E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৬০ বর্ষ ২৫ সংখ্যা / ৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ / ১৯ মাঘ, ১৪২৯

মোহন ভাগবতের সাক্ষাৎকারঃ হিন্দুত্বের সাম্প্রতিকতম বয়ান

বৃন্দা কারাত


আরএসএস প্রকাশিত পত্রিকা ‘অর্গানাইজার’ ও ‘পাঞ্চজন্য’-এর ১৫ জানুয়ারি সংখ্যায় আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবতের সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়েছে। আরএসএস’র প্রতিষ্ঠাতা হেডগেওয়ার ও দ্বিতীয় সরসংঘচালক গোলওয়ালকর হিন্দু রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বিষয়ে যা লিখে গিয়েছেন তার ব্যাখ্যা ২০২৩ সালের পরিপ্রেক্ষিতে হাজির করেছেন মোহন ভাগবত। তিনি বলেছেন, ‘‘হিন্দুস্তান এক হিন্দুরাষ্ট্র। এই সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী হিন্দু সমাজ-হিন্দু রাষ্ট্র-ভারত-গৌরবের শিখরে পৌঁছাবে এবং বিশ্বকে নেতৃত্ব দেবে।’’

আরএসএস প্রথম যখন তাদের পরিকল্পনা প্রকাশ করেছিল তখন ভারত ব্রিটেনের উপনিবেশ। বর্তমানে স্বাধীন ভারতের নিজস্ব সংবিধান আছে। আরএসএস প্রধানের আপত্তিকর মন্তব্যগুলি প্রমাণ করে যে, আরএসএস কখনো এই সংবিধান মানেনি। তিনি আরও উল্লেখ করেছেন যে, এখন আরএসএস’র ‘সম্পদ’, ‘প্রাচুর্য’ ও ‘নানাবিধ উপকরণ’ রয়েছে। তাহলে এই প্রশ্ন করা অন্যায় নয় যে, এই সমস্ত সম্পদ কী, তার পরিমাণ কতটা এবং এই অর্থ কোথা থেকে আসছে।

অভ্যন্তরীণ শত্রুঃ গোলওয়ালকরের ভাবনার সম্প্রসারণ

মোহন ভাগবতের সাক্ষাৎকারের মূল আলোচনা ছিল হিন্দু সমাজকে নিয়ে। কিন্তু আরএসএস প্রধান হিন্দু সমাজের যে ব্যাখ্যা হাজির করেছেন তার কোনো স্থান ভারতের সংবিধানে নেই। তার মতে, ‘‘হিন্দু সমাজ গত এক হাজার বছর ধরে যুদ্ধরত - আর যারা যুদ্ধে লিপ্ত তারা স্বাভাবিকভাবেই আগ্রাসী হবে।’’ অর্থাৎ এক ঝটকায় ভাগবত ভারতের ইতিহাসকে দুই ভাগে বিভক্ত করে এমনভাবে দেখাতে চাইছেন যেখানে একদিকে সব হিন্দু অন্যদিকে বাকি সম্প্রদায়। ভারত আক্রমণকারী ও বিজেতারা তাদের স্থানীয় সহযোগী সামন্ত প্রভুদের নিয়ে যে সমস্ত যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিল সেগুলিকে মুসলিম বনাম হিন্দু সমাজের ধর্মীয় যুদ্ধ হিসেবে দেখানো হচ্ছে। যে সমস্ত অন্যায় অতীতে হয়েছে বলে ধরে নেওয়া হচ্ছে, সেগুলির পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমানে ‘হিন্দুদের’ ‘আগ্রাসন’-কে ন্যায়সম্মত বলে মান্যতা দেওয়া হচ্ছে। মোহন ভাগবতের কথায়, ‘‘এখানে কোনো বাইরের শত্রু নেই, ভেতরের শত্রু আছে। সুতরাং হিন্দু সমাজ, হিন্দু ধর্ম ও হিন্দু সংস্কৃতিকে রক্ষা করার লড়াই চলছে।’’ তিনি আরও বলেছেন, ‘‘ভারতের যে সমস্ত মুসলমান নিজেদের ধর্মাচরণ করছেন কিংবা যারা তাদের পূর্বপুরুষদের ধর্মবিশ্বাস পুনরায় গ্রহণ করতে চান এদের কারোরই কোনো সমস্যা হবে না - ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের ভয় পাওয়ার কিছু নেই... কিন্তু একইসাথে মুসলিমদের শ্রেষ্ঠত্বের বেপরোয়া দাবি থেকে অবশ্যই সরে আসতে হবে।’’ মোহন ভাগবত আরও বলেছেন যে, মুসলমানরা নাকি দাবি করেন যে তারা ‘‘উন্নত জাতি’’ যারা আবার ভারত শাসন করবে,ইত্যাদি। তার ভাষায়, ‘‘ওদের এই বক্তব্য বন্ধ করতেই হবে। বস্তুত এদেশে যারাই থাকেন - একজন হিন্দু বা কমিউনিস্ট - তাদের এই যুক্তি থেকে সরে আসতে হবে।’’

