৬০ বর্ষ ২৫ সংখ্যা / ৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ / ১৯ মাঘ, ১৪২৯
ভারতের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে একটি সংক্ষিপ্ত রাজনৈতিক বিশ্লেষণ
(শেষাংশ)
জ্যোতির্ভূষণ দত্ত
এই আরএসএস-ই এখন রাষ্ট্রায়ত্ত মালিকানার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে সরাসরি আসরে নেমেছে। তাই সব রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা বেসরকারি হাতে তুলে দেবার সুপারিশ করা হচ্ছে এবং বিজেপি সরকার রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলি নামমাত্র মূল্যে করপোরেটদের হাতে তুলে দিচ্ছে। করোনা অতিমারীর পরিস্থিতি এ ব্যাপারে তাদের সহায়কের ভূমিকা পালন করেছে। কল্যাণকামী রাষ্ট্রের ধারণায় রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার বিকাশ ঘটে, সেটা একচেটিয়া বৃহৎ পুঁজির লাগামছাড়া মুনাফা ও সম্পদ বৃদ্ধির প্রতিবন্ধক। তাই পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থা রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প ও বাণিজ্যের বিরুদ্ধে। আরএসএস-এর অর্থনৈতিক অবস্থান এই জায়গায়। তারা বৃহৎ পুঁজি তথা একচেটিয়া কারবারের সমর্থক। অর্থনীতির প্রতিটি ক্ষেত্রে তারা সরকারের কর্তৃত্ব বিনষ্ট করে বেসরকারি সংস্থাগুলিকে নিয়ন্ত্রণহীন মুনাফা অর্জনের সুযোগ করে দিতে চায়। এক্ষেত্রে সরকার এখন তাদের এজেন্টের ভূমিকা পালন করতে সচেষ্ট। সেই সঙ্গে বৃহৎ পুঁজি ও করপোরেটদের অর্থে উপছে পড়ছে বিজেপি’র দলীয় তহবিল। এই প্রক্রিয়ায় বিজেপি এবং আরএসএস এখন হিন্দু রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার আড়ালে প্রকৃতপক্ষে করপোরেট রাষ্ট্র গড়ার দিকেই দ্রুত অগ্রসর হচ্ছে। রাজ্যও প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এই লক্ষ্যেরই পৃষ্ঠপোষকতা করতে তৎপর। তাই মুখ্যমন্ত্রীর মুখে বারংবার শোনা যাচ্ছে আরএসএস-এর প্রশস্তি। সাম্প্রতিককালে তাঁর মুখে শোনা যাচ্ছে মোদি-স্তুতিও। এছাড়া তাঁরই মদতে দুর্নীতি ও কেলেঙ্কারিতে প্রতিদিনই নিজের রেকর্ড ভাঙছে তৃণমূল।
বর্তমানে কী আমাদের রাজ্য অথবা দেশ, সবক্ষেত্রের ঘটনাবলির একটি বিশ্ব প্রেক্ষিত আছে। কারণ নয়া বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ায় সমস্ত বিশ্বকে global village-এ রূপান্তরিত করার প্রচেষ্টা চলছে। এই বিষয়টিকে বাদ দিয়ে রাজ্য ও দেশের পরিস্থিতির সঠিক কার্যকারণ ব্যাখ্যা করা আজ অসম্ভব। প্রসঙ্গত, বর্তমানে নয়া উদারবাদী বিশ্বায়ন তার অন্তিম পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। দুটি কারণে সেটা ঘটেছে। প্রথমত, বিশ্বায়নের বর্তমান অবস্থায় বিশ্বজুড়ে অতি