E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৯ বর্ষ ১৬ সংখ্যা / ৩ ডিসেম্বর, ২০২১ / ১৬ অগ্রহায়ণ, ১৪২৮

আলোচনা ছাড়াই সংসদে কৃষি আইন প্রত্যাহৃত


টিকরি সীমান্তে কৃষকদের উচ্ছ্বাস।

নিজস্ব সংবাদদাতাঃ কৃষিবিরোধী তথা জাতীয়স্বার্থ বিরোধী কেন্দ্রের তিন কৃষি আইন অবশেষে সংসদে প্রত্যাহৃত হলো। ২৯ নভেম্বর সংসদে শীতকালীন অধিবেশনের প্রথম দিন সংসদের দুই কক্ষে তিন কৃষি আইন প্রত্যাহারের বিল অনুমোদিত হয়েছে। বিলটি পেশ হবার পর বিরোধীরা সেটি নিয়ে আলোচনার দাবি তুলেছিলেন। কিন্তু সরকার তাতে কর্ণপাত করেনি। ২০২০-র সেপ্টেম্বরে কৃষি আইন পাশ করানোর সময়ে যেমন কোনো আলোচনার সুযোগ দেওয়া হয়নি, তেমনি এদিনও সেই আইন প্রত্যাহারের সময় কোনো আলোচনার অবকাশ দেয়নি কেন্দ্র। বিলটিকে অবশ্য বিজেপি নেতারা ধ্বনি ভোটে সমর্থন জানান।

তবে যাই হোক, কৃষক স্বার্থবিরোধী ও কর্পোরেট স্বার্থবাহী কালা কৃষি আইন সংসদে প্রত্যাহারের মধ্য দিয়ে ভারতে নতুন ইতিহাস রচনা হলো বলে এদিন এক বিবৃতিতে উল্লেখ করেছে সংযুক্ত কিষান মোর্চা।

প্রধানমন্ত্রী এদিন সকালে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, যে কোনো বিষয়ে আলোচনা করতে সরকার রাজি। কিন্তু তার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া প্রতিশ্রুতির খেলাপ করা হলো। এদিন বিরোধীরা অভিযোগ করেছেন, আলোচনা হলে অন্তত তিনটি বিষয়ে প্রশ্ন উঠত। সেগুলি হলো -

এক, ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের নিশ্চয়তা আইন তৈরি। এই দাবিতে অনড় রয়েছেন কৃষকরা। তিন কৃষি আইন প্রত্যাহারের পর থেকে এটাই কৃষক আন্দোলনের মুখ্য দাবি হয়ে উঠেছে।

দুই, কেন্দ্রের সর্বনাশা তিন কৃষি আইন বাতিলের দাবিতে আন্দোলনে ৭০০-র বেশি কৃষক প্রাণ দিয়েছেন। তাঁদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণের দাবি তুলেছেন কৃষকরা।

তিন এবং অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, সংসদে আলোচনা হলেই লখিমপুর খেরির হত্যাকাণ্ডের প্রসঙ্গ উঠে আসত। এই হত্যাকাণ্ডের ষড়যন্ত্রে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অজয় মিশ্র টেনি জড়িত। তাঁর গাড়িতেই পিষ্ট হয়ে প্রাণ হারিয়েছেন চার কৃষক ও এক সাংবাদিক। এই ঘটনায় প্রত্যক্ষভাবে জড়িত কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর পুত্র আশিস মিশ্র টেনি। সে এখন কারারুদ্ধ হয়ে আছে। এই অবস্থায় অজয় মিশ্রকে মন্ত্রীসভায় রেখে কোন্‌ নৈতিকতা দেখাচ্ছে সরকার, এই প্রশ্নে বিদ্ধ হতেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী। এই অস্বস্তিকর প্রশ্নগুলি এড়াতেই কোনো আলোচনা ছাড়াই কৃষি আইন প্রত্যাহারের বিল পাশ করিয়ে নিয়েছে সরকার।

