E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৬০ বর্ষ ২৫ সংখ্যা / ৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ / ১৯ মাঘ, ১৪২৯

বামপন্থীরাই পারবে

আভাস রায়চৌধুরী


বিগত ২৬ ডিসেম্বর ২০২২ আরএসএস’র বাংলা মুখপত্রে প্রকাশিত একটি প্রবন্ধের মর্মবস্তু ছিল, বিজেপি পশ্চিমবাংলায় ক্ষমতায় না আসতে পারুক, কিন্তু কোনোভাবেই কমিউনিস্টদের শক্তি বৃদ্ধি না হয় তা দেখার দায়িত্ব সংঘ পরিবারের। বলাবাহুল্য, আরএসএস তার ঘোষিত লক্ষ্যকে আরও একবার স্পষ্ট করেই ঘোষণা করেছে। ২০১৬ বিধানসভা নির্বাচনের পর সংঘ পরিবার দাবি করেছিল তারা রাজ্যের শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেসের পক্ষে ভোট ট্রান্সফার করেছে। আবার ২০২১ বিধানসভা নির্বাচনের প্রচার পর্বে এমন একটা পরিবেশ তৈরি করা হয়েছিল যে, তৃণমূলের বিকল্প হিসেবে বিজেপি পশ্চিমবঙ্গে সরকার গঠন করতে চলেছে। ফলাফলে দেখা গেল এই প্রথমবার বিজেপি পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় উল্লেখযোগ্য শক্তি অর্জন করলেও সরকার গঠন থেকে অনেক দূরে রয়েছে। বিজেপি’র কর্মী সমর্থক এবং যাঁরা তৃণমূল কংগ্রেসকে হারাতে বিজেপি-কে ভোট দিয়েছিলেন তাঁদের সকলকে অবাক করে আরএসএস প্রধান নাগপুর থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুনরায় জয়লাভে স্বস্তি ও আনন্দ প্রকাশ করেছিলেন। বিগত লোকসভা এবং বিধানসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থীদের বিপর্যয়কর ফলাফল রাজনৈতিক হিন্দুত্বের মতাদর্শে পরিচালিত ফ্যাসিস্ত ধাঁচের আরএসএস-কে উৎসাহিত করেছে। চলতি এক দশক ধরে তৃণমূল কংগ্রেসের ধ্বংসাত্মক রাজনীতি ও সরকার পরিচালনার ফলে রাজনৈতিকভাবে বাংলার সমাজে সবথেকে লাভবান হয়েছে সংঘ পরিবার। সম্প্রতি সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে বিগত এক দশকে পশ্চিমবঙ্গে আরএসএস’র শাখা পাঁচ হাজার অতিক্রম করেছে। বিপরীতে সংখ্যালঘু সাম্প্রদায়িক কার্যকলাপ বৃদ্ধির পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। রাজনীতি ও গণচেতনায় বামপন্থী, গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ চেতনার পরিবর্তে সাম্প্রদায়িক বিভাজন ও বিদ্বেষ শক্তিশালী হয়েছে। ফলে তা আরএসএস-বিজেপি’র পক্ষে শক্তি সঞ্চয় করার সুযোগ বৃদ্ধি করেছে। রাজনৈতিক হিন্দুত্বের মতাদর্শ প্রসারের উপযুক্ত সুযোগ বৃদ্ধি এবং কমিউনিস্ট ও বামপন্থীদের শক্তি ক্ষয় আরএসএস-কে উৎসাহিত এবং আগ্রাসী করেছে। মনে রাখা দরকার, এই পরিবেশের বৃহত্তর প্রেক্ষাপট হলো বিশ্বব্যাপী আধুনিক চিন্তাভাবনার উপর সর্বব্যাপী ‘যুক্তিবিনাসী’ আগ্রাসন। বর্তমান সময়ে পশ্চিমবঙ্গের তীব্র দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক পরিবেশ এই প্রেক্ষাপটের সঙ্গেই সম্পর্কযুক্ত।

সমাজ পরিবর্তনের লক্ষ্য নিয়ে চলা সিপিআই(এম) শুধুমাত্র নির্বাচনী পার্টি নয়। পার্টির সর্বস্তরের সংগঠক, কর্মী ও সমর্থক হিসেবে আমরা এ বিষয়ে সচেতন থাকতে চাই। আবার পার্টি কর্মসূচিতেই সিপিআই(এম) সংসদীয় ও সংসদ বহির্ভূত ভূমিকা ও আন্দোলনের কথা স্পষ্ট করে ঘোষণা করেছে, পার্থক্য নির্দেশ করেছে এবং সম্পর্ক নির্দিষ্ট করেছে। এই উভয় পথের সম্পর্ক একমুখী নয়, দ্বান্দ্বিক। বর্তমান পরিস্থিতিতে এটা বলার অপেক্ষা রাখে না, ভারতে জনগণের ভবিষ্যৎ সংগ্রামকে গড়ে তোলার প্রশ্নে নির্বাচনী সংগ্রামের ভূমিকা ও গুরুত্ব তাৎপর্যপূর্ণ। নির্বাচনী সংগ্রামের মাধ্যমে জনগণের সমর্থন কিংবা বিরোধিতার প্রতিফলন ঘটে। নির্বাচনী সংগ্রাম হোক অথবা সমাজ পরিবর্তনের মৌলিক সংগ্রাম হোক, উভয় পথেই সংগ্রামী মানুষের সমর্থন ও অংশগ্রহণ আবশ্যিক শর্ত। ২০১৪ এবং ২০১৯-এ পরপর দুটি লোকসভা নির্বাচনে আরএসএস-বিজেপি’র নিরঙ্কুশ গরিষ্ঠতা আজ ভারতকে কোন বিপদের কিনারায় নিয়ে চলেছে তা সহজেই বোঝা যাচ্ছে। আবার ২০১১-পরবর্তী পশ্চিমবঙ্গ যে অন্ধকারের দিকে ক্রমশ এগিয়ে চলেছে তা আজ দিনের আলোর মতো স্পষ্ট।