এই হচ্ছে আরএসএস’র বক্তব্য। যারাই আরএসএস’র মিথ্যা বয়ানের বিরুদ্ধে কমিউনিস্টদের মতো আপসহীনভাবে লড়াই করছে তাদের হুমকি দেওয়া, ভয় দেখানো ও আক্রমণ করা হচ্ছে। গোলওয়ালকর বলেছিলেন, ‘‘মুসলিমরা হিন্দু জাতির অধীনতা স্বীকার করে ভারতে থাকতে পারে।’’ ভাগবত আইনের হাত থেকে বাঁচার জন্য এই বক্তব্যকেই কিছুটা পরিশোধিত করলেও একই লক্ষ্য নিয়ে কথা বলছেন। তার উদ্দেশ্য, মুসলমান সম্প্রদায়কে আরএসএস’র নজরদারিতে রাখা, সংঘ পরিবারের অপরাধমূলক আক্রমণগুলিকে অনুমোদন করা, অভ্যন্তরীণ শত্রু হিসেবে মুসলিম, কমিউনিস্ট ও খ্রিস্টানদের সাথে যুদ্ধ চালানোর যে কথা বলেছিলেন গোলওয়ালকর, সেই শত্রু তালিকায় সেই সমস্ত হিন্দুদেরও যুক্ত করা যারা আরএসএস-এর বক্তব্য মেনে চলে না। এ হচ্ছে সাম্প্রদায়িকতার সাথে স্বৈরতন্ত্রের ভয়ংকর সংমিশ্রণ, যেখানে হুমকি দেওয়া হয়েছে - ‘‘যারা এখানে থাকেন তাদের সকলকে’’, যেন ভারতীয় নাগরিকদের শান্তিতে থাকতে হলে দেশের সংবিধান নয় আরএসএস’র মতামত মেনে চলতে হবে।

একথাও এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, সিপিআই(এম) মনে করে আরএসএস’র তীব্র প্ররোচনার ফলে একদল ইসলাম ধর্মাবলম্বী মুসলমান সম্প্রদায়ের কিছু অংশের মধ্যে মৌলবাদী মনোভাব ও কার্যকলাপ বিস্তারের সুযোগ পেয়েছে। এর ফলে মেরুকরণ বৃদ্ধি পেয়েছে এবং আরএসএস’র বিভেদপন্থা শক্তিশালী হয়েছে। মোহন ভাগবতের এই সাক্ষাৎকার সিপিআই(এম)’র এই বক্তব্যকেই সত্য প্রমাণ করে যে, এক ধরনের সাম্প্রদায়িকতা আরেক ধরনের সাম্প্রদায়িকতাকে পুষ্ট করে।

