৫৭ বর্ষ ৪৫ সংখ্যা / ৩ জুলাই ২০২০ / ১৮ আষাঢ় ১৪২৭
ইন্দো-চীন সংঘাত
গালওয়ান নদীর অববাহিকায় ভারতীয় ও চীনা সৈন্যদের সংঘাতের ফলে ১৬ বিহার রেজিমেন্টের কম্যান্ডিং অফিসার সহ ২০ ভারতীয় সৈন্যের প্রাণহানি স্বাভাবিকভাবেই দেশের জনগণের মধ্যে ক্রোধের জন্ম দিয়েছে। এই ঘটনা অত্যন্ত বেদনাদায়ক ও নিন্দনীয়। গত ৬ই জুন দু’পক্ষের বরিষ্ঠ সামরিক অফিসাররা প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখার বিভিন্ন জায়গায় উত্তেজনা প্রশমন ও সৈন্য প্রত্যাহারের বিষয়ে ঐকমত্যে উপনীত হন। এরপরেও ১৫ জুন রাত্রে কি পরিস্থিতিতে ভারতীয় ও চীনা সৈন্যদের মধ্যে শারীরিক সংঘর্ষ হয়েছিল তার অনেকটাই এখনও অজানা। ভারত সরকার এখনও এবিষয়ে ধোঁয়াশা কাটানোর কোনো চেষ্টা করেনি।
১৯ জুন সর্বদলীয় বৈঠকে সমস্ত দলই পুনরায় জানায় যে, পরিস্থিতি মোকাবিলায় গোটা দেশ ঐক্যবদ্ধ। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, লাদাখে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখার কাছে ভারতীয় ও চীনা সৈন্যদের সংঘাত এবং আমাদের প্রতিক্রিয়া নিয়ে কোনো প্রশ্ন করা যাবে না। এই সবকিছুকে যথাযথভাবে মূল্যায়ন করতে হবে এবং প্রয়োজনীয় শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে। কেবল এভাবেই সরকার এবং দেশ সামনের দিকে এগিয়ে যেতে পারবে।
গত ১৭ জুন ভারত ও চীনের বিদেশমন্ত্রীদের মধ্যে টেলিফোনে কথা হয়। উভয়পক্ষই নিজস্ব অবস্থানের কথা পুনরায় ব্যক্ত করে সিদ্ধান্তে পৌঁছন যে: ‘‘সামগ্রিক পরিস্থিতিকে দায়িত্বশীলভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হবে এবং ৬ জুন সামরিক তৎপরতা বন্ধ করার যে বোঝাপড়া হয়েছিল তা আন্তরিকভাবে রূপায়ণ করা হবে।’’ এছাড়া ‘‘উভয়পক্ষই উত্তেজনা সৃষ্টিকারী কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করবে না এবং দ্বিপাক্ষিক সমঝোতা ও রীতিনীতি অনুযায়ী শান্তি ফিরিয়ে আনতে সচেষ্ট হবে।’’ সর্বদলীয় বৈঠকে সিপিআই(এম) এই দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করেছে।
এর প্রেক্ষাপটে প্রতিশোধ গ্রহণ ও সামরিক প্রত্যাঘাতের জিগিরকে পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করতে হবে। রাজনৈতিক বিশ্বাস যাইহোক না কেন, বিবেচক মানুষ মাত্রেই এরকম অপরিণত ও অবাস্তব মনোভাব পোষণ করতে পারেন না।
কেউ কেউ দাবি করেছেন যে, সীমান্তে শান্তি বজায় রাখার জন্য চীনের সঙ্গে অতীতে যে সমস্ত চুক্তি হয়েছে সেগুলি মূল্যহীন হয়ে গিয়েছে। প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখায় সীমান্ত সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বোঝাপড়ার জন্য ১৯৯৩ সালের চুক্তি ‘Agreement on the Maintenance of Peace and Tranquillity along the Line of Actual Control in the India-China Border Areas’। এরপর অনেকগুলি সমঝোতা হয়েছে। ১৯৯৬, ২০০৫, ২০১৩ এবং ২০১৫ সালের তৎকালীন ভারত সরকারগুলি যা কিনা কংগ্রেস এবং বিজেপি দুই দলেরই নিয়ন্ত্রণাধীন ছিল তারা বিভিন্ন সমঝোতাপত্রে স্বাক্ষর করেছে। মতপার্থক্য ও সংঘাত অবসানের জন্য স্বাক্ষরিত এই সমস্ত সমঝোতা ও তার অন্তর্গত বোঝাপড়ার প্রক্রিয়ার দরুন হিমালয় পার্বত্য অঞ্চলে শান্তি বজায় রাখা সম্ভবপর হয়েছিল। এর আগে ভারতীয় ও চীনা। সৈন্যদের শেষ সশস্ত্র সংঘাত ও মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছিল ৪৫ বছর আগে, ১৯৭৫ সালে। এই সমস্ত প্রয়াসকে এককথায় নস্যাৎ করে দেওয়াটা ভুল হবে। বরং অতীতের সমঝোতার উপর ভিত্তি করে বর্তমানের বোঝাপড়া গড়ে তোলাটাই প্রয়োজন।