১৯৯১-এ নয়া উদারবাদী অর্থনীতি চালু হওয়ার পর থেকে সাধারণ মানুষের জীবন-জীবিকা ভয়ংকর আক্রমণের সামনে পড়েছে। ২০১৪ এবং ২০১৯ সালে আরএসএস-বিজেপি নিরঙ্কুশ গরিষ্ঠতা নিয়ে দিল্লিতে সরকার গঠনের পর নয়া উদারবাদের প্রয়োগ আরও বেপরোয়া ও ভয়ঙ্কর হয়েছে। এই মুহূর্তে দেশের প্রায় সমস্ত করপোরেট মোদি সরকারের পাশে রয়েছে। কারণ মোদি সরকার বেপরোয়া গতিতে দেশের শ্রমজীবী মানুষের স্বার্থের বিরুদ্ধে গিয়ে করপোরেটের স্বার্থ পূরণ করছে। রাজনৈতিক হিন্দুত্বের পক্ষে সর্বতোভাবে সাহায্য করছে করপোরেট। রাজনৈতিক হিন্দুত্ব করপোরেটের স্বার্থ পূরণের পথে সহযোগিতা করে চলেছে। আবার এই সময়ের মধ্যেই দেশের রাজনীতিতে বামপন্থী ও অন্যান্য গণতান্ত্রিক শক্তির শক্তি ক্ষয় ঘটেছে। নয়া উদারনীতির শুরুর দিন থেকে পার্লামেন্টের ভিতর ও বাইরে বামপন্থীদের লাগাতার লড়াই এবং পার্লামেন্টের ভিতরে বামপন্থীদের উল্লেখযোগ্য শক্তি সাধারণ মানুষের কণ্ঠস্বরকে তুলে ধরতে পেরেছিল। সংসদের বাইরে নয়া উদারবাদের বিরুদ্ধে রাস্তার সংগ্রামে বামপন্থীদের ভূমিকা আজও উজ্জ্বল। কিন্তু ভারত রাষ্ট্র কাঠামোর বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী পার্লামেন্টের ভিতরে শক্তি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সেখানে এখন বামপন্থীদের শক্তি খুবই দুর্বল। পশ্চিমবঙ্গেও সংসদীয় রাজনীতিতে এখন বামপন্থীদের কোনো প্রতিনিধি নেই। বামপন্থীদের সংসদীয় শক্তির দুর্বলতা শাসক শ্রেণিকে ভয়ঙ্কর আগ্রাসী করেছে। আজ দেশের কৃষি, শিল্প ক্রমবর্ধমান অধাগতির মুখে। সাধারণ মানুষের জীবনমান ভয়ংকরভাবে নিম্নমুখী, অথচ দেশের কয়েকটি মাত্র করপোরেট সংস্থার মুনাফা বেড়ে চলেছে বিপুল হারে। লকডাউনের সময়ে গোটা দেশের উৎপাদন কার্যত স্তব্ধ, লক্ষ লক্ষ পরিযায়ী কাজ হারিয়ে, মাথার ওপর ছাদ হারিয়ে পথে পথে ঘুরছেন। গড় জাতীয় উৎপাদন যখন একেবারে নিম্নগামী সেই সময় বিপুল পরিমাণ মুনাফা সংগ্রহ করেছে করপোরেটগুলি। বেকারত্বের হার সর্বকালীন রেকর্ড অতিক্রম করেছে। অর্থনীতি ও সাধারণ মানুষের ক্রমবর্ধমান এই অধোগতির পাশাপাশি আক্রান্ত ভারতের সংবিধান গণতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতা। আক্রান্ত দলিত, আদিবাসী, মহিলা এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষজন।

