৬০ বর্ষ ২৫ সংখ্যা / ৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ / ১৯ মাঘ, ১৪২৯
কলকাতায় সুবিশাল সমাবেশে আহ্বান
সাম্প্রদায়িক বিজেপি এবং দুর্নীতিগ্রস্ত তৃণমূলকে পরাস্ত করো শক্তিশালী করো বাম বিকল্পকে
বক্তব্য রাখছেন পার্টির সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি। মঞ্চে বিমান বসু, সূর্য মিশ্র, মহম্মদ সেলিম সহ নেতৃবৃন্দ।
নিজস্ব প্রতিনিধিঃ কেন্দ্রীয় সরকারকে রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ বাড়িয়ে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। খাদ্যশস্যে ভরতুকি দিতে হবে, বরাদ্দ দ্বিগুণ করতে হবে রেগায়। ধনীদের ওপর কর বসাতে হবে, অত্যাবশ্যকীয় পণ্য, সবজির ওপর থেকে জিএসটি তুলতে হবে। জনগণের টাকা লুটের তদন্ত করে দোষীদের শাস্তি দিতে হবে। একাজে দেশের সরকারকে বাধ্য করতে হবে গণআন্দোলনের মধ্যদিয়ে। গত ৩০ জানুয়ারি, সোমবার কলকাতার রানি রাসমণি রোডের সুবিশাল জনসভায় একথা বলেন সিপিআই(এম) নেতৃবৃন্দ।
কলকাতার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সংযোগস্থল থেকে ধর্মতলার রানি রাসমণি মোড়ের সমাবেশে অংশ নিতে এদিন পার্টির নবরত্নের নামে ৯টি মিছিল সংগঠিত হয়। জীবন জীবিকার অধিকার ও বৈষম্য ঘোচানোর ক্ষেত্রে পার্টির নবরত্নের সংগ্রামী ঐতিহ্যকে এগিয়ে নিয়ে যাবার শপথ উচ্চারিত হয় সমাবেশমুখী ওই ৯টি মিছিল থেকে। এই মিছিলগুলিতে অংশ নিয়েছেন সীতারাম ইয়েচুরি, বিমান বসু, সূর্য মিশ্র, মহম্মদ সেলিম, নীলোৎপল বসু, রামচন্দ্র ডোম, কল্লোল মজুমদার, রবীন দেব, বিজু কৃষ্ণান, শ্রীদীপ ভট্টাচার্য, আভাস রায়চৌধুরী, দেবলীনা হেমব্রম সহ নেতৃবৃন্দ।
কলকাতায় কেন্দ্রীয় কমিটির তিনদিনের বৈঠক শেষে আয়োজিত এই জনসভায় বক্তব্য রাখেন পার্টির সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি, রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম, কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য দেবলীনা হেমব্রম। সভায় সভাপতিত্ব করেন সিপিআই(এম) কলকাতা জেলা কমিটির সম্পাদক কল্লোল মজুমদার। সভায় উপস্থিত ছিলেন প্রবীণ কমিউনিস্ট নেতা বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসু, পলিট ব্যুরো সদস্য সুর্য মিশ্র, রামচন্দ্র ডোম, নীলোৎপল বসু, রবীন দেব, বিজু কৃষ্ণান সহ কেন্দ্রীয় কমিটির নেতৃবৃন্দ।
সভায় সীতারাম ইয়েচুরি বলেন, আজ আমরা মহাত্মা গান্ধীর ৭৫তম শাহাদাত দিবসে সমবেত হয়েছি। আজ দেশকে কীভাবে রক্ষা করতে হবে তার শপথ নেওয়া জরুরি। গান্ধীজিকে হত্যা করার মধ্যদিয়েই ধর্মনিরপেক্ষ প্রজাতন্ত্র ভারতকে কট্টরপন্থী ফ্যাসিস্ট একটি দেশে পরিণত করার চেষ্টা চলছে। বিজেপি সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মোদি গত ৯ বছর ধরে কট্টরপন্থী ফ্যাসিবাদী হিন্দুত্ব রাষ্ট্র তৈরি করার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছেন। এই মোদি সরকারের বিরোধিতায় সংসদে তৃণমূল চুপ করে গেছে কেন?
নির্বাচনে তৃণমূলের ভূমিকার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, উপরাষ্ট্রপতি নির্বাচনের সময় তাদের ভূমিকা উলটে গেল কেন? ত্রিপুরাতে বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি’কে হঠাতে বামফ্রন্ট বিজেপি বিরোধী সবাইকে একজোট করার চেষ্টা করছে। ত্রিপুরাতে গিয়ে তৃণমূল সেই নির্বাচনে কি বিজেপি’কে বাঁচানোর জন্য লড়তে চাইছে?
