৫৯ বর্ষ ১৬ সংখ্যা / ৩ ডিসেম্বর, ২০২১ / ১৬ অগ্রহায়ণ, ১৪২৮
কলকাতার ৯৮ নম্বর ওয়ার্ডে বামফ্রন্ট প্রার্থীর জয়ের হ্যাট্রিক রুখতে দিশেহারা তৃণমূলের ভরসা হুমকিতে
৯৮ নম্বর ওয়ার্ডে সিপিআই(এম) প্রার্থী মৃত্যুঞ্জয় চক্রবর্তীর প্রচার।
নিজস্ব সংবাদদাতাঃ ব্যাকফুটে তৃণমূল। কলকাতার ৯৮ নম্বর ওয়ার্ডে। কারণ বামফ্রন্ট মনোনীত সিপিআই(এম) প্রার্থী মৃত্যুঞ্জয় চক্রবর্তীর জনপ্রিয়তা। ২০১০ এবং ২০১৫ দু’বারের জেতা এই বামফ্রন্ট প্রার্থীর তৃতীয়বার জয়ের ক্ষেত্রে এমনকী তৃণমূল সমর্থকদেরও কোনও সংশয় নেই। তাঁরাও ওয়ার্ডে প্রচার পরিক্রমারত বাম প্রার্থী মৃত্যুঞ্জয় চক্রবর্তী ওরফে তাদের কাছের মানুষ প্রদীপ দা’র কাছেই বলছেন আগামী দিনে ওয়ার্ডে আর কী কী করা দরকার তার সুপারিশ আর ভাবনার কথা। এই ওয়ার্ড যা যাদবপুর লোকসভা আর টালিগঞ্জ বিধানসভার অন্তর্গত দক্ষিণ কলকাতার উদ্বাস্তু আন্দোলনের অন্যতম ভিত্তিভূমি সেখানে ধরা পড়ল এমনই ছবি।
ওয়ার্ডে পুর পরিষেবার ক্ষেত্রে কী কী করতে পেরেছেন মৃত্যুঞ্জয় চক্রবর্তী? ওয়ার্ড ঘুরলেই তার ছবিটা স্পষ্ট। ওয়ার্ডে আন্ডারগ্রাউন্ড সুয়ারেজ বা ভূগর্ভস্থ নিকাশি ১০০ শতাংশ কাজ সম্পূর্ণ হয়েছে। তবে সমস্যা কি নেই? আছে। নিকাশির মুখ - রাতের দিকে প্রমোটিং ইত্যাদির সঙ্গে যুক্ত সিণ্ডিকেটের ইট, বালির ভারি গাড়ি ঢুকলে নিকাশি পাইপগুলির ক্যাচ পিট, গালি পিট, ম্যানহোলের ক্ষেত্রে ভেঙে যাওয়ার বা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সমস্যা রয়েছে। ভেঙে গেলে তখন পাইপ বা ঢাকনা বদল করতে হয়। ডাক পড়ে ঠিকাদারের। নিজের ফান্ড থেকে সজাগ কাউন্সিলর দ্রুত বদলে দেন ভাঙা ঢাকনা। ঘটে না দুর্ঘটনা। এখানে কম জমা জলের সমস্যা।
বলা বাহুল্য, তৃণমূলের সিন্ডিকেট সংস্কৃতির ছোটো খাটো সংঘর্ষের ছাপ এবং চাপ দুটোই রয়েছে এই এলাকায়। আবার পুর নির্বাচন নিয়ে রাজ্যের হাইকোর্টের জবাবদিহির জেরে ওয়ার্ডের উত্তর প্রান্তে মেট্রো রেলের ব্রিজের নিচে নেমেছে জেসিবি- টালি নালার সম্প্রসারিত অংশের সংস্কারের জন্য। যে সংস্কারের সঙ্গে যোগ রয়েছে এলাকার নিকাশির, যা নিয়মিত করার দাবি বামফ্রন্টের দীর্ঘদিনের। শুধু দাবি নয়, বাম আমলে এই অংশের নিয়মিত সংস্কারের ধারাবাহিকতা নিয়ে প্রবীণ নাগরিকদের স্মৃতিচারণ উঠে আসছে আড্ডায়-আলাপচারিতায়।
