৬০ বর্ষ ২৫ সংখ্যা / ৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ / ১৯ মাঘ, ১৪২৯
সাম্প্রতিক কলেজিয়াম বিতর্ক - আসলে বিপন্ন সংবিধান
সব্যসাচী চট্টোপাধ্যায়
কলেজিয়াম সিস্টেম। জগদীপ ধনখড়। কেশবানন্দ ভারতী। কিরণ রিজিজু... বিচারপতি মান্থার ঘরে আক্রমণ - তাঁর নামে পোস্টার, মমতা ব্যানার্জির মুখে বিচারবিভাগের স্বাধীনতার কথা।
ভারতের বিচারব্যবস্থার সামনে গভীর সংকট। এই সংকটকালেই সিপিআই(এম) সাংসদ বিকাশ ভট্টাচার্য ন্যাশনাল জুডিশিয়াল অ্যাপয়েন্টমেন্ট কমিশন বিল নামে প্রাইভেট মেম্বার বিল মুভ করলেন! তৃণমূল হইহই শুরু করল। আমরা গুলিয়ে ফেললাম।
আসল কথা হলো সংবিধান থাকবে তো...!
বছর চারেক আগে সুপ্রিম কোর্টে একটা জনস্বার্থ মামলা - সংবিধানের প্রস্তাবনা থেকে সমাজতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ শব্দদুটি কেটে বাদ দিতে হবে। সরাসরি ৪২ তম সংবিধান সংশোধনীতে হয়েছে তাই ওগুলোও কুখ্যাত। একটা অদ্ভুত পরিস্থিতি! শুধুমাত্র ইতিহাস দিয়ে, নজির দিয়ে সমস্যার সমাধান হবেনা। ভারতের সাংবিধানিক ব্যবস্থার সামনে এবং বিচারব্যবস্থার সামনে।
সংবিধানের মৌলিক নির্মিতির বিষয়টির একটি ঐতিহাসিক তাৎপর্য আছে। আইনের শাসন বা Rule of Law এই মূলগত নির্মিতির অবিচ্ছেদ্য উপাদান। একে অস্বীকার করার বা পরিবর্তন বা পরিমার্জন করার অর্থ সংবিধানের মূলগত নির্মিতিকেই অস্বীকার করা। ১৯৬৭ সালে গোলকনাথ বনাম পাঞ্জাব রাজ্য মামলায় দেশের সর্বোচ্চ আদালতের ১১ সদস্যের সাংবিধানিক বেঞ্চের সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারপতিরা যে রায় দিয়েছিলেন তার নির্যাস ছিল এই - যে কোনো পরিস্থিতিতেই আমাদের সংসদের হাতে থাকা সংশোধনীর ক্ষমতা সংবিধানের মূলগত নির্মিতির পরিবর্তনের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যাবে না। অথবা সহজ করে বললে সংবিধানের ৩৬৮ তম অনুচ্ছেদে বর্ণিত সংসদের সংশোধনী ক্ষমতা এমনভাবে ব্যবহার করতে হবে যাতে সংবিধানের মৌলিক নির্যাস বদলে না যায়। গোলকনাথ মামলার এই রায় ৪২তম সংবিধান সংশোধনী আইনের পরিপ্রেক্ষিতে ১৩ সদস্য বিশিষ্ট সুপ্রিম কোর্টের সাংবিধানিক বেঞ্চ কেশবানন্দ ভারতী বনাম কেরালা রাজ্যের মামলায় Doctrine of Basic Structure প্রণয়ন করেন। যেহেতু আইনের শাসন এই বেসিক স্ট্রাকচার বা মূলগত নির্মিতির অন্যতম উপাদান এবং স্বাধীন বিচারব্যবস্থা দেশের আইনের শাসনের চালক, তাই স্বাধীন বিচার ব্যবস্থার উপর কোনোরকম হস্তক্ষেপ, বিশেষত প্রশাসনিক হস্তক্ষেপ চূড়ান্তভাবে আমাদের সংবিধানের পরিপন্থী।
সংবিধানের ৫০তম অনুচ্ছেদে স্বাধীন বিচারব্যবস্থার কথা স্বীকৃত আছে। এই স্বীকৃতি অনুযায়ী আমাদের দেশের বিচারব্যবস্থা, বলা ভালো, উচ্চতর বিচারব্যবস্থা অর্থাৎ সুপ্রিম কোর্ট এবং হাইকোর্টের বিচারপতিদের স্বাধীনতা নির্দিষ্ট করার মধ্যে দিয়েই স্বাধীন বিচারব্যবস্থাকে নিশ্চিত করা সম্ভব। এই প্রসঙ্গে হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের নিয়োগ, কার্যক্রম ইত্যাদি বিষয়গুলি মাঝে মাঝেই খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে আমাদের জাতীয় রাজনীতির মূল ধারার আলোচনা হিসেবে উঠে এসেছে।