এদিন সংসদে যে তিন কৃষি আইন প্রত্যাহৃত হয়েছে তা হলো -
(১) কৃষকের ফসল বাণিজ্য (উন্নতকরণ ও সহায়ক) আইন;
(২) অত্যাবশ্যক পণ্য আইন (সংশোধনী);
(৩) কৃষকদের চুক্তি চাষে সুরক্ষা ও ফসলের মূল্য নিশ্চিতকরণ আইন।

এদিন লোকসভায় ১২.০৬ মিনিটে বিলটি পেশ হয়, অনুমোদিত হয় ১২.১০ মিনিটে। বিলটি পেশের পর বিরোধীদের আলোচনার দাবিকে উপেক্ষা করেই সরকার পক্ষ ধ্বনি ভোটে বিল‍‌টি পাশ করায়। একইভাবে দুপুর দু’টোয় রাজ্যসভায় বিলটি পেশ করেন কেন্দ্রীয় কৃষিমন্ত্রী নরেন্দ্র সিং তোমর। এখানেও মিনিট খানেকের মধ্যে ধ্বনি ভোটে বিল পাশ হয়ে যায়। বিরোধীরা আলোচনার দাবি তুললে কৃষিমন্ত্রী আলোচনার কোনো প্রয়োজনই নেই বলে জানান। তিনি এও জানান, গুরু পরবের দিন এই বিল প্রত্যাহারের ঘোষণা নাকি উদারতার প্রমাণ! কংগ্রেসের লোকসভার নেতা অধীর চৌধুরী বলেন, যে বিল পেশ হলো, অনুমোদনের জন্য সম্মতি চাওয়া হচ্ছে, সেই বিল নিয়ে আলোচনা হবে না কেন? সরকার সংসদের নিয়মকানুনও মানছে না। রাজ্যসভায় কংগ্রেস নেতা মল্লিকার্জুন খাগড়েকে অল্প সময়ের জন্য বলতে দেওয়া হয়েছিল। সেই সুযোগে তিনি বলেন, ৭০০-র বেশি কৃষক আন্দোলনে প্রাণ হারিয়েছেন। তাঁদের স্মরণে শোকজ্ঞাপন করা উচিত। লোকসভা ও রাজ্যসভায় বিলটি পাশ হবার পর রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষর হলে ‘কৃষি আইন প্রত্যাহার বিল, ২০২১’ আইনে পরিণত হবে।

সংসদে যে বিল পেশ করে এই আইন তিনটি তোলা হলো তার ভাষায় আপত্তি ছিল বিরোধীদের। কারণ সরকার সওয়াল করতে থাকে তারা কৃষক স্বার্থেই আইন করেছিল। নতুন বিলের উদ্দেশ্য সংক্রান্ত বিবৃতিতে দাবি করা হয়, তিন কৃষি আইনের মাধ্যমে ছোটো ও প্রান্তিক কৃষকদের স্বার্থ দেখা হয়েছিল। কৃষক নিজের ফসল যে কোনো জায়গায় যে কোনো ক্রেতার কাছে বিক্রির স্বাধীনতা পাচ্ছিলেন। এমন এক ব্যবস্থা তৈরি করা হচ্ছিল যেখানে প্রক্রিয়ণকারী, বড়ো পরিমাণ শস্য কেনেন এমন ক্রেতা, সংগঠিত খুচরো বণিজ্য, রপ্তানিকারীর সঙ্গে কৃষকদের সরাসরি যোগাযোগ হতো। বৈদ্যুতিন বাণিজ্যের পরিকাঠামো তৈরি করা হচ্ছিল। চুক্তি চাষের আইনি কাঠামো তৈরি করা হচ্ছিল যেখানে কৃষক ফসলের দাম আগাম পেয়ে যেতেন। সরকারের এই ব্যাখ্যার সঙ্গে প্রথম থেকেই দ্বিমত ছিল কৃষকদের।

