গেল। প্রার্থী সুদীপ বর্মণের উপর পর্যন্ত প্রাণঘাতী আক্রমণ করা হয়। ভোট লুটের সকল প্রচেষ্টা তো ছিলই। তথাপি তারা পরাস্ত হয়। ৪টি কেন্দ্রে ব্যাপক রিগিং, ছাপ্পা ভোট সত্ত্বেও বিজেপি’র ভোট লক্ষণীয়ভাবে কমেছে। এতে সারা রাজ্যে বিজেপি ত্যাগ করে কংগ্রেসে ফিরে আসার স্রোত আরও জোরালো হচ্ছে। ২০১৮ সালের আগে রাজ্যে বিজেপি’র ভোট মাত্র দেড় থেকে দুই শতাংশ ছিল। কংগ্রেস এবং আইপিএফটি’র কারণে তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়। সেই কংগ্রেস এবং আইপিএফটি’র নেতা-কর্মীরা আজ অনেকেই তাদের সঙ্গে না থাকার পরিণাম কী হবে, তা অনুমান করা খুবই সহজ ব্যাপার। আগে পাহাড় পরে সমতলও হাতছাড়া হবার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে উপনির্বাচনের ফলাফলে।

গত উপনির্বাচনে আরেকটি তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় লক্ষণীয়। সুরমা কেন্দ্রে তিপ্রা মথা’র প্রার্থী পরাজিত হলো। এডিসি নির্বাচনে জয় লাভের পর তিপ্রা মথা’র নেতা-কর্মীদের মধ্যে প্রচণ্ড অহংকার দেখা দেয়। হাবভাবে দেখা যায় যেন তারাই এডিসি এলাকার একমাত্র চূড়ান্ত কথা বলার মালিক। গ্রেটার তিপ্রাল্যান্ডের অবাস্তব দাবিতে নাকি তারা শেষ লড়াই লড়বে ২০২৩ সালে। সুতরাং, ২০২৩ সাল পর্যন্ত এডিসি এলাকায় অন্য কোনও পার্টি করা চলবে না। অত্যন্ত অন্যায় ও অগণতান্ত্রিক বক্তব্য। তারা মনে করেছিল তারা অপরাজেয়-অপ্রতিরোধ্য। তারা যা চাইবে তাই হবে। কিন্তু সুরমা কেন্দ্রে প্রমাণিত হলো, তারা চাইলেই সবকিছু তাদের ইচ্ছামতো হয় না। তাদের দর্প চূর্ণ হলো। গণবর্জিত বিজেপি’র কাছেই তারা পরাজিত হলো এতে সাধারণ আসন তো দূরে থাক বিধানসভার এস টি কেন্দ্রগুলিতেও যেখানে ননট্রাইবেল ভোট ফ্যাক্টর সেখানে তারা জিততে পারবে না, তা পরিষ্কার হলো।

মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন

আজকাল প্রায় প্রতিদিন বিভিন্ন দাবিতে রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় মানুষের বিক্ষোভ আন্দোলন দেখা যাচ্ছে। রাস্তা, বিদ্যুৎ, পানীয় জল, রেগার মজুরি, সামাজিক ভাতা, বিদ্যালয়ের শিক্ষক ইত্যাদি দাবিতে মানুষ স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনে শামিল হচ্ছেন। রাস্তা অবরোধ, অফিস ঘেরাও, অফিসে তালা ইত্যাদি খবর মিডিয়ার পর্দায় প্রায় প্রতিদিন দেখা যাচ্ছে। এর সঙ্গে বিভিন্ন পার্টি ও সংগঠনের আহূত সংগঠিত আন্দোলনগুলি তো চলছেই। রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় মন্ত্রী, এমএলএ’দের বিরুদ্ধে মানুষ বিক্ষোভ প্রদর্শন করছে। একটা সরকারের পতনের আগে জনগণের যে আচরণ দেখা যায়, সেটাই দেখা যাচ্ছে আজ আমাদের রাজ্যেও।

