E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৬০ বর্ষ ২৫ সংখ্যা / ৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ / ১৯ মাঘ, ১৪২৯

ফিরে দেখাঃ গান্ধী হত্যা

সুপ্রতীপ রায়


আর একটা ৩০ জানুয়ারি আমরা অতিক্রম করলাম। ১৯৪৮ সালের ৩০ জানুয়ারি মহাত্মা গান্ধীকে খুন করা হয়েছিল। গান্ধীজিকে হত্যা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল না। পরিকল্পনামাফিক খুন করা হয়েছিল। খুন করেছিল আরএসএস। ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিকে হুঁশিয়ারি দিয়েছিল এই খুন। বর্তমান সময়ে দেশের রাষ্ট্রক্ষমতাতে আসীন বিজেপি। বিজেপি আরএসএস’র রাজনৈতিক মুখ। বিপদ এখানেই।

মোহনদাস প্রতিদিন বিকালের পর প্রার্থনাসভাতে যেতেন। ৩০ জানুয়ারিও তার ব্যতিক্রম ছিল না। এদিন বিকাল চারটের সময় সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল গান্ধীজির সঙ্গে দেখা করতে আসেন। উভয়ের মধ্যে এক ঘণ্টা আলোচনার পর গান্ধীজি তাঁর ‘কটিদেশ’ থেকে ঘড়ি বার করে বল্লভভাইকে বলেন, এখন তাঁকে উঠতে হবে, কারণ প্রার্থনার সময় হয়েছে। মহাত্মাজি বিকাল ৫.৫ মিনিটে বিড়লা ভবন থেকে প্রার্থনার উদ্দেশ্যে বার হন। তাঁর নাতনি মানু গান্ধী ও নাতবৌ আভা গান্ধীর কাঁধে ভর দিয়ে তিনি প্রার্থনাস্থলে পৌঁছান। অন্যান্য দিনের চেয়ে প্রার্থনা সভায় আসতে পাঁচ মিনিট দেরি হয়। এদিনের প্রার্থনা সভায় পাঁচ শতাধিক মানুষের জমায়েত হয়েছিল।

গান্ধীজি যখন প্রার্থনা মঞ্চে যাওয়ার জন্য সিঁড়ি দিয়ে উঠছিলেন তখন খাঁকি শার্ট ও পায়জামা পরিহিত একজন লোক ভিড় ঠেলে গান্ধীজির দিকে এগিয়ে আসেন। মনে হচ্ছিল লোকটি মহাত্মাজির পদধূলি নিতে আসছেন। মানু গান্ধী লোকটির বাঁ হাত ধরে ফেলেন। যদিও লোকটি মানুকে ঠেলে সরিয়ে দেয় এবং একটি পিস্তল বার করে গুলি ছুঁড়তে আরম্ভ করে। প্রথম গুলিটি গান্ধীজির তলপেট বিদ্ধ করে। তিনি ‘হে রাম’ এই কথা বলে পিছনের দিকে লুটিয়ে পড়েন। গান্ধীজির নাতনি ও নাতবৌ তাঁকে ধরে বসান। চার-পাঁচজন লোকের সাহায্যে অতি দ্রুত মোহনদাসকে বিড়লা ভবনে নিয়ে যাওয়া হয়।

ঘটনাস্থলে কয়েকজন লোক আততায়ীকে ধরে ফেলে। পুলিশ এসে আততায়ীকে পুলিশ স্টেশনে নিয়ে যায়। আততায়ীর নাম নাথুরাম বিনায়ক গডসে। সে পুনার অধিবাসী এবং ‘হিন্দু রাষ্ট্র’ নামক দৈনিক পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। নাথুরাম ঘটনার দিনেই ট্রেনে করে দিল্লিতে এসেছিল এবং প্রথম শ্রেণির ওয়েটিং রুমে তার একটি বিছানার পুটুলি পাওয়া গিয়েছিল। গডসেকে প্রথমে তুঘলক রোড পুলিশ স্টেশনের হাজতে রাখা হয়েছিল। সে কিছু বলতে চায় কিনা এ প্রশ্ন করা হলে নাথুরাম হেসে বলেছিল - আপাতত আমি এই কথা বলতে চাই যে, আমি যা করেছি, তার জন্য এতটুকুও দুঃখিত নই। অন্য কথা আদালতে খুলে বলব। নাথুরামের হাতে যে পিস্তল পাওয়া গিয়েছিল তা ফরাসি দেশের তৈরি ছোটো আকারের। একসঙ্গে পরপর পাঁচটি গুলি ছোঁড়া চলে ওই পিস্তলটি থেকে। পুলিশের হাতে যখন পিস্তলটি আসে তখন তিনটি গুলি ছোঁড়া হয়েছিল, আর দুটি ভিতরেই ছিল।