উৎপাদনের অভূতপূর্ব প্রবণতা ও পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে। অন্যদিকে বর্তমানে ধনতন্ত্রের এবং সাম্রাজ্যবাদের ধরার মতো বাজার নেই বললেই চলে, যেমনটা সম্ভব ছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে উপনিবেশবাদ তৈরি করার মাধ্যমে এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ ও রাষ্ট্রীয় ব্যয় বৃদ্ধির ব্যাপক প্রয়োগের দ্বারা। অর্থনৈতিক দিক থেকে উন্নত দেশগুলির ব্যাপকভাবে Sub-prime Security-এর বিনিময়ে অথবা Derivative Security প্রথার মাধ্যমে ব্যাঙ্কের ঋণ প্রদান করে লগ্নি বৃদ্ধির চেষ্টা করেছিল। কিন্তু ২০০৮ সালে উন্নত সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির বিধ্বস্ত অর্থনীতি দেখিয়েছে যে, এর দ্বারা পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের সংকট দূর করা সম্ভব নয়।
সমসাময়িক বিশ্বায়নের প্রবণতাই হলো অতি উৎপাদন। বর্তমান সময়ে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অভূতপূর্ব উন্নতি এই প্রবণতার অভাবনীয় বৃদ্ধি ঘটিয়েছে। রাষ্ট্রীয় ব্যয় বৃদ্ধির দ্বারা এর মোকাবিলা করা হয়তো যেত। কিন্তু বর্তমানকালে করপোরেট নিয়ন্ত্রিত শাসন ব্যবস্থায় সেটা সম্ভব নয়। কর্মসংস্থান বৃদ্ধি এবং সামগ্রিক চাহিদা বৃদ্ধির জন্য রাষ্ট্রের বর্ধিত ব্যয় সম্পর্কে পুঁজি সাধারণভাবে বিরোধী। পুঁজির মালিকদের ওপর বর্ধিত করের শুধু তারা বিরোধী নয়, সরকারের কোষাগারীয় ঘাটতি বৃদ্ধিরও তারা বিরোধী। সরকার বর্ধিত ব্যয়ে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি করতে পারে, হয় তা কোষাগারীয় ঘাটতির মাধ্যমে অথবা পুঁজিপতিদের ওপর কর বৃদ্ধি করে। কিন্তু এই দুই পদ্ধতিরই লগ্নি পুঁজি তীব্র বিরোধী।
পুঁজিপতিদের ওপর বর্ধিত করের বিরোধিতা না হয় বোঝা গেল, কিন্তু তারা কোষাগারীয় ঘাটতির বিরোধিতা কেন করে? এই বিরোধিতার কারণ নিহিত আছে গভীরতর সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যেঃ যদি পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা সরাসরি কর্মসংস্থানের জন্য সামগ্রিক চাহিদা বৃদ্ধির ওপর নির্ভরশীল হয়ে যায় এবং সফল হয়, তাহলে পুঁজিবাদের সামাজিক বৈধতা খর্ব হয় এবং তার অর্থনৈতিক মান্যতা বিনষ্ট হয়। এই সম্ভাব্য বিপদ সম্পর্কে পুঁজির সহজাত আশঙ্কা। তাই রাষ্ট্রের মাধ্যমে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি করার প্রচেষ্টার বিরোধিতা করে লগ্নিপুঁজি।