‘কম চাপের জলের সমস্যাটা রয়েছে এখানে। ফিরহাদ হাকিম কথা দিয়ে কথা রাখতে পারলেন না। গার্ডেনরিচ থেকে টালিগঞ্জকে যে জলটা দেবার কথা দিয়েছিলেন, দেওয়া হয়নি বলছেন মৃত্যুঞ্জয় চক্রবর্তী। জলের কম চাপের সমস্যা রয়েছে কেন? বাঙ্গুর হাসপাতাল থেকে গড়িয়া পর্যন্ত রানিকুঠি থেকে বাঘাযতীন, পল্লিশ্রী মোড় থেকে লর্ডসের মোড় পর্যন্ত ভূগর্ভস্থ যে পানীয় জলের সিমেন্টের পাইপ আছে সেগুলি পুরনো। এই পাইপগুলির ভেতরের জল যাওয়ার কার্যকর পরিসর কমে গেছে। জলের একটু বাড়তি চাপ হলেই এগুলি ফেটে যাচ্ছে স্বাভাবিকভাবেই। তাই এলাকাবাসীর ভোগান্তি দু’রকমের। এক, টালিগঞ্জ ট্রাম ডিপো থেকে গড়িয়া দিকে যেতে গেলে প্রতিদিন বেশ কিছু জায়গায় লিকেজ নাগরিকদের নিত্যদিনের সমস্যা। আর দ্বিতীয় সমস্যা হলো, পাইপ সারিয়ে গর্ত বুজিয়ে রাস্তায় অনিয়মিত ব্যবধানে করা এবড়ো খেবড়ো প্যাচ ওয়ার্ক। তাই রাস্তায় উধাও মসৃণতা। ছোটো গাড়িতে বেশি সমস্যা হচ্ছে। যানবাহনের গতি ব্যাহত হচ্ছে, সব মিলিয়ে নাকাল মানুষ।
ক্ষুব্ধ মৃত্যুঞ্জয় চক্রবর্তী বলছিলেন, ‘গোটা পাইপলাইনটা চেঞ্জ করলে জলের বাড়তি প্রেসার দেওয়া যাবে, সে ক্ষেত্রে এই সমস্ত এলাকায় প্রয়োজনীয় পরিমাণ জল ঢুকবে। এই পাইপ বদল হচ্ছে না। কেন হচ্ছে না সেটা কর্পোরেশন বলতে পারবে। ফিরহাদ হাকিম চাইলে তো জল উপর দিয়ে চলে আসবে না!’
বারবার এই বিষয়গুলি তুলে ধরা হয়েছে এমনকী প্রশাসনিক যে সমস্ত বৈঠক হয় সেখানেও, এই বিষয়টাই প্রচারে বেরিয়ে ওয়ার্ডের নেতাজিনগরের হলিডে ক্লাব এলাকার তৃণমূল কর্মী শীল পরিবারের বধূ মাধবী শীলকে ঠান্ডা মাথায় বোঝাচ্ছিলেন তিনি। মাধবী শীল অবুঝ নন। তিনি বিলক্ষণ জানেন, এলাকার পরিস্থিতি আর তাঁর দল পরিচালিত পুরবোর্ডের কীর্তিকলাপের কথা। জানেন কীভাবে মা-মাটি-মানুষের দল বিরোধী কাউন্সিলরকে কাজ করতে দেয় না। তাই তিনি বললেন, ভোট মিটে গেলেই যেন এই ব্যাপারে কাউন্সিলর আবার উদ্যোগ নেন। অর্থাৎ, জনপ্রিয় জনপ্রতিনিধি মৃত্যুঞ্জয় চক্রবর্তী জিতছেন এবারও। মানে তৃতীয় বারেও জিতছেন এটা চাইছেন এবং বিশ্বাস করেন মাধবী শীলের মতো তৃণমূলীরাও। তাই তৃণমূলীরাও এড়াতে পারছেন না তাঁকে।
