৫৯ বর্ষ ১৬ সংখ্যা / ৩ ডিসেম্বর, ২০২১ / ১৬ অগ্রহায়ণ, ১৪২৮
ত্রিপুরার চিঠি
পুর ও নগর ভোটে প্রকৃত রায় প্রতিফলিত হয়নি
নিজস্ব সংবাদদাতাঃ পুর ও নগর ভোটে শাসক বিজেপি অবাধে ভোট লুট করল। ২৫ নভেম্বর গণতন্ত্রের বহ্নিউৎসব দেখলেন রাজ্যের মানুষ। গত ৪৪ মাসে প্রতিটি নির্বাচনেই সন্ত্রাসের পুনরাবৃত্তি ঘটল পুরভোটে। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ৭টি পুর ও নগরের ১১টি আসন দখলের পর ২২২টি আসনের ভোট লুট করতে ফ্যাসিস্তসুলভ আক্রমণ নামিয়ে এনে ভোটকে প্রহসনে পরিণত করা হয়। আগরতলা সহ পাঁচ পুর সংস্থায় নির্বাচন বাতিলের দাবি জানিয়েছিল বামফ্রন্ট। কিন্তু নির্বাচন কমিশন শাসককে খুশি করতে তা মানেনি। ভোট লুটে প্রধান ভূমিকা নিয়েছে শাসকদলের বিধায়ক, মন্ত্রীরা। রিগিং মাস্টার মাইন্ডের লিডার ছিলেন মুখ্যমন্ত্রীই। সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশ পর্যন্ত কার্যকর করেনি নির্বাচন কমিশন। দলদাসের ভূমিকায় ছিল প্রশাসন।
বেনজির অবাধে ভোট লুট হয়েছিল ২৫ নভেম্বর পুর নির্বাচনে, ২৮ নভেম্বর প্রকাশিত ফলাফলেও তারই প্রতিফলন ঘটল। চরম প্রহসনের পুর নির্বাচনে কলঙ্কিত জয় পেল শাসকদল। নির্বাচন কমিশন ও পুলিশ প্রশাসনের নির্লজ্জ সহযোগিতায় এই জয়। এমনকী সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশও মূল্য পায়নি।
সবক’টি নগর সংস্থার ৩৩৪ আসনের ১১২টিতে এবং ৭টি নগরে প্রবল সন্ত্রাস করে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আগেই জয়ী হয়েছিল শাসক বিজেপি। ২৫ নভেম্বর যে ২২২টি ওয়ার্ডে ভোট হয়েছে তার মধ্যে ২১৭টিতে জিতেছে বিজেপি। ভোটের দিন সকাল দশটার পর কার্যত সবক’টি বুথেরই দখল নিয়েছিল বিজেপি। বিরোধী দলের এজেন্ট এমনকী প্রার্থীদেরও বুথ থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। ভোটের আগের রাত অবধি বাড়ি বাড়ি গিয়ে হুমকি, সন্ত্রাসের পরেও যারা ভোট দিতে এসেছিলেন, সকাল ১০টার পর সেই ভোটারদের বুথেও ঢুকতে দেওয়া হয়নি। রাজ্যের এত বছরের ভোটের সাধারণ প্রবণতা অনুযায়ী বেলা দশটা থেকে এগারোটা অবধি ৩০-৩৫ শতাংশ ভোট পড়ে। সুতরাং, ৮১.৫৪ শতাংশ ভোটের যে হিসাব তাতে প্রায় ৪৫ শতাংশ ভুয়ো ভোট। বেনজির রিগিং, সন্ত্রাস এবং ভোট জালিয়াতির এই আবহেও গোটা রাজ্যে ১৯.৬৫ শতাংশ ভোট পেয়েছে বামফ্রন্ট। যে ২২২টি ওয়ার্ডে ভোট হয়েছে তার মধ্যে ২১২টিতে লড়ে ৩টিতে জয়ী হলেও ১৪৯টি ওয়ার্ডে দ্বিতীয় স্থানে থাকা বামফ্রন্টই যে রাজ্যে বিজেপি বিরোধী মূল শক্তি তা এই চরম প্রহসনের ভোটেও স্পষ্ট।