আরএসএস জাতিগত নিপীড়ন অস্বীকার করে

ভাগবত ‘হিন্দু সমাজে’র স্বনিযুক্ত প্রতিনিধি হিসেবে কথা বলেছেন এবং এই ‘সমাজের’ পক্ষ থেকে অদ্ভুত সব বক্তব্য তুলে ধরেছেন। হিন্দুত্বের ধ্বজাধারী হয়ে কথা বলা এক বিষয়, কেননা এটি এক রাজনৈতিক তত্ত্ব যার সাথে ধর্মের কোনো সম্পর্ক নেই। কিন্তু সমস্ত হিন্দুর হয়ে কথা বলার দাবি করা আর এক বিষয়, কেননা এদেশের অধিকাংশ মানুষ যারা হিন্দু তারা আরএসএস’র দৃষ্টিভঙ্গিকে সমর্থন করে না। ভারতে দলিতদের ওপর অত্যাচার লক্ষণীয়ভাবে বৃদ্ধি পাওয়ার ঘটনা আরএসএস প্রধানের কাছে কোনো ইস্যুই নয়। এই সাক্ষাৎকারে জাতের প্রসঙ্গ একবারই উল্লেখিত হয়েছে এই বলে যে, ‘‘শ্রীরাম সমস্ত জাতি ও গোষ্ঠীকে একত্রিত করেছিলেন’’। এইভাবে শ্রীরামকে রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে ‘‘জয় শ্রীরাম’’ স্লোগানের মাধ্যমে ব্যবহার করে হিন্দুত্বের পরিচিতি নির্মাণ করা হচ্ছে। অন্যদিকে দলিতদের উপর উচ্চবর্ণের হিন্দুরা যে বৈষম্য, হিংসা ও যৌন নির্যাতন নামিয়ে আনছে তাকে উল্লেখ মাত্র করা হচ্ছে না।

আরএসএস প্রধানের অভিধানে ‘দারিদ্র্য’ শব্দটি নেই

মোহন ভাগবত এক ‘‘সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী হিন্দু সমাজের’’ কথা বলেছেন। অথচ বিশ্ব খাদ্য সূচকে ভারতের স্থান লজ্জাজনক। এর কারণ পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি অপুষ্টিতে আক্রান্ত এবং ক্ষুধার্ত মানুষের বাস ভারতে যাঁদের অধিকাংশ হিন্দু ধর্মাবলম্বী। সেই দেশে ‘সমৃদ্ধি’র কথা বলা অসুস্থ রসিকতা। এটা তাৎপর্যপূর্ণ যে দেশের সাধারণ মানুষের দুর্দশা নিয়ে, যে সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য ভারতকে ধ্বংস করে দিচ্ছে তা নিয়ে আরএসএস প্রধানের কোনো বক্তব্য নেই। আরএসএস প্রধানের কাছে কৃষক বা শ্রমিক বলে কোনো আলাদা বর্গ নেই, সবাই তথাকথিত হিন্দু সমাজের অঙ্গীভূত। তাই যখন আদানি একদিনে গড়ে ১২১৬ কোটি টাকা রোজগার করেন, আর একজন গ্রামীণ শ্রমজীবী মহিলা দৈনিক আড়াইশো টাকা কোনোমতে রোজগার করেন তখন আরএসএস এই দুজনকেই একই পংক্তিভুক্ত করে - অর্থাৎ এরা হিন্দু সমাজের অঙ্গ। কঠোর বাস্তবকে অস্বীকার করা আসলে কোনো কিছুর পক্ষ অবলম্বন করাকেই বোঝায়। সেদিক থেকে দেখতে হলে বোঝা যায় যে, আরএসএস প্রধান তার কাঙ্ক্ষিত হিন্দু পরিচিতিসত্তার মধ্যে ধনী ও দরিদ্রের পরিচয়কে স্বীকার না করার মাধ্যমে আসলে ভয়ঙ্কর বৈষম্যকে সমর্থন করছেন। যেখানে অধিকাংশ হিন্দু মূল্যবৃদ্ধির দ্বারা আক্রান্ত, যেখানে সরকারি তথ্যতেও দেখা যাচ্ছে যে, ভোগের জন্য ব্যয় কমে গিয়েছে যা কীনা প্রমাণ করে যে অধিকাংশ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমছে, সেখানে আরএসএস প্রধান বলছেন যে, মূল্যবৃদ্ধি নাকি ‘‘ভোগবাদের’’ ফল - অর্থাৎ জনগণ বেশি বেশি জিনিস কিনে দাম বাড়িয়ে তুলছে। অথচ ভারত এখন মন্দার মুখোমুখি হতে চলেছে। এমনকী পুঁজিবাদের সমর্থক অর্থনীতিবিদরাও চাহিদা বৃদ্ধির পক্ষে সহায়ক অর্থনীতি গ্রহণের জন্য সওয়াল করছেন। এই পরিস্থিতিতে আরএসএস প্রধান মূল্যবৃদ্ধির জন্য আম জনতাকে দায়ী করছেন।