গান্ধীজিকে বিড়লা ভবনের ভিতরে একটি চারপায়ার উপরে শুইয়ে রাখা হয়েছিল। বাইরে উৎকণ্ঠিত জনতা। বিকাল ৫.৩৫ মিনিটের সময় দেওয়ান চমনলাল ভিতর থেকে বাইরে আসেন। তিনি খুব ধীরে ধীরে বলেন, বাপুজি এখনও জীবিত আছেন। এর পাঁচ মিনিট পর আর একজন বিড়লা ভবন থেকে বাইরে এসে বলেন - বাপুজী আমাদের ছেড়ে চিরদিনের জন্য চলে গেছেন।

গান্ধীজিকে এর আগেও হত্যার চেষ্টা হয়েছিল।১৯৪৮ সালের ২০ জানুয়ারি মহাত্মা গান্ধী যখন নয়াদিল্লিতে প্রার্থনা সভায় বক্তৃতা করছিলেন তখন তাঁকে লক্ষ্য করে বোমা নিক্ষেপ করা হয়েছিল। অবশ্য বোমাটি ১৫ গজ দূরে ফেটেছিল। ১৯৩৪ সালের ২৫ জুন পুনা শহরে একবার গান্ধীজিকে বোমা নিক্ষেপ করে হত্যার চেষ্টা হয়েছিল। অর্থাৎ মহাত্মাজিকে আগেও খুন করার চেষ্টা হয়েছিল।

গান্ধীজির মৃত্যুর পর সন্ধ্যায় বেতার ভাষণে জওহরলাল নেহরু যা বলেছিলেন তাতে পরিষ্কারভাবেই সাম্প্রদায়িক শক্তির দিকে আঙুল তোলা হয়েছিল এবং বিপদের দিকটিও বলা হয়েছিল। নেহেরু তাঁর বেতার ভাষণে বলেছিলেন -
‘‘বন্ধু ও সাথীগণ, আমাদের জীবনের আলোক নির্বাপিত হইয়াছে - চতুর্দিকে আজ অন্ধকার। আপনাদের কী কথা বলব, তাহা আমি বুঝতে পারছি না। আমাদের প্রিয় নেতা - আমাদের বাপু আর নেই। আমরা তাঁকে বহু বছর ধরে দেখে আসছি, আর তাঁকে আমরা দেখতে পাব না। পরামর্শ চাইতে তাঁহার নিকট ছুটে যাব না, সান্ত্বনা লাভ করতে পারব না - এই ভীষণ আঘাত শুধু আমার নয়, লক্ষ লক্ষ দেশবাসীরও। আমার বা আর কারোরও উপদেশে এই বেদনার লেশমাত্র উপশম হবে না।

আমি বলেছি, আলোক নির্বাপিত হয়েছে। না তবুও আমি ভুল বলেছি। এই দেশের উপর যে আলোকরশ্মি বিকিরণ হয়েছে, তা সাধারণ আলো নয় - বহু বছর ধরে এই আলো দেশকে ভাস্বর করে রেখেছে এবং আরও অনেক বছর ধরে রাখবে। হাজার বছর পরেও এই আলোকরশ্মি দেশবাসী তথা বিশ্ববাসী দেখতে পাবে - অসংখ্য হৃদয়ে ইহা সান্ত্বনা দেবে। এই আলো জীবন্ত সত্য ও শাশ্বত সত্য। ইহা আমাদের সত্য পথ স্মরণ করে দেয় - আমরা ভ্রান্ত পথ ত্যাগ করে চলি।

গত কয়েকমাস ও বছর দেশে বহু বিষ ছড়িয়েছে। এই বিষে দেশবাসীর মন জর্জরিত। এই বিষ আমাদের দূর করতেই হবে। আমাদের পথে যতই বিঘ্ন ও বাধা আসুক না কেন, সমস্তই দূর করতে হবে।...’’

