৬০ বর্ষ ২৫ সংখ্যা / ৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ / ১৯ মাঘ, ১৪২৯
পলিট ব্যুরোর অভিমত
সংকোচনমূলক বাজেট অর্থনৈতিক সংকটকে আরও ঘনীভূত করবে
দেশের বর্তমান সংকটজনক আর্থিক পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে বাজেটকে ঘিরে যে চাহিদাসমূহ পূরণ করা জরুরি ছিল, তা করতে ব্যর্থ হয়েছে ২০২৩-এর প্রস্তাবিত সাধারণ বাজেট। প্রয়োজন ছিল জনগণের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ানোর উদ্যোগ, কর্মসংস্থান এবং অভ্যন্তরীণ চাহিদা বৃদ্ধি - কিন্তু ঘটেছে তার উল্টোটাই। বাজেট সম্পর্কে সিপিআই(এম) পলিট ব্যুরো এক বিবৃতিতে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে এভাবেই।
কেন্দ্রের ২০২৩-২৪ সালের প্রস্তাবিত বাজেটকে এককথায় সংকোচনমূলক বলে অভিযোগ করেছে সিপিআই(এম)। বিবৃতিতে একথা জানিয়ে পলিট ব্যুরো বলেছে, আগামী ২২-২৮ ফেব্রুয়ারির দেশব্যাপী প্রতিবাদ আন্দোলনে জনবিরোধী বাজেটের সংকোচনমুখী বিষয়গুলির পাশাপাশি পাঁচ দফা দাবির কথাও তুলে ধরা হবে। মানুষের জীবন জীবিকা সুরক্ষিত থাকা উচিত বলে যাঁরা মনে করেন তাঁরাও প্রতিবাদে সরব হন বলে আহ্বান জানিয়েছে সিপিআই(এম) পলিট ব্যুরো।
পলিট ব্যুরোর বিবৃতিতে বলা হয়েছে, কেন্দ্রের বাজেট এমন এক সময় পেশ করা হয়েছে যখন অতিমারীর আগে থেকেই দেশের অর্থনীতির অধোগতি শুরু হয়েছিল, অতিমারীর দু’বছরে তা আরও খারাপ অবস্থায় পৌঁছে যায়। এমনকি অতিমারী পরবর্তীকালে অর্থনীতির মাথা তুলে দাঁড়ানোর সময় বিশ্ব অর্থনীতির অধোগতির ফলে ফের জর্জরিত, যা সম্ভাব্য মন্দার দিকেই এগোচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে কর্মসংস্থান সৃষ্টির সঙ্গে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি এবং অভ্যন্তরীণ বাজারে চাহিদা বাড়ানোর মতো কেন্দ্রীয় বিষয়গুলিতে নজর দেওয়া উচিত ছিল।
সিপিআই(এম) বলেছে, এই পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়েছে বাজেট। উলটে ধনীদের আরও কর ছাড় দিতে কোষাগারীয় ঘাটতি কমানোর লক্ষ্যে সংকুচিত করা হয়েছে সরকারি বিনিয়োগ। এমন এক সময় এই বাজেট প্রস্তাব রাখা হলো যখন অক্সফ্যাম রিপোর্ট স্পষ্টই জানিয়েছে, ভারতের ধনীতম ১ শতাংশের কাছে গত দু’বছরে তৈরি হওয়া ৪০.৫ শতাংশ সম্পদ কুক্ষিগত হয়ে রয়েছে। এর ফলেই সংকোচনমূলক বাজেটের ধাক্কায় অর্থনৈতিক সংকট আরও ঘনীভূতই হবে।
এই বাজেট প্রস্তাবে ২০২৩-২৪ সালের মোট সরকারি ব্যয় ২০২২-২৩’র সংশোধিত বরাদ্দের তুলনায় মাত্র ৭ শতাংশ বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে। যা ওই সময়কালের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন (জিডিপি)-র হার ১০.৫ শতাংশের তুলনায় সামান্যতম বৃদ্ধি বলা যায়। জিডিপি’র শতাংশের নিরিখে সরকারি বিনিয়োগও কমানো হয়েছে। এক্ষেত্রে সুদ বাদ দিলে গত বছরের তুলনায় সরকারি বিনিয়োগে বৃদ্ধির হার মাত্র ৫.৪ শতাংশ। যদি অন্তর্নিহিত মুদ্রাস্ফীতির ৪ শতাংশ এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১ শতাংশ হয় তাহলে এই তথাকথিত ‘জনমুখী বাজেট’র ধাক্কা আরও বেশি আঘাত করবে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনতার জীবনজীবিকার ওপর।
