E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৭ বর্ষ ৪৫ সংখ্যা / ৩ জুলাই ২০২০ / ১৮ আষাঢ় ১৪২৭

গরিবদের প্রতারিত করতে প্রধানমন্ত্রীর অমর্যাদাকর রাজনীতি


নিজস্ব প্রতিবেদনঃ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিতে এলেই সারা দেশ তটস্থ হয়ে থাকে। কে জানে আবার দেশের জনগণকে ‘মিঁত্রোও’ সম্ভাষণ করে কোন্‌ নতুন খ‍‌ড়্গ তাঁদেরই কাঁধে নামিয়ে আনেন। নোটবন্দি, জিএসটি এবং অতি সম্প্রতি কোভিড-১৯জনিত কারণে মার্চ মাসের ২৫তারিখে লকডাউনের ঘোষণা দেশের জনগণের কাছে এখনও দুঃস্বপ্নের মতো সব ঘটনা। এইগুলি সবই তিনি জাতির উদ্দেশে ভাষণ কিংবা ‘মন কি বাত’-এ দেশবাসীকে জানিয়েছিলেন। তাই আনলক-১-এর শেষ দিন ৩০ জুন প্রধানমন্ত্রীর জাতির উদ্দেশে ভাষণে স্বাভাবিকভাবেই দেশবাসী এক অজানা আশঙ্কায় ছিল।

তবে দেশের মানুষের ভাঙা মাজাকে পঙ্গু করে দিতে পারে এমন কোনো ‘চমক’লাগা (!) ঘোষণা প্রধানমন্ত্রী এবারে করেননি। সামনেই বিহার বিধানসভার নির্বাচন। সেই দিকে লক্ষ রেখেই মনে হয় একটু সংযমী হয়েছেন আমাদের প্রধানমন্ত্রী। কেন না পঙ্গু মানুষ তো আর ভোট দিতে পারে না! মিঁত্রোও সম্ভাষণে যে দুঃস্বপ্ন মানুষকে তাড়া করে তা থেকেও একটু মুক্তি দিতে চেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। এবারে ‍‌তিনি বলেছেন ‘সাথীও’।

তবে ভোটের বাজারে মিথ্যাচার খুবই শক্তিশালী হাতিয়ার। বহু পরীক্ষিতও। ২০১৪ এবং ২০১৯-র লোকসভা নির্বাচনে মিথ্যাচারকে প্রায় শিল্পের পর্যায়ে উন্নীত করেছিলেন নরেন্দ্র মোদী ও তাঁর দল বিজেপি। শেষ বক্তৃতায় পরীক্ষিত ও সফল সেই অস্ত্রেই শান দিয়েছেন এবং শক্ত করে ধরেছেন মোদী। ঘোষণা করেছেন, দেশের ৮০ কোটি মানুষের জন্য বিনামূল্যে রেশন নভেম্বরের শেষ পর্যন্ত বাড়ানো হলো।

৩ জুলাই লকডাউনের শততম দিন। ২৫ মার্চ পরবর্তী তিন মাস ছিল দেশের মানুষের কাছে সবচেয়ে কঠিন সময় ছিল। জীবন-জীবিকার উপর নেমে এসেছিল এক নজিরবিহীন পরিস্থিতি। সেই সময়েই ৮০ কোটি মানুষের কথা ঘোষণা করেও সবার কাছে রেশন পৌঁছতে পারেনি কেন্দ্রীয় সরকার। খাদ্য সুরক্ষা আইনে প্রতি মাসে ভরতুকিযুক্ত খাদ্যশস্য দরকার পড়ে ৪৩ লক্ষ টন। কিন্তু এপ্রিলে তা লেগেছে ২৬ লক্ষ টন এবং মে মাসে ২৯ লক্ষ টন। এই তথ্য থেকেই পরিষ্কার যে, কোটি কোটি মানুষ রেশন পান নি। বিশেষজ্ঞদের মতে, রেশন না পাওয়া মানুষের সংখ্যাটা সময়ভেদে ২০—৩০ কোটিও হতে পারে। সেই বুভুক্ষা পীড়িত মানুষের সাথে আবার ছলনা করলেন প্রধানমন্ত্রী। বাতাসে ভোটের গন্ধ এলেই বিজেপি ‘ভারতীয় জুমলা পার্টি’ হয়ে যায়। সেই হিসেবে বলা যায়, এবারের প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে ‘রেশনের জুমলা’ই হলো চমক।