সদ্য স্বাধীন একটি রাষ্ট্রের সামনে গান্ধীজির হত্যাকাণ্ড যে বিপদ ডেকে আনতে পারে তা ‘দেশ’ পত্রিকার (পঞ্চদশ বর্ষের ১৪শ সংখ্যার শনিবার, ২৪ মাঘ, ১৩৫৪, শনিবার, ৭ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৮) ‘তর্পণ’ শিরোনামের সম্পাদকীয়র কয়েকটি লাইন উল্লেখ করলে উপলব্ধি করা যায়ঃ ‘‘অন্ধকার, দিগন্ত ব্যাপিয়া অন্ধকার ঘনাইয়া আসিতেছে। আলো নিভিয়া গিয়াছে। ১৬ মাঘ, শুক্রবারের সেই নিদারুণ সন্ধ্যাকাল। মহাত্মা আর নাই। ভারতের আকাশে যে সূর্য এতদিন প্রাণময় আলোকধারায় আমাদিগকে সঞ্জীবিত রাখিয়াছিলেন তিনি আজ অস্তমিত হইয়াছেন। আজীবন অহিংসার সাধক চরম হিংসার সম্মুখে আত্মবলি দিয়াছেন। সমগ্র জাতি এ সংবাদে স্তব্ধ হইয়া গেল। ভাষা নাই। ছন্দ এখানে নীরব।

ঘোরতম সন্ধ্যা ঘনাইয়া আসিতেছে। সন্ধ্যার এই ভূতপতি প্রমথদল লইয়া নৃত্য করেন। অন্ধকারের বক্ষ ভেদ করিয়া তাঁহার ডমরুধ্বনি নিনাদিত হয়। ভারতের যিনি মঙ্গলমূর্তি ছিলেন, ধ্যান-সমাহিত চিত্তে সন্ধ্যার এই আঁধারে যিনি জগতের কল্যাণ সাধনা করিতেন আজ তিনি অন্তর্হিত হইয়াছেন। জাতি নিতান্ত অসহায়। মঙ্গল দীপ নির্বাপিত।...’’।

নাথুরাম যে আরএসএস’র সক্রিয় কর্মী ছিল এবং গান্ধীজিকে হত্যার সঙ্গে যে আরএসএস যুক্ত ছিল তার একাধিক প্রমাণ আছে। ১৯৯৩ সালের ডিসেম্বরে নাথুরাম গডসের ভাই একটি বই প্রকাশ অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, ‘‘আমি ও নাথুরাম দুজনেই আরএসএস’র সক্রিয় সদস্য ছিলাম।’’ ১৯৯৪ সালের ২৮ জানুয়ারি ‘ফ্রন্টলাইন’কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে গোপাল গডসে বলেন, ‘‘আমরা সব ভাইই ছিলাম আরএসএস-এ, নাথুরাম, দত্তাত্রেয়, আমি এবং গোবিন্দ। বলতে গেলে নিজেদের বাড়ি ছেড়ে আরএসএস’র মধ্যেই আমরা বড়ো হয়েছি। ওটা আমাদের পরিবারের মতোই ছিল। নাথুরাম হয়ে উঠল আরএসএস’র ‘বৌদ্ধিক কার্যবাহক’। সে তাঁর বিবৃতিতে বলেছে যে, সে আরএসএস-কে পরিত্যাগ করেছে। একথা সে বলেছিল তার কারণ গান্ধী হত্যার পর গোলওয়ালকর এবং আরএসএস পড়েছিল বিপুল অসুবিধার মধ্যে। নাথুরাম কিন্তু আরএসএস-কে ত্যাগ করেনি।’’ (সূত্রঃ আরএসএস এবং বিজেপি শ্রম বিভাজন - এ. জি. নুরানি, পৃঃ- ৫৫)

হিন্দুত্ববাদী নেতা সাভারকরের ভূমিকাও সন্দেহের ঊর্ধ্বে ছিল না। ১৯৪৮ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি ভারতের প্রথম স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল নেহরুকে একটি চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘‘প্রত্যক্ষভাবে সাভারকরের অধীনে হিন্দু মহাসভার একটি ধর্মোন্মত্ত শাখা এই ষড়যন্ত্রটির পরিকল্পনা করেছিল এবং তাকে চূড়ান্ত পরিণতি দিয়েছিল।’’