এই একই নেতিবাচক প্রবণতা ২০১১-পরবর্তী পশ্চিমবাংলায়। চলতি এক দশকে সারা দেশের মতো পশ্চিমবঙ্গেও কৃষি ও কৃষক ভয়ংকর বিপর্যয়ের দিকে চলেছে। এই সময়ে কার্যত কোনো নতুন শিল্প এ রাজ্যে গড়ে ওঠেনি। শ্রমিকশ্রেণি ও শ্রমজীবী মানুষের আয় দিন দিন কমছে। বেড়ে চলেছে বেকার সংখ্যা। রাজ্যে কেবলমাত্র সরকারি দপ্তরে স্থায়ী শূন্যপদের সংখ্যা আনুমানিক ৬ লক্ষ। পাশাপাশি কয়েকটি ক্ষেত্রে নিয়োগের নামে সীমাহীন দূর্নীতি ও মানুষের অর্থ লুট করেছে তৃণমূল কংগ্রেসের নেতারা। চিকিৎসার খরচ ক্রমশ সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। শিক্ষা কার্যত রসাতলে। রাজ্যে সরকার পরিবর্তনের পর বামপন্থীদের উপর নেমে আসা আক্রমণ ও সন্ত্রাস গোটা রাজ্যেই প্রসারিত হয়েছিল। দুর্নীতি এখন তৃণমূল কংগ্রেস দল ও সরকারের সমার্থক। সাধারণ মানুষ থেকে তৃণমূল কংগ্রেস সরকার ক্রমশ বিচ্ছিন্ন হচ্ছে। মানুষের মধ্যে ক্ষোভ-বিক্ষোভ বাড়ছে। আশার কথা সাধারণ মানুষ প্রতিবাদের রাস্তা নিতে চাইছেন, পারছেন। এখন সাধারণ মানুষের ক্ষোভ মোকাবিলা করা এবং তৃণমূল কংগ্রেস দলটিকে টিকিয়ে রাখার দায়িত্ব পালন করছে কার্যত পুলিশ। অথচ রাজ্যের আইনের শাসন কার্যত ভেঙে পড়েছে। প্রায় সর্বত্র পুলিশি রাজের প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। সারাদেশে আরএসএস-বিজেপি’র মতোই এই রাজ্যেও গণতন্ত্রের উপর আক্রমণ সংগঠিত করছে তৃণমূল কংগ্রেস সরকার। উভয় স্বৈরশাসনের সাধারণ বৈশিষ্ট্য হলো, সাধারণ মানুষের অধিকার হরণ করা এবং একই সঙ্গে সাধারণ মানুষকে সরকারের অনুগ্রহ প্রার্থী হিসেবে গড়ে তোলা।

কমিউনিস্ট ও বামপন্থীদের জনগণের মধ্যে কাজের ধারার প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো শ্রমজীবী ও সাধারণ মানুষকে তাদের অধিকার সচেতন ও সংগঠিত করে দাবি আদায়ের লড়াইয়ে জড়ো করা। তিন দশকের বেশি সময় এ রাজ্যের জনগণ বামপন্থীদের সরকার পরিচালনার দায়িত্ব দিয়েছিলেন। পঞ্চায়েত ও পৌরসভা বামপন্থীরা পরিচালনা করেছে। ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন ভেঙে দিয়ে গরিব খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের কাছ পর্যন্ত তা প্রসারিত হয়েছিল। রাজনীতিবিজ্ঞানের ভাষায় যাকে আমরা ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ বলি। সেই কারণে সরকার থেকে চলে যাবার পরেও বামপন্থীদের উপর শাসকশ্রেণি ও তার রাজনৈতিক দল আক্রমণ অব্যাহত রাখে। বামফ্রন্টের সময় সিলিং বহির্ভূত উদ্বৃত্ত জমি জমিচোরদের কাছ থেকে উদ্ধার করে গরিব খেটে খাওয়া ও কৃষিতে প্রকৃত উৎপাদকদের হাতে পৌঁছে দিয়েছিল বামফ্রন্ট সরকার। জমি ও ফসলের উপর গরিব মানুষের অধিকারকে প্রতিষ্ঠা করার জন্যই গ্রামীণ বাস্তুঘুঘুর বাসা ভেঙে জোতদার-জমিদারের সিন্দুকে বন্দি থাকা পঞ্চায়েতকে উদ্ধার করে গরিব খেটে খাওয়া সাধারণ গ্রামীণ জনগণের পঞ্চায়েতে পরিণত করেছিল বামফ্রন্ট। ক্ষমতার এই বিকেন্দ্রীকরণ ক্রমে সমাজের দুর্বলতর অংশের মানুষের মধ্যে প্রসারিত হয়েছিল বামফ্রন্টের সময়। সংরক্ষণ ব্যবস্থার মাধ্যমে তফশিলি জাতি, উপজাতি এবং মহিলা সহ সামাজিকভাবে পিছিয়ে পড়া ও অবদমিত মানুষদের ক্ষমতায়ন ঘটেছিল। বামফ্রন্ট সরকারের আগে শিক্ষার সুযোগ সাধারণভাবে সমাজের উচ্চবিত্ত, উচ্চ-মধ্যবিত্ত অংশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। বামফ্রন্ট সরকার জ্ঞান অর্জনের এই বাধা ভেঙে দিয়ে শিক্ষার আলো পৌঁছেছিল সমাজের সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে। জমি ও ফসলের উপর গরিব খেটে খাওয়া মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার ফলে গ্রামীণ অর্থনীতির বিরাট ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটেছিল। বামফ্রন্ট সরকার প্রতিষ্ঠার আগে পশ্চিমবঙ্গের উল্লেখযোগ্য অংশের মানুষের মধ্যে দারিদ্র্য ও কার্যত অনাহার ছিল নিত্যসঙ্গী। তিন দশকের বামফ্রন্ট সরকার ও পঞ্চায়েত গণ উদ্যোগের মধ্য দিয়ে গ্রাম বাংলার অর্থনীতির বিপুল পরিবর্তন ঘটিয়েছিল।

