E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৯ বর্ষ ১৬ সংখ্যা / ৩ ডিসেম্বর, ২০২১ / ১৬ অগ্রহায়ণ, ১৪২৮

গণসংগ্রামের রাজনীতি

বৃন্দা কারাত


কৃষকবিরোধী, করপোরেটমুখী তিন কৃষি আইনকে ফিরিয়ে নিতে সরকার বাধ্য হওয়ায় কৃষক সংগ্রামের ঐতিহাসিক বিজয় গণ সংগ্রামের রাজনীতির গুরুত্বকে বড়ো করে তুলে ধরেছে। সংযুক্ত কৃষক মোর্চার নেতৃত্বে কৃষকদের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের শক্তি বিজেপি এবং কেন্দ্র ও রাজ্যে তাদের সরকারগুলির বিরুদ্ধে এই লড়াইকে মৌলিকভাবে গণসংগ্রামে রূপান্তরিত করায় সরকারকে আত্মরক্ষামূলক অবস্থানে ঠেলে দিয়েছে। কৃষকরা জীবনের অভিজ্ঞতায় দেখেছে, সরকারের নীতিসমূহ উদ্ধত এবং আগ্রাসীভাবে করপোরেটদের স্বার্থেরই উন্নতি ঘটিয়েছে।অন্যদিকে, সরকারের এই নীতিসমূহের পরিণতিতেই কৃষকদের দুর্দশা। তাই এই লড়াইয়ের সময় হরিয়ানা এবং পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের গ্রামগুলিতে পরিদর্শনে গেলে বিজেপি নেতাদের বিরুদ্ধে কৃষকদের সরাসরি ও স্বতঃস্ফূর্ত জমায়েত ঘটেছে। লখিমপুর খেরির নৃশংস ঘটনা একদিকে কৃষকদের জমায়েত অন্যদিকে এর প্রতিক্রিয়ায় বিজেপি’র পাশবিক আচরণ - এই দুই বাস্তবতারই প্রতীক।

করপোরেট স্বার্থের পক্ষে এবং নয়াউদার নীতি-পরিকাঠামোকে প্রয়োগ করার ক্ষেত্রে সহায়ক বর্তমান রাজনৈতিক ও শ্রেণিশক্তির ভারসাম্যের স্থিতাবস্থায় বিঘ্নতা ঘটাতে এবং তার পরিবর্তনে গণসংগ্রামের রাজনীতির এই সম্ভাবনা হলো এক রূপান্তরকামী উপকরণ। বামদলগুলি এবং বিশেষকরে সিপিআই(এম) তার শাখাগুলির দ্বারা গণ-কার্যক্রমের মধ্যদিয়ে কৃষি দুর্দশা সহ উদারনীতিসমূহের বিকল্প দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি ধারাবাহিকভাবে তাদের সমর্থন ও প্রতিশ্রুতিবদ্ধতা দেখিয়ে চলেছে। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি তাদের পূর্বের অবস্থানকে অগ্রাহ্য করে কৃষক সংগ্রাম ও তার দাবিগুলিকে সমর্থন করতে বাধ্য হয়েছে। এটাও জনমুখী অ্যাজেন্ডাগুলিকে তুলে ধরতে গণসংগ্রামের রাজনীতির সামর্থ্যকেই দেখিয়েছে।

এটা সত্য যে, কৃষকরা তাদের শ্রেণি অবস্থান থেকে অপৃথকীকৃত নয়। মোদি সরকার এই আন্দোলনকে শুধু ধনী কৃষকদের আন্দোলন বলে চিহ্নিত করেছিল। সারা ভারত কৃষক সভার মতো সংগঠনের মধ্যদিয়ে কৃষকদের গরিব অংশ সহ শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়নগুলি ও খেতমজুর ইউনিয়নগুলি সচেতনভাবেই এই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে মোদি সরকারের এইভাবে আন্দোলনকে চিহ্নিত করার প্রয়াসকে প্রতিরোধ করেছে। এটা জানা আছে যে, গরিব কৃষকদের বিরাট অংশ যাঁদের বাজারজাত করার মতো উদ্বৃত্ত ফসল থাকে না, ফলে তাঁরা ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের উপকার পায় না এবং শস্য সংগ্রহ ব্যবস্থা থেকে সম্পূর্ণ বাইরে থাকে। করপোরেট সংস্থাগুলি গরিব কৃষকদের কাছ থেকে ভালো দামে ফসল কিনবে - মোদি সরকার এই অবাস্তব ধারণা বিক্রির চেষ্টা করেছিল। কৃষকদের বিভক্ত করার মোদির এই প্রচেষ্টা চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে। কোনো সন্দেহ নেই যে, সংযুক্ত কৃষক মোর্চা যখন আন্দোলনের নতুন পর্যায় ঘোষণা করবে সেখানে কৃষকসমাজের বিরাট অংশের ইস্যুগুলি সুসংহতভাবে তুলে ধরা হবে। যাতে অন্যান্য অনেক বিষয়ের সাথেই বহু ধরনের ফসলে কৃষকদের জন্য ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের সর্বজনীন অধিকারের বিষয়টি থাকবে।

