E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৬০ বর্ষ ২৫ সংখ্যা / ৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ / ১৯ মাঘ, ১৪২৯

ত্রিপুরার চিঠি

প্রার্থী নিয়ে তুমুল ক্ষোভ বিজেপি’র অন্দরে

জনগণকে সঙ্গে নিয়ে নতুন দিন আনার শপথ বামপন্থীদের প্রচারে

হারাধন দেবনাথ


নির্বাচনী জনসভায় বক্তব্য রাখছেন মানিক সরকার।

ত্রিপুরায় গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক নির্বাচনী সংগ্রামে জয়ের লক্ষ্যে বামপন্থীরা ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। জনস্রোতে বামফ্রন্ট প্রার্থীদের মনোনয়ন পেশ শাসক বিজেপি’র রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছে। ২০১৮ সালে ভিশন ডকুমেন্টে দেওয়া ২৯৯টি প্রতিশ্রুতি পূরণে ব্যর্থ বিজেপি’কে আসামীর কাঠগড়ায় তুলেছেন রাজ্যের মানুষ। প্রার্থী তালিকা নিয়ে তুমুল বিক্ষোভ চলছে বিভিন্ন প্রান্তে। বিজেপি’র অন্দরে ক্ষোভের পারদ চড়েছে। এর বহিঃপ্রকাশও ঘটছে রাজ্যের প্রান্তে প্রান্তে। দলীয় অফিস ভাঙচুর, পতাকা ছিঁড়ে ফেলা, বিধায়ক ও ডক্টর সেলের কর্মকর্তা পদত্যাগের সঙ্গে প্রতিক্রিয়ায় জানিয়েছেন, বিজেপি’র কাজে তিনি হতাশ। পাঁচ বছরের শাসনকালে অনেককেই ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে বিজেপি। বিধানসভা নির্বাচনে প্রার্থী তালিকা ঘোষণার পরপরই শাসক শিবিরে বিদ্রোহ শুরু হয়েছে। ডক্টর সেলের কর্মকর্তা ডাঃ তমোজিৎ নাথের নেতৃত্বে ১০০ পরিবারের সদস্যরা বিজেপি’র সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করে নিয়েছেন। বিজেপি’র ওবিসি মোর্চার এক প্রদেশ সম্পাদকও দল ছেড়েছেন। জোট শরিক বিজেপি এবং আইপিএফটি’র কোন্দল কোনো অবস্থাতেই চাপা দেওয়া যাচ্ছে না।

শাসক বিজেপি’র গোষ্ঠী কোন্দল, জনবিরোধী কার্যকলাপের বিরুদ্ধে মানুষ জোটবদ্ধ হচ্ছেন। গণতন্ত্র হত্যা করে সন্ত্রাস জিইয়ে রেখে এতদিন মানুষকে ঘরবন্দি করে রাখার যাবতীয় প্রচেষ্টা ভেস্তে গেছে। বামপন্থীদের প্রচারে মানুষ দল বেঁধে বের হচ্ছেন। আওয়াজ তুলেছেন ভোটদানের গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষায় নির্বাচন কমিশনকে মেরুদণ্ড সোজা করে দায়বদ্ধতা নিয়ে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষভাবে নির্বাচন পরিচালনা করতে হবে। দেখা যাচ্ছে নির্বাচনী আচরণ বিধি লঙ্ঘন করে শাসকদল রাজ্যের নানাস্থানে সন্ত্রাস জিইয়ে রেখেছে। বামপন্থীদের প্রচারসজ্জা নষ্ট করছে। নির্বাচনী কাজে যুক্তদের একটি অতি ক্ষুদ্র অংশ বিজেপি’র প্রচারে পা মেলাচ্ছে। নলছড়ে বোমা হামলার সঙ্গে বাড়িঘর ভাঙচুর করেছে বিজেপি আশ্রিত দুর্বৃত্তরা। হাসপাতালে গিয়ে পর্যন্ত আক্রমণ করা হচ্ছে। জোলাইবাড়িতে বামফ্রন্ট প্রার্থী আক্রান্ত হয়েছেন। এর নাম জিরো পোল ভায়োলেন্স? প্রশ্ন তুলছেন মানুষ। পরিস্থিতির উপর সতর্ক নজর রেখেই বামপন্থীরা প্রচারকে সংহত করছেন। যাচ্ছেন বাড়ি বাড়ি।