সীতারাম ইয়েচুরি বলেন, আরএসএস প্রধান এক হাজার বছর ধরে যুদ্ধের কথা বলছেন সংখ্যালঘুদের শত্রু চিহ্নিত করতে। আমরা বলছি কয়েক হাজার বছর ধরে যুদ্ধ চলছে ধনী গরিবে, উঁচু এবং নিচু জাতে, মনুষ্যত্ব নিয়ে। আরএসএস কমিউনিস্টদের খতম করার কথা বলছে, আমরা হিটলারের পরিণতি দেখিয়ে বলছি, লালঝান্ডাকে খতম করা যায় না।
গৌতম আদানির প্রসঙ্গ উল্লেখ করে তিনি বলেন, দেশে এখন লুটের আজাদি চলছে। আদানি তার ব্যবসায় দেশের যে টাকা ধার নিয়ে বিনিয়োগ করেছিলেন তা সাধারণ মানুষের ব্যাঙ্কে, এলআইসি’তে গচ্ছিত টাকা। এই সরকার আদানি-আম্বানিদের হাতে বিমানবন্দর কয়লা সিমেন্ট সহ বিভিন্ন ক্ষেত্র তুলে দিয়েছে। জমি এবং কৃষিক্ষেত্র তুলে দেওয়ার চেষ্টা করেছিল, সেটা কৃষকরা তীব্র আন্দোলনের মধ্য দিয়ে রক্ষা করেছে, সবক শিখিয়েছে সরকারকে। জনগণের টাকা লুটের তদন্ত করতে হবে সুপ্রিম কোর্টের নজরদারিতে, দোষীদের শাস্তি দিতে হবে। বেশ কয়েকজন পুঁজিপতি টাকা লুট করে দেশ ছেড়ে চলে গেছে। আর একজন যাতে চলে না যায় পালিয়ে না যায় সেদিকে নজর রাখতে হবে।
তিনি দেশের ভুখমারি, নজিরবিহীন বেকারির প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বলেন, ৮১ শতাংশ মানুষকে খাদ্যদ্রব্য দেবার কথা বলে সরকার স্বীকার করেছে দেশের বড়ো অংশের ভুখা মানুষের অস্তিত্বের কথা। ভরতুকি-যুক্ত খাদ্য দেবার ব্যবস্থা আবার চালু করতে হবে। কেন্দ্রীয় সরকারকে রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। পরিকাঠামো তৈরি করতে হবে। তাতে মাঝারি শিল্প চালু হবে, সুযোগ সৃষ্টি হবে কর্মসংস্থানের। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়বে। জনকল্যাণে সরকার ব্যয় বাড়াক, খাদ্যশস্যে ভরতুকি দিক। রেগায় বরাদ্দ দ্বিগুণ করে আরও কাজ সৃষ্টি করুক, সম্পদের বৈষম্য দূর করতে বিত্তবানদের ওপরে সম্পত্তি কর বসাক, সম্পত্তির উত্তরাধিকারে কর বসাক, কিন্তু অত্যাবশ্যকীয় পণ্য, সবজির ওপর থেকে জিএসটি সরাক। গান্ধীজি যেভাবে ডান্ডি মার্চ করে নুনের ওপরে কর তুলতে ব্রিটিশদের ওপরে চাপ সৃষ্টি করেছিলেন, আজকেও তেমনি আনাজের ওপর থেকে জিএসটি তুলতে গণআন্দোলনের দরকার আছে। যা দেশের মধ্যে বামপন্থীরাই সংগঠিত করতে পারে। এই সরকারকে সঠিক রাস্তায় আনতে হবে গণ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে।
দেবলীনা হেমব্রম বলেন, ৩৪ বছর আমরা রাজ্য চালিয়েছি। লোকে আমাদের দেখলে ‘ওই চোরের দল আসছে’ এটা বলে না। আমাদের কোনো এমএলএ-এমপি-কে দুর্নীতির দায়ে ঘাড় ধরে সিবিআই-ইডি গাড়িতে তুলতে পারেনি এটা আমাদের গর্ব। জঙ্গলমহল সহ সর্বত্র সাধারণ মানুষের অধিকার রক্ষার লড়াইয়ে যাঁরা নেতৃত্ব দিতেন তাঁদের বেছে বেছে খুন করা হয়েছে। আমরা তা ভুলে যাইনি। মেয়েরা এখানে প্রতিদিন নির্যাতিত হচ্ছে। সরকার নিরাপত্তা দিতে পারছে না। এখনো নির্যাতন চলছে। এর বিরুদ্ধে আমাদের সংগঠিত ও ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।