নয়া উদারবাদী অর্থনীতি প্রবলভাবে চেপে বসার পরিপ্রেক্ষিতে পশ্চিমবঙ্গেও ক্রমশ আর্থিক সংকট সৃষ্টি হয়েছিল। তার আগেই কেন্দ্রীয় সরকারের দীর্ঘ বঞ্চনার ফলে পূর্বাঞ্চল বিশেষত পশ্চিমবঙ্গের যে সংকট সৃষ্টি হয়েছিল, নয়া উদারবাদী অর্থনীতির ফলে তা গুণগতভাবে বেড়েছিল। তার মধ্যেও এই শতকের প্রথম দশকে পশ্চিমবঙ্গে বছরে কুড়ি হাজার কোটি টাকার শিল্পপণ্যের বাজার তৈরি হয়েছিল। তা সৃষ্টি হয়েছিল ভূমি সংস্কার ও গ্রামীণ অর্থনীতির অগ্রগতির ফলে। এই পরিপ্রেক্ষিতেই উন্নত কৃষির ভিতের উপর নতুনভাবে শিল্প গড়ে তোলার সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে সচেষ্ট হয়েছিল বামফ্রন্ট সরকার। এখানে দুটি বিষয় মনে রাখা খুবই জরুরি। প্রথমত, ভূমি সংস্কার ও পঞ্চায়েতিরাজের মধ্য দিয়ে গ্রামীণ অর্থনীতির বিপুল ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটলেও জমির সীমাবদ্ধতার কারণেই এই অর্থনৈতিক অগ্রগতির সীমাবদ্ধতা ক্রমশ বোঝা যাচ্ছিল। ফলে কৃষি ও গ্রামীণ অর্থনীতির বিকাশ ধরে রাখার জন্যই শিল্প বিকাশের সম্ভাবনা সৃষ্টি করাটা অর্থনৈতিক অগ্রগতির বিচারে প্রয়োজনীয় ছিল, বাধ্যতামূলকও ছিল। দ্বিতীয়ত, দীর্ঘ বঞ্চনার ফলে রাজ্যের অর্থনীতি বিশেষত শিল্পের যে সংকট তৈরি হচ্ছিল তা থেকে বেরিয়ে আসার লক্ষ্যেই ১৯৯৪-এ বামফ্রন্ট সরকার নতুন শিল্পনীতি প্রয়োগ করে পশ্চিমবাংলাকে ক্ষুদ্র, মাঝারি ও কুটির শিল্পের বিকাশে দেশের মধ্যে প্রথমস্থানে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিল। নয়া উদারবাদী ভারতে পশ্চিমবাংলার মতো শ্রেণি ও গণ আন্দোলনের ঐতিহ্যশালী অঞ্চলে নতুন বৃহৎ ও সংগঠিত শিল্প স্থাপনের সংগ্রাম হলো নয়া উদারবাদের বিরুদ্ধে সরাসরি ভূমিকা পালন। তাই লুটেরা পুঁজির দিক থেকে শক্তিশালী প্রত্যাঘাত সিঙ্গুর ও নন্দীগ্রামকে কেন্দ্র করে আন্তর্জাতিক, জাতীয় স্তরের ও আঞ্চলিক স্তরে সংগঠিত ও সফল বামফ্রন্ট বিরোধী ষড়যন্ত্র এবং চলতি এক দশকে তৃণমূল কংগ্রেসের কার্যকলাপে তা স্পষ্ট।