সাম্প্রতিককালের ঘটনার প্রবাহের দিকে তাকালে আমরা বুঝতে পারি যে, ভারতের বিচারব্যবস্থার উপর একটি পরিকল্পিত আক্রমণ নামিয়ে আনার চেষ্টা চলছে, যার লক্ষ্য শুধুমাত্র বিচার ব্যবস্থা দখল নেওয়া নয়, ভারতের সংবিধানে বর্ণিত আইনের শাসনকে সার্বিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করা। অতি সম্প্রতি কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী শ্রী কিরণ রিজিজু সুপ্রিম কোর্টের কলেজিয়ামকে যে চিঠি লিখেছেন তার ভাষা নিশ্চিতভাবেই বিচারব্যবস্থার পক্ষে সম্মানহানিকর। সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি নিয়োগের প্রশ্নে বর্তমান আইনি অবস্থান স্পষ্টভাবে জানা সত্ত্বেও দেশের আইনমন্ত্রী হিসেবে সরকারি প্রতিনিধি চেয়ে তাঁর এই চিঠি শুধু আক্রমণাত্মকই নয়, দেশের স্বাধীন বিচারব্যবস্থার পক্ষে মারাত্মক। ১৯৮১ সালে প্রথম বিচারপতি নিয়োগ সংক্রান্ত মামলার রায়ে সুপ্রিম কোর্টের সাংবিধানিক বেঞ্চ সংবিধানের ১২৪তম অনুচ্ছেদে ব্যবহৃত আলোচনা সাপেক্ষ (consultation and concurrence) হিসাবেই কথাটিকে ব্যাখ্যা করেন এবং নির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করেন যে, রাষ্ট্রপতি বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন, কিন্তু প্রধান বিচারপতির মতামতও এখানে গুরুত্বপূর্ণ। এক্ষেত্রে ‘আলোচনা সাপেক্ষে’ কথাটির অর্থ কখনোই ‘সম্মতি সাপেক্ষে’ নয়। এই মামলায় এটিও নির্ধারিত হয় যে, বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি প্রধান বিচারপতির মতামতকে প্রাধান্য দেবেন। বিচারপতি নিয়োগে এই অবস্থান বলবৎ ছিল।
কিন্তু দ্বিতীয় বিচারপতি নিয়োগ ও বদলি সংক্রান্ত মামলার রায় মামলায় ৯ সদস্যের বৃহত্তর সংবিধান বেঞ্চ প্রথম বিচারপতির নিয়োগ সংক্রান্ত মামলার রায়কে বাতিল করে এবং উল্লেখযোগ্যভাবে প্রধান বিচারপতি মতের প্রশ্নে আরও দুই প্রবীণতম বিচারপতির মত নেওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়। এই রায় সংক্রান্ত ব্যাখ্যা নিয়ে প্রশ্ন উঠলে ১৯৯৩ সালে এই ৯ সদস্যের বিশিষ্ট সাংবিধানিক বেঞ্চ দ্বিতীয় বিচারপতি নিয়োগ সংক্রান্ত মামলার ব্যাখ্যা করার সময় কলেজিয়াম ব্যবস্থার কথা প্রথম উল্লেখ করেন। এবং এই কলেজিয়াম ব্যবস্থার অর্থ হলো দেশের প্রধান বিচারপতি ‘বিচারপতি নিয়োগ সংক্রান্ত বিষয়ে মুখ্য নির্ধারকের ভূমিকা পালন করবেন এবং সেক্ষেত্রে তাঁকে ২ জন প্রবীণ বিচারপতির সঙ্গে আলোচনা করতে হবে। কলেজিয়াম-এর পাঠানো নামের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি সেই নামগুলিকেই গ্রহণ করতে বাধ্য থাকবেন।
এই গোটা পরিস্থিতি বদলে যায় যখন ২০১৪ সালে National Judicial Appointment Commission গঠনের ক্ষেত্রে সংবিধানের ৯৯তম সংশোধনী পাশ হয়। কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট এই সংশোধনীকে অসাংবিধানিক এবং মৌলিক বিরোধী বলে ঘোষণা করেন।
বিতর্কের সূত্রপাত এই বিলটিকে কেন্দ্র করে। একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী) বিচারপতি প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে National Judicial Appointment Commission সুলভ সংস্থার গঠনকে স্বাগত জানায়, কিন্তু পার্টির পক্ষ থেকে তৎকালীন আইনমন্ত্রী রবিশংকর প্রসাদকে লেখা চিঠিতে National Judicial Appointment Commission সংক্রান্ত পার্টির অবস্থানকে ব্যাখ্যা করেন। এবং এই কমিশনের সদস্য হিসেবে বার অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিনিধিদের আবশ্যিক সংযুক্তির কথা বলেন। প্রশ্ন হলো সিপিআই(এম) Judicial Appointment Commission দাবি করেও বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারের ভূমিকাকে স্বাধীন বিচার ব্যবস্থার পক্ষে বিপজ্জনক বলে মনে করছে কী?
