৫৯ বর্ষ ১৬ সংখ্যা / ৩ ডিসেম্বর, ২০২১ / ১৬ অগ্রহায়ণ, ১৪২৮
দুর্নীতি অকর্মণ্যতার অবসান ঘটিয়ে উন্নত এবং আধুনিক নাগরিক পরিষেবাই হবে বামফ্রন্টের লক্ষ্য
কলকাতা পুর নির্বাচনের ইস্তাহারে থাকছে এই ঘোষণা
৪৬ নম্বর ওয়ার্ডে বামফ্রন্ট প্রার্থী অনুষা আকবরের সমর্থনে মিছিল।
নিজস্ব সংবাদদাতাঃ কলকাতার নগরবাসীর দুর্বিষহ জীবনযাত্রা থেকে মুক্তি, আকাশছোঁয়া দুর্নীতি-বেনিয়ম, শ্রমিক-মুটে-মজুর-বস্তিবাসীর দুঃসহ জীবনযন্ত্রণা, বেকারি-কর্মহীনতা, করোনা-ডেঙ্গু-ম্যালেরিয়া মোকাবিলায় সার্বিক ব্যর্থতা, গণতান্ত্রিক অধিকার হরণের মতো তৃণমূল কংগ্রেসের নানা ব্যর্থতা, অনাচার, আর অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিবাদ ধ্বনিত করে বামফ্রন্টের নির্বাচনী ইস্তাহার প্রকাশ হতে চলেছে। একই সঙ্গে বিজেপি’র সাম্প্রদায়িক বিভেদের রাজনীতির বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলার পাশাপাশি বামফ্রন্ট প্রকাশিত ডিজিটাল ইস্তাহারে বিকল্প ভাবনা, উদ্যোগ ও গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প রূপায়ণের কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা তুলে ধরে উন্নত নাগরিক জীবনের আশ্বাস দেওয়া হয়েছে।
গত ২৬ নভেম্বর কলকাতা পৌর কর্পোরেশন নির্বাচনে বামফ্রন্টের প্রার্থী তালিকা প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে একটি প্রচারপত্র ও ডিজিটাল মাধ্যমে নির্বাচনী ইস্তাহারের উল্লেখযোগ্য কিছু বিষয় তুলে ধরা হয়েছে। ইস্তাহারে প্রকাশিতব্য বিষয়গুলির কিছু দিক প্রকাশ করে কলকাতা জেলা বামফ্রন্টের আহ্বায়ক কল্লোল মজুমদার বলেছেন, বাস্তব অভিজ্ঞতায় মানুষ ক্ষুব্ধ। শাসকদলের বিরুদ্ধে তলায় তলায় উলটো হাওয়া বইছে। এবারের কর্পোরেশন নির্বাচনে ঘুরে দাঁড়ানোর মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। ডিজিটাল মাধ্যমে প্রকাশিত ইস্তাহারের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পর্কে তিনি বলেছেন, আমাদের চিরাচরিত দাবিগুলির পাশাপাশি উন্নত নাগরিক জীবনের স্বার্থে আমরা অনেকগুলো নতুন গুরুত্বপূর্ণ দাবি উত্থাপন করেছি। ক্ষুদ্র রাজনৈতিক স্বার্থের বাইরে কলকাতাবাসীর স্বার্থে এর জনপ্রিয় প্রচার হওয়া দরকার।
এদিন ডিজিটাল মাধ্যমে ইস্তাহারের কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বিভিন্ন শিরোনামে তুলে ধরা হয়েছে। বলা হয়েছে, প্রতিটি বরোতে অন্তত একটি গরিব শ্রমজীবী মানুষের জন্য রাতের আস্তানা ও শ্রমজীবী মহিলাদের সন্তানদের জন্য ক্রেশ তৈরি করা হবে।