অগ্রগতির জন্য দুটো পথ খোলা রয়েছে। প্রথমত, বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখা বরাবর উত্তেজন প্রশমন ও সেনা সংখ্যা হ্রাসের কৌশল গ্রহণের জন্য আলোচনা চালাতে হবে। ২২ জুন মলডোতে লেফটেন্যান্ট জেনারেল পর্যায়ের সভা এই লক্ষ্যে আয়োজিত হয়েছে। কিন্তু কেবল সামরিক পর্যায়ের আলোচনাই যথেষ্ট নয়। আলোচনার স্বার্থে উচ্চপর্যায়ের কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক স্তরে প্রয়াস গ্রহণ করতে হবে। অবশ্য এই জন্য সুস্পষ্ট নীতিগত দৃষ্টিভঙ্গি থাকা প্রয়োজন।
লাদাখে যে সংঘাত হয়েছে তাকে অনেক বিশ্লেষক ‘সালামি স্লাইস’ বা ভারতীয় ভূখণ্ড অল্প অল্প করে দখল করার চীনা কৌশল হিসেবে দেখছেন। কিন্তু একে কেবল ভারতীয় ভূখণ্ডের খানিকটা দখল করার প্রয়াস হিসেবে দেখাটা যথেষ্ট হবে না। সীমান্তে সংঘাতের অনেক গভীর কারণ রয়েছে। প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখা সংক্রান্ত সাধারণত যে ঝামেলা-ঝঞ্ঝাট হয় তার ঊর্ধ্বে বিভিন্ন ভূ-রাজনৈতিক বিষয় এখানে যুক্ত রয়েছে। আদতে ভারত ও চীনের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটা অবিশ্বাস ও সন্দেহের বাতাবরণ সৃষ্টি হয়েছে।
যদিও চীনের পক্ষ থেকে ভ্রান্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে, তবে ভারত সরকারের কিছু পদক্ষেপও এই পরিস্থিতি সৃষ্টির ক্ষেত্রে ভূমিকা গ্রহণ করেছে। জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের অবলুপ্তি এবং জম্মু ও কাশ্মীর ও লাদাখকে দুটি কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলে পরিণত করার সিদ্ধান্তের প্রভাব বহির্বিশ্বে পড়েছে। চীন এই ঘটনাকে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখেছে। ভারত সরকারের কাছে তারা এনিয়ে দু’বার প্রতিবাদ জানিয়েছে কেননা তারা মনে করে যে, এরফলে এতদঞ্চলে প্রশাসনিক কাঠামোর যে পরিবর্তন ঘটেছে তাতে ভারতীয় ভূখণ্ডের যে অঞ্চলে চীনের দাবি রয়েছে তার ওপর প্রভাব পড়বে। কিন্তু ভারত সরকার এ বিষয়টি এড়িয়ে যায়, এমনকি যখন রাষ্ট্রসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদের ঘরোয়া আলোচনায় এই বিষয়টি চীন উত্থাপন করে তখনও কোনো প্রতিক্রিয়া ভারত সরকার দেখায়নি।
এবিষয়ে সরকারের বরিষ্ঠ মন্ত্রীরা সস্তা বাহবা কুড়ানোর জন্য যে সমস্ত মন্তব্য করেছেন তারও প্রভাব পড়েছে। ৬ই আগস্ট যখন সংসদে জম্মু ও কাশ্মীরের পুনর্গঠন নিয়ে আলোচনা হয় তখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বলেন যে: ‘‘আমি এটা নথিভুক্ত করাতে চাই যে, আমি যখনই এই কক্ষে জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের কথা বলি তখন তার অংশ হিসেবে পাক অধিকৃত কাশ্মীর ও আকসাই চীনকে গণ্য করি।’’ বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর গত সেপ্টেম্বর মাসে সাংবাদিক সম্মেলন করে ‘‘কোনো একদিন পাক অধিকৃত কাশ্মীরে বাস্তবিক অধিকার স্থাপন’’ করবার কথা বলেন।
