৫৯ বর্ষ ১৬ সংখ্যা / ৩ ডিসেম্বর, ২০২১ / ১৬ অগ্রহায়ণ, ১৪২৮
জন্মদিনে আত্মবলিদানের চর্চা
বিশ্বম্ভর মণ্ডল
অনেকেই ভুলে গিয়েছি তাঁকে। ভুলে যাবার দোষ শুধু আমাদের না। তাঁকে ভুলে যাই এটাই হয়তো বর্তমান রাজনীতির প্রভাবশালীরা চায়। তাই আকাশ বাতাস গর্জন করে ওঠে না যে আজ ৩ ডিসেম্বর তাঁর জন্মদিন। তিনি সেই ঘরানার স্বাধীনতা সংগ্রামী ছিলেন না, যারা জেলে পাঠানোর পরপরই ব্রিটিশের কাছে মুক্তি চেয়ে আবেদন করেছিলেন। কখনো নিজেকে বাঁচানোর জন্যে এমন আবেদন করেননি যে ছেড়ে দিলে বাকি জীবন ব্রিটিশদের সমস্ত আদেশ নির্দেশ মেনে চলবেন। তিনি এমন স্বাধীনতা সংগ্রামী ছিলেন না যিনি ব্রিটিশদের পক্ষে কাজ করবার মুচলেকা দিয়ে মুক্তি পাবার পর স্বাধীনতা আন্দোলনে সাম্প্রদায়িক বিভাজন তৈরি করাতে সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছিলেন। কারণ তাঁর কাছে নিজেকে বাঁচানোর চেয়ে, দেশের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতার থেকেও অনেক বেশি দায়বদ্ধতা ছিল ব্রিটিশের অত্যাচার থেকে দেশবাসীকে বাঁচানো।
জন্ম মেদিনীপুরে ১৮৮৯ সালে। নাম ক্ষুদিরাম বোস। ছোটোবেলাতেই বাবা মাকে হারিয়েছেন, বড়ো হয়েছেন আত্মীয়দের বাড়িতে। সহায় সম্বলহীন অনাথ ছেলে আত্মীয়ের বাড়িতে কি সমাদরে বড়ো হতে পারেন, যাঁরা এভাবে বড়ো হয়েছেন তাঁরা কিছুটা অনুমান করতে পারবেন। নিজের জীবনে অবহেলিত ছিলেন, তাই অবহেলিত দেশবাসীর যন্ত্রণায় অল্প বয়স থেকেই কাতর বোধ করতেন।
খুব অল্প বয়সেই তিনি বিপ্লবী দল ‘যুগান্তর’-এ কর্মী হিসেবে যোগ দেন। বাংলায় গুপ্ত সংঘের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হেমচন্দ্র কানুনগোর সাথে তাঁর ইতিমধ্যে যোগাযোগ হয়। ১৯০৬ সালে মেদিনীপুরে একটি কৃষি শিল্প প্রদর্শনীতে ঢোকার পথে ব্রিটিশ বিরোধী ‘সোনার বাংলা’ লিফলেট বিলি করছিলেন। পুলিশের কাছে ধরা পড়ে গেলেন। কিন্তু ভয় না পেয়ে পুলিশকে মেরে নাক ভেঙে দিয়ে বিপ্লবী সত্যেন্দ্রনাথের সাহায্যে পালিয়ে গিয়েছিলেন। ক্ষুদিরামের নামে রাজদ্রোহী মামলা হলো। অল্প বয়স বলে সে মামলায় ছাড় পেয়ে যান। এই প্রথম দেশের স্বার্থের পক্ষে লড়াইয়ের সৈনিক হিসাবে ক্ষুদিরামের নাম কিছু মানুষের কাছে হলেও পৌঁছে গেল। ১৯০৭ সালে এলো বন্যা। তিনি ত্রাণের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। গুপ্ত সমিতি পরিচালনার কাজে টাকার প্রয়োজন। স্বাধীনতা সংগ্রামের কাজে লাগবে বলে মেল ব্যাগ লুট করে দলের হাতে টাকা তুলে দিয়েছিলেন।
ব্রিটিশের বঙ্গভঙ্গের ঘোষণায় তখন স্বদেশি আন্দোলন চলছে। সেই সময়ে বিপ্লবীরাও সিদ্ধান্ত নিল অ্যাকশনে যাবার। দেশজুড়ে বিপ্লবীদের সশস্ত্র হামলা, চোরাগোপ্তা হামলা, পুলিশের সাথে সংঘর্ষ ইত্যাদি শুরু হলো। ফৌজদারি আদালতের ম্যাজিস্ট্রেট কিংসফোর্ড বিচারে বিপ্লবীদের কঠিন সাজা দিতেন। তাকে হত্যার দায়িত্ব দেওয়া হলো ক্ষুদিরাম ও প্রফুল্ল চাকীর উপর। পরিকল্পনা মতো বোমা ছুঁড়ে মারলেন তাঁরা। সেদিন গাড়িতে কিংসফোর্ড ছিলেন না। প্রফুল্ল গ্রেপ্তার এড়াতে আত্মহত্যা করলেন। ক্ষুদিরাম ধরা পড়লেন। বিচারে তার ফাঁসি হলো। এসব ইতিহাস বা বাকি ইতিহাস কমবেশি সবারই জানা। অবাক লাগে একটা বিষয়ে, সেই সময় পশ্চিমবাংলার কোনো উকিল ক্ষুদিরামের পক্ষে দাঁড়িয়ে আদালতে লড়াই করতে রাজি হননি। শেষে পূর্ববঙ্গের রংপুর থেকে কয়েকজন উকিল লড়েছিলেন ক্ষুদিরামের পক্ষে। উকিলরা তাঁকে বলেছিলেন - তুমি আদালতে সত্যি কথাটা বোলো না। বাকিটা আমরা বুঝে নেব। আমরা আদালতকে বলবো বোমাটা মেরেছে প্রফুল্ল চাকী, তুমি মারোনি, তুমি সাথে ছিলে। উকিলদের যুক্তি ছিল - তাহলে তো প্রফুল্ল’র নতুন করে কোনো ক্ষতি হবে না, কারণ ইতিমধ্যেই তিনি প্রয়াত। তবুও সেদিন উকিলদের সব পরামর্শ মানতে রাজি করানো যায়নি মাত্র ১৮ বছর বয়সের ছেলেটাকে। তাই হয়তো ফাঁসিটা এড়ানো গেল না। এমনটাই ছিল তাঁর আদর্শ, এমনটাই ছিল আদর্শের প্রতি দায়বদ্ধতা।