১০০ দিনের কর্মীদের জন্য দিনে ন্যূনতম ৩২৭ টাকা মজুরির ব্যবস্থা ও প্রতিটি ওয়ার্ডে শ্রমজীবী ক্যান্টিন ও শ্রমজীবী বাজার তৈরি করা হবে।
কর্মসংস্থান সংক্রান্ত বিষয়ে ‘কাজের কলকাতা’ শিরোনামে উল্লেখ করা হয়েছে, বর্তমানে যে ২৮ হাজার শূন্যপদ রয়েছে, সেখানে এক বছরের মধ্যে নিয়োগ করা হবে। ১০০ দিনের কাজের পরিধি ও লোক বৃদ্ধি করা হবে। নতুন প্রকল্প রচনা করে কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করা হবে। ছোটো পরিবেশ বান্ধব শিল্প উদ্যোগে সহায়তা করা হবে।
পানীয় জল সরবরাহ সংক্রান্ত বিষয়ে ‘সব ঘরে সারাদিন’ শিরোনামে উল্লেখ করা হয়েছে, প্রতিটি বাড়িতে ২৪ ঘণ্টা পানীয় জল সরবরাহ করা হবে। আপতকালীন অবস্থায় সংশ্লিষ্ট এলাকায় পরিবারপিছু প্রতিদিন ২০ লিটার পানীয় জল সরবরাহের বিশেষ ব্যবস্থা চালু করা হবে।
বামফ্রন্টের ইস্তাহারে গরিব অংশের মহিলাদের জন্য বিশেষ কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ‘কাদম্বিনীর কলকাতা’ শিরোনামে এক্ষেত্রে বলা হয়েছে, মহিলাদের জন্য শৌচাগার নির্মাণ, স্কুল ও শৌচালয়ে স্যানিটারি প্যাড ভেন্ডিং মেশিন বসানো, মহিলাদের যুক্ত করে স্বনির্ভর গোষ্ঠী ও তাদের পরিষেবা বিপণনের জন্য অনলাইন বুকিং/ডেলিভারির পরিকাঠামো তৈরি করা হবে। এছাড়া গার্হস্থ্য হিংসা প্রতিরোধে প্রতি ওয়ার্ডে নেবারহুড কমিটি গড়ার পরিকল্পনা রয়েছে।
এছাড়া এই ইস্তাহারে সাধারণ মানুষের স্বার্থে কিছু জরুরি পরিষেবা দেবার কথা উল্লেখ থাকছে। ‘বিনা ফি’তে’ শিরোনামে বলা হয়েছে, বিনামূল্যে জন্ম ও মৃত্যুর সার্টিফিকেট প্রদান করা হবে। রিকশা, ভ্যান, হকারদের বিনা ফিতে লাইসেন্স দেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে। জমি, বাড়ি, ফ্ল্যাটের মিউটেশন ইত্যাদি ক্ষেত্রকে দালাল চক্র থেকে মুক্ত করতে বিশেষ বিকেন্দ্রীভূত ব্যবস্থাসহ কর্পোরেশন এলাকার মধ্যে থাকা হাসপাতালগুলিতে ২০ শতাংশ ফ্রি বেডের ব্যবস্থা করা হবে।
কলকাতা জেলা বামফ্রন্টের নির্বাচনী ইস্তাহারে কলকাতা মহানগরীর সড়ক ও সেতুগুলির উন্নয়নে নানা উদ্যোগের কথা উল্লেখ থাকছে। ‘পথের দাবি’ শিরোনামে এখানে বলা হয়েছে, নতুন রাস্তার সম্প্রসারণ এবং মাল্টিলেভেল ফ্লাইওভার তৈরি করা হবে। ১০ ফুট পর্যন্ত রাস্তাগুলিকে কার্ব চ্যানেল রোডের আওতায় নিয়ে আসার পাশাপাশি সমস্ত ব্রিজের মেরামতি ও সংরক্ষণের জন্য দ্রুত ব্যবস্থাগ্রহণ করা হবে।
কলকাতা মহানগরীর পরিবেশ সুরক্ষা ও ভারসাম্য রক্ষায় বিশেষ কিছু উদ্যোগের কথা থাকছে ইস্তাহারে। ‘সবুজ সিটি’ শিরোনাম দিয়ে উল্লেখ করা হয়েছে, সিএনজি-ইলেকট্রিক বাস চালুর উদ্যোগ নেওয়া হবে। শহরে বিভিন্ন স্থানে গ্রিন জোন তৈরি করা, পুকুর ভরাট, গাছ কাটা রুখতে বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া এবং প্রতিটি বাজার অঞ্চলে পরিবেশ বান্ধব ক্যারিব্যাগ স্টোর তৈরি করা হবে।