আজকের তৃণমূল কংগ্রেস সরকার শ্রমিক কৃষক, খেতমজুর, ছাত্র-যুব, কর্মচারী, তফশিলি জাতি ও উপজাতি, সংখ্যালঘু মহিলা সহ সমাজের সর্বস্তরের খেটে খাওয়া ও সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে। গ্রামবাংলায় গরিব মানুষের কাছ থেকে জমি কেড়ে সেই জমি তৃণমূল কংগ্রেসের একাংশ বিক্রি করে দিচ্ছে। সরকারি ও খাস জমি লুট ও বিক্রি করা হচ্ছে। বনাঞ্চল লুট ও ধ্বংস করা হচ্ছে। বালি, পাথর, কয়লা সহ সব ধরনের হালকা ও ভারি খনিজ সম্পদ অবাধে লুট করা হচ্ছে। সরকার ও পুলিশ সরাসরি মালিকপক্ষের দালালি করছে। সাধারণ মানুষের স্বার্থ বিরোধী এই সবক’টি পদক্ষেপের বিরুদ্ধে একমাত্র দায়বদ্ধতার সাথে লড়াই করছে বামপন্থীরা। এই লড়াইকে দুর্বল করার জন্যই ২০১৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনের সময় থেকে দেশীয় শাসকশ্রেণি ও করপোরেট চালিত মিডিয়া এবং অবশ্যই রাজনৈতিক হিন্দুত্বের মতাদর্শে চলা আরএসএস জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছে। তৃণমূল কংগ্রেসের দক্ষিণপন্থী রাজনীতির সঙ্গে বামপন্থীদের সরাসরি রাজনৈতিক লড়াইকে দুর্বল করার জন্য বিজেপি-কে হাজির করেছে। বামপন্থীরা বিশেষত কমিউনিস্টরা আরএসএস-বিজেপি এবং তৃণমূল কংগ্রেসের সাধারণ শত্রু। রাজ্যে ২০১৮’র পঞ্চায়েত নির্বাচনের সময় থেকে তৃণমূলের বিকল্প বিজেপি কিংবা বিজেপি’র বিকল্প তৃণমূল, এই রাজনৈতিক বাইনারি তৃণমূল কংগ্রেস এবং বিজেপি-কে রাজনৈতিকভাবে সাফল্য এনে দিয়েছে। এই রাজনৈতিক বাইনারিকে ভূমিস্তরে আরও ভয়ংকর ও বিষাক্ত করে তুলতে পরিকল্পিতভাবে আরএসএস-বিজেপি এবং তৃণমূল কংগ্রেস সাম্প্রদায়িক বিভাজনকে কাজে লাগিয়েছে। উভয়ে উভয়কে পুষ্টি দিয়েছে এবং দিয়ে চলেছে।

বামপন্থীদের দুর্বলতার সুযোগে এই কাজে বিগত পাঁচ-ছ বছর ধরে তৃণমূল কংগ্রেস এবং আরএসএস-বিজেপি সফল হয়েছে। খেটে খাওয়া মানুষের লড়াই আড়ালে চলে গেছে। বাংলার মতো উদার গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ সমাজে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ও বিভাজন উদ্বেগজনকভাবে বেড়েছে। ফলে জীবনমানের দিক থেকে ক্রমবর্ধমানভাবে দুর্বল হতে থাকা সাধারণ মানুষ কখনো বিভ্রান্ত হয়েছেন, কখনো হতাশ হয়েছেন, কখনো নৈরাজ্যের শিকার হয়েছেন। সাধারণ মানুষের বিভ্রান্তি, হতাশা কিংবা নৈরাজ্যের আচরণ শাসকশ্রেণির কিংবা দক্ষিণপন্থী রাজনীতির কোনো ক্ষতি করে না। বামপন্থী ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে দুর্বল ক’রে শেষ পর্যন্ত তা সাধারণ মানুষের জীবন-জীবিকা, অস্তিত্ব ও ভবিষ্যতের সংগ্রামকেই দুর্বল করে ফেলে। পরিকল্পিতভাবে বামপন্থীদের দুর্বল করার যে ষড়যন্ত্র দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে শুরু হয়েছে ২০১১-তে-বামফ্রন্টের নির্বাচনী পরাজয় এবং তার পরের এক দশকের রাজনৈতিক সামাজিক ঘটনাবলিতে কমিউনিস্ট ও বামবিরোধী শক্তি আপাতভাবে সফল হয়েছিল। এই সাফল্য বাম বিরোধী এবং শেষ বিচারে গণতন্ত্র ও শ্রমজীবী মানুষের শত্রুরা পরিকল্পিতভাবেই ঘটাতে সক্ষম হয়েছিল। ২০১৯-এ বিজেপি লোকসভা নির্বাচনে এবং ২০২১-এ তৃণমূল কংগ্রেস বিধানসভা নির্বাচনে সংকীর্ণ বাইনারির সাফল্য পেয়েছে। ফ্যাসিস্ত ধাঁচের আরএসএস এই বাইনারি সৃষ্টিতে এবং বাইনারির ফলাফল থেকে সাফল্য পেয়েছে। পশ্চিমবাংলার ইতিহাসে এর আগে এত বিপুল সংখ্যায় সাংসদ ও বিধায়ক লাভ করেনি বিজেপি। উনিশ শতকের জাগরণ সমৃদ্ধ ইতিহাসের বাংলায় ২০২১-এর নির্বাচনে এই প্রথম বিধানসভা গঠিত হয়েছে একই শিকড়ে বাঁধা দুটি তীব্র দক্ষিণপন্থী স্বৈরাচারী রাজনৈতিক শক্তিকে নিয়ে। এর প্রতিক্রিয়া পশ্চিমবঙ্গের সমাজ, অর্থনীতি, রাজনীতি, সংস্কৃতিতে গভীর নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করে চলেছে। এই নেতিবাচক উপাদান ও প্রভাব বিগত এক দশক ধরে বেড়েই চলেছে।