বামপন্থী দলগুলির দীর্ঘদিন ধরেই দাবি অতি স্বল্পমূল্যে সর্বজনীন গণবণ্টন ব্যবস্থা। বর্তমানে উদ্ভূত বিশেষ পরিস্থিতিতে বামপন্থী দলগুলি দাবি করেছে : আগামী ৬ মাস অর্থাৎ ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রতি ব্যক্তিকে মাসে ১০ কেজি খাদ্যদানা বিনামূল্যে দিতে হবে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেছে,ন নভেম্বর পর্যন্ত প্রতি ব্যক্তিকে ৫ কেজি খাদ্যদানা ও ১ কেজি ছোলা প্রতি মাসে দেওয়া হবে। কেন্দ্রীয় সরকারের দেওয়া তথ্যই বলছে, লকডাউনের ফলে ১৪ কোটি মানুষ তাঁদের জীবিকা হারিয়েছেন। সিপিআই(এম) পলিট ব্যুরো’র সাম্প্রতিক বিবৃতিতেও উদ্বেগ প্রকাশ করে এই তথ্য জানানো হয়েছে। একজন রোজগেরের উপর ৫ জন নির্ভরশীল এই হিসেবে ৭০ কোটি জীবন কোটি জীবন আক্রান্ত। অর্থনীতিবিদদের মতে দেশে বর্তমানে দরিদ্র ও পীড়িত মানুষের সংখ্যা ১০০ কোটিরও বেশি।

একদিকে খাদ্যদানার পরিমাণ কম এবং অন্যদিকে এই রেশন সর্বজনীনও নয়। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা মতো ৮০ কোটি সংখ্যাটা যদি সত্যিও হয়, তাহলেও কমপক্ষে ২০-২৫ কোটি মানুষ যাঁদের এই রেশন প্রকৃতই জরুরি তাঁরা এই ব্যবস্থার বাইরে থেকে যাবেন। তাই সবদিক দিয়েই প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা অপর্যাপ্ত এবং অপ্রতুল। কোনো নতুনত্বও নেই। নতুন মোড়কে পুরনো পানীয়কে আবার বাজারে এনেছেন। বামপন্থী দলগুলি প্রথম থেকে গণবণ্টন ব্যবস্থা সম্পর্কিত যে দাবি করে আসছে, তা যদি সরকার অক্ষরে অক্ষরে মেনে নিত তাহলেই একমাত্র দেশের সর্বঅংশের মানুষ কিছুটা হলেও সুরাহা পেতেন।

কোভিড-১৯জনিত পরিস্থিতিতে ত্রাণ প্যাকেজ ঘোষণার দিন থেকেই সংখ্যাতত্ত্বের মারপ্যাঁচ করে যাচ্ছে কেন্দ্রীয় সরকার। প্রধানমন্ত্রীর সেই প্যাকেজ ঘোষণার পর পাঁচ দিন অর্থমন্ত্রী নি‌র্মলা সীতারামন সাংবাদিক সম্মেলনে প্যাকেজ ঘোষণার নামে বৈকালিক ঋণমেলা বসাতেন। সেও ছিল সংখ্যাতত্ত্বের কচকচানি। এদিনের ১৬ মিনিটের বক্তৃতাতেও সেই চেষ্টার কসুর করেননি প্রধানমন্ত্রী। বলেছেন, ৯ কোটি কৃষককে ২ হাজার টাকা করে ১৮ হাজার কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ২০১৯ সালে নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিতেই মোদী বলেছিলেন : ১৪ কোটি কৃষককে বছরে তিনদফায় ৬ হাজার টাকা করে দেওয়া হবে। বর্তমান কঠিন পরিস্থিতিতে এই টাকা বৃদ্ধি হওয়ার কথা। কিন্তু বকেয়া অর্থই সব কৃষক পায়নি। আসলে সবেতেই ‘জুমলা’টা আজ কেন্দ্রীয় সরকারের দস্তুর।