এছাড়া ‘গ্রিন অ্যাডমিন’ শিরোনামে পরিবেশ রক্ষায় গণউদ্যোগের কথা উল্লেখ করে বলা হয়েছে, মোবাইল অ্যাপ চালু করে গাছকাটা, পুকুর ভরাটের মতো পরিবেশের জন্য ক্ষতিকারক দিকে দৃষ্টি আকর্ষণের লক্ষ্যে সাধারণ মানুষকে যুক্ত করে বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া হবে।
স্বাস্থ্য পরিষেবা উন্নয়নের লক্ষ্যে ‘ফিট কলকাতা’ শিরোনামে বলা হয়েছে, প্রতিটি ওয়ার্ডে হেল্থ সেন্টারগুলি উন্নত করা হবে। কলকাতার অন্তত ২০টি জায়গায় ভাইরাল এপিডেমিক ডেঙ্গু, করোনা মোকাবিলায় বিশেষ হেলথ ইউনিট গড়ে তোলা হবে। এছাড়া বরোগুলিতে তৈরি হবে মেন্টাল হেলথ কেয়ার ইউনিট।
‘সামাজিক সুরক্ষা’ ক্ষেত্রে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত মাসিক আয় - এমন সমস্ত পরিবারকে সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পের আওতায় আনা হবে এবং বিপিএল তালিকার অন্তর্ভুক্ত করা হবে।
‘বনস্পতি প্রকল্প’ শিরোনামে উল্লেখিত হয়েছে, বাড়িতে যে সমস্ত লোকদের একা থাকতে হয়, তাদের নানারকম সহায়তা প্রদানের জন্য গড়ে তোলা হবে ভলান্টিয়ার ইউনিট ও বনস্পতি অ্যাপস।
প্রতিবন্ধীদের সহায়তায় ‘প্রতিকল্প’ শিরোনামে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, প্রতিবন্ধকতাযুক্ত মানুষদের জন্য সাধারণ মানুষের ব্যবহারের উপযোগী সব নির্মাণে রাম্প, ব্রেইল চিহ্ন সহ অন্যান্য সহজতর সুব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। কর্পোরেশন স্কুলগুলিতে বিশেষ শিক্ষক নিয়োগ করা হবে। কর্পোরেশনের স্বাস্থ্য পরিষেবায় শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধীদের অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। আয় নিরপেক্ষভাবে সমস্ত প্রতিবন্ধী মানুষকে স্বাস্থ্যবিমার আওতায় আনা হবে।
বস্তিবাসী শিশুদের শিক্ষা সংক্রান্ত বিষয়ে ‘উঠোনে পাঠশালা’ শীর্ষক অংশে উল্লেখ করা হয়েছে, বস্তি অঞ্চলে প্রতিজন স্কুলছুটের শিক্ষা সম্পূর্ণ করার জন্য বাড়িতে বাড়িতে বিশেষ কর্মসূচি নেওয়া হবে। এখানে বলা হয়েছে, বিশেষ প্রয়োজনে কর্পোরেশন স্কুল যাবে বস্তিতে। প্রতিটি বস্তিতে গড়ে তোলা হবে কমিউনিটি লানিং সেন্টার। মিড-ডে মিলে শিশুদের জন্য নিয়মিত পরিমাণমতো পুষ্টিকর সুষম খাবার পরিবেশন করার উদ্যোগ নেওয়া হবে।