মোদী সরকারের দ্বিতীয় দফার প্রথম বছরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক রণনীতি যা কিনা চীনের বিরুদ্ধে পরিচালিত তার অঙ্গ হিসেবে ভারতকে যুক্ত করার প্রক্রিয়া দ্রুততর করা হয়। গত বছর সেপ্টেম্বর মাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, জাপান ও অস্ট্রেলিয়ার চতুর্মুখী-জোট মন্ত্রীপর্যায়ে উন্নীত হয়; যখন রাষ্ট্রসঙ্ঘের সাধারণসভার অধিবেশনের ফাঁকে নিউইয়র্কে এই চারটি দেশের বিদেশমন্ত্রীরা বৈঠকে মিলিত হন।
বর্তমানে করোনা অতিমারীর সময়ে ওয়ার্ল্ড হেল্থ অ্যাসেমব্লিতে ভারত আমেরিকার সাথে একযোগে কূটনৈতিকভাবে চীনকে কোণঠাসা করার চেষ্টা করেছে। একজন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী আমেরিকার সুরে সুর মিলিয়ে বলেছেন যে, করোনা ভাইরাস চীনের ল্যাবরেটরিতে তৈরি হয়েছে।
এইসবকিছু মিলিতভাবে এমন এক পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে যেখানে লাদাখে সংঘাত ঘটেছে। দৌলতবাগ ওলডি পর্যন্ত রাস্তা এবং আরও উত্তরে শাখা সড়ক নির্মাণের যে কাজ ভারত আইনসম্মতভাবেই সীমান্ত এলাকার পরিকাঠামো উন্নয়নের অঙ্গ হিসেবে করছে তাকে চীনের পক্ষ থেকে এখন অন্যচোখে দেখা হচ্ছে।
সরকারের নিজেকে প্রশ্ন করা উচিত যে, কেন প্রতিবেশী দেশগুলির সাথে তার সমস্যা ক্রমশ বেড়েই চলেছে। চীন ও পাকিস্তানের সাথে জটিল সীমান্ত সমস্যার সাথে সাথে নেপাল কালাপানি এলাকা নিয়ে বিতর্ক তৈরি করছে। আরেক বন্ধু প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশ ক্রমশ অস্বস্তির মধ্যে পড়ছে কেননা সরকারিভাবে ক্রমাগত বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারীদের বিরুদ্ধে বক্তব্য রাখা হচ্ছে এবং সিএএ-এনআরসি-র মাধ্যমে এইসব ‘উইপোকা’কে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর কথা বলা চলছে। এই সবকিছুকেই চীনের ষড়যন্ত্রের অংশ বলে নস্যাৎ করা নিজেকে বিভ্রমে ফেলার শামিল। বাস্তব হলো বিজেপি-আরএসএস-র উগ্র জাতীয়তাবাদী, হিন্দুত্ববাদী বিশ্ববীক্ষা আমাদের সাথে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের সম্পর্কের ওপর প্রভাব ফেলছে।
ভারতকে কেবল বর্তমানের এই সংঘাত থেকে বেড়িয়ে আসার জন্য নয়, চীনের সাথে যাবতীয় অমীমাংসিত বিবাদের নিরসন ঘটানোর জন্য পথ খুঁজতে হবে। কেবলমাত্র উচ্চপর্যায়ের রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক হস্তক্ষেপের মাধ্যমেই তা হওয়া সম্ভব। এরজন্য চীনের প্রতি আমাদের কৌশলগত দৃষ্টিভঙ্গির পুনর্বিন্যাস প্রয়োজন। পূর্বতন জাতীয় নিরাপত্তা পরামর্শদাতা এবং অভিজ্ঞ নিরাপত্তা বিশারদ এম কে নারায়ণন একটি জাতীয়স্তরের সংবাদপত্রে এই অভিমত ব্যক্ত করেছেন যে, আমেরিকা ও চীনের বিবাদে জোটনিরপেক্ষ অবস্থান গ্রহণ করাই হবে আমাদের দেশের স্বার্থে সবচেয়ে ভালো পদক্ষেপ। পশ্চিমী দেশগুলির পক্ষাবলম্বী কৌশলগত বিশেষজ্ঞ ও দালালরা যা দাবি করছেন তার বিপরীতে এই পরামর্শ সুবিবেচনার পরিচয়বাহী। মোদী সরকার বর্তমানে আমেরিকার ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীর অঞ্চলের জন্য গৃহীত কৌশল এবং ক্রমবর্ধমান সামরিক ও কৌশলগত সম্পর্কে অংশীদার। সরকারকে ভাবতে হবে যে, চীনের বিরুদ্ধে জোটে শামিল হলে আদৌ আমাদের স্বার্থ কতটা রক্ষিত হবে।
ভারতকে স্বাধীন অথচ সমমর্যাদাসম্পন্ন অবস্থান থেকে চীনের সাথে দৃঢ়তার সাথে কথা বলতে হবে। এরজন্য আমাদের মূল স্বার্থ বিসর্জন দেওয়ার প্রয়োজন নেই। এরজন্য কেবলমাত্র প্রয়োজন, এমন এক রাজনৈতিক নেতৃত্বের যা বাস্তবতাকে স্বীকার করে এবং দেশের গুরুত্বপূর্ণ স্বার্থ ও স্বাধীনতাকে রক্ষা করবার জন্য কাজ করতে সক্ষম।