বিবৃতিতে বলা হয়েছে, বেকারত্বের হার যখন এযাবৎকালের মধ্যে সবচেয়ে বেশি তখন রেগায় বরাদ্দ হ্রাস করা হয়েছে ৩৩ শতাংশ। খাদ্যপণ্যে ভরতুকি কমানো হয়েছে ৯০ হাজার কোটি। সারে ভরতুকি কমানো হয়েছে ৫০ হাজার কোটি এবং পেট্রোলিয়ামে ৬ হাজার ৯০০ কোটি। অতিমারীর ভয়ঙ্কর প্রভাব সত্ত্বেও স্বাস্থ্য খাতে গত বছরের বরাদ্দ ৯২৫৫ কোটি টাকা খরচই করতে পারেনি সরকার। একইভাবে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ ৪২৯৭ কোটি খরচ হয়নি। আইসিডিএস কর্মীদের ভাতাও বাড়ানো হয়নি। মহিলাদের জন্য বাজেটে বরাদ্দ হয়েছে মোট খরচের মাত্র ৯ শতাংশ। জনসংখ্যার ১৬ শতাংশ হওয়া সত্ত্বেও বাজেটে বরাদ্দ হয়েছে মাত্র ৩.৫ শতাংশ, আদিবাসীরা ৮.৬ শতাংশ হলেও বরাদ্দ মাত্র ২.৭ শতাংশ। কৃষকদের আয় দ্বিগুণ করে দেওয়া হয়েছে বড় গলায় দাবি করালেও তা যে কতটা অসার তার প্রমাণ পাওয়া যায় প্রধানমন্ত্রী কিষান তহবিলের বরাদ্দ ৬৮ হাজার কোটি থেকে কমিয়ে ৬০ হাজার কোটি টাকা করার ক্ষেত্রেই।
সরকার দাবি করে মূলধনী ব্যয়ের ভালো পরিমাণ বৃদ্ধির ফলে কর্মসংস্থান সৃষ্টি আরও প্রসারিত করবে। ২০২২-২৩ সালের সংশোধিত বরাদ্দেই দেখা যাচ্ছে, রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাসমূহের সম্পদ ধরলেও এবারের বাজেটে মূলধনী ব্যয় বৃদ্ধি করা হয়েছে মাত্র ৯.৬ শতাংশ।
বিবৃতিতে বলা হয়েছে, বেতনভুক কর্মচারিদের সামান্য স্বস্তি দিতে কর ছাড়ের ঊর্ধ্বসীমা ৫ লক্ষ থেকে ৭ লক্ষ টাকা করা হয়েছে। যদিও এই বৃদ্ধি মুদ্রাস্ফীতির নিরিখে সামান্যই। এরই সঙ্গে ছেঁটে ফেলা হয়েছে সামাজিক খাতে খরচ, যার ফলে স্বাস্থ্য ও শিক্ষার মতো অত্যাবশ্যকীয় ক্ষেত্রে জনগণকে আরও বেশি খরচ করতে হচ্ছে।
বাজেটে কোষাগারীয় যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় ফের বড় ধরনের আঘাত করা হলো রাজ্য সরকারগুলিকে সম্পদ হস্তান্তর সঙ্কুচিত করে। দেখা যাচ্ছে, ২০২২-২৩ সালের সম্পদ হস্তান্তর আর ২০২১-২২ সালের হস্তান্তরের মধ্যে কোনও পার্থক্যই নেই। অথচ ২০২২-২৩ সালে মুদ্রাস্ফীতির হার ছিল ৮.৪ শতাংশ। এমনকি ঋণের মূল্যায়নেও বেশ কিছু শর্তাবলী চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে রাজ্যগুলির ওপর। অর্থমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন, ধনীদের কর ছাড় এবং সামগ্রিক কর প্রস্তাবের জেরে ২০২৩-২৪ সালে রাজস্ব ক্ষতি হবে ৩৫ হাজার কোটি টাকা।
একারণেই পলিট ব্যুরো বিবৃতিতে বলেছে, জনগণকে স্বস্তি দেওয়ার পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ চাহিদা বৃদ্ধি করে অর্থনীতির মোড় ঘুরিয়ে দিতে চাইলে বাজেটে কতগুলি বিষয়কে গুরুত্ব দেওয়ার প্রয়োজন ছিল। যেমন,
১) কর্মসংস্থানমুখী প্রকল্পে সরকারি বিনিয়োগ ভালো পরিমাণ বৃদ্ধি।
২) ভাতা বাড়িয়ে রেগায় বরাদ্দ বেশি পরিমাণে বৃদ্ধি।
৩) ৫ কেজি বিনামূল্যে খাদ্যশস্য বিতরণের পাশাপাশি ৫ কেজি ভরতুকিযুক্ত খাদ্যশস্য প্রদান।
৪) সম্পদ ও উত্তরাধিকার কর চাপানো।
৫) ওষুধ সহ খাদ্য এবং অত্যাবশ্যকীয় পণ্যে জিএসটি প্রত্যাহার।
জনবিরোধী বাজেটের বিরোধিতার পাশাপাশি এই পাঁচ দফা দাবি তুলে ধরা হবে প্রতিবাদ আন্দোলনে।