এ রাজ্যের সংগ্রামী মানুষ কংগ্রেস-যুব সমিতি জোট আমলে পাহাড়ে রাইফেল এবং সমতলে রামদা বাহিনীকে মোকাবিলা করে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করেছিলেন। এই জোট সরকারের বাইক বাহিনীকেও ত্রিপুরাবাসী মোকাবিলা করতে সক্ষম। ইতিমধ্যে বাইক বাহিনীর সংখ্যা কমেছে। উপনির্বাচনে আগরতলায় অন্য মহকুমা থেকে প্রচুর সংখ্যায় তাদের গুন্ডাবাহিনী জড়ো করতে হয়েছিল। আগরতলা শহরে প্রয়োজনীয় সংখ্যক সন্ত্রাসী তারা জোগাড় করতে পারেনি।

মানুষের সরকার হঠানোর প্রবল ইচ্ছা

এডিসি নির্বাচনের সময় দেখা গিয়েছিল যে, আমাদের বামপন্থীদের একটা ভালো অংশের ভোট তিপ্রা মথা পেয়েছে। বিজেপি’কে পরাজিত করার প্রবল ইচ্ছা থেকে মানুষ এ কাজ করেছিল ভোট ভাগাভাগি এড়ানোর লক্ষ্যে। তখন আমাদের শত্রুপক্ষ আইপিএফটি’র লোকদের বলতে শোনা যায় যে, তারা ২৫ বছর বাম আমলে বিরোধী দলে ছিল, কিন্তু বামফ্রন্টের লোকেরা কয়েক মাসও বিরোধী হিসাবে থাকতে চাইছে না। এটা ঠিক নয়। আমাদের মধ্যেও কেউ কেউ বলতে চাইলেন এটা হলো সর্বদা ক্ষমতায় থাকার প্রবল ইচ্ছা বা সংসদীয় মোহ।

বামফ্রন্টের ২৫ বছরের রাজত্বে মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার আক্রান্ত হয়নি, এখনকার মতো শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি অকল্পনীয় ছিল। কারও ব্যক্তি স্বাধীনতা খর্ব হয়নি। রাজ্যের অভূতপূর্ব উন্নয়ন সাধিত হয়েছিল। বিরোধীরাও এই উন্নয়ন থেকে বঞ্চিত ছিলেন না। সে ধরনের শান্তি-সম্প্রীতি ও উন্নয়নের কাজ যদি আজ বিজেপি সরকার করত তবে জনগণের মধ্যে যেকোনো প্রকারে সরকারকে হঠানোর এই প্রবল আকাঙ্ক্ষা দেখা যেত না। ফ্যাসিস্টসুলভ সন্ত্রাসের রাজত্বের শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পাবার লক্ষ্যেই মানুষের মধ্যে আজ এই প্রবল সরকার বিরোধী প্রবণতা বিরাজমান।

এই গণবিক্ষোভের নেতৃত্ব দিতে হবে

রাজ্যে জোট সরকারের ফ্যাসিস্টসুলভ সন্ত্রাস এবং সীমাহীন দুর্নীতির বিরুদ্ধে রাজ্যে ব্যাপক গণবিক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে। একে সঠিক দিশায় পরিচালনা করতে সক্ষম আমাদের পার্টি। অতীতে প্রথম জোট সরকারকে পরাস্ত করে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে যেভাবে আমাদের পার্টির নেতৃত্বে রাজ্যবাসী সফল হয়েছিল, তেমনি এবারও সফল হবে। এক্ষেত্রে পার্টির ২৩ তম কংগ্রেসের গৃহীত রাজনৈতিক রণকৌশল অনুযায়ী নিজের পার্টি ও বামফ্রন্টকে শক্তিশালী করে বাম গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ দল ও জনগণের বৃহত্তম যুক্ত আন্দোলন গড়ে তোলার মাধ্যমে রাজ্য রাজনীতির পুনরায় পালা বদলের অভিমুখে যাত্রাকে চূড়ান্ত রূপ দিতে পার্টি সক্ষম হবে।


[লেখকঃ সিপিআই(এম) ত্রিপুরা রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য এবং পূর্বতন বামফ্রন্ট সরকারের গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রী]