এই বিরোধিতা বরাবরই ছিল। কিন্তু নয়া বিশ্বায়নের সময়কালে এই বিরোধিতা রাষ্ট্রের কর্মপদ্ধতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে প্রধান নির্ণায়কের ভূমিকা পালন করছে। যতক্ষণ পর্যন্ত লগ্নি পুঁজি জাতীয় থাকে এবং রাষ্ট্র জাতিরাষ্ট্র থাকে ততক্ষণ রাষ্ট্র কোনো কোনো পরিস্থিতিতে এই বিরোধিতা অতিক্রম করতে পারে এবং করে থাকে, যেমন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে যখন ধনতন্ত্রের অস্তিত্বের সংকট দেখা দিয়েছিল। কিন্তু বর্তমানকালে যখন লগ্নিপুঁজি বিশ্বায়িত, দেশের সীমান্ত পেরিয়ে যে কোনো সময়ে অতিদ্রুত চলাচল করতে পারছে, যদিও দৃশ্যত রাষ্ট্র জাতিরাষ্ট্রই থাকছে, তখন কোষাগারীয় ঘাটতির বিরুদ্ধে পুঁজির বিরোধিতা প্রধান নির্ণায়ক হয়ে ওঠে। রাষ্ট্র যদি তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে যায় তাহলে লগ্নি পুঁজি সদলবলে সংশ্লিষ্ট দেশ ছেড়ে চলে যাবে, দেশে ঘোরতর অর্থনৈতিক সংকট তৈরি হবে। সুতরাং, বিশ্বায়িত লগ্নিপুঁজির দাবির কাছে রাষ্ট্র আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ সর্বত্র কর্মহীনতায় আক্রান্ত হচ্ছে বিশ্ব অর্থনীতি এবং তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির জাতীয় সম্পদ ও সম্পত্তি বেশি বেশি করে আন্তর্জাতিক পুঁজির হাতে হস্তান্তরিত হয়ে যাচ্ছে। অন্যভাবে বলা যায় যে, তৃতীয় বিশ্বের অর্থনীতির ওপরে সাম্রাজ্যবাদী ফাঁস আরও তীব্র হচ্ছে। সাম্রাজ্যবাদ এক ধরনের ছদ্মবেশী নয়া ঔপনিবেশিকতাবাদের প্রচলন শুরু করেছে। এখানে সাম্রাজ্যবাদ বলতে একটি বা দুটি প্রধান শক্তির কথা বলা হচ্ছে না, আন্তর্জাতিক লগ্নি পুঁজির সাম্রাজ্যবাদের কথা বলা হচ্ছে। যার সঙ্গে বিভিন্ন দেশের শ্রমজীবী মানুষের বিরুদ্ধে অভ্যন্তরীণ বৃহৎ বুর্জোয়াও যুক্ত হয়ে থাকছে। উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, বর্তমান সময়ে সাম্রাজ্যবাদীদের মধ্যে পারস্পরিক দ্বন্দ্ব অনেকটাই প্রশমিত। তারা প্রকৃতপক্ষে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে এবং আইএমএফ, বিশ্বব্যাঙ্ক ও বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতায় তৃতীয় বিশ্বে খবরদারি করার ক্ষেত্রে এবং অর্থনীতি ও রাজনীতির ওপর আধিপত্য বিস্তার করতে অত্যন্ত সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে। ওইসব দেশের সংবাদমাধ্যমসহ সংস্কৃতি, শিক্ষাব্যবস্থা ও স্বাস্থ্য পরিষেবার ওপর তাদের প্রভাব বিস্তার করতেও ভীষণভাবে তৎপর হয়ে উঠেছে। এক্ষেত্রে অধিকাংশ সময় ভারত সহ তৃতীয় বিশ্বের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অধিকারীরা আমেরিকা এবং বৃহৎ পুঁজির সাম্রাজ্যবাদী সংস্থাসমূহের অনুগত এজেন্টের ভূমিকা পালন করে থাকে।