এই সাক্ষাৎকারের ফলে প্রকৃতপক্ষে এই প্রয়োজনীয়তা আরও স্পষ্ট হয়েছে যে, ‘হিন্দু সমাজের’ প্রতিনিধি হিসেবে নিজেদের দাবি করা আরএসএস’র স্বরূপ উন্মোচন করা দরকার এবং হিন্দুত্ব যেভাবে করপোরেটের শ্রেণিস্বার্থকে রক্ষা করছে সেই বাস্তবতাকে তুলে ধরা দরকার।

সংবিধান বহির্ভূত কর্তৃত্ব

এই সাক্ষাৎকারের আরেকটি তাৎপর্যপূর্ণ অংশ সেইটি যেখানে আরএসএস, স্বয়ংসেবক, রাজনীতি এবং সরকারের আন্তঃসম্পর্ক নিয়ে কথা বলা হয়েছে। মোহন ভাগবত পুনরায় এই মিথ প্রচার করেছেন যে, আরএসএস একটি ‘সাংস্কৃতিক’ সংগঠন যা প্রতিদিনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সাথে যুক্ত নয়।কিন্তু তিনি স্বীকার করেছেন যে, বর্তমান পরিস্থিতিতে অনিচ্ছা সত্ত্বেও সরকারের কাজে হস্তক্ষেপ করতে আরএসএস ‘‘বাধ্য’’ হচ্ছে। তিনি বলেছেন, ‘অতীতের সাথে পার্থক্য এই যে তখন আমাদের স্বয়ংসেবকরা ক্ষমতাসীন ছিল না। রাজনীতিতে স্বয়ংসেবকরা যা করেন তার জন্য আমাদের দায়ী করা হয়... অবশ্যই আমাদের এক্ষেত্রে দায়বদ্ধতা আছে, কেননা শেষ পর্যন্ত সংঘেই স্বয়ংসেবকরা প্রশিক্ষিত হয়। তাই আমরা এ কথা চিন্তা করতে বাধ্য হচ্ছি যে, আমাদের সম্পর্ক কী হবে এবং কী ধরনের কাজ আমরা ধৈর্য সহকারে করব।’ এটাই ‘পার্থক্য’ যে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী একজন প্রাক্তন আরএসএস প্রচারক। কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভার আনুমানিক ৭১ শতাংশ সদস্য আরএসএস-এর সাথে যুক্ত। যে রাজ্যগুলিতে বিজেপি সরকার চালাচ্ছে সেই সমস্ত রাজ্যের মন্ত্রীসভার সদস্যদের একইরকমভাবে আরএসএস’র সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে। আরএসএস ঘোষণা করেছে যে, সরকারে যে স্বয়ংসেবকরা রয়েছে তাদের কাজের উপর নজরদারি আছে। না হলে কিছু দায়বদ্ধতা রয়েছে বলতে কি আর বোঝানো যেতে পারে?

তিনি আরও বলেছেন, ‘‘কেবলমাত্র রাজনৈতিক ঘটনাবলি এখানে বিবেচ্য। যদি জনগণ কিছু প্রত্যাশা করে, যদি তাদের কোনো সমস্যা আমাদের জানানো হয় তাহলে আমরা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নজরে আনতে পারি যদি তারা স্বয়ংসেবক হয়... এই সমস্ত কাজ আমরা করে থাকি।’’