‘‘সবাই আমাকে যে যার মতো করে ব্যবহার করবে। আমাকে কি ক্ষুদিরাম পেয়েছে’’ বলে যারা খেদ প্রকাশ করে ফেলেন তাঁদের উদ্দেশ্য করে বিনীত নিবেদন, নিজেকে ছোটো করছেন করুন, দয়া করে ক্ষুদিরামকে ছোটো করবেন না। যারা এইভাবে ভাবেন দোষটা তাদেরও নয়। এটাও ‘‘সম্মতি নির্মাণের’’ রাজনীতির একটা উদাহরণ মাত্র। ক্ষুদিরামের মতো শহিদদের স্বাধীনতা আন্দোলনের অবদানকে কোনোমতেই ছোটো করা যায় কি? ছাত্র অবস্থায় দেশের কাজে নেমে পড়া, ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়িয়ে বেড়ানোর লোকের বড়ো অভাব সব যুগেই। দেশের জন্য নিজের জীবন দিয়ে দেবার হিম্মত যিনি দেখাতে পারেন তাঁর কলিজার আকার মাপার যোগ্যতা আছে কার!
অনেক বছর ধরেই ‘‘গণমাধ্যমের উপর একচেটিয়া কর্তৃত্বকে ষোলআনা কাজে লাগিয়ে নতুন প্রজন্মের মগজে উপনিবেশ তৈরির অভিযান চলছে জোর কদমে। লক্ষ্যটা পরিষ্কার... নতুন প্রজন্মকে স্বার্থপর প্রজন্মে পরিণত করা। আর তারই জন্য আদর্শবাদ, সামাজিক কল্যাণ, দেশপ্রেম, বিশ্বভ্রাতৃত্ববোধ, পরোপকার এসব ধ্যান-ধারণা মাথা থেকে একেবারে মুছে ফেলতে হবে। নতুন প্রজন্মকে শেকড় থেকে আলগা করতে হবে। আমাদের গৌরবোজ্জ্বল অতীতকে কালিমালিপ্ত করতে হবে। আত্মত্যাগ, দেশপ্রেম, পরার্থপরতাকে বিশুদ্ধ বোকামি হিসেবে চিত্রিত করতে হবে। ক্ষুদিরামকে যুব সমাজের আদর্শ হিসেবে হাজির করার পরিবর্তে উপেক্ষা ও অবজ্ঞার পাত্র হিসেবে দেখানো প্রয়োজন।’’(১) প্রশ্ন হলো প্রয়োজনটা কার? প্রয়োজনটা তাঁদের, দেশটাকে বড়ো বড়ো শিল্পপতির হাতে বিক্রি করে দিতে যাঁদের বুক কাঁপে না। স্বাধীনতার পরে পুতুলনাচের পুতুলদের সবাই দেখে অভ্যস্ত ছিল, এখন মঞ্চের আড়ালে আর কেউ নেই। আড়ালে থাকা কুশীলবদের উত্তাল নাচন-কোদন প্রকাশ্যে চলে এসেছে। মনে হচ্ছে তাদের হাতে একেবারেই সময় নেই। সব চাই তাদের। রেল চাই, বিমান চাই, ব্যাংক চাই, ফোন চাই, টিভি চাই, পত্র-পত্রিকা চাই, বিমা চাই, স্বাস্থ্য ব্যবস্থা চাই, শিক্ষায় ব্যবসা চাই, সরকারের সব কিছু চাই, এমনকী হাজার হাজার কেজি মাদক নিরাপদে পৌঁছানোর জন্যে নদী বন্দর, সমুদ্র বন্দর চাই। বহু বছর আড়ালে থাকা কুশীলবদের চাহিদা আর আবদারের শেষ নেই। প্রশ্নহীন সমাজ চাই, প্রশ্নহীন মিডিয়া চাই, মেরুদণ্ডহীন মানুষ চাই, স্তাবক চাই, মোসাহেব চাই। অথচ দেশটা তো শুধু পিরামিডের উপরে থাকা মানুষদের নয়। দেশটা আমার, আপনার, সবার। দেশের ভিতরে কতিপয় শিল্পপতির হাতে সব ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হবার যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে সেটা দেশের অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎকে নড়বড়ে করে দেবার সম্ভাবনাকে প্রবল থেকে প্রবলতর করে তুলছে। এখানেই তো যত উদ্বেগ, আশঙ্কার জন্ম। ক্ষুদিরামের জন্মদিনে দেশপ্রেমী মানুষদের এটাই শপথ হোক - দেশটাকে বাঁচাতেই হবে।
তথ্যসূত্রঃ
(১) বাদল দত্ত, ক্ষুদিরাম এবং ইত্যাদি, চাকদহ, নদীয়া, পৃঃ-২৬-২৭।