তৃণমূল কংগ্রেস ৫৬টিতে এবং কংগ্রেস ৭টি আসনে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। নির্দলীয় প্রার্থীরা (মথা) ৫টি ওয়ার্ডে দ্বিতীয়। তৃণমূল কংগ্রেস ১টি এবং নির্দলীয় প্রার্থী (মথা) ১টি ওয়ার্ডে জয়ী হয়েছে। ভোট শতাংশের হিসেবে তৃতীয় তৃণমূল ১৬.৩৯ শতাংশ এবং কংগ্রেস ২.০৭ শতাংশ ভোট পেয়েছে।
২৫ নভেম্বর পুর ভোটের দিন শাসকদল যেভাবে গণতন্ত্রকে নিধন করেছিল তা দেখে বামফ্রন্ট সেদিনই জানান দিয়েছিল রাজ্য নির্বাচন কমিশন পুনঃভোট না করলে রবিবার গণনা বয়কট করবে বামফ্রন্ট। সে অনুযায়ী এদিন বামফ্রন্ট আগরতলা পুরনিগম, মেলাঘর পুর পরিষদ, বিলোনিয়া পুর পরিষদ, খোয়াই পুর পরিষদ ও ধর্মনগর পুর পরিষদের গণনা বয়কট করে।
আগরতলা পুরনিগমের ৫১টি ওয়ার্ডের সবক’টিতেই জয়লাভ করে বিজেপি। এর মধ্যে বামফ্রন্ট ৪৬টি ওয়ার্ডে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ২৪টি ওয়ার্ডে দ্বিতীয় স্থান দখল করে। তৃণমূল কংগ্রেস দ্বিতীয় স্থান অর্জন করে ২৭টি ওয়ার্ডে। ৫১টি ওয়ার্ডেই প্রার্থী দিয়েছিল তৃণমূল কংগ্রেস। প্রবল সন্ত্রাসের মুখে বামফ্রন্ট ৫টি ওয়ার্ডে প্রার্থীপদ প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়েছিল। বামফ্রন্টের উপরই আক্রমণ কেন্দ্রীভূত করেছিল বিজেপি।
এছাড়া ধর্মনগর পুর পরিষদের ভোট হওয়া ২৪টি ওয়ার্ডের মধ্যে ২৪টিতেই জয়ী হয় বিজেপি। ১টি ওয়ার্ডে বিজেপি আগেই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হয়েছে। পানিসাগর নগর পঞ্চায়েতের ১৩টি ওয়ার্ডের মধ্যে বিজেপি’র প্রার্থীরা ১২টি ওয়ার্ডে জয়ী হয়েছেন। ১টি ওয়ার্ডে জয়ী হয়েছেন সিপিআই(এম) প্রার্থী। ২ নম্বর ওয়ার্ডে জয়ী হয়েছেন সিপিআই(এম) প্রার্থী শঙ্করলাল দাস।
কৈলাসহর পুর পরিষদের ১৭টি ওয়ার্ডের মধ্যে ১৬টি ওয়ার্ডেই জয়ী হয়েছেন বিজেপি’র প্রার্থীরা। কৈলাসহর পুর পরিষদের ১টি ওয়ার্ডে সিপিআই(এম) প্রার্থী জয়ী হয়েছেন। ৬ নম্বর ওয়ার্ডে জয়ী হয়েছেন সিপিআই(এম) প্রার্থী মোহিত ধর। কুমারঘাট পুর পরিষদের ১৫টি ওয়ার্ডের মধ্যে সবক’টি ওয়ার্ডেই জয়ী হয়েছেন বিজেপি’র প্রার্থীরা।
আমবাসা পুরপরিষদের ১৫টি ওয়ার্ডের মধ্যে ১২টি ওয়ার্ডে জয়ী হয়েছেন বিজেপি’র প্রার্থীরা। পুর পরিষদের ৩ নম্বর ওয়ার্ডে নির্দল প্রার্থী তিপ্রা মথা, ১৩ নম্বর ওয়ার্ডে সর্বভারতীয় তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থী ও ১৫ নম্বর ওয়ার্ডে সিপিআই(এম) প্রার্থী সুরেশ মুণ্ডা জয়ী হয়েছেন।
