৬০ বর্ষ ২৫ সংখ্যা / ৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ / ১৯ মাঘ, ১৪২৯
মহিলা কুস্তিগীরকে যৌন হয়রানিতে অভিযুক্ত হরিয়ানার ক্রীড়ামন্ত্রী
সুমিত গঙ্গোপাধ্যায়
একদিকে যখন ভারতীয় মহিলা ক্রীড়াবিদদের সাফল্যে ভারতীয় ক্রীড়ামহল ও ক্রীড়াপ্রেমীগণ উদ্বেলিত তখনই মহিলা কুস্তিগীররা একজন মন্ত্রীর প্রতি যৌন হয়রানির অভিযোগ আনছেন। আক্ষরিক অর্থেই এর থেকে বিব্রত ও অভূতপর্ব ঘটনার সম্মুখীন কোনদিন ভারতের ক্রীড়াজগৎ হয়েছে কীনা সন্দেহ। এদিকে কেন্দ্রীয় সরকারের ‘বেটি বাঁচাও বেটি পড়াও’ নামক গালভরা স্লোগানের বিরাম নেই।
বর্তমান ভারতে যে অতি দক্ষিণপন্থার যুগ চলছে, সেখানে মহিলাদের ওপর অত্যাচার অস্বাভাবিক পরিমাণে শুধু বেড়েই যায়নি, বরং মারাত্মকভাবে সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন মহিলারা বিভিন্ন ক্ষেত্রে। সর্বাধিক জনপ্রিয় খেলা ক্রিকেটে এমনও কর্মকর্তাদের দেখা গেছে, যাঁরা মোটেই মহিলাদের ক্রিকেট খেলা পছন্দ করতেন না। আবার মহিলাদের আইপিএল’র ঘোষণা এই সময়েই হয়েছে। মাত্র কয়েক বছর আগেই টেনিস তারকা সানিয়া মির্জাকে নিয়ে সমস্যা হয়েছিল, সম্প্রতি তিনি অবসর নেওয়ায় কুম্ভিরাশ্রু দেখানোর লোকের কিছু বৃদ্ধিই ঘটেছে বলা যায়।
কিন্তু মহিলা কুস্তিগীরদের নিয়ে যা ঘটেছে তা সবকিছুকে ছাপিয়ে গেছে। হরিয়ানার একটি সাম্প্রতিক ঘটনায় দেখা গেছে, একজন সুপরিচিত আন্তর্জাতিক ক্রীড়াবিদ যিনি একটি বিশেষ প্রকল্পের অধীনে রাজ্য ক্রীড়া বিভাগে জুনিয়র কোচ হিসাবেও কাজ করছেন, তিনি হরিয়ানার ক্রীড়া মন্ত্রীর বিরুদ্ধে অত্যন্ত গুরুতর অভিযোগ তুলেছেন।
তাঁর অভিযোগে মহিলা কোচ জানিয়েছেন যে, মন্ত্রী তাঁর সঙ্গে যৌন হয়রানি করেন এবং তাঁর শ্লীলতাহানি করার চেষ্টা করেন এবং এমনকী তাঁর সরকারি বাসভবনে তাঁকে ধর্ষণের চেষ্টা করেন। এসব অভিযোগের গুরুত্ব বিবেচনা করে যেখানে রাজ্য সরকারের উচিত ছিল অবিলম্বে অভিযুক্ত মন্ত্রীকে বরখাস্ত করে তাঁর বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া, তার পরিবর্তে, কেবল মন্ত্রীর হাত থেকে ক্রীড়াদপ্তর কেড়ে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু এখনও মন্ত্রীপরিষদ মন্ত্রী হিসাবে তাঁকে বাদ দেয়নি। “ক্ষমতার প্রভাবে” অভিযুক্ত মন্ত্রী নির্লজ্জভাবে বিচার প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করছেন। ফলে মন্ত্রী রাজ্যের ডিজিপি-কে অভিযোগকারীর “চরিত্র” তদন্ত করে দেখতে একটি এসআইটি গঠন করতে বলেছেন, যা আদালতেরও অভিযোগের তদন্তকে বাধা দেওয়ার প্রচেষ্টা ছাড়া অন্য কিছুই নয়। মন্ত্রী সরকারি সুবিধার ব্যবহার করে অভিযোগকারীকে হয়রানি করছেন। সাদা পোশাকের পুলিশ কর্মকর্তাদের অভিযোগকারীর গতিবিধি অনুসরণ করতে বলা হয়েছে। এমনকী রাজ্য মহিলা কমিশন অভিযোগকারীর অভিযোগগুলিকে কেবলমাত্র অভিযুক্ত মন্ত্রীর সাথে যোগাযোগের ভিত্তিতে এবং অভিযোগকারিনীর সঙ্গে কোনো কথা না বলেই “বিশ্বাসযোগ্য নয়” হিসাবে চিহ্নিত করেছে।
বেশ কয়েকটি মহিলা ও সামাজিক সংগঠন এবং একটি “খাপ পঞ্চায়েত” বেশ কিছু দিন ধরে মন্ত্রীর পদত্যাগ চেয়ে রাজ্যের বিভিন্ন অংশে বিক্ষোভ করেছে। কংগ্রেস এবং ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল লোকদলও মন্ত্রীকে অবিলম্বে বরখাস্ত করার দাবি জানিয়েছে।
অভিযুক্ত মন্ত্রী হরিয়ানার সন্দীপ সিংয়ের পদত্যাগের জন্য ক্রমবর্ধমান কোলাহলের মধ্যে, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মনোহর লাল সম্প্রতি বলেছেন যে, মহিলা ক্রীড়াবিদ “অযৌক্তিক” অভিযোগ করেছেন। তিনি আরও বলেন, নিছক অভিযোগ কাউকে দোষী করে না।