এই আন্দোলনের সামাজিক অভিব্যক্তিও বিশেষ করে, গ্রামীণ মহিলাদের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। কৃষক হিসেবে মহিলাদের স্বীকৃতির জন্য নারী আন্দোলন এই সংগ্রাম থেকে বিরাট উৎসাহ পেয়েছে। এগুলি হলো সবুজ মঞ্জরীর মতো, গণসংগ্রামের রাজনীতির জমিতে বেড়ে উঠছে এমনকী সেই এলাকা এবং অঞ্চলগুলিতে যেখানে এযাবৎকাল মহিলাদের জন্য যেসব বাধ্যবাধকতা ছিল যেমন খাপ পঞ্চায়েত সেইসব থেকে বেরিয়ে আসার তারা একটা জায়গা খুঁজছে। তবে এসব এখনও সবুজ মঞ্জরী অবস্থাতেই রয়েছে। একে পূর্ণতা দিতে গেলে সহায়ক পরিবেশের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করা জরুরি। গণসংগ্রামের রাজনীতি শক্তিশালী হওয়ার সাথেই এই পরিস্থিতি আসতে পারে।

কৃষি আইনের প্রশ্নে সরকার পরাস্ত হওয়া সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রী বাগারম্বর করা থেকে বিরত থাকেননি।

এই আন্দোলনে শহিদ হওয়া ৭০০ কৃষকের জন্য দুঃখপ্রকাশ করে কোনো শব্দ প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে ছিল না। ছিল না কৃষকদের বিরুদ্ধে রুজু হওয়া মিথ্যা মামলাগুলো প্রত্যাহার করার কোনো আশ্বাস। গত এক বছরে কৃষকদের বিরুদ্ধে যে রূঢ় শব্দগুলো ব্যবহার করা হয়েছে তার জন্য কোনো ক্ষমাও চাওয়া হয়নি। কৃষকদের সন্ত্রাসবাদী, বিশ্বাসঘাতক, গুন্ডা, বিশৃঙ্খলাসৃষ্টিকারী, মিথ্যুক এবং রাজনৈতিক দলের নেতাদের দ্বারা প্রতারিত বলে অবমাননা করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভায় এখনও এমন একজন রয়েছেন যিনি লখিমপুর খেরির ভয়ংকর ঘটনায় যুক্ত। এই সব বিষয়ে মোদিজি বধিরের নিশ্চুপতা বজায় রেখেছেন।

প্রধানমন্ত্রী তাঁর বক্তব্যে কৃষি আইনের পক্ষে বলতে গিয়ে একটা আত্মঘাতী গোল করে ফেলেছেন। তিনি বলেছেন, ‘কিছু’ কৃষককে বোঝাতে ব্যর্থ হওয়ায় তিনি খুবই দুঃখ পেয়েছেন। এখানেই প্রশ্ন ওঠেঃ যদি আইনগুলি ভালোই হয়, যদি সামান্য ‘কিছু’ কৃষক এর বিরোধিতা করে - তাহলে কেন আইনগুলি প্রত্যাহার করে নেওয়া হলো? এই আইন প্রত্যাহারের পিছনে যে কারণগুলি রয়েছে তা তলিয়ে দেখার জন্য কোনো রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর প্রয়োজন পড়ে না। এই আন্দোলনের এপিসেন্টার বিশেষ করে, উত্তরপ্রদেশ এবং পাঞ্জাবে আসন্ন নির্বাচনে চলতে থাকা কৃষক সংগ্রাম একটা বিরাট রাজনৈতিক ইস্যু। এমনকী আইনগুলি প্রত্যাহারের সময়েও এই আইনগুলিকে সমর্থন করে প্রধানমন্ত্রীর বার্তা অনেকটা ছিল, যা কৃষকদের কাছেও খুবই স্পষ্ট তা হলো - একটা সুযোগ শুধু, যদি নির্বাচনগুলিতে বিজেপি জেতে তা’হলে সরকার ফের আইনগুলি চাপিয়ে দেবে। ইতিমধ্যে উত্তরপ্রদেশে ক্ষমতায় আসার ক্ষেত্রে বিজেপি’র মূল প্রতিদ্বন্দ্বী সমাজবাদী পার্টি স্লোগান তুলেছেঃ “সাফ নেহি হে ইনকি দিল, চুনাওকে বাদ ফির লে আয়েঙ্গে বিল” (এদের ইচ্ছা সাধু নয়, নির্বাচনের পর আবার আইন পুনর্বহাল করবে)।