জেমস লঙ সরণি থেকে বাঙ্গুর হাসপাতাল পর্যন্ত হাজারডাঙ্গার সম্প্রসারণের যে কাজ সেই কাজ সম্পূর্ণ। এই দাবি পূরণ হয়েছে কাউন্সিলারের। এলাকায় ঘুরে মানুষের সঙ্গে কথা বলে কাউন্সিলরের এই সাফল্যের কথাও বারবার শোনা গেল নাগরিকদের প্রশংসাসূচক কণ্ঠে।
রাস্তার আলোর মেরামতির ক্ষেত্রে বাল্ব জোগান দিতে পারছে না কলকাতা কর্পোরেশন। তাই কাউন্সিলরের উদ্যোগ সত্ত্বেও কিছু কিছু রাস্তায় বাল্ব-আলো, ল্যাম্প পোস্ট খারাপ হলেও বরাদ্দ অর্থের অভাবে আসলে ভুগছেন নাগরিকরা। বোর্ড অফ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন চললেও কত টাকা কর বাবদ আয় হয়েছে তার কৈফিয়ত বা জবাব দেবার প্রয়োজন কর্তৃপক্ষ মনে করছেন না। এক্ষেত্রে অন্ধকারে থাকছেন সংশ্লিষ্ট বিরোধী ওয়ার্ড কাউন্সিলররা। মৃত্যুঞ্জয় চক্রবর্তী সেটা বোঝালে বুঝছেনও নাগরিকরা।
নাগরিকরা বলছেন, মানুষকে সঙ্গে নিয়ে গণতান্ত্রিকভাবে মানুষের দাবি-দাওয়া শুনে পৌর পরিষেবা দেবার কাজ চলছে এই ওয়ার্ডে। অতিমারীর সময় রেড ভলান্টিয়ারদের নিয়ে কাউন্সিলর এবং বামপন্থীরা পৌঁছে গেছেন আর্ত মানুষদের কাছে। আবার এলাকার গরিব মানুষের আরেক সমস্যা ১০০ দিনের কাজের সঙ্গে যুক্ত শ্রমিকরা মাইনে পাচ্ছেন না। লক্ষ্মীর ভাণ্ডারে টাকার জোগান আসছে, কিন্তু খাটনির টাকা শ্রমিকরা পাচ্ছেন না এই মূল্যবৃদ্ধির সময়ে। গণতান্ত্রিক নেতৃত্বকে নিয়ে সরব হয়েছেন এলাকার একাধিক পুর প্রতিনিধি, কারণ সমস্যাটা শুধু এই ওয়ার্ডের নয়। ওয়ার্ডে মানুষের স্বার্থে পরিষেবা দেবার কাজ স্বচ্ছতার সঙ্গে চালানো হচ্ছে। কেন্দ্রীয় আইন থাকলেও এই ওয়ার্ডের দু’টি পুকুরের সংস্কার দলবাজি করে হয়নি। যদিও অন্যত্র কাজ হয়েছে।
আবার রাজ্য সরকারের গালভরা বিভিন্ন প্রকল্পের ব্যর্থতা চলছেই। স্বাস্থ্যসাথী কার্ড বা ডিজিটাল রেশন কার্ড পান নি অনেকেই। মাঠে মাঠে গিয়ে দুয়ারে সরকার প্রকল্পের প্রচার ঢাকঢোল পিটিয়ে হলো বটে, কিন্তু কাজের কাজ এগোয়নি।