হিন্দু মহাসভার নেতা শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়কে ১৮ জুলাই, ১৯৪৮ লেখা এক চিঠিতে বল্লভভাই প্যাটেল লিখেছিলেন - ‘‘আরএসএস এবং হিন্দু মহাসভা নিয়ে আলোচনায়, গান্ধী হত্যা সম্পর্কিত মামলাটি এখনও বিবেচনাধীন এবং এই দুটি সংগঠনের অংশগ্রহণ সম্পর্কে কোনো কথা বলাই উচিত মনে করি না, কিন্তু আমাদের বিবৃতি নিশ্চিতভাবে জানাচ্ছে যে, এই দুটি গোষ্ঠীর, বিশেষত, পূর্বোক্তদের কার্যকলাপের ফলশ্রুতিতেই দেশে এমন একটি পরিস্থিতির জন্ম হয়েছিল যেখানে এই ধরনের ভয়ানক দুর্ঘটনা ঘটতে পেরেছিল। আমার মনে অন্তত কোনো সন্দেহ নেই যে, হিন্দু মহাসভার চরমতম অংশ এই ষড়যন্ত্রে যুক্ত ছিল। সরকার এবং রাষ্ট্রের অস্তিত্বের প্রশ্নে আরএসএস’র কার্যকলাপ স্পষ্টতই ভীতিজনক হয়ে উঠেছে। আমাদের প্রতিবেদনগুলি থেকে উঠে আসছে যে, নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও এই ধরনের কার্যকলাপ এখনও শেষ হয়ে যায়নি। বাস্তবত, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আরএসএস বর্গ আরও বেশি বেপরোয়া হয়ে উঠছে এবং তাদের অন্তর্ঘাতমূলক কার্যকলাপে আরও বেশি মদত দিয়ে চলেছে।’’ (চিঠি ৬৪, সর্দার প্যাটেল উদ্ধৃত, সিলেক্ট করেসপন্ডেন্স ১৯৪০-৫৯, খণ্ড ২, নবজীবন পাবলিশিং হাউস, আমেদাবাদ, ১৯৭৭, পৃষ্ঠা-২৮৩)।

প্রসঙ্গত, আরএসএস এবং হিন্দু মহাসভা আলাদা কিছু নয়। সাভারকরের জীবনীকার ধনঞ্জয় কীর বলেছিলেন ‘‘আরএসএস-কে গণ্য করা হতো হিন্দু মহাসভার একটি জঙ্গি ঝটিকাবাহিনী হিসাবে। যৌবনকালে গডসে ছিলেন আরএসএস’র কর্মী এবং পরবর্তীকালে তিনি হয়ে উঠেছিলেন হিন্দু মহাসভার সর্বভারতীয় শাখার বিশিষ্ট সদস্য।” (ধনঞ্জয় কীর, বীর সাভারকর, পপুলার প্রকাশন, বোম্বে, ১৯৮৮, পৃষ্ঠা-৪০০)।

বিজেপি’র এক নেতা সাক্ষী মহারাজ গডসের প্রশংসা করে তাকে গান্ধীর সঙ্গে তুলনা করে বলেছিলেন, ‘‘আমি বিশ্বাস করি নাথুরাম গডসেও একজন জাতীয়তাবাদী ছিলেন এবং মহাত্মা গান্ধীজিও দেশের জন্য অনেক অবদান রেখেছেন। গডসে ছিলেন এক ক্ষুব্ধ ব্যক্তি। তিনি ভুলবশত কিছু করতে পারেন কিন্তু কখনও দেশদ্রোহী নয়। তিনি একজন দেশপ্রেমিক।’’ (দ্য টাইমস অব ইন্ডিয়া, ডিসেম্বর ১২, ২০১৪)।

গান্ধীজির হত্যাকাণ্ড সুপরিকল্পিত ছিল। মৃত্যুর পর আরএসএস বিভিন্ন জায়গাতে লাড্ডু বিলি করেছিল। গান্ধী হত্যার পর এটা পরিষ্কার হয়ে যায় হিন্দু মহাসভা, আরএসএস এবং বেশ কিছু হিন্দু রাজন্যদের মধ্যে অশুভ বোঝাপড়া ছিল। গোয়ালিয়র, ভরতপুর এবং আলওয়ারের মতো রাজন্যশাসিত রাজ্যগুলিতে আরএসএস এবং হিন্দু মহাসভার উদ্যোগে গান্ধী হত্যার পর মিষ্টান্ন বিলি করা হয়েছিল। জওহরলাল নেহরু গান্ধী হত্যার ছ’দিন পর সর্দার প্যাটেলকে এক চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘‘এটি স্পষ্ট যে যথেষ্ট বেশি সংখ্যায় মুখ্য আরএসএস ব্যক্তিরা কিছু রাজ্যে (দেশীয়) জড়ো হয়েছে, বিশেষ করে ভরতপুর এবং আলওয়ার। তারা বিভিন্ন ধরনের রসদ সঙ্গে নিয়ে গেছে। যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে যে, তারা হয়ত ওই অঞ্চলে ভিত সংগঠিত করবে, অন্যত্র গোপন কার্যকলাপ চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য।’’ (হিন্দুত্ব সাভারকরের স্বরূপঃ শামসুল ইসলাম, পৃষ্ঠা-৩১)

