৫৭ বর্ষ ৪৫ সংখ্যা / ৩ জুলাই ২০২০ / ১৮ আষাঢ় ১৪২৭
ত্রাণ চোর তৃণমূল
নিজস্ব সংবাদদাতাঃ লকডাউন এবং আমফান-উত্তর পর্বে সরকারি ত্রাণ সাহায্য এবং ক্ষতিপূরণ বণ্টনে দুর্নীতির রকমফেরে এবার অতীতের সব নজির টপকে যেতে বদ্ধপরিকর তৃণমূল কংগ্রেস পরিচালিত পঞ্চায়েতগুলি। রাজ্যের ওই সমস্ত পঞ্চায়েতগুলিতে প্রায় সমস্ত স্তরেই স্বজনপোষণ এবং চুরির অভিনব সব ফিকির খুঁজে চলছে নির্লজ্জ চুরি। আর নজরদারির ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট বিডিও এবং জেলা প্রশাসনের চূড়ান্ত গাফিলতি আর উদাসীনতার জেরে এই সামগ্রিক চুরি কার্যত প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিয়েছে রাজ্য জুড়ে। এই চুরির ভাগিদারিতে যোগ্য স্যাঙাতের ভূমিকা পালন করছে বিজেপি পরিচালিত পঞ্চায়েতগুলি। তাই রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে প্রতিদিনই প্রান্তিক ও ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের বিক্ষোভ-অবরোধের ঘটনা ঘটছে এই চুরির বিরুদ্ধে। রাজ্যের পুলিশ প্রশাসন এই দুর্নীতিগ্রস্ত নেতাদের জনরোষ থেকে রক্ষা করতেই ব্যস্ত। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে, ফি দিনই বাজারি সংবাদমাধ্যম তার সবিস্তার প্রতিফলন ঘটাতে বাধ্য হচ্ছে, নীরব থাকতে পারছে না। এই দুর্নীতি রুখতে বামফ্রন্টের পক্ষ থেকে ব্লক স্তরে সর্বদলীয় বৈঠক ডাকার দাবি জানানো হয়েছে।
রায়দিঘির নন্দকুমারপুরে কান ধরে ক্ষমা চাইছেন তৃণমূল নেতা স্বপনকুমার ঘাটি।
রাজ্যের উত্তরের আলিপুর দুয়ার থেকে মুর্শিদাবাদ, নদীয়া, হুগলী, দুই ২৪ পরগনা, হাওড়া সহ দক্ষিণের পূর্ব মেদিনীপুর পর্যন্ত চিত্রটা মোটামুটি একইরকম। ত্রাণের নামে চলছে নির্লজ্জ দলবাজি, আর স্বজনপোষণ। প্রত্যন্ত এলাকার আদিবাসী মানুষ থেকে ঘরে ফেরা পরিযায়ী শ্রমিক সহ সব ধরনের প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের অধিকাংশই সরকারি সাহায্য পাচ্ছেন না। অধিকাংশ জায়গাতেই ভুয়ো তালিকা তৈরি করে টাকা আত্মসাৎ করা হচ্ছে। আর বঞ্চনার ঘটনাগুলি প্রায় একই ধাঁচের। জেলাওয়াড়ি অভিযোগের ভিত্তিতে বলা যায় দুর্নীতির নিপুণ নকলনবিশি। যেমন অক্ষত পাকা বাড়ির বাসিন্দা তৃণমূল নেতারা ঝড়ে ভাঙা বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তুলে ক্ষতিপূরণ তুলেছে - এটা সব জেলার চেনা ছবি। তবে বৈচিত্র্যও আছে।