মানুষের কাছ থেকে দাবি উঠছে বয়স্ক ভাতা, বার্ধক্য ভাতা ইত্যাদি যা সমব্যথী প্রকল্পের অন্তর্গত এমনকী লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের ক্ষেত্রেও টাকার পরিমাণ বাড়ানো উচিত এই সরকারের। কাউন্সিলরের দাবি দ্বিগুণ করতে হবে এই ভাতা এবং যারা পাননি তাদের দিতে হবে অবিলম্বে। আগামিদিনে আরও কী কী করতে চান ৯৮ নম্বর ওয়ার্ডের জন্য মৃত্যুঞ্জয় চক্রবর্তী? বামফ্রন্ট? একটি বুস্টিং (পাম্পিং) স্টেশন দরকার। মানুষের সঙ্গে আলাপচারিতায়ও এই দাবি উঠে এলো। এর জন্য পদ্মপুকুরের জায়গা অধিগ্রহণ করে এটি করতে হবে। অবিলম্বে। এটা এলাকার মানুষের বহুদিনের দাবি।
বাজেট বক্তৃতায় মেয়রের সামনে কাউন্সিলর মানুষের দাবি তুলে ধরে বলেছেন যে বাজ পড়ার জন্য ক্ষয়ক্ষতি ও বিপদ থেকে সতর্কতার ক্ষেত্রে বাড়ির প্ল্যান পাশ করানোর সময় বজ্র নিরোধক ব্যবস্থা আবশ্যিক করতে হবে এবং তা পরিদর্শনের মাধ্যমে নিশ্চিত করতে হবে।
অন্যান্য দাবিসমূহের মধ্যে রয়েছে, ওয়ার্ডের স্বাস্থ্যকেন্দ্র দোতলা করতে হবে। কর্পোরেশন যেহেতু বলছে তাদের ফান্ড নেই তাই রাজ্যসভার বামপন্থী সাংসদ বিকাশ রঞ্জন ভট্টাচার্যের কাছে স্বাস্থ্যকেন্দ্রটি দোতলা এবং আধুনিক করার পরিকল্পনা জমা দেওয়া হয়েছে। ৪০ লক্ষ টাকার পরিকল্পনায় সাংসদ সাহায্য করবেন বলেছেন। ভোট প্রক্রিয়ার মধ্যে গোটা বিষয়টি আটকে রয়েছে।
অন্যদিকে বেশ কয়েকটি বিষয়ে শাসকদলের জবাবদিহি চাইছেন মানুষ। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জনাকয়েক নাগরিকের কথায়, এই পুরবোর্ড ওয়ার্ড কমিটি করেনি। এখানে বোরো কমিটি লাটে তুলে দিয়েছে। রাজনীতির আখড়া হয়ে গেছে এই পরিষেবা ক্ষেত্র। সব মিলিয়ে ভাবনা চিন্তার দৈন্য আর আইনকে উপেক্ষা করার মানসিকতা পরিষ্কার। পৌর আইনের মধ্যেই সংস্থান রয়েছে একজন চিকিৎসক, একজন ইঞ্জিনিয়ার, বিরোধী দলের একজন প্রতিনিধি, মেয়রের প্রতিনিধি নিয়ে ওয়ার্ড কমিটি গড়ার ক্ষেত্রে যা করা দরকার ছিল তা করেনি এরা। রসিকতা করে মানুষ বলছেন, ওয়ার্ড কমিটি থাকলে ‘কাট মানি’ খাওয়া যায় না যে! ওয়ার্ডের মানুষের স্মৃতিতে রয়েছে, কাট মানির অভিযোগে এবং তা ফেরতের দাবিতে একবার একটি প্রশাসনিক মিটিং বন্ধ করে দিয়েছিলেন কাউন্সিলরকে সঙ্গে নিয়ে - সেই প্রতিবাদের ঘটনা। ‘জবাবদিহির দায়বদ্ধতা থাকলে প্রশাসনিক স্বচ্ছতা থাকে’ - এই কালচারে অবিশ্বাস এলাকার বিধায়ক অরূপ বিশ্বাসদের। কিন্তু মানুষ জবাব চান, ইভিএমে-ই এই জবাব চাইতেই প্রস্তুতি নিচ্ছেন মানুষ।