খোয়াই পুর পরিষদে মোট ওয়ার্ড সংখ্যা ১৫টি। এর মধ্যে ৭টি ওয়ার্ডে বিজেপি’র প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হয়েছিলেন। নির্বাচন হয়েছিল ৮টি ওয়ার্ডে। নির্বাচনে এই ৮টি ওয়ার্ডেই জয়লাভ করেছেন বিজেপি’র প্রার্থীরা। খোয়াইয়ে ১২টি আসনে প্রার্থী দিয়েছিল বামফ্রন্ট। জোর জবরদস্তি করে চারটি আসনে প্রার্থীপদ তুলতে বাধ্য করে শাসকদল।
তেলিয়ামুড়া পুরপরিষদের ১৫টি ওয়ার্ডের মধ্যে সবক’টি ওয়ার্ডেই জয়ী হয়েছেন বিজেপি’র প্রার্থীরা।
মেলাঘর পুরপরিষদের মোট ১৩টি ওয়ার্ড রয়েছে। এর মধ্যে ১১টি ওয়ার্ডে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে ১১টি ওয়ার্ডেই জয়লাভ করেছেন বিজেপি’র প্রার্থীরা। সোনামুড়া নগর পঞ্চায়েতের ১৩টি ওয়ার্ডের সবক’টি ওয়ার্ডেই বিজেপি’র প্রার্থীরা জয়লাভ করেছেন।
অমরপুর নগর পঞ্চায়েতের ১৩টি ওয়ার্ডের মধ্যে সবক’টি ওয়ার্ডেই জয়ী হয়েছেন বিজেপি’র প্রার্থীরা।
বিলোনিয়া পুরপরিষদের ১৭টি ওয়ার্ডের মধ্যে সবক’টি ওয়ার্ডেই জয়ী হয়েছেন বিজেপি।
সাব্রুম নগর পঞ্চায়েতের ৯টি ওয়ার্ডের মধ্যে সবক’টি ওয়ার্ডেই বিজেপি প্রার্থীরা জয়ী হয়েছেন।
২৫ নভেম্বর ভোটের আগেই সাতটি পুর ও নগর সংস্থা জোর করে নিজেদের দখলে নিয়ে নিয়েছিল শাসকদল। কমলপুর নগর পঞ্চায়েত, রানিরবাজার পুর পরিষদ, মোহনপুর পুর পরিষদ, খোয়াই পুর পরিষদ, বিশালগড় পুর পরিষদ, উদয়পুর পুর পরিষদ এবং শান্তিরবাজার পুর পরিষদের কোনো ওয়ার্ডে বামফ্রন্ট সহ কোনো বিরোধী প্রার্থীকেই মনোনয়ন জমা দিতে দেয়নি গেরুয়াবাহিনী। আর জিরানিয়া নগর পঞ্চায়েতের ১১টি ওয়ার্ডের মধ্যে ১০টিতেই শাসকদল প্রার্থী দাঁড় করাতে দেয়নি বিরোধীদের। ফলস্বরূপ এই সাতটি সংস্থা জবরদখল করে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হয় বিজেপি।
সব মিলিয়ে ভোট হওয়ার কথা ছিল ২৩টি পুর ও নগর সংস্থার ৩৩৪টি ওয়ার্ডে। কিন্তু ২২ অক্টোবর ভোট ঘোষণার পর থেকে শাসকদল গোটা রাজ্যে নামিয়ে আনে ব্যাপক সন্ত্রাস। বামফ্রন্টের নেতা, কর্মী, সমর্থকদের বাড়িঘরে হামলা, ভাঙচুরের পাশাপাশি চলে মারধর। বহু কর্মী আহত হন। বামফ্রন্টের হয়ে যাতে প্রার্থী না হন তার জন্য চলে আক্রমণ। বামফ্রন্টের প্রার্থী তালিকা ঘোষণার পর আক্রমণের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দেয় শাসকদল। শেষ পর্যন্ত বন্দুকের মুখে এবং প্রবল সন্ত্রাসের ফলে ৩৩৪টি ওয়ার্ডের মধ্যে ১১২টি ওয়ার্ডে বামফ্রন্ট মনোনয়ন জমা দিতে পারেনি। বেশ কিছু ওয়ার্ডে প্রত্যাহার করে নিতে হয় প্রার্থীপদ। আর ২৫ নভেম্বরের ভোট গোটা দেশ এমনকি দেশের বাইরের মানুষও দেখেছেন। একজনের ভোট আরেক জন দিয়েছে। সব মিলিয়ে রাজ্য নির্বাচনের ইতিহাসে ২০১৮ সালের ৩ মার্চের পর রচিত হয়েছে আরও একটা কলঙ্কজনক অধ্যায়।