ছোটো বা বড়ো, স্বল্পস্থায়ী বা দীর্ঘস্থায়ী কোনো একটা ঘটনা পরিকল্পিতভাবে ঘটানো যায়। ঘটে যাওয়া সেই ঘটনাটি পরবর্তী পরিবর্তনমুখী ঘটনার উপাদান ও পূর্বশর্ত হিসেবে কাজ করে। ঘটনা যারা ঘটালো পূর্বশর্তের উপর তাদের আর কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে না। এটাই ইতিহাসের বস্তুবাদী শিক্ষা। প্রায় বছরখানেক বিশেষত ২০২২-র মাঝামাঝি সময় থেকে পশ্চিম বাংলার রাজনীতিতে বাম গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ শক্তির পক্ষে ইতিবাচক পরিবর্তনের সম্ভাবনার সৃষ্টি হয়েছে। পঞ্চায়েতে তৃণমূল কংগ্রেসের ব্যাপক দুর্নীতি, যোগ্য প্রার্থীদের বঞ্চিত করে টাকার বিনিময়ে শিক্ষকতা সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে চাকরি বিক্রি, আবাস যোজনায় ব্যাপক দুর্নীতি, রেগার কাজে বিপুল পরিমাণ মজুরি বকেয়া থাকা ইত্যাদি দুর্নীতি ও জনবিরোধী কাজগুলির বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের ক্ষোভ এখন প্রতিবাদ ও বিক্ষোভে পরিণত হচ্ছে। এই বিষয়গুলি নিয়ে বামপন্থীদের ধারাবাহিক আন্দোলন এখন সাধারণ মানুষকে ছুঁতে পারছে। সাধারণ মানুষ তাদের জীবন জীবিকা ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বামপন্থীদের সামনে দেখতে চাইছেন। বামপন্থীদের প্রতিবাদী লড়াইয়ের ডাকে সাড়া দিচ্ছেন গরিব ও খেটেখাওয়া মানুষ। তৃণমূল কংগ্রেস সরকারের এই অনাচারের বিরুদ্ধে বামপন্থীদের যে আন্দোলনমুখী ভূমিকা বৃদ্ধি পাচ্ছে, তাতে খেটে খাওয়া ও সাধারণ মানুষ আস্থা প্রকাশ করতে আগ্রহী হয়ে উঠছেন। বিশেষত, ২০২২-র আগস্ট মাস ব্যাপী পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলাতে আইন অমান্য আন্দোলনে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ, বামপন্থীদের দৃঢ় ও লড়াকু মনোভাব পরিবর্তনকামী মানুষের মধ্যে উৎসাহ সৃষ্টি করছে। অনেক জায়গাতেই আন্দোলন সংগ্রামে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণের প্রবণতা কিছুটা বাড়ছে।

সাধারণ মানুষের মধ্যে ক্রমশ এই ধারণা স্পষ্ট হচ্ছে দুর্নীতি ও জনবিরোধী ইস্যুতে আরএসএস-বিজেপি এবং তৃণমূলের মধ্যে প্রকৃতপক্ষে কোনো পার্থক্য নেই। বিজেপি এবং তৃণমূল কংগ্রেস কিংবা কেন্দ্রীয় সরকার ও রাজ্য সরকারের মধ্যে ঝগড়া ও লড়াই আসলে লোক দেখানো। এরা পরস্পর পরস্পরকে পুষ্টি দিচ্ছে এবং দিয়ে চলছে। কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্যের তৃণমূল কংগ্রেস সরকারের সীমাহীন সর্বব্যাপী দুর্নীতির বিরুদ্ধে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করবে না। কেন্দ্রীয় সরকারের পদক্ষেপগুলি আসলে তৃণমূল বনাম বিজেপি বাইনারিকেই জিইয়ে রাখার প্রচেষ্টা, এটা এখন মানুষের কাছে স্পষ্ট। রাজ্যে তৃণমূল কংগ্রেস সরকারের বিভিন্ন দুর্নীতির বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় সংস্থা যে সমস্ত তদন্তগুলি চালাতে বাধ্য হচ্ছে আসলে সেগুলি সবই আদালতের নির্দেশে।

২০২৪-র লোকসভা নির্বাচনে আরএসএস-বিজেপি পুনরায় রাজনৈতিক হিন্দুত্ব এবং সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ও বিভাজনের রাজনীতিকেই তুলে ধরতে সচেষ্ট। অতি সম্প্রতি আরএসএস প্রধানের মন্তব্যেই তা স্পষ্ট হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গেও আরএসএস-বিজেপি এবং তৃণমূল কংগ্রেস গত কয়েক বছর ধরে চলা বিদ্বেষ বিভাজন ও বাইনারি রাজনীতিকেই জিইয়ে রাখতে মরিয়া হবে। কিন্তু সাধারণ মানুষের অভিজ্ঞতা সাধারণ মানুষকে এই উভয় শক্তির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ করবেই। ঘামের গন্ধ, প্রতিবাদী মানুষের দৃঢ় আওয়াজ আর মাটির উত্তাপ সেই ইঙ্গিত দিচ্ছে। আবার মানুষের জীবন-জীবিকার দাবি সামনে আসছে। তবে আত্মসন্তুষ্টি যেন হাতছানি না দেয়। শাসকশ্রেণি সবসময়ই খেটেখাওয়া মানুষের মধ্যে ফাটল ধরাতে মরিয়া চেষ্টা চালায়। আজকের ফিন্যান্স নিয়ন্ত্রিত আন্তর্জাতিক লগ্নিপুঁজি ভুক্তভোগী ও ক্ষুব্ধ শ্রমজীবী মানুষদের রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া ও আচরণকে দক্ষিণপন্থী বাইনারিতে বন্দি রাখতে চায়। এই কাজে আজকের নয়া ফ্যাসিস্ত শক্তিগুলি হস্তক্ষেপকারী ভূমিকা নিচ্ছে। এদেশ, এরাজ্যে আরএসএস এই কাজ করে চলেছে।