রাজস্থানের শিরোহি এলাকায় এক অনুষ্ঠানে তিনি জানান যে, অভিযুক্ত মন্ত্রী একসময় ভারতের হকি অধিনায়ক ছিলেন। মুখ্যমন্ত্রী জানান যে, হরিয়ানা ও চণ্ডীগড় পুলিশ তদন্ত করছে। তিনি আশাবাদী।
আসুন একবার দেখি এই সন্দীপ সিং-কে। বর্তমানে এঁর বয়স ৩৬। ইনি ২০১৬ অবধি হকি খেলেছেন। ফুল ব্যাক ও পেনাল্টি কর্নার বিশেষজ্ঞ হিসেবে খেলতেন। ১৮৬টি আন্তর্জাতিক খেলায় ১৩৮টি গোল করেন। ফ্লিকার সিং নামে খ্যাত এই হকি খেলোয়াড় ২০০৯-এ আজলান শাহ জয়ী দলের সদস্য, এশিয়ান গেমসে ব্রোঞ্জ ও কমনওয়েলথে রূপো পেয়েছেন তিনি। তাঁকে নিয়ে ২০১৮ সালে বায়োপিক হয়েছে। ২০১৯-এ বিধানসভা নির্বাচনে অতি দক্ষিণপন্থী ভারতীয় জনতা পার্টির হয়ে ভোটে দাঁড়ান, জয়ী হন, ক্রীড়া ও যুব কল্যাণ দপ্তর মন্ত্রী হিসেবে পান। তিনি কিন্তু অভিযোগ অস্বীকার করেছেন, আবার দাবি করেছেন, অভিযোগ যিনি করছেন তিনি ব্যক্তিগত আক্রোশ মেটাচ্ছেন। অভিযোগকারীর কাছে এও জানতে চাওয়া হয়েছে যে, তিনি ভবিষ্যতে নির্বাচনে দাঁড়াতে চান কী না!
বাস্তবিক এত বড়ো খেলোয়াড়ের বিরুদ্ধে লড়াই খুব সাধারণ বিষয় নয়। তবে লড়াই চলছে।
ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী)-র প্রাক্তন কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও বর্তমান রোহতাক জেলা সম্পাদক জগমতী সাঙ্গওয়ান এই ব্যাপারে খোলা চিঠি লিখেছেন ইন্ডিয়ান অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি পি টি উষাকে। তিনি সেই চিঠিতে সমস্ত ক্রীড়াসংস্থায় যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া ও অভিযোগ জানানোর উদ্যোগ আরও মসৃণ হওয়ার দাবি তুলেছেন। একটি অন্য লেখায় তিনি পুরুষতন্ত্রের হাতে কার্যত ক্রীড়াক্ষেত্রে নিয়মিত সমস্যায় পড়া মহিলাদের অবস্থার পুঙ্খানপুঙ্খভাবে বর্ণনা ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে ক্রীড়া জগতে মহিলাদের অসহায় অবস্থা তুলে ধরে যে বাস্তব চিত্র দেখিয়েছেন, তাতে স্পষ্টতই প্রতীয়মান যে, বহু পরিশ্রমে নিজের কেরিয়ার গড়ে তোলা মহিলাদের এই রকম সমস্যায় পড়ে চুপ করে থাকতে হয়, নচেৎ কেরিয়ার হয়ে যায় সংক্ষিপ্ত, দীর্ঘ দিনের শ্রম জলে যায়। উদাহরণ হিসেবে তিনি ভিনেশ ফোগোটের কথা এবং ১৯৯০ সালের টেনিস খেলোয়াড় রুচিকা গিরহোত্রার কথা বলেছেন। ১৯৯০ সালের ঘটনাটিতে অভিযুক্ত পুলিশে পদোন্নতি পায়, বহু লড়েও তাঁর মাত্র ছয় মাসের জেল ও ১০০০ টাকা জরিমানা হয়।
এখানে উল্লেখ না করে পারছি না, জগমতী সাঙ্গওয়ান হরিয়ানার ক্রীড়া জগতের বিষয়ে গবেষণা করে ডক্টরেট পান, মহর্ষি দয়ানন্দ বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন স্টাডিজের প্রাক্তন ডিরেক্টর ও বর্তমানে সর্বভারতীয় গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতির জাতীয় সহ সভাপতি। একসময় নবম এশিয়ান গেমসে পিটি উষার মতোই ভারতীয় পতাকার নিচে হেঁটেছিলেন, তবে ভলিবল দলের হয়ে।
অতি দক্ষিণপন্থী, হিন্দুত্ববাদী, ফ্যাসিস্টিক ধাঁচের বর্তমান সরকারের ছত্রছায়ায় প্রতিপালিত পুরুষতান্ত্রিক ক্রীড়াক্ষেত্র বর্তমানে অতীব সংকটের মুখে। অধিকাংশ খেলা আর্থিক নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে ব্যর্থ, তেমনই অতি জাতীয়তাবাদী মানসিকতা খেলোয়াড়দের ওপর অস্বাভাবিক চাপ এনে দিচ্ছে। এর ওপর পরিকল্পনাহীন উন্নয়ন ও উন্নয়নের নামে লোক দেখানো আতিশয্য ক্রমাগত সমস্যায় ফেলছে। করপোরেট তোষণের কারণে মূল থেকে উপড়ে ফেলা হচ্ছে খেলা গুলোকে। তার ওপর মহিলাদের ওপর ক্রমবর্ধমান অত্যাচার বিষয়টিকে আর সাধারণ রাখছে না। এর বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে গর্জে ওঠা ও সর্বাত্মক প্রতিরোধ ও প্রতিবাদ ছাড়া গতি নেই।