বর্তমান এই পরিস্থিতির প্রধান লক্ষণ হলো বিশ্বব্যাপী ফ্যাসিবাদের উত্থান, ব্যাপক দুর্নীতি এবং দুর্নীতি ও ভ্রষ্টাচারের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের ক্ষেত্রে সরকারি সংস্থাগুলির বেপরোয়া পৃষ্ঠপোষকতা, সাম্প্রদায়িকতার শক্তি বৃদ্ধি এবং দক্ষিণপন্থী স্বৈরাচারের উত্থান এবং ক্রোনি ক্যাপিটালিজম বা ধান্দার পুঁজিবাদের নীতি-নৈতিকতাহীন কর্ম তৎপরতা।
অন্তিম দশায় পৌঁছানোর আগেই নয়া উদারবাদী ধনতন্ত্র বিশ্বে ব্যাপকভাবে ক্ষুধা ও দারিদ্র্য বাড়িয়েছে এবং তীব্রভাবে অর্থনৈতিক বৈষম্যের বৃদ্ধি ঘটিয়েছে। কিন্তু ক্ষুধা, বেকার সমস্যা প্রভৃতি প্রতিহত করার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য প্রতিরোধ-আন্দোলন কিন্তু সংগঠিত করা সম্ভব হয়নি। নয়া উদারবাদে এই ধরনের আন্দোলন করা অনেক কঠিন হয়েছে। এই অবস্থায় একদিকে থাকে রাষ্ট্রীয় ও পুঁজিবাদী সন্ত্রাস এবং অন্যদিকে থাকে প্রলোভনের চক্রান্ত। যখন বামপন্থীরা ‘গুরুতর বিপদ’ হিসেবে দেখা দেয়, বৃহৎ বুর্জোয়ারা চেষ্টা করে বিভিন্ন সুবিধা ও প্রলোভন প্রদানের মাধ্যমে তাকে বিভাজন করার। বামপন্থীরা দুর্বল হলে তাদের ধ্বংস করতে বিভিন্ন ধরনের মুখোশের আড়ালে ফ্যাসিবাদ বা সাম্প্রদায়িকতাকে ব্যবহার করা হয়।
উদারবাদী ধনতন্ত্রের মতাদর্শ ছিল উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি। নয়া উদারবাদী ধনতন্ত্র অন্তিম দশায় পৌঁছানোয় এই ধরনের প্রতিশ্রুতির ওপর সাধারণ মানুষের আস্থা ভীষণভাবে কমেছে। মতাদর্শগত অবস্থানের গ্রহণযোগ্যতাও বিনষ্ট হয়েছে। এই অবস্থায় নয়া উদারবাদী ধনতন্ত্র অন্য কোনো ‘মতাদর্শ’-কে আশ্রয় করে টিকে থাকার প্রচেষ্টায় নেমেছে। ফ্যাসিবাদ, শ্রেষ্ঠত্ববাদ, অতীত ঐতিহ্যের কাল্পনিক গরিমা অথবা দক্ষিণপন্থী ‘জাতীয়তাবাদ’ এই ধরনের ‘মতাদর্শ’। এগুলি জীবন-জীবিকার বস্তুগত পরিস্থিতি থেকে সাধারণ মানুষের দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে যায় ‘জাতি’, ‘ধর্ম’ অথবা অন্য কোনো সংকীর্ণ আনুগত্যের দিকে। অন্যদিকে অযৌক্তিকভাবে তুলে ধরা হয় কোনো মানুষের ‘ইমেজ’কে যার পৌরুষ, প্রচার করা হয় সমস্ত সমস্যার সমাধান করে দেবে। অবৈজ্ঞানিক ও অযুক্তির সংস্কৃতি তৈরি করা হয়। সেই সঙ্গে বৃহৎ পুঁজির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলে বৃহৎ বাণিজ্য এবং উদীয়মান ফ্যাসিস্তদের মধ্যে অংশীদারিত্বের সম্পর্ক গড়ে তোলে।
বর্তমানের এই পরিস্থিতিতে পৃথিবীর প্রধান শক্তিসমূহের মধ্যে বিশ্বযুদ্ধের মতো বড়ো কোনো যুদ্ধ হয়তো আর দেখা যাবে না। ভয়ংকর কোনো যুদ্ধে ফ্যাসিবাদী উত্থানকে ধ্বংস হতেও দেখবো না। সম্ভবত আমরা দেখব, কোনো সাম্রাজ্যবাদী সংস্থার, যেমন ন্যাটোর চক্রান্তে সংগঠিত রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধের মতো কোনো আঞ্চলিক যুদ্ধ। অথবা তুলনামূলকভাবে কম শক্তিশালী দীর্ঘায়িত