৬০ বর্ষ ২৫ সংখ্যা / ৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ / ১৯ মাঘ, ১৪২৯
মোদি ঘনিষ্ঠ আদানি গোষ্ঠীর জালিয়াতি
ঈশিতা মুখার্জি
নিউ ইয়র্ক শহরের একটি ছোটো আর্থিক বিষয়ক গবেষণা সংস্থা কিছুদিন আগে ভারতের ধনীতম করপোরেট আদানি সম্পর্কে এক আর্থিক জালিয়াতির অভিযোগ ফাঁস করেছে। অভিযোগটি হলো এই যে, কৃত্রিমভাবে জালিয়াতির সাহায্যে নানা কৌশলে আদানি গোষ্ঠী শেয়ার বাজারে তার শেয়ারের দাম চড়া আছে বলে প্রতিপন্ন করেছিল, যা আদতে সঠিক নয়। এইভাবে শেয়ার বাজারে কয়েকদিনের মধ্যেই জাঁকিয়ে বসে আদানি এবং ফাটকা মুনাফা লুঠতে থাকে ও বাজার দখল করে। এই কৃত্রিমভাবে বাজার দখল, স্বচ্ছতা বজায় না রেখে লুঠেরা মনোভাবে বাজার দখল করার কথাই নিউ ইয়র্কের হিন্ডেনবার্গ সংস্থা বলেছে। এরকম কথা, অভিযোগ, পাল্টা অভিযোগ ফাটকাপুঁজির বাজারে হয়েই থাকে। অভিযোগ ওঠা বড়ো কথা নয়। এই অভিযোগ ওঠার পর যা যা ঘটল আমাদের দেশের রাজনীতি, অর্থনীতির ক্ষেত্রে তা নিঃসন্দেহে উদ্বেগের।
এটা স্বাভাবিক যে, আদানি অভিযোগ অস্বীকার করবেন। কিন্তু আদানি শুধু অস্বীকারই করেনি; অভিযোগ, আদানি হিন্ডেনবার্গ সংস্থাকে হুমকি দিতে শুরু করেছে। গত ২৪ জানুয়ারি এই সংস্থা আদানির জালিয়াতির বিষয়ে সন্দেহ জানিয়ে এর সপক্ষে প্রমাণ দাখিল করে। আদানি এর উত্তরে এই সংস্থাকে হুমকি দিয়ে ৪১৩ পাতার একটি পত্র পাঠায়।
মোদী সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় এই আদানির বাড়বাড়ন্ত। আদানি বিশ্বের তৃতীয় ধনীতম ব্যক্তি হন সরকারের প্রচ্ছন্ন মদতে। আমাদের দেশের বেসরকারিকরণ বলতে মোদির জমানায় যা হয়েছে তা এককথায় আদানিকরণ। এহেন আদানি হিন্ডেনবার্গ সংস্থার অভিযোগকে ভারতের ক্ষেত্রে জাতীয়তাবিরোধী একটি বৈদেশিক চক্রান্ত বলে আখ্যা দেবে তা স্বাভাবিক। দেশের ভিতরে মোদি সরকার যেরকমভাবে যে কোনো প্রশ্নে প্রশ্নকর্তাকে জাতীয়তাবিরোধী আখ্যা দেয়, সেরকমভাবেই আদানির ওই দীর্ঘ পাতার উত্তরে মূল কথা তিনি বলেন যে, এই ধরনের অভিযোগ ভারত রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বৈদেশিক চক্রান্ত। তাই আর্থিক কথায় ব্যাখ্যা না দিয়ে তিনি পেশিশক্তি দেখিয়েছেন।
ভারতে ত্রিশ বছরে নয়া উদারীকরণে যে পুঁজিবাদের জন্ম হয়েছে তা হলো লুঠেরা পুঁজিবাদ যা মার্কিনি ভাষায় ক্রোনি পুঁজিবাদ বলা হয়। এই পুঁজিবাদ তার মুনাফা অর্জনের জন্য অর্থনীতির উপর নির্ভর করে না; রাজনৈতিক ক্ষমতা, পেশীশক্তি, ভয় দেখানো ইত্যাদির উপর নির্ভর করে। এই পুঁজিবাদ সরকারের সহযোগিতায় কাজ করে। ভারতেও তাই হয়েছে। মুক্তবাজারের অর্থনীতি কিন্তু বাজারের নিয়মে চলে; তাতে