শিল্পী টম ভাত্তাকুজি অঙ্কিত ‘ডেথ অফ গান্ধী’ (মাধ্যমঃ অয়েল অন ক্যানভাস)।

গান্ধী হত্যার পরে কমিউনিস্টদের ভূমিকা কী ছিল? মহাত্মা গান্ধী হত্যার পরের দিন আলিগড়ে এক বিশাল সমাবেশ হয়েছিল। কমিউনিস্ট আর সমাজবাদীরা স্লোগান তুলেছিলেন, ‘‘গান্ধীকে হত্যারো কো ফাঁসি দো।’’

কমিউনিস্ট পার্টির বাংলা প্রাদেশিক কমিটির পক্ষে মুজফ্‌ফর আহ্‌মদ ও ভবানী সেন বিবৃতি দিয়ে এই হত্যাকাণ্ডের তীব্র নিন্দা যেমন করেছিলেন, তেমনি গান্ধী হত্যার ঘটনাকে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষে পরিণত করার চেষ্টা যারা করেছিল তাদেরও সাবধান করা হয়েছিল। ‘স্বাধীনতা’ পত্রিকার সম্পাদকীয়র শিরোনাম ছিল, ‘‘সাম্প্রদায়িক আততায়ীর গুলিতে গান্ধীজি নিহতঃ শোক নয় ক্রোধ”। এটি লিখেছিলেন সোমনাথ লাহিড়ী। রাজ্য বিধানসভায় ১৯৪৮ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি শোকপ্রস্তাবের উপর জ্যোতি বসু ভাষণে বলেছিলেন, ‘‘ভাবে গদগদ হয়ে একটা প্রস্তাব পাশ করে কিংবা প্রার্থনাসভায় যোগ দিয়ে কিংবা স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করে কখনোই গান্ধীজির অত্যন্ত প্রিয় সেই কর্তব্য পালন করা যাবে না। রেডিওতে আর জনসভায় সর্বক্ষণ এই প্রচার করা হচ্ছে, ‘পিতা তুমি ওদের ক্ষমা করো, কেননা ওরা জানে না ওরা কি করছে’ - সে তো এক মিথ্যে কান্না। ...আমরা অপেক্ষা করব। লক্ষ্য রাখব, এই চূড়ান্ত ট্রাজেডির পরে আজ পর্যন্ত সব কাজেই অকৃতকার্য কংগ্রেস সরকারের মনোভাবে কোনো পরিবর্তন আসে কী না। নিছক প্রার্থনায় নয়, এমনভাবে তারা কাজ করে কী না যা হবে গান্ধীজির স্মৃতির প্রতি উপযুক্ত স্মারক।”

‘গান্ধী ও গান্ধীবাদ’ শীর্ষক বইয়ে ই. এম. এস. নাম্বুদিরিপাদ লিখেছেনঃ গান্ধী হলেন ‘সমগ্র জাতীয় বুর্জোয়ার প্রতিনিধি’ এবং ভুল ত্রুটি সত্ত্বেও এদেশের ‘সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সর্বাগ্রগণ্য নেতা।” গান্ধী হত্যা নিয়ে তিনি লিখেছেন, ‘‘সঙ্গে সঙ্গে ইতি হলো সেই যুগটির, ভারতবাসীর ইতিহাসে যাকে গান্ধীর নামাঙ্কিত ‘গান্ধীযুগ’ বলে চিহ্নিত করা যায়।”

দুঃখের হলেও এটাই বাস্তব গান্ধীজির হত্যাকারী, রক্ত কলঙ্কিত আরএসএস আজ রাষ্ট্রক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণ করছে। আরএসএস ধর্মনিরপেক্ষতার বিরুদ্ধে। সংবিধানে ‘মনুস্মৃতি’র উল্লেখ না থাকায় এবং মনুপ্রদত্ত রাষ্ট্রিক ও সামাজিক বিধানসমূহের যথাযোগ্য মর্যাদাসহ ভারতীয় সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত না হওয়ায় আরএসএস ভারতীয় সংবিধানের বিরোধিতা করে। ওদের মুখপত্র ‘অর্গানাইজার’-এ ১৯৪৯ সালের ৩০ নভেম্বরে তা লিপিবদ্ধ আছে। গান্ধীজি ছিলেন ধর্মনিরপেক্ষ। ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিকে চ্যালেঞ্জ জানানোর প্রাথমিক পদক্ষেপ ছিল গান্ধী হত্যা। সাভারকর, গোলওয়ালকর আর গডসের স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করার দিকে এগিয়ে চলেছে মোদির নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকার। কিন্তু হিন্দুত্ববাদীদের স্বপ্ন বাস্তবায়িত হবে না। জয়ী হবে ধর্মনিরপেক্ষ শক্তি।