ফ্যাসিবাদ; রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকুক বা না থাকুক এই ধরনের শক্তি সমাজ ও রাজনীতিতে সন্ত্রাসমূলক কাজ চালিয়ে যাবার মতো বলবান থাকবে। এই কারণেই নয়া উদারনীতির অন্তিম দশায় বর্তমান পর্বে আমাদের মতো দেশে শক্তিশালী চালিকাশক্তি হিসাবে সক্রিয় থাকছে - একটি ধর্মীয় মৌলবাদ এবং অন্যটি বাজার অর্থনীতির মৌলবাদ। দুটোরই ব্যাপক শক্তি বৃদ্ধি ঘটেছে বিশ শতকের নয়ের দশক থেকে। ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর থেকে ভারতে ধর্মীয় মৌলবাদ ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং ১৯৯০ সালে সোভিয়েত রাশিয়ার অবলুপ্তির পর থেকে ভারত সহ পৃথিবীর সর্বত্র বাজার-মৌলবাদের তাণ্ডব অভূতপূর্ব ব্যাপকতায় প্রসারিত হচ্ছে।
এই অবস্থাতেও সঠিক এবং ঐক্যবদ্ধ গণআন্দোলন যে পুঁজির চক্রান্ত ব্যর্থ করতে পারে তার প্রমাণ মিলেছে ভারতে সাম্প্রতিক কৃষি ও কৃষক বিরোধী নরেন্দ্র মোদির আইনের বিরুদ্ধে গণআন্দোলনের সাফল্য অর্জনের মধ্যে। মোদি সরকারের তৎপরতায় দেশের কৃষি ব্যবস্থাকে করপোরেটদের হাতে তুলে দেবার নীল নকশা আঁকা হয়েছিল। কিন্তু কৃষকরা প্রমাণ করেছে যে, ঐক্যবদ্ধভাবে লড়তে পারলে ৫৬ ইঞ্চি ছাতির তাণ্ডবকেও পরাস্ত করা সম্ভব। ৫০০টির বেশি কৃষক সংগঠন একযোগে লড়াইতে নামে ২০২০ সালের নভেম্বর মাসে। এই আন্দোলনের বিরুদ্ধে কয়েক হাজার মামলা হয়েছে। এই সংগ্রামে ৭১৫-র বেশি কৃষক প্রাণ হারিয়েছেন, তবুও আন্দোলন হয়েছে শান্তিপূর্ণ ও ঐক্যবদ্ধভাবে। এই আন্দোলন সম্পর্কে নোয়াম চমস্কি বলেছেন - দিল্লির বুকে কৃষক আন্দোলন পৃথিবীর গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সামনে একটি আলোকবর্তিকা। ভবিষ্যৎ গণআন্দোলনের সামনে আর একটি উজ্জ্বল পথনির্দেশিকা সাম্প্রতিককালে পশ্চিমবঙ্গের ছাত্র-যুবদের সাহসী কর্মতৎপরতা। গত ২০ সেপ্টেম্বর আনিস হত্যার বিরুদ্ধে বামপন্থী ছাত্র-যুবদের কলকাতায় যে ঐতিহাসিক জমায়েত হয়েছে সেটা সাম্প্রতিককালে নজিরবিহীন এবং প্রমাণ করেছে যে, যুবশক্তি চিরকাল কোনো সন্ত্রাসবাদ ও স্বৈরতন্ত্রের কাছে মাথা নত করে থাকে না।
বর্তমানে এই অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সেই সঙ্গে সাংস্কৃতিক ও আদর্শবাদের যে অবক্ষয় এবং সংকট তার মোকাবিলা করার জন্য সঙ্ঘবদ্ধ গণআন্দোলন যেমন জরুরি, সেই সঙ্গে অপরিহার্য শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন, যার মাধ্যমে গড়ে তুলতে হবে যুক্তিভিত্তিক সচেতনতা, বিজ্ঞানমনস্কতা এবং সুস্থ বহুত্ববাদী সাংস্কৃতিক বাতাবরণ। এখানেই প্রয়োজন হয় গণতান্ত্রিক সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলির কর্মকাণ্ড। শক্তিশালী গণআন্দোলন সংগঠিত করার সাথে সাথে সাংস্কৃতিক ও বিজ্ঞানমনস্ক মানবিক সচেতনতার ব্যাপক প্রসার ঘটাতে পারলে তবেই নয়া উদারবাদী ধনতন্ত্রের বর্তমান পর্বের দুর্নীতি এবং আদর্শহীন ও মানবতা-বিরোধী কর্মকাণ্ড এবং চক্রান্তের সাথে মোকাবিলা করা সম্ভব হবে। এই ঐতিহাসিক দায়িত্বের কথা স্মরণে রেখেই আমাদের আগামীদিনের কর্মসূচি প্রস্তুত করতে হবে।