কেন্দ্রীয় সরকারই বলেছে, গত দু’মাসে রাস্তায় ৮ কোটি পরিযায়ী শ্রমিক ছিল। তাঁদের জীবন-জীবিকার প্রসঙ্গে একটাও বাক্য খরচ করেননি আমাদের জনদরদি প্রধানমন্ত্রী। বামপন্থী দলগুলি দাবি করেছে : পরিযায়ী শ্রমিক সহ আয়কর দেয় না এমন সব মানুষকে আগামী ৬ মাস প্রতি মাসে ৭৫০০ টাকা করে দিতে হবে। আর প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, জনধন অ্যাকাউন্টে ৫০০ টাকা দেওয়া হয়েছে। যেখানে কোটি কোটি মানুষের আয় নেই, সেইখানে এই ৫০০ টাকা ওই মানুষগুলোর দুর্দশার সঙ্গে রসিকতা ছাড়া আর কীই বা বলা যাবে। একমাত্র আয়হীন বা নামমাত্র আয়ের মানুষের কাছে কেন্দ্রীয় সাহায্যে নগদ অর্থ পৌঁছালেই তাঁরা বাজারে পণ্য কিনতে যেতে পারতেন। তাতে এই মানুষগুলোও বাঁচতেন, দেশের মুখ থুবড়ে পড়া অর্থনীতিও ঘুরে দাঁড়াত।

আগেই কেন্দ্রীয় সরকার ঘোষণা করেছিল, অতিরিক্ত এক কোটি মানুষকে ১০০ দিনের কাজের আওতায় আনা হবে। মূলত ঘরে ফেরা পরিযায়ী শ্রমিকদেরই কাজ দেওয়া হবে এই প্রকল্পে। এর জন্য প্রয়োজন ২ লক্ষ ৪৬ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু বাজেটে যে টাকা বরাদ্দ করা আছে এবং প্রধানমন্ত্রীর এদিনের ঘোষণা মিলিয়ে পাওয়া যাবে সর্বসাকুল্যে ১ লক্ষ ৫০ হাজার কোটি টাকার মতো। বাকি টাকা কোথা থেকে আসবে তার কোনো সদুত্তর নেই প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে। এও হলো আরেক জুমলা।

অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামনের প্যাকেজের বিষয়বস্তু আর এদিনের প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার মধ্যে কোনো মৌলিক পার্থক্য নেই। পেট্রোল-ডিজেলের টানা দামবৃদ্ধি, কর্পোরেট-ধনী ব্যবসায়ীদের মুনাফা সুনিশ্চিত করতে শ্রমআইনের মৃত্যুঘণ্টা বাজানো, রাষ্ট্রায়ত্ত সম্পদের অবাধ বেসরকারিকরণ যখন সাধারণ মানুষের জীবনকে মৃত্যুর কিনারায় এনে উপস্থিত করেছে, তখন গরিব দরদি সাজতে আসরে অবতীর্ণ হয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। বিহারের ভোটের জন্য তার ছট পুজো আর অন্য অনেক উৎসবের কথা মনে পড়েছে। কিন্তু ভারতের মানুষের জীবনে উৎসবের রোশনাই যে আবার কবে ফিরে আসবে তা কেউ জানে না। এই ‘জুমলা’ প্রধানমন্ত্রী কিংবা বিজেপি দলের ভোট বৈতরণী পেরনোর ভেলা হয়তো হতে পারে কিন্তু একটি স্বাধীন দেশের কোটি কোটি দুর্দশাপীড়িত জনগণের কাছে এই রাজনীতি নিতান্তই অমর্যাদাকর। ততোধিক অমানবিকও।