তবে বিলের ভাষায় অসঙ্গতি, ঔদ্ধত্য, অহংবোধের প্রকাশের উল্লেখ করেও কৃষি আইন প্রত্যাহারকে স্বাগত জানিয়েছে সংযুক্ত কিষান মোর্চা। ২৯ নভেম্বর এক বিবৃতিতে সংযুক্ত কিষান মোর্চা বলেছে, কৃষক স্বার্থবিরোধী ও কর্পোরেটদের স্বার্থবাহী কালা কৃষি আইন সংসদে প্রত্যাহারের মধ্য দিয়ে ভারতে নতুন ইতিহাস রচিত হলো। তবে এখানেই শেষ নয়, একটি সংগ্রামে জয় এসেছে, আরও পথ হাঁটা বাকি। এখনও বকেয়া রয়েছে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দাবি। এই দাবিগুলিও আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আদায় করতে হবে। তাই জারি থাকবে আন্দোলন।

সংযুক্ত কিষান মোর্চা আরও বলেছে, ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলনের চাপে পড়ে কেন্দ্রীয় সরকার সংসদে কালা কৃষি আইন প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়েছে। যা এই সময়কালে কৃষক আন্দোলনে বড়ো জয়। কিন্তু এখনও অনেক গুরুত্বপূর্ণ দাবি পড়ে রয়েছে। কৃষক আন্দোলনের পক্ষ থেকে এবং বিরোধী দলগুলির তরফে এই দাবিগুলি তোলা হলে মোদী সরকার তা এড়িয়ে যেতে চেষ্টা করছে। তবে ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের গ্যারেন্টির দাবিতে যে আন্দোলন জারি রয়েছে, তা আগামী দিনেও চলবে। আন্দোলনকারীরা ধৈর্য নিয়ে অপেক্ষা করছে এই দাবি যথাযথ পূরণের জন্য।

কালা কৃষি আইন প্রত্যাহারের বিষয়ে প্রতিক্রিয়া দিতে গিয়ে সারা ভারত কৃষকসভার সাধারণ সম্পাদক হান্নান মোল্লা বলেছেন, মোদী সরকার যেদিন এই আইনের জন্ম দিয়েছিল, সেদিনই তার মৃত্যু পরোয়ানা লেখা হয়ে গিয়েছিল। আদানি, আম্বানিদের খুশি করতে এই আইন দেশে চালু করতে চে‍‌য়েছিলেন মোদী। কিন্তু গোটা দেশের কৃষক, খেতমজুররা এই আইন মেনে নেয়নি। কিন্তু মনে অন্য কথা থাকলেও আন্দোলনের চাপে সরকার এই আইন তুলে নিতে বাধ্য হয়েছে। সংসদে কোনো আলোচনা না করে ধ্বনি ভোটে এই আইন প্রত্যাহার করায় ক্ষোভ প্রকাশ করে হান্নান মোল্লা বলেছেন, আলোচনা করলে প্রকাশ্যে এসে যেত আইনটা সঠিক না বেঠিক। বিরোধীরাও আলোচনায় ওই আইনের ক্ষতিকারক দিকগুলি সংসদে তুলে ধরতে পারতেন, কিন্তু সরকার আলোচনা না করে একতরফাভাবে ধ্বনি ভোটে নতুন বিলটি পাশ করালো। তিনি বলেন, প্রবল কৃষক আন্দোলনের চাপে মোদী মাথা নুইয়েছে। কিন্তু পুরোপুরি নতজানু হননি। কারণ, কৃষকদের ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের (এমএসপি) নিশ্চয়তার বিষয়টিও এখনো নিষ্পত্তি হয়নি। অথচ কৃষকদের কাছে এমএসপি হলো জীবন মরণের মতোই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