পুরোপুরি প্রহসনে পরিণত পুরনির্বাচনঃ বামফ্রন্ট
পুর নির্বাচনের ফলাফল সম্পর্কে ত্রিপুরা রাজ্য বামফ্রন্ট কমিটি এক বিবৃতিতে বলেছে, ‘‘অভূতপূর্ব সন্ত্রাস, নির্বাচন কমিশন এবং পুলিশের সচেতন ব্যর্থতার পাশাপাশি প্রশাসনিক সুযোগকে ব্যবহার করে শাসক বিজেপি দল নগর সংস্থার নির্বাচনকে পুরোপুরি প্রহসনে পরিণত করেছে।
এটা পরিষ্কার হয়ে গেল বিজেপি’র শাসনে গণতন্ত্রের উপর, নির্বাচন ও জনগণের ভোটের অধিকারের উপর যে আক্রমণ অব্যাহত রয়েছে তা থেকে ত্রিপুরাকে বের করে আনতে এবং মানুষের বেঁচে থাকার জন্য অর্থনৈতিক দাবি আদায়ে শান্তিকামী এবং গণতন্ত্রপ্রিয় জনগণকে ব্যাপক ঐক্য গড়ে তুলতে সংগ্রামের ময়দানে আগামীদিন আরও সক্রিয় হতে হবে। এই লক্ষ্যে বামফ্রন্ট জনগণের সাথে থেকে তার কর্মধারা অব্যাহত রাখবে।
সমস্ত প্রতিকূলতাকে উপেক্ষা করে নির্বাচকমণ্ডলীর যে অংশ বামফ্রন্টের প্রার্থীদের দৃঢ়তা নিয়ে ভোট দিয়েছেন, তাদের প্রতি বামফ্রন্ট কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছে।’’
গণতন্ত্রে কলঙ্কজনক অধ্যায়ঃ জীতেন্দ্র চৌধুরী
পুর ও নগরের প্রহসনাত্মক এবং ছাপ্পা ভোটের ফলকে গণতন্ত্রের জন্য কলঙ্কজনক অধ্যায় বলে মন্তব্য করেছেন সিপিআই(এম) রাজ্য কমিটির সম্পাদক জীতেন্দ্র চৌধুরী।
জীতেন্দ্র চৌধুরী বলেন, শাসকদল, রাজ্য নির্বাচন কমিশন এবং প্রশাসন মিলে পুর ও নগর ভোটে যে পাণ্ডুলিপি রচনা করেছিল সে অনুযায়ীই প্রত্যাশিত ফল বেরিয়েছে। এতে নির্বাচকমণ্ডলীর প্রকৃত রায়ের প্রতিফলন ঘটেনি। রাজ্যের নির্বাচনী ইতিহাসে এবং সংবিধান, গণতন্ত্রের জন্য একটি কলঙ্কজনক অধ্যায় রচিত হলো। তিনি বলেন, চলমান দমবদ্ধকর অবস্থা থেকে রাজ্যকে মুক্ত করতে এবং গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে লড়াই চালিয়ে যাবে সিপিআই(এম) সহ বামপন্থীরা।
আধা ফ্যাসিস্ত সন্ত্রাস কলঙ্কিত জয়ে আত্মতৃপ্তি লাভ করে রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি শুরু করেছে বিজেপি। রাজ্যের বিভিন্ন স্থান থেকে সন্ত্রাসের খবর আসছে।
ছাপ্পা ভোটে রাজ্যের পুর ও নগর সংস্থাগুলি জয়ের আনন্দে কমলপুরের দুর্গাচৌমুহনির চুলুবাড়িতে এক সিপিআই(এম) কর্মীর টং দোকান পুড়িয়ে দিয়েছে বিজেপি দুর্বৃত্তরা। জয়ের আনন্দে কমলপুর মহকুমার নানা স্থানে বিজয়োল্লাসের নামে দৌরাত্ম্য চলছে বিজেপি দুর্বৃত্তদের।