বামপন্থা ও দক্ষিণপন্থার সরাসরি রাজনৈতিক সংগ্রাম শ্রেণি সংগ্রামকেই শক্তিশালী করে। তীব্র দক্ষিণপন্থী রাজনীতিতে শ্রমজীবী মানুষ যদি দক্ষিণপন্থী বাইনারির মধ্যে আটকে থাকে, তবে শ্রমজীবী মানুষেরা নিজেদের শক্তিকে চিনতে পারেনা, নিজেদের উপর ভরসা করতে পারে না, নিজেদের প্রকৃত লড়াই লড়তে ব্যর্থ হয় এবং শেষ পর্যন্ত শাসকদের হাতের খেলার পুতুলে পরিণত হয়। শাসকশ্রেণি, বড়ো বড়ো করপোরেট চালিত মিডিয়া, আরএসএস-বিজেপি এবং রাজ্যে তৃণমূল কংগ্রেস এই রাজনৈতিক পরিমণ্ডলকেই টিকিয়ে রাখতে মরিয়া। গত পঞ্চায়েত নির্বাচনের সময় এই শক্তি প্রচার করেছিল বামপন্থীরা বিশেষত সিপিআই(এম) এখন দুর্বল, তাই তৃণমূলকে আটকাতে পারে একমাত্র বিজেপি। করপোরেট চালিত মিডিয়া প্রকাশ্যে এবং আরএসএস নিবিড়ভাবে প্রচার গড়ে তুলেছিল - ‘আগে রাম পরে বাম’। এই প্রচারে বিভ্রান্ত হয়েছিলেন গরিব খেটেখাওয়া মানুষেরা। পঞ্চায়েত নির্বাচনের পরে ২০১৯-র লোকসভা নির্বাচনেও এই প্রচারই পশ্চিমবঙ্গের গরিব খেটে খাওয়া মানুষদের বিভ্রান্ত করেছে। নিজেদের আসল ঠিকানা থেকে অসচেতনভাবে তাদেরকে সরিয়ে নিয়ে গেছে। ২০২১-র বিধানসভা নির্বাচনে এই প্রচারের উলটো প্রতিক্রিয়ার সাফল্য পেয়েছিল তৃণমূল। সেখানেও বিজেপি-কে আটকাতে তৃণমূলকেই একমাত্র শক্তি হিসেবে তুলে ধরা হয়েছিল। শুধুমাত্র দক্ষিণপন্থী দিক থেকে এই প্রচার গড়ে তোলা হয়নি। ‘নো ভোট টু বিজেপি’ স্লোগান পরিপূর্ণভাবে সাহায্য করেছিল তৃণমূল কংগ্রেসের মতো স্বৈরাচারী শক্তিকে।

বিগত এক বছরে পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থীরা আবার নির্ভরযোগ্য শক্তি হিসেবে সামনে আসছে। সিপিআই(এম) সহ সমস্ত বামপন্থী শক্তি সম্মিলিতভাবে অন্যান্য গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করে তৃণমূল কংগ্রেস এবং বিজেপি’র বিরুদ্ধে গণ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারবে এই বিশ্বাস ও আস্থা সাধারণ মানুষের মধ্যে গড়ে উঠছে। অদূর ভবিষ্যতে গ্রাম-শহরের গরিব খেটে খাওয়া শ্রমজীবী সাধারণ মানুষ বিগত কয়েক বছরের বিভ্রান্তি কাটিয়ে আবার বাম গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ শক্তির পক্ষে শামিল হবেন। জীবনের অভিজ্ঞতা সাধারণ মানুষের মধ্যে দিন-প্রতিদিন এই প্রত্যয় গড়ে তুলছে যে, তাদের রুটি-রুজি এবং অস্তিত্ব লাল ঝান্ডার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। লাল ঝান্ডাও শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে বিশ্বাস ও আস্থা সৃষ্টি করতে সক্ষম হচ্ছে। সব থেকে বড়ো কথা রাজনীতিতে প্রকৃত ক্ষমতা রয়েছে সাধারণ মানুষের কাছে। সূর্যের কিরণ আমাদের চারপাশকে আলোকিত করে বস্তুজগৎকে দেখতে সাহায্য করে, তেমনই মানুষের সমর্থনই রাজনৈতিক শক্তিকে শক্তিশালী করে। অভিজ্ঞতায় রাজ্যের মানুষ বুঝতে পারছেন বিজেপি কখনো তৃণমূলের বিকল্প নয়। পথে-ঘাটে এই আলোচনা ক্রমশ বাড়ছে যে, বামফ্রন্ট সরকারের সময়ে পশ্চিমবঙ্গ ও পশ্চিমবঙ্গের মানুষ ভালো ছিল। এক দশক আগে রাজ্যের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ বামপন্থীদের প্রতি সমর্থন সরিয়ে নিয়েছিলেন। এক দশকের মধ্যেই আবার মানুষ বামফ্রন্ট সরকারের সময়ের সাফল্য ও বামপন্থীদের শ্রমজীবী মানুষের পক্ষে ভূমিকাকে স্মরণ করছেন। উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় যুব জনঅংশ আরএসএস-বিজেপি এবং তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে এবং বামপন্থীদের পক্ষে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করছেন। রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে রাজ্যে বামপন্থীদের পক্ষে এটাই সবথেকে সম্ভাবনার দিক। এই সম্ভাবনাকে সফল করে তুলতে সিপিআই(এম) সমস্ত বাম গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করে রাজ্যে তৃণমূল কংগ্রেস এবং বিজেপি-কে পরাস্ত করতে দায়বদ্ধ এবং সক্ষম।