কর্পোরেশনে দুর্নীতি প্রতিরোধেও গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগের উল্লেখ থাকছে ইস্তাহারে। ‘পাবলিকই প্রহরী’ শিরোনামে উল্লেখ করা হয়েছে, মিউনিসিপাল ভিজিলেন্স অথরিটি তৈরি করতে হবে। কর্পোরেশনের সমস্ত টেন্ডার ও প্রকল্পের বাজেট জনগণের নজরে আনার জন্য ওয়েবসাইটে দেওয়া হবে। এছাড়া কোনোরকম দুর্নীতি মানুষের নজরে এলে তা অভিযোগ হিসেবে জানানোর জন্য কমপ্লেন সেল তৈরি করা হবে।
এছাড়াও যে গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলি করার কথা বলা হয়েছে - ১৯৮০-র পৌর আইন অনুসারে সমস্ত ওয়ার্ডে পুনরায় ওয়ার্ড কমিটি তৈরি ও বরোগুলোকে শক্তিশালী করার উদ্যোগ নেওয়া হবে।
প্রথম অগ্রাধিকার দেওয়া হবে বস্তি উন্নয়নে। এছাড়া ঠিকা প্রজা আইনের সার্থক রূপায়ণের উদ্যোগ গ্রহণ, বস্তি উন্নয়ন খাতে পৌর বাজেটের ২৫ শতাংশ ব্যয়ের মাধ্যমে সমস্ত বস্তিতে পর্যাপ্ত পানীয় জল, রাস্তা, নিকাশি ব্যবস্থা উন্নত করা হবে। ‘এক ব্যক্তি এক পদ’ নীতি অনুসারে সর্বক্ষণের মেয়র ও মেয়র পরিষদে নেতৃত্ব নির্বাচন। মেয়রের হাতে ১০/১২টি গুরুত্বপূর্ণ দপ্তর না রেখে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ করা হবে। গরিব, নিম্নবিত্ত মানুষদের পৌরকর, ট্রেড লাইসেন্স, বিভিন্ন পরিষেবা প্রদান, বিদ্যুৎ বিলের ক্ষেত্রে যতটা সম্ভব ছাড় ও ভরতুকি দেওয়া হবে।
এছাড়া নিকাশি ব্যবস্থাকে আরও আধুনিকীকরণ করে অল্প বৃষ্টিতেই জল জমার সমস্যার স্থায়ী সমাধান করা হবে। নিকাশি নালা ও খালগুলোর নিয়মিত সংস্কারও করা হবে।
মা ও শিশুদের স্বাস্থ্য, সার্বিক স্বাস্থ্য, স্বনিযুক্তি কর্মপ্রকল্প, স্বল্প সঞ্চয় গ্রুপ ইত্যাদি প্রকল্প পুনরায় গুরুত্বসহকারে শুরু করা হবে।
আরও যে গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলো তুলে ধরা হয়েছে তা হলো, মাতৃসদনগুলো যত্ন সহকারে উন্নত করা হবে। স্বাস্থ্যখাতে সামগ্রিকভাবে ব্যয় বাড়ানো হবে।
কলকাতার অক্সিজেন ভাণ্ডার, ইস্ট ক্যালকাটা ওয়েটল্যান্ডকে যুদ্ধকালীন তৎপরতায় প্রমোটারদের হাত থেকে রক্ষা করা হবে। পাড়ায় পাড়ায় তোলাবাজি, সিন্ডিকেড রাজ বন্ধ করা ও গরিব খেটে খাওয়া মানুষের ওপর অকারণে পুলিশি নির্যাতন বন্ধ করতে যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে।
এরই পাশাপাশি ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত মাসিক আয় থাকা সমস্ত পরিবারের ৬০ বছর বয়সিদের বয়স্কভাতার আওতায় নিয়ে আসা হবে। প্রতিবন্ধী ভাতা, বয়স্কভাতা ও বিধবা ভাতার আর্থিক পরিমাণ দ্বিগুণ করা হবে।
খেলার মাঠ সংরক্ষণ, খেলার মাঠ দখল করার বিরুদ্ধে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণের কথা উল্লেখ থাকছে ইস্তাহারে।