মহম্মদ সেলিম বলেন, দেশে একদিকে লুট, চুরি দুর্নীতি বাড়ছে, অন্যদিকে দুর্নীতি থেকে মানুষের নজর ঘোরাতে ধর্মের নামে রাজনীতিকে গ্রাস করা হচ্ছে। তৃণমূল এখন কালীঘাট থেকে নয়, নাগপুর থেকে চলছে। পশ্চিমবঙ্গের মানুষ যতো জাগছে, কালীঘাটের খুঁটি যত নড়বড়ে হচ্ছে। মনরেগা তুলে দিতে চাইছে মোদি সরকার, আর রাজ্যের তৃণমূল সরকার চাইছে এর বরাদ্দ থেকে চুরি চালিয়ে যেতে। তৃণমূল চুরি জোচ্চুরি শিখেছে অমিত শাহ-মোদির বিজেপির পাঠশালায়। মধ্য প্রদেশের ব্যাপম কেলেঙ্কারির মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকা চুরি করেছে বিজেপি-আরএসএস, খুন করা হয়েছে শতাধিক মানুষকে। আর এখানে শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতি করছে তৃণমূল।
তিনি বলেন, গত নভেম্বর মাস থেকে আমরা ধারাবাহিকভাবে গ্রামে এবং শহরের মানুষের কাছে গেছি। মানুষ আমাদের কথা শুনেছেন, তাদের অভিযোগের কথা বলেছেন এবং সাহায্য করেছেন বামপন্থী আন্দোলনকে পুনরায় শক্তিশালী করার জন্য।
মহম্মদ সেলিম বলেন, মুখ্যমন্ত্রী লাইব্রেরিতে কোন কোন কাগজ রাখা যাবে তার তালিকা করে দিয়েছিলেন, আর প্রধানমন্ত্রী বিবিসি’র তথ্যচিত্র বন্ধ করে দিচ্ছেন। বুদ্ধিজীবীদের অনেকে মুখে লিউকোপ্লাস্ট লাগিয়ে রাখতে পারেন, কিন্তু কমিউনিস্টদের মুখ বন্ধ করা যায়নি। বিজেপি বলেছিল কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা রদ হলে সমস্ত সমস্যার সমাধান হবে। কিন্তু তা হয় নি। তাই সোনাম ওয়াংচুককে খোলা আকাশের নিচে অনশন করতে হচ্ছে। দিল্লিতে বিজেপি’র বিরুদ্ধে তৃণমূল লড়বে না, এরাজ্যে তৃণমূলের বিরুদ্ধে বিজেপি লড়বে না। চোর কখনো চোরকে ধরে না। ঠিকা প্রজাস্বত্ব আইনে বদল এনে বস্তি উচ্ছেদ করার চেষ্টা করা হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে দেশ ও রাজ্য বাঁচানোর জন্য লালঝাণ্ডার লড়াইয়ের বার্তা মানুষের বাড়িতে বাড়িতে পৌঁছে দিতে হবে।
মহম্মদ সেলিম নওসাদ সিদ্দিকির গ্রেপ্তারির তীব্র প্রতিবাদ করে বলেন, বিধায়কের প্রতিবাদের অধিকার আছে। তাঁদের মুক্তির জন্য আদালতে এবং রাস্তাতেও লড়াই হবে। মহার্ঘ ভাতার দাবিতে রাস্তায় আন্দোলনরত সরকারি কর্মচারীদের প্রতিও সমর্থন ও সংহতি জানিয়েছেন সেলিম।
সভার সভাপতি কল্লোল মজুমদার বলেন, বামপন্থীরা ৩৪ বছর ধরে যে বিকল্প নীতির ভিত্তিতে পঞ্চায়েত থেকে শহরে গ্রামে বিকেন্দ্রীকরণের যে ইতিহাস সৃষ্টি করেছে ওরা তার মোকাবিলা করতে পারছে না। তাই ২০১১ সাল থেকেই বামপন্থী সহ গরিব সাধারণ মানুষের ওপর বলগাহীন আক্রমণ নেমে এসেছে। সাম্রাজ্যবাদ এবং কর্পোরেট মিডিয়ার মদতে বিজেপি এবং তৃণমূল রাজ্যে তাদের শ্রেণি শাসন বজায় রাখতে ধর্মের নামে এবং জাতের নামে বিভাজন করতে হাত মিলিয়েছে। তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধের ধারাবাহিক সংগ্রামে আমরা রয়েছি।