২৭ ও ৩০ জানুয়ারি হাজার হাজার মানুষকে সঙ্গে নিয়ে বামফ্রন্ট প্রার্থীরা মনোনয়ন পেশ করেছেন। ধর্মনগর থেকে সাব্রুম - গ্রাম-পাহাড়,পাহাড়-সমতল, সমতল-শহরের লাল স্রোত পরিণত হয় দুর্বার জনজোয়ারে। শপথের মোহানায় তরী ভাসাচ্ছেন ত্রিপুরার লড়াকু জনগণ। গানের সুরেই হাজার হাজার মানুষের কণ্ঠ ছুঁয়ে বেরিয়ে আসে শপথ, ‘ত্রিপুরায় ভালো দিন ফিরা আইতাসে/ বিভেদের কালো রাত শেষ হইতাসে/ ...জনগণ জোট বানতাসে।’

গত ২৭ ও ৩০ জানুয়ারি বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাসে বিভিন্ন স্থানে বিশাল মিছিল করে মনোনয়ন জমা দিয়েছেন বামফ্রন্টের প্রার্থীরা। সাব্রুমে মনোনয়ন জমা দিয়েছেন বামফ্রন্ট প্রার্থী সিপিআই(এম) রাজ্য কমিটির সম্পাদক জীতেন্দ্র চৌধুরী।

যে কোনো মূল্যে বিজেপি-কে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করবই - সর্বত্র ছিল একই সুর। চোয়াল কষা শপথ। লড়াইয়ের রং, স্লোগান এক অন্য ত্রিপুরাকে চেনালো। চেনা রাস্তায় অবিরাম মানুষের স্রোত বয়ে যায়। গান ও ব্যান্ডের তালে মা-বোন, যুবক সহ নানা বয়সের মানুষের নৃত্য, কণ্ঠে কণ্ঠে গগনভেদী স্লোগান ছিল পথে পথে। জনসমাগম এবং লড়াকু মেজাজে উত্তাল ছিল ত্রিপুরা।

উল্লেখ্য, ২৫ জানুয়ারি প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করে বামফ্রন্ট। কংগ্রেসের সাথে আসন সমঝোতা করেই বামফ্রন্ট ২০২৩ সালের নির্বাচনে লড়ার ঘোষণা করেছে। সন্ধ্যায় মেলারমাঠে সিপিআই(এম) রাজ্য দপ্তর দশরথ দেব স্মৃতি ভবনে সাংবাদিক সম্মেলনে প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করেন রাজ্য বামফ্রন্টের আহ্বায়ক নারায়ণ কর। বিজেপি’র নৈরাজ্য ও দুঃশাসনের অবসান ঘটাতে মানুষ ঘরে ঘরে তৈরি হচ্ছেন বলে সাংবাদিক সম্মেলনে দৃঢ়তার সাথে জানিয়েছেন বামফ্রন্ট নেতৃত্ব। আসন সমঝোতা করে ভোটে লড়ে বামফ্রন্ট ও কংগ্রেস বিধানসভায় নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে বলে দৃঢ় আশা ব্যক্ত করেন বামফ্রন্ট আহ্বায়ক। বামফ্রন্ট প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে ৪৬টি আসনে, ১টি আসনে নির্দল প্রার্থীকে সমর্থন করছে। বিধানসভায় মোট আসন ৬০।