এই সম্ভাবনা যত বাড়ছে ততই আরএসএস আবার প্রচার শুরু করেছে চলো সবাই মিলে তৃণমূলকে হারাই। অথচ আরএসএস নিজেই ঘোষণা করেছে পশ্চিমবঙ্গে এখন তৃণমূলের পরাজয় তারা চায় না। বামপন্থীদের শক্তি বৃদ্ধি হোক তারা কোনোভাবেই তা চায় না। রাজ্যের উল্লেখযোগ্য অংশের মানুষের তৃণমূল কংগ্রেসকে যেকোনোভাবে হারাবার ইচ্ছে ও আবেগকে ব্যবহার করতেই আরএসএস পরিকল্পিতভাবে এই প্রচার গড়ে তুলছে। আমরাও চাই স্বৈরাচারী তৃণমূল কংগ্রেসকে পরাস্ত করতে। তৃণমূল কংগ্রেসকে পরাস্ত করতে গেলে বিজেপি-কেও বিচ্ছিন্ন ও পরাস্ত করতে হবে। বিজেপি-কে সঙ্গে নিয়ে তৃণমূল কংগ্রেসকে পরাস্ত করা যাবে না, আরএসএস-র রাজনীতিকে কোনোভাবেই পরাস্ত করা যাবে না। এই প্রচারের ফাঁদে পা দেওয়া কিংবা এই ভাবনা হলো নিশ্চিতভাবে একটি আত্মঘাতী পথ এবং তা তৃণমূল কংগ্রেসকে টিকে থাকতে সাহায্য করবে। সবাই মিলে তৃণমূল কংগ্রেসকে হারানোর স্লোগান আসলে রাজ্যে তৃণমূল কংগ্রেস বিরোধী ঐক্যবদ্ধ শক্তির মধ্যে ঢুকে শক্তি ও ঐক্যকে ভাঙতে সূচ হয়ে ঢুকে ফাল হয়ে বেরিয়ে আসার আরএসএস-বিজেপি’র পরিকল্পনা। সারাদেশে বিজেপি বিরোধী ঐক্য ভাঙতে যে কাজ করতে সচেষ্ট তৃণমূল কংগ্রেস। তাই সাম্প্রতিক সময়ে গ্রামবাংলায় আরএসএস পরিকল্পিত এই প্রচারের ফাঁদে পা দেওয়ার আত্মঘাতী পথ সম্পর্কে আমাদের সর্বস্তরের সংগঠক কর্মী সমর্থকদের সচেতন ও সতর্ক থাকতে হবে। তৃণমূল কংগ্রেস এবং বিজেপি উভয় শক্তিকেই পরাস্ত করতে হবে। এই পথেই শ্রমজীবী মানুষের জীবন-জীবিকা ও অস্তিত্বের ভবিষ্যৎ সংগ্রাম অনেকটা নির্ভরশীল। এই উভয় শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই এবং লড়াইয়ের ক্ষেত্রকে প্রসারিত করে সম্ভাব্য সর্ববৃহৎ মঞ্চ গড়ে তোলার জন্য বামপন্থীরা কাজ করছে। বামপন্থীরা আজ তৃণমূল কংগ্রেস এবং বিজেপি’র বিরুদ্ধে শক্তিশালী লড়াই গড়ে তুলতে পারে। বামপন্থীরাই পারে সাধারণ মানুষের জীবন-জীবিকার লড়াইকে জারি রাখতে। বামপন্থীরাই পারে আজকের দিনে এদেশ, এরাজ্যে আরএসএস’র মতাদর্শ ও রাজনীতির বিরুদ্ধে শক্তিশালী লড়াই গড়ে তুলতে।