এদিন সংসদে বিল পেশ করতে গিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে যে বিবৃতি দেওয়া হয়েছে, তাতে কৃষি আইনের পক্ষে খুবই দুর্বল যুক্তি হাজির করেছে কেন্দ্রীয় সরকার। একথা উল্লেখ করে সারা ভারত কৃষক সভা বলেছে, এই আইনে যে কোনো জায়গা, যে কোনো ব্যক্তিকে কৃষকরা তাঁদের ফসল বিক্রি করতে পারবেন। এই আইনে ফসল বিক্রি করার ক্ষেত্রে এমন স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছিল বলে মোদী সরকার যে দাবি করেছে তা নস্যাৎ করে কৃষক সভা এদিন এক বিবৃতিতে বলেছে, কৃষি ব্যয় ও মূল্য সংক্রান্ত কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী ‘এ২+এফএল’ সূত্র অনুযায়ী ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য পেয়ে থাকেন দেশের মাত্র ৬ শতাংশ কৃষক। অর্থাৎ দেশের ৯৪ শতাংশ কৃষকই উপযুক্ত দাম না পেয়ে ‍‌খোলা বাজারে অনেক ক্ষতি স্বীকার করে তাঁদের ফসল বিক্রি করতে বাধ্য হন। দেশের ৮৪ শতাংশ কৃষকই ছোটো ও প্রান্তিক চাষি। এরা সরকারি সুবিধা থেকে সব সময়ই বঞ্চিত। ফসল বাজারে নিয়ে যাওয়া এবং গুদামে রাখার খরচ বহন করার ক্ষমতা এদের নেই। অন্য জায়গায় গিয়ে অবাধে ফসল বিক্রি করতে বা ক্রেতাদের সঙ্গে দর কষাকষি করার ক্ষমতাই নেই। ফলে সরকারের এই দাবি সম্পূর্ণ অবাস্তব ছাড়া আর কিছুই নয়। উলটে স্বামীনাথন কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী ‘সি২+৫০শতাংশ’ সূত্র অনুযায়ী ফসলের ন্যূনতম দামে নিশ্চয়তা দিতে বলা হয়েছিল। মোদী এবং বিজেপি উভয়েই ‘সি২+৫০শতাংশ’ সূত্র অনুযায়ী কৃষকদের ফসলের দাম দেবার বিষয়ে প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এসেছিল।

মোদী সরকার বিবৃতিতে দাবি করেছিল, বৈদ্যুতিন বাণিজ্যের পরিকাঠামো তৈরি করার পাশাপাশি চুক্তি চাষের আইনি কাঠামো তৈরি করা হচ্ছিল, যেখানে কৃষক ফসলের দাম আগাম পেয়ে যেতেন। কিন্তু এই বিষয়ে সুনির্দিষ্ট ধারা থাকা দরকার ছিল যাতে কৃষকদের স্বার্থ রক্ষিত হয়। কৃষক সভা বলেছে, এসবের মধ্য দিয়ে ন্যূনতম সহায়ক মূল্য ও সরকারি সংগ্রহের ব্যবস্থা কার্যত তুলে দেওয়া হচ্ছিল। ‘বড়ো ক্রেতা’ অর্থাৎ কর্পোরেট কৃষি বাণিজ্যের হাতে ফসলের বিক্রির ভবিষ্যৎ তুলে দেবার ব্যবস্থা করা হয়েছিল।

এদিকে ভারত সরকারের তিন কৃষি আইন প্রত্যাহারকে স্বাগত জানিয়েছে রাষ্ট্রসঙ্ঘের মানবাধিকার বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা আশা প্রকাশ করেছেন‍‌ যে, ভবিষ্যতে কৃষি সংক্রান্ত যে কোনো সংস্কারের সিদ্ধান্ত নেবার আগে যেন দেশের মানবাধিকার দায়বদ্ধতাগুলি খতিয়ে দেখা হয়। পাশাপাশি এই ধরনের আইন রূপায়ণের আগে কৃষক সমাজ এবং ইউনিয়ন সহ সংশ্লিষ্ট সকল অংশের সঙ্গে যেন ফলপ্রসূ আলোচনা করে নেওয়া হয়।