উল্লেখ্য, ডঃ কস্তুরী রঙ্গনের সহায়তায় ভারত সরকার ২০২০ সালে যে নয়া জাতীয় শিক্ষা নীতি চালু করেছে তার জনকল্যাণবিরোধী অভিমুখের বিরুদ্ধেও সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি ও সচেতনতা সৃষ্টির উদ্যোগকেও আমাদের আগামীদিনের কর্মসূচির অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। ১৯৬৮ সাল থেকে প্রবর্তিত ভারতের জাতীয় শিক্ষা নীতিগুলিতে শিক্ষা সম্পর্কে যেটুকু ইতিবাচক লক্ষ্য ও কর্মসূচি মান্যতা পেয়েছিল, ২০২০ সালে ঘোষিত জাতীয় শিক্ষা নীতিতে সেগুলিকে বর্জন করা হয়েছে। ভারতীয় শিক্ষার গৌরবময় উত্তরাধিকার বিরোধী, সংবিধান বিরোধী, সর্বজনীন শিক্ষার পরিপন্থী, শিক্ষায় স্বাধিকার বিনষ্টকারী, শিক্ষায় ব্যাপক বেসরকারিকরণ, বাণিজ্যিকীকরণ, বৈদেশিকীকরণ এবং সাম্প্রদায়িকীকরণের স্বার্থে প্রস্তুত ২০২০ সালের জাতীয় শিক্ষানীতি সম্পর্কে মানুষজনকে সচেতন করা এবং তার বিরুদ্ধে শিক্ষা আন্দোলন সংগঠিত করাও আমাদের অত্যাবশ্যক দায়িত্ব।
বলাইবাহুল্য যে, বর্তমানের এই সার্বিক অর্থনৈতিক সংকটকালে সবরকম সাংস্কৃতিক কাজকর্মের সুযোগ ভীষণভাবে সংকুচিত হয়েছে। করোনা অতিমারীর সময়কালে এই সুযোগ আরও হ্রাস পেয়েছে।
ভারতের স্বাধীনতার পর ৭৫ বছর অতিক্রান্ত। জমেছে প্রতিশ্রুতির বিশাল পাহাড়। কিন্তু এ বছর ৭৬তম স্বাধীনতা দিবসে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তাঁর বারংবার উচ্চারিত ‘‘সব কা সাথ সব কা বিকাশ’’ এবং ‘‘আত্মনির্ভর ভারত’’ প্রতিশ্রুতির সাথে সাযুজ্য রেখে যে প্রতিশ্রুতির ফোয়ারা ছেড়েছেন সেটা অতীতের সব প্রতিশ্রুতির রেকর্ড অতিক্রম করেছে। তিনি ঘোষণা করেছেন যে, আগামী ২৫ বছরে শততম স্বাধীনতা দিবসে ভারত হবে ‘পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ দেশ’, অবশ্যই হিন্দুরাষ্ট্র গঠনের চরম লক্ষ্যমুখে এগিয়ে গিয়ে। কিন্তু আমরা কি ভুলতে পারি যে, সঙ্ঘ পরিবারের সর্বকালীন অবস্থান সাম্রাজ্যবাদমুখী, ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকেও তারা নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিল। স্বাধীনতার পরে আজও আমেরিকার জুনিয়র পার্টনার হিসাবে তাদের অভিমুখ সাম্রাজ্যবাদের দিকে। তাছাড়া ভারতের আর্থিক সার্বভৌমত্ব বিভিন্নভাবে বিপন্ন হওয়ায় রাষ্ট্রের পরনির্ভরতাও মারাত্মকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ধ্বংসপ্রাপ্ত