৬০ বর্ষ ২৫ সংখ্যা / ৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ / ১৯ মাঘ, ১৪২৯
প্রতিদিনই সামনে আসছে নিয়োগ দুর্নীতিতে শাসকদলের পরিকল্পিত উদ্যোগের তথ্য
বঞ্চনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদও তীব্র হচ্ছে
নিজস্ব সংবাদদাতাঃ রাজ্যে শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী নিয়োগে সীমাহীন দুর্নীতির বিরুদ্ধে এবং দোষীদের শাস্তির দাবিতে রাজ্যজুড়ে লাল ঝান্ডার প্রতিবাদী মিছিল, বিক্ষোভ আন্দোলন ক্রমশ তীব্র হচ্ছে। এদিকে এই দুর্নীতি মামলার তদন্তে নিত্যনতুন চাঞ্চল্যকর সব তথ্য উঠে আসছে। দেখা যাচ্ছে বর্তমানে হাজতবাস করা পার্থ চট্টোপাধ্যায় ও শিক্ষা দপ্তরের অন্যান্য আধিকারিকরাই শুধু নন, এই দুর্নীতির শিকড় ছড়িয়েছে শাসকদল তৃণমূলের বিভিন্ন স্তরে, শাখা প্রশাখায়। বিপুল টাকার বিনিময়ে এই কেলেঙ্কারিতে শাসকদল যে আপাদমস্তক যুক্ত, তা ইতিমধ্যেই স্পষ্ট হয়ে গেছে। এছাড়াও স্পষ্ট হয়েছে, নিয়োগ কাণ্ডে বিভিন্ন জেলায় যে এজেন্ট চক্র ছিল, সেখান থেকে কলকাতায় প্রভাবশালী মহলে নির্দিষ্ট সময় অন্তর টাকা পাঠানো হতো।
এই দুর্নীতিতে যুক্ত তৃণমূলের যুব নেতা কুন্তল ঘোষকে সম্প্রতি গ্রেপ্তার করেছে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা। তাকে জেরার মাধ্যমে উঠে আসছে রকমারি সব তথ্য। তার আগে কুন্তলের ফ্ল্যাট থেকে উদ্ধার হয়েছে প্রায় দশ কোটি টাকা। ইডি’র লাগাতার জেরায় সে স্বীকার করেছে প্রাইমারি ও আপার প্রাইমারির নিয়োগ থেকেই তোলা হয়েছিল কোটি কোটি টাকা। এমনকী মাথাপিছু ১ লক্ষ টাকায় টেট পরীক্ষার্থীদের পাশ করিয়ে দেওয়ার নামেও টাকা তোলা হয়েছিল। ধৃত তৃণমূল নেতা ইডি’র জেরায় স্বীকার করে নিয়েছে, নিয়োগের জন্য সংগৃহীত ১৫ কোটি টাকা এক মধ্যস্থতাকারীর মাধ্যমে সে পাঠিয়েছিল খোদ পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের কাছে। সে নিজেও একাধিকবার তৎকালীন এই শিক্ষামন্ত্রীর ফ্ল্যাটে গিয়েছে বলে জেরায় জানিয়েছে।
ইতিমধ্যে নিয়োগ দুর্নীতিতে ইডি এবং সিবিআই’র একাধিকবার জেরার মুখে পড়া শিক্ষা-ব্যাবসায়ী তাপস মণ্ডল একটি সংবাদমাধ্যমে অভিযোগ করেছিলেন যে, খোদ কুন্তল ঘোষই তাঁকে জানিয়েছিল, এই টাকার একটা অংশ ‘কালীঘাটের কাকুকে’ নাকি দিতে হয়। জানা গেছে, সেই কালীঘাটের কাকু আসলে অভিষেক ব্যানার্জির ঘনিষ্ঠতম ব্যক্তি।
এই কুন্তলের বিরুদ্ধে আরও অভিযোগ উঠেছে, প্রভাব খাটিয়ে এক ঠিকাদারকে ঠকানোর। তারকেশ্বরের এই ঠিকাদার অভিযোগ করেছেন, একটি কলেজের নির্মাণ কাজের জন্য ৩৫ লক্ষ টাকার চুক্তি হলেও ৮৫ শতাংশ কাজ হয়ে যাবার পরও তার প্রাপ্য টাকা মেলেনি। টাকা চাইতে গেলে উলটে হুমকি দেওয়া হয়েছে বলেও সেই ঠিকাদার অভিযোগ করেছেন।
এমন একজন যুব নেতাকেই গত নভেম্বর মাসে যুব তৃণমূলের অন্যতম রাজ্য সম্পাদক পদে বসানো হয়। যুব সংগঠনের রাজ্য সম্পাদক পদে বসার মাত্র পনেরো দিনের মধ্যেই প্রাথমিকে নিয়োগের পরীক্ষা হয়েছিল রাজ্যে। আশ্চর্যের ঘটনা হলো, সেই টেটের ওএমআর শিট, একাধিক টেট পরীক্ষার্থীর অ্যাডমিট কার্ডও মিলেছে কুন্তল ঘোষের ফ্ল্যাট থেকে। ইডি’র পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, সদ্য শেষ হওয়া টেটের ১৮৯টি ওএমআর শিট পাওয়া গেছে সেখান থেকে।