সংযুক্ত কৃষক মোর্চার বিবৃতি বলছে যে, যতদিন না সরকার তাদের উত্থাপিত ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের আইনি নিশ্চিতিকরণের গুরুত্বপূর্ণ দাবি মেনে নিচ্ছে ততদিন তারা আন্দোলন প্রত্যাহার করবে না। অন্যান্য দাবিগুলির কথাও কৃষক নেতৃত্বরা বলেছেন। এঁদের মধ্যে অনেকেই সরকারের ঘোষণা নিয়ে সংশয় প্রকাশও করেছেন। কৃষকদের মধ্যে সরকারের প্রতি বিশ্বাসহীনতা খুবই বেশি। তাই বিজেপি যদি মনে করে তাদের এই ঘোষণার মধ্যে দিয়ে তারা কৃষক ইস্যুকে নির্বাচনী লড়াই থেকে সরিয়ে দিতে পারবে, তাহলে তাদের হয়তো বা আরেক দঃখজনক ঘটনার মুখোমুখি হতে হবে।

বিজেপি’র এই পদক্ষেপকে অবিশ্বাস করার আরও একটি মূল্যবোধজনিত কারণ আছে। উত্তরপ্রদেশে, বিশেষকরে পশ্চিম উত্তরপ্রদেশে গত বিধানসভা নির্বাচনে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বিজেপি’কে উচ্চ নির্বাচনী লাভ দিয়েছিল। যখন থেকে এবারের নির্বাচনের কাউন্টডাউন শুরু হয়েছে, তখন থেকেই বিজেপি সাম্প্রদায়িক বিরোধ তৈরির লক্ষ্যে সাম্প্রদায়িক স্লোগান, সংখ্যালঘুদের উদ্দেশে তথাকথিত ‘লাভ-জিহাদ’, গো-হত্যা বিরোধী হিংস্রাত্মক প্রচার এবং পুলিশকে ইচ্ছামতো মুসলিম তরুণদের গ্রেপ্তার করার ছাড়পত্র দেওয়ার মতো তাদের অস্ত্রভাণ্ডারের তূণগুলির ব্যবহার শুরু করেছে। যদিও সাম্প্রদায়িক প্রচারে সাড়া সেরকম আশাপ্রদ কিছু নয়। কৃষকদের মধ্যে ধর্মীয় সম্প্রদায় ও জাতগত ঐক্য বিজেপি’র এই মজ্জাগত নির্বাচনী কৌশলের বাধা হিসেবে কাজ করছে। বিজেপি মনে করছে, কৃষকদের দাবিগুলি এখন মেনে নেওয়ার মধ্যদিয়ে তারা এই বিষয়গুলিকে রাস্তা থেকে সরিয়ে দিয়ে তাদের নিজস্ব বিভাজনবাদী বিষয়গুলিকে প্রয়োগ করার একটা সুযোগ পাবে।

এটা ভারতের পক্ষে ভালো হবে, যদি কৃষকরা যে শিক্ষা দিয়েছে তা থেকে সরকার শিক্ষাগ্রহণ করে।

শিক্ষা ১: সংখ্যাগরিষ্ঠতাকে নিষ্ঠুরভাবে ব্যবহার করে সংসদীয় প্রক্রিয়াকে পদদলিত করলে তার মূল্য দিতে হতে পারে। যদি সরকার বিলটাকে স্ট্যান্ডিং কমিটিতে পাঠাতো, যদি কৃষকদের কথা শোনার সুযোগ থাকত, যদি সংসদে নিরপেক্ষ ভোটিং প্রক্রিয়া চালানোর অনুমতি দেওয়া হতো তাহলে এই পরিস্থিতির উদ্ভব হতো না। বর্তমান আকারে বিলটি আইনে পরিণত হতো না।

শিক্ষা ২: বিরোধী কণ্ঠস্বরের প্রতি অসম্মান প্রদর্শন এবং তাকে দমিয়ে দেওয়া হলে তা বুমেরাং হয়। একেবারে প্রথম থেকেই কৃষকদের অপদস্ত করতে সরকার তার সমস্ত শক্তি ব্যবহার করেছে। যেমনভাবে, আদিবাসী, দলিত এবং সংখ্যালঘুদের ন্যায়ের জন্য যাঁরা লড়াই করে তাঁদের ‘শহুরে নকশাল’ বলে চিহ্নিত করা হয় এবং জেলে পোরা হয়; একইভাবে, কৃষক নেতাদেরও দেশ-বিরোধী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

শিক্ষা ৩: ভারতের শ্রমজীবী শ্রেণিগুলি, কৃষক এবং শ্রমিকরা তাঁদের সাহস দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে - একনায়কত্ব কাজ করে না, একনায়কত্বকেও পরাস্ত করা যায়।

এই কৃষক আন্দোলনের জয়ের বিরাট গুরুত্ব আছে। যাঁরা ন্যায় এবং আমাদের সংবিধানে বর্ণিত গণতন্ত্রের মূল্যবোধ ও ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষে তাঁদের এই কৃষক আন্দোলন ভরসা জোগাবে।


অনুবাদঃ শংকর মুখার্জি