খোয়াইতে মনোনয়নপত্র জমা দিতে যাচ্ছেন বামফ্রন্টের প্রার্থীরা।

১৬ ফেব্রুয়ারি ৬০টি বিধানসভা কেন্দ্রে একইসঙ্গে ভোট। বামপন্থীরা ছাড়াও লড়াইয়ে রয়েছে শাসক বিজেপি- আইপিএফটি, তিপ্রা মথা, তৃণমূল কংগ্রেস। রামনগর বিধানসভা কেন্দ্রে নির্দল প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন আইনজীবী পুরুষোত্তম রায় বর্মন। এই কেন্দ্রে বামফ্রন্ট বা কংগ্রেস প্রার্থী দেয়নি। বিরোধী দলনেতা, সিপিআই(এম) পলিট ব্যুরো সদস্য মানিক সরকার এবার প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন না। এবারকার নির্বাচনে বামফ্রন্টের প্রার্থী তালিকায় ৫৬ শতাংশই নতুন মুখ। নির্বাচনী লড়াই থেকে সরে দাঁড়ানোর পর মানিক সরকার বলেছেন, বিজেপি’র বিরুদ্ধে এক জনমুখী সরকারের জয় নিশ্চিত করার জন্য তিনি লড়বেন। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকার সহ বামফ্রন্ট মন্ত্রীসভার সদস্য বাদল চৌধুরী, অঘোর দেববর্মা, ভানুলাল সাহা, মানিক দে, তপন চক্রবর্তী, সহিদ চৌধুরী স্বেচ্ছায় অব্যাহতি নিয়েছেন নির্বাচনী লড়াই থেকে।

বামফন্টের প্রার্থী তালিকা ঘিরে জনমানসে উচ্ছ্বাস পরিলক্ষিত হচ্ছে। নির্বাচনী প্রচারে তার প্রভাব পড়েছে। এক ঝাঁক যুবক, শিক্ষাবিদ এবং সমাজের সব অংশের প্রতিনিধি রয়েছেন প্রার্থী তালিকায়। জনমুখী সরকার গড়তে ধর্মনগর থেকে সাব্রুম সর্বত্র আওয়াজ উঠেছে। নির্বাচনী মিছিল- সভায় লাল লহর বইছে। সংগ্রামী মেজাজে ভরপুর লালঝান্ডার মিছিল মানুষের মনে সাহস জোগাচ্ছে। রাজপথ থেকে গ্রামীণ জনপদে যুদ্ধ জয়ের গান ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হচ্ছে।

বামফ্রন্ট নেতৃবৃন্দ দৃঢ়তার সাথে বলেছেন, ফসল ঘরে না তোলা পর্যন্ত মাঠ ছাড়বেন না। জয়ী হয়েই ঘরে ফিরুন। এই আহ্বানে যে মানুষ সাড়া দিচ্ছেন তার বহু দৃষ্টান্ত উঠে আসছে প্রচারে।

সন্ত্রাসের প্রাচীর ভাঙা লড়াকু মানুষের হাতে উড়ছে চেনা লালঝান্ডা। সেদিন দুপুরে কাঁঠালিয়ার বুকে মিশেছে লড়াইয়ের রং। বড়ো মিছিল ও জনসভায় সোচ্চারে ধ্বনিত হয় অন্ধকারের বুক চিরে নতুন ভোর ছিনিয়ে আনার প্রত্যয়ী সুর। ঐক্যবদ্ধ হয়ে বৃহত্তর সংগ্রামের দায়বদ্ধতা নিয়ে রাস্তায় নামা মানুষের দৃপ্ত ঘোষণা ছিল, বিজেপি’কে ক্ষমতা থেকে হটানোর এবং বাম-গণতান্ত্রিক-ধর্মনিরপেক্ষ শক্তির সরকার গড়তে জানকবুল লড়াইয়ের। মানুষের বাঁধ ভাঙা স্রোতে যেন অনুরণন ছিল বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শব্দমালা ‘‘লহরীর ‘পরে লহরী তুলিয়া/ আঘাতের’ পরে আঘাত কর্/ মাতিয়া যখন উঠিছে পরান/ কিসের আঁধার, কিসের পাষাণ!’’

নির্বাচনী জনসভা থেকে ধনপুর সহ রাজ্যের সমস্ত অংশের মানুষের উদ্দেশে সিপিআই(এম) পলিট ব্যুরো সদস্য মানিক সরকারের বার্তা ছিল, সমস্ত ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে ভোটাধিকার প্রয়োগ করুন। এতে কেউ বাধা দেবার চেষ্টা করলে তার বিরুদ্ধে গড়ে তুলুন দুর্জয় প্রতিরোধ। নিজেদের অধিকার নিজেরা প্রয়োগ করে বিজেপি জোট সরকারকে উচ্ছেদ করুন। বামপন্থীদের নেতৃত্বে অন্যান্য গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিকে নিয়ে জনগণের স্বার্থরক্ষাকারী সরকার গড়তে কার্যকরী ভূমিকা নিন।