প্রায় গোটা রাষ্ট্রায়ত্তক্ষেত্র মোদি সরকারের তৎপরতায়, এর নাম স্বনির্ভরতা? আট বছর ধরে মোদি অসংখ্য প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তার হাস্যকর পরিণতি প্রত্যক্ষ করে আর সেগুলি উচ্চারণ করেন না। ব্যর্থতা আড়াল করার প্রয়োজনে নতুন উদ্যমে অতি সক্রিয় হয়েছেন বিজেপি-র অতি প্রিয় কৌশল সাম্প্রদায়িক বিভাজন এবং কোথাও কোথাও সরাসরি ফ্যাসিস্ত পদ্ধতির শাসনের মাধ্যমে।
এই ধরনের অপশাসনের ফলশ্রুতিতে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, রাজনীতির ক্ষমতায়ন, অর্থনৈতিক উন্নতি ইত্যাদি ১৪টি সূচক ধরে বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের সাম্প্রতিক রিপোর্টে দেখা গেছে যে, ১৪৬টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান নিম্নগামী - ২০০৬ সালে ৯৮তম স্থান থেকে ২০২২ সালে ১৩৫তম স্থানে নেমে এসেছে। স্বাস্থ্য পরিষেবা খাতে খরচে ভারতের স্থান ১৯৬টি দেশের মধ্যে ১৮৪তম (বিশ্ব ব্যাঙ্কের হিসাব)। বিশ্ব ব্যাঙ্কের সাম্প্রতিকতম রিপোর্ট অনুসারে ভারতের অতিমারীর এই সময়কালে নতুন করে ৫.৬ কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমেছে। ৪৩ বছরের মধ্যে বর্তমানে ভারতের ভাগ্যে জুটেছে সব থেকে বেশি বেকারত্ব।
অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গেও জালিয়াতি, মিথ্যা প্রতিশ্রুতির ফুলঝুরি, ব্যাপক প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি, কেন্দ্রের ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে গোপনে আত্মসমর্পিত সখ্য এবং প্রকাশ্যে কেন্দ্রবিরোধী অবস্থান নিয়ে তৃণমূল সরকার ব্যাপকভাবে ধ্বংসাত্মক রাজনীতি চালিয়ে যাচ্ছে। এজন্য সরকারের কোনো প্রতিশ্রুতিতেই সাধারণ মানুষ আর ভরসা রাখতে পারছেন না। তারা পার্থ-কেষ্টর সহচর তৃণমূলের কুশীলবদের এবং রথী-মহারথীদের প্রতিও পুরোপুরি আস্থা হারিয়েছে। কিন্তু বিজ্ঞাপনের মিথ্যা ভাষণে রাজ্যের তৃণমূল সরকার এবং কেন্দ্রের বিজেপি সরকার নির্লজ্জভাবে প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হয়েছে।
পরিশেষে উল্লেখ করতে বাধ্য হচ্ছি যে, রিজার্ভ ব্যাঙ্কের কার্যপ্রণালী সম্পর্কে এবং ক্রিপ্টোকারেন্সি সম্পর্কে কেন্দ্রীয় সরকারের যে দৃষ্টিভঙ্গি সেটা ভারতীয় অর্থনীতিতে গভীর সংকট সৃষ্টি করতে পারে। ক্রিপ্টোকারেন্সি বিষয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের সহনশীল দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে সম্প্রতি রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর শক্তিকান্ত দাশও গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করতে বাধ্য হয়েছেন।