এদিকে শিক্ষায় নিয়োগ দুর্নীতি কাণ্ডে একজন অভিনেত্রীর নামও উঠে এসেছে। বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা ইডি-কে নির্দেশ দিয়েছেন, ওই অভিনেত্রীর নাম জানিয়ে দ্রুততার সঙ্গে আদালতে হলফনামা জমা দিতে হবে। আদালত বলেছে, ওই অভিনেত্রীর সম্পদের বিষয় হলফনামায় উল্লেখ করতে হবে।
ইডি হেফাজতে থাকা কুন্তল ঘোষের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ উঠে এলেও যুব তৃণমূলের রাজ্য সম্পাদক পদে এখনও তাকে বহাল রাখা হয়েছে! তৃণমূলের কাছে যেমন অনুব্রত থেকে মানিক ভট্টাচার্য অথবা কয়লা কাণ্ডে অভিযুক্ত বিনয় মিশ্র ‘দোষী’ নন, তেমনি যুব নেতা কুন্তলকেও অভিযুক্ত হিসেবে স্বীকার করতে চাইছে না তৃণমূল।
এদিকে শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় সিবিআই তদন্তের কাজে তীব্র অসন্তোষ প্রকাশ করেছে হাইকোর্ট। প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় ঢিলেমির জন্য সিবিআই’র এক অফিসারকে সরিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। সেই সঙ্গে তিনি নতুন অফিসারের নাম জানানোর নির্দেশ দিয়েছেন।
১ ফ্রেব্রুয়ারি তৃণমূলের আরেক যুব নেতা শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায়কে কুন্তলের মুখোমুখি বসিয়ে জেরা করা হয়েছে। প্রশ্ন করা হয়েছে কুন্তল ও শান্তনুর মোবাইলের সূত্র ধরে। ইডি সূত্রে জানা গেছে, গ্রেপ্তারের পর কুন্তল দাবি করেছিলেন শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতিতে পার্থকে তিনি সাড়ে ১৫ কোটি টাকা দিয়েছেন এবং সেই টাকা লেনদেনের অন্যতম সাক্ষী গোপাল দলপতি। কিন্তু মুখোমুখি জেরায় গোপাল তা অস্বীকার করেছেন।
প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতি মামলার শুনানিতে ১ ফ্রেব্রুয়ারি হাইকোর্টের বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় মানিক ভট্টাচার্য সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন, তিনি এখন বিধায়ক পদে ইস্তফা দেননি, এটা লজ্জার বিষয়। এছাড়াও তিনি প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের সভাপতি এই মানিক ভট্টাচার্যের দু’টি পাসপোর্ট, লন্ডনে বাড়ি ইত্যাদি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। বিচারপতি এমনও মন্তব্য করেছেন যে, ‘দিদি একা আর সামলাতে পারছেন না। চারপাশে এত দুর্বৃত্ত থাকলে তিনি সামলাবেন কী করে?’
সিবিআই সূত্রে জানা গেছে। দীর্ঘ দশ বছরে এই মানিক ভট্টাচার্য পর্ষদের সভাপতি থাকাকালীন তিনটি টেটেই দুর্নীতিতে বিপুল পরিমাণ আর্থিক লেনদেনের অভিযোগ রয়েছে। এই সময়কালেই তিনি লন্ডনে বাড়ি হাঁকিয়েছেন। নিয়োগ দুর্নীতির টাকাই তাতে খেটেছিল বলে মনে করা হচ্ছে।
শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী নিয়োগ দুর্নীতির বিরুদ্ধে একদিকে যেমন বঞ্চিত চাকরি প্রার্থীরা লাগাতার বিক্ষোভ আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন, অন্যদিকে এই সীমাহীন দুর্নীতির বিরুদ্ধে রাজ্যজুড়েই লাল ঝান্ডার আন্দোলন তীব্র হয়ে উঠছে।