শোষণ আছে কিন্তু মুনাফা শুধুই আর্থিক; পেশীশক্তির ভূমিকা প্রচ্ছন্নভাবে মুনাফা অর্জনে থাকে না। আদানি-আম্বানি পুঁজিবাদ তো সরকারি সহায়তায় চলে। তাই হিন্ডেনবার্গ সংস্থাকে আস্তিন গুটিয়ে জাতীয়তাবাদের দাওয়াই দিয়েছে আদানি। ৪১৩ পাতার উত্তরের মধ্যে মাত্র ত্রিশটি পাতা আসল উত্তর দিতে ব্যয় করেছেন আদানি এবং তাতেও এমন বলা হয়েছে, এর মধ্য দিয়ে ভারতকে আক্রমণ করা হয়েছে। ভারতের ধনীতম ব্যক্তি যদি জালিয়াতি করে তাহলে ধরে নিতে হবে যে, এই জালিয়াতি আসলে হয়েছে দেশের সাধারণ মানুষের আর্থিক চাওয়া-পাওয়ার সাথে। ধনীতম ব্যক্তির জালিয়াতির দায়ভার তো কোনো অবস্থাতেই দেশের উপর চাপে না।
দেশের মানুষের আর্থিক নিরাপত্তার ওপরও এই জালিয়াতি হাত বসাতে চলেছে। এই খবর চালু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পুঁজির বাজারে ধস নামে। আদানি গোষ্ঠীর শেয়ারের দাম পড়তে থাকে। ভারতের শেয়ার বাজারেও দোলাচল দেখা যায়। দেশের বাজারের এক বড়ো ক্ষেত্র তো আদানির হাতে তুলে দিয়েছে মোদি সরকার। ফেসবুক, টুইটার ভরে গেল হ্যাশট্যাগে, যে ভারত আছে আদানির সাথে। এগুলো তো তৈরি করা হলো বিজেপি দলের পক্ষ থেকে; যাকে বহুদিন আগে নোয়াম চমস্কি বলেছিলেন “manufacturing consent” বা জনসম্মতি উৎপাদন করা। অর্থাৎ দেশকে লুঠ করলেও বিজেপি দল তার সঙ্গে আছে।
কিন্তু আসলে বিপদ কোথায়? ভারতের শেয়ার বাজারের ধস পয়লা ফেব্রুয়ারি বাজেট আটকাতে পারল না। দেশের অর্থমন্ত্রী পুঁজির দুনিয়া নিয়ে ভালো ভালো আশ্বাস বাণী শোনালেও তা পুঁজির বাজারকে সুস্থির করল না। আদানি গোষ্ঠীর শেয়ারের ধস অব্যাহত। ধসের পরিমাণ আদানি এন্টারপ্রাইজের ২৬শতাংশ; আদানি পোর্টের ১৭শতাংশ। আরও উদাহরণ আছে। আশঙ্কার কথা এই যে, স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া এবং ভারতীয় জীবন বিমা আদানির শেয়ারে বিনিয়োগ করায় দেশের সাধারণ মানুষের ব্যাঙ্কে ও জীবন বিমায় গচ্ছিত অর্থ তো বিপদের মুখে পড়ল। এই অনিশ্চয়তা তো দেশের সরকারেরই তৈরি করা। দেশের মানুষের স্বার্থে তাই জনসমক্ষে এই আর্থিক মুনাফা, তার জালিয়াতির বিষয়ে স্বচ্ছ তদন্ত প্রয়োজন। দেশের স্বার্থে দেশের মানুষের আজ প্রকৃত তথ্য জানার অধিকার আছে। তাই চাই দেশের সর্বোচ্চ ন্যায়ালয় সুপ্রিম কোর্টের তত্ত্বাবধানে তদন্ত এবং বিচার। দেশের সম্পদ যার হাতে সরকারি মদতে তুলে দিয়েছে মোদি সরকার, বিদেশের পুঁজির বাজারে যদি তার জালিয়াতি সম্পর্কে ইঙ্গিত থাকে, সেটাই কি যথেষ্ট নয় তদন্ত করার? এই তদন্ত না করার অর্থ দেশের সম্পদ লুঠের কাজে সরকারের প্রচ্ছন্ন মদত দেওয়া এবং তা অবশ্যই দেশদ্রোহিতা।