কথাগুলি লক্ষ করা দরকার যেমন, ‘এই সমস্ত আমরা করে থাকি’, ‘আমাদের কিছু দায়বদ্ধতা আছে’ অর্থাৎ মন্ত্রীসভার দুই-তৃতীয়াংশের অধিক ব্যক্তি যারা সংঘে প্রশিক্ষিত তাদের উপর নজরদারি, ‘সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নজরে আনা’ অর্থাৎ স্বয়ংসেবক মন্ত্রীদের কাছে আরএসএস’র সুপারিশ। এই সমস্ত শব্দবন্ধ আরএসএস’র সংবিধান বহির্ভূত কর্তৃত্বকে প্রমাণ করে।

বিজেপি পরিচালিত সরকারগুলির উপর আরএসএস’র কর্তৃত্ব কখনই গোপন ছিল না- এখন আরএসএস প্রধান নিজে এই কথা বলছেন। আরএসএস-এর এই সংবিধান বহির্ভূত ক্ষমতা এবং বিভেদকামী মতাদর্শের একটি দিক হলো নীতিগত কোনো পরিবর্তন না ঘটিয়ে জনমানসে সে সম্পর্কিত ধারণার পরিবর্তন ঘটানো। ভাগবতের কথায়, ‘‘ আমরা গণমাধ্যমের সাথে যোগাযোগ বাড়িয়েছি, সংগঠনের বিস্তার ঘটাতে বেশ কিছু কর্মসূচি নিয়েছি, এখন এগুলিকে আরও প্রসারিত করতে হবে... ভবিষ্যতে কাঙ্ক্ষিত ফল পাওয়া নিশ্চিত করতে আমাদের সঠিক সময়ে সঠিক পন্থা অবলম্বন করতে হবে।’’ আমরা অপেক্ষা করছি যে, আগামীদিনে আরএসএস-কে গৌরবান্বিত করার মতো কাহিনি শুনতে পাব যা এদের ঘৃণায় ভরা অতীতকে মুছে দিতে চাইবে।

সমলিঙ্গের সম্পর্ক ও মহিলাদের বিষয়ে

কেউ কেউ ‘‘এলজিবিটি ও তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ’’দের সম্পর্কে আরএসএস’র মনোভাবের আপাত পরিবর্তনকে স্বাগত জানিয়েছেন। ভাগবত বলেছেন, ‘‘এগুলি নতুন বিষয় নয়, এগুলি আগে থেকেই ছিল। এইসব মানুষদেরও বাঁচার অধিকার আছে।’’ এই বক্তব্যের মধ্যে এক প্রকার অনুগ্রহের সুরকে যদি উপেক্ষা করাও হয় তবুও ভাগবতের পরবর্তী বক্তব্যে ঘৃণার মনোভাব প্রকট। তিনি বলেছেন, ‘‘যেহেতু আমি পশু চিকিৎসক আমি জানি যে, এমন বৈশিষ্ট্য পশুদের মধ্যেও থাকে। এটি জীবনধারণের একটি জৈবিক পদ্ধতি...একে এভাবে দেখার কথাই আমরা বলছি কেননা অন্যভাবে এই বিষয়টি সমাধান করা যাবে না।’’ অর্থাৎ যৌনতার ক্ষেত্রে পছন্দের বিষয়টি কেবলমাত্র জৈবিক বিষয় হয়ে গেল এবং পশুদের সাথে অপমানজনক তুলনা করা হলো। ভাগবতের এই মনোভাব সুপ্রিম কোর্টের ঐতিহাসিক রায়ের সম্পূর্ণ বিপরীত, যেখানে বলা হয়েছে যে, ‘‘দেশের সংবিধান অনুযায়ী যৌনতার ক্ষেত্রে পছন্দের অধিকার একটি মৌলিক অধিকার।’’