এ কথার উত্তর খুঁজতে গেলে আমাদের সাম্প্রতিক অতীতের কয়েকটি ঘটনার দিকে নজর দিতে হবে। প্রথমত, বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার বিচারপতি নিয়োগের প্রশ্নটিকে যতটা না সমাধানের দৃষ্টিভঙ্গিতে বিচার করছে, বিচারব্যবস্থার সঙ্গে প্রত্যক্ষ যুদ্ধে মানুষকে নিয়োজিত করে দেশের স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচার ব্যবস্থাকে প্রশ্নচিহ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে। কেন্দ্রের বিজেপি সরকার বারে বারে কলেজিয়াম ব্যবস্থাকে আক্রমণ করতে গিয়ে এমন কিছু প্রস্তাব ও বক্তব্য তুলে ধরছে যা স্বাধীন বিচারব্যবস্থার চালিকাশক্তি আইনের শাসনের সামনে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিচ্ছে। ২০১৭ থেকে ২০২২ পর্যন্ত আমরা দেখেছি যে, কীভাবে প্রশাসন ও সরকার বিচারব্যবস্থায় বারংবার হস্তক্ষেপ করেছে। বিপজ্জনক বিষয় হলো কলেজিয়াম ব্যবস্থা যতই ত্রুটিপূর্ণ হোক না কেন তাকে চ্যালেঞ্জ করার জন্য কার্যকরী সংবিধানসম্মত আইন প্রণয়নের চেষ্টা না করেই কলেজিয়াম ব্যবস্থাকে সরাসরি আক্রমণ করা এবং একই সময়ে দেশের সংবিধানের বেসিক স্ট্রাকচার Doctrine নিয়ে প্রশ্ন তোলা আর যাই হোক কোনো কার্যকরী সাংবিধানিক পদে থাকা প্রশাসনিক ব্যক্তিত্বদের মানায় না।
কলেজিয়াম ব্যবস্থা সঠিক নয়, সিপিআই(এম) ১৯৯৩ সাল থেকেই বিচারপতি নিয়োগের প্রক্রিয়ার তীব্র বিরোধিতা করে এসেছে। কিন্তু স্বাধীন বিচারব্যবস্থা আক্রান্ত হতে পারে বা আইনের শাসনই ঠুনকো হয়ে যেতে পারে এমন কোনো বক্তব্য সিপিআই(এম) সমর্থন করেনা। সিপিআই(এম) মনে করে কলেজিয়াম সিস্টেম উঠিয়ে দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা আছে, কারণ স্বচ্ছতা ও দায়বদ্ধতার ভিত্তিতে স্বাধীন বিচারব্যবস্থাকে আরও সংহত করার প্রয়োজনীয়তা আছে। কিন্তু তারমানে এই নয় কেন্দ্রীয় সরকার বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে নিজেদের ক্ষমতা প্রদর্শনের নামে নিজেদের প্রতি রাজনৈতিক দায়বদ্ধ মানুষদেরকেই বিচারপতি নিয়োগ করবে! কিরণ রিজিজু বড়োই চটেছেন কারণ, যে নামগুলি কেন্দ্রীয় সরকার বাতিল করার পরেও সুপ্রিম কোর্ট পাঠিয়েছে, এই নামগুলি বাতিলের কারণগুলি হলো একজন সম্ভাব্য বিচারপতি সমকামী, একজন সম্ভাব্য বিচারপতি মোদি বিরোধী এবং আরও একজন ঘোষিত সরকার বিরোধী। এই কারণগুলি সুপ্রিম কোর্টের পক্ষ থেকে ওয়েবসাইটে তুলে দেওয়ায় মানুষও বুঝতে পারছেন বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার আসলে কলেজিয়াম ব্যবস্থাকে আক্রমণ করতে চাইছে নিজেদের দলীয় নিয়ন্ত্রণ কায়েম করতে। এই ধরনের প্রচেষ্টা শুধু অসাংবিধানিক নয়, গণতন্ত্রের ভবিষ্যতের পক্ষেও বিপজ্জনক।
একদিকে যখন কেন্দ্রে এই পরিস্থিতি, দেশের আইনমন্ত্রী সরাসরি যুদ্ধ ঘোষণা করছেন বিচার ব্যবস্থার বিরুদ্ধে, ঠিক সেই সময়ই এই পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল সরকারের অবস্থান চূড়ান্তভাবে স্বাধীন বিচারব্যবস্থার প্রতি আক্রমণাত্মক। একের পর এক বিচারপতিদের সম্পর্কে আক্রমণাত্মক মন্তব্য আমাদেরকে শুধু চিন্তিতই করছে না, মনে করিয়ে দিচ্ছে কোনো এক জঙ্গলের রাজত্বের কথা, যে জঙ্গল থেকে মুক্তি পেয়েই একটি সার্বভৌম দেশ হিসেবে ১৯৫০ সালে ভারত আত্মপ্রকাশ করেছিল একদিন।