মৌলিক অধিকারের উপর ভিত্তি করে তৈরি গণতান্ত্রিক কাঠামোকে অস্বীকার করার এই মনোভাব ভাগবতের মহিলাদের সম্পর্কিত মন্তব্যেও প্রতিফলিত হয়েছে। আরএসএস মহিলাদের পরিবারের অঙ্গ হিসেবে দেখতে চায়। মোহন ভাগবত বলেছেন, ‘‘নারী মুক্তি এবং নারীদের ক্ষমতায়ন ইত্যাদি বিষয়গুলো অনেকদিন ধরেই উত্থাপিত হচ্ছে... কিন্তু পাশ্চাত্যের মহিলারাও নারী-পুরুষের পারস্পরিক নির্ভরশীলতা ও পারিবারিক জীবনের প্রয়োজনীয়তারদিকে মনোনিবেশ করেছে।’’ আরএসএস মনে করে যে, নারীরা স্বাধীন মনোভাবাপন্ন হলে, সমানাধিকার ভোগ করলে এবং তাঁদের ক্ষমতায়ন ঘটলে পরিবারের সাথে সংঘাত অবশ্যম্ভাবী। কেননা এরা মনুবাদী দৃষ্টিভঙ্গির অনুসারী হওয়ায় মনে করে যে, পরিবারে তাদের ওপর হিংসার ঘটনা ঘটলেও মহিলাদের ‘মানিয়ে নেওয়া’ উচিত। আরএসএস’র মহিলা শাখা রাষ্ট্রীয় সেবিকা সমিতি এই ভাবধারা প্রচার করছে। কিন্তু আরএসএস প্রধান নিজেই এই পরিকল্পনার ব্যর্থতা স্বীকার করেছেন যে, ‘‘এখনও সমিতি সেই শক্তি অর্জন করেনি।’’ যে কথাটা তিনি নতুন বলেছেন সেটি এই যে, শাখা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা মহিলার সংখ্যা বাড়ছে, তাই মহিলাদের আর সমিতিতে না পাঠিয়ে কীভাবে আরও সরাসরি যুক্ত করা যায় তা আরএসএস-কে ভাবতে হবে। প্রজ্ঞা ঠাকুরের মতো হিন্দুত্ব ব্রিগেডের মহিলা সদস্যদের যে চরম প্ররোচনামূলক ও ঘৃণা সৃষ্টিকারী ভাষণ শোনা গেছে তা আরএসএস’র কাছে মডেল হিসেবে মহিলাদের সরাসরি যুক্ত করতে উৎসাহ জোগাচ্ছে। পণপ্রথার জন্য বধূহত্যা, শিশুদের ধর্ষণ সহ নারীদের ওপর ক্রমবর্ধমান নির্যাতনের বিষয়ে আরএসএস প্রধান নীরব। মহিলাদের অধিকার অর্জনের জন্য নয়, আরএসএস’র মহিলা ক্যাডারদের দিয়ে ঘৃণার মতাদর্শ আরও বেশি সরাসরি প্রচার করার জন্য মহিলাদের সরাসরি আরএসএস-এ যুক্ত করতে তারা উৎসাহী।

যারা আমাদের দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রধানতম মূল্যবোধ অর্থাৎ ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও ন্যায়ের আদর্শে ভারতকে গড়ে তোলায় বিশ্বাস করেন তাঁদের সকলের কাছেই আরএসএস প্রধানের এই সাক্ষাৎকার একটি সাবধানবাণী। পুঁজিবাদের বিধ্বংসী রূপ ভারতের সংবিধানের অনেক প্রতিশ্রুতিকে বাস্তবায়িত হতে দেয়নি এবং তারই ফলে চরম প্রতিক্রিয়ার শক্তি এ দেশে জেগে উঠেছে। এই সাক্ষাৎকারে এটা স্পষ্ট হয়েছে যে, এই সমস্ত শক্তি এখন মোদি সরকারের সুবাদে রাষ্ট্রক্ষমতায় প্রবেশাধিকার পেয়েছে এবং কিছু ক্ষেত্রে রাষ্ট্রক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করছে। এর প্রতিকার করতে হলে পুঁজিবাদী লুঠের বিরুদ্ধে জনগণের অধিকার রক্ষা ও হিন্দুত্বের সাম্প্রতিকতম কর্মসূচিকে প্রতিহত ও পরাস্ত করতে বিকল্প নীতির ভিত্তিতে গণ সমাবেশের মধ্য দিয়ে কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে।


ভাষান্তরঃ অর্ণব ভট্টাচার্য