যেমন দক্ষিণ ২৪ পরগনায় ক্ষতিপূরণের বরাদ্দকৃত টাকায় খুব নিম্নমানের ত্রিপল কেনা হয়েছে। জেলা জুড়ে পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য যে কোয়ারান্টাইন সেন্টারগুলি হয়েছে, সেখানে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে তাদের রাখার অভিযোগ উঠেছে। দেওয়া হচ্ছে নিম্নমানের খাবার। সেন্টারগুলির দৈনিক খরচের যে ফিরিস্তি তুলে ধরা হচ্ছে, আদতে সেই পরিমাণ খরচ হচ্ছে না। সেখানেও লুট হয়েছে টাকা। ক্ষয়ক্ষতি হয়নি এমন বহু তৃণমূলী পরিবারের লোককে পাইয়ে দেওয়া হয়েছে সরকারি টাকা। পাশাপাশি কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী মাথা পিছু বিনামূল্যে ১০ কেজি চাল এবং ২ কেজি ডাল দেওয়ার ঘোষণা মোতাবেক চাল ডাল পাচ্ছেন না গরিব মানুষ। আর রায়দিঘির তৃণমূল নেতা স্বপন কুমার ঘাটির জনসমক্ষে কান ধরে থাকার ছবিটা গোটা রাজ্যের ত্রাণ চুরির ছবিটা একেবারে বেআব্রু করে দিয়েছে।
বারাসত-২ ব্লকের বিডিও অফিসের সামনে বক্তা বিধায়ক তন্ময় ভট্টাচার্য।
আবার উত্তর দিনাজপুর জেলায় রেগা প্রকল্পের ক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণের টাকা এবং আবাস যোজনার ক্ষেত্রে দুর্নীতি হয়েছে বলে অভিযোগ। যাঁদের প্রকৃত প্রয়োজন, সেই জব কার্ড হোল্ডাররা কাজ পাচ্ছেন না, পাকা বাড়ি আছে কিন্তু ক্ষতি হয়নি কোনো, এমন পরিবারও ক্ষতিপূরণের টাকা পেয়েছেন। ইন্দিরা আবাস যোজনার ঘরের টাকা কাকে দেওয়া হলো তার জবাবদিহি চেয়ে হেমতাবাদ ব্লকের চৈনগর গ্রাম পঞ্চায়েত ঘিরে ফেলেন হাজারো মানুষ, ঘটছে এমন ঘটনাও।
পূর্ব মেদিনীপুরের নন্দীগ্রামের চিত্রটা অনেকটা একই রকম। বেশিরভাগ ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ বরাদ্দ টাকা পাননি। পেয়েছেন তৃণমূল নেতা আর তাঁদের পরিবারের দূর সম্পর্কের আত্মীয় স্বজনরা। পাকা বাড়িতে থাকা দাউদপুর গ্রামে তৃণমূল কংগ্রেস নেতা আব্বাস বেগ পঞ্চায়েতের সদস্য হবার সুবাদে তার পরিবারের (প্রত্যেকের ঠিকানা একই) ১০ জন আমফানের ক্ষতিপূরণ বাবদ মাথাপিছু কুড়ি হাজার টাকা করে মোট ২লক্ষ টাকা পেয়েছেন। সেখানকারই আরেক কুখ্যাত তৃণমূল নেতা শেখ সুফিয়ান এর জামাই, জামাই এর মা, জামাইয়ের ভাই প্রত্যেকেই কুড়ি হাজার টাকা করে পেয়েছেন। জানা যাচ্ছে সুফিয়ানের জামাই সেখ সাবির সরকারি চাকরি করে আর তার মা শরিফা খাতুন এমএসকে শিক্ষিকা। তাদের পরিবারের আরেক সদস্য বেসরকারি সংস্থায় কর্মরত। এদের কারোরই বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত নয় কিন্তু মোট ৬০ হাজার টাকা পেয়ে গেছেন এরা। এই জেলাতেই কোনো কোনো জায়গায় দুর্নীতি নিয়ে প্রশ্নের মুখে পড়ে আবার অভিযুক্ত তৃণমূল নেতা কবুল করেছেন, তিনি অসদ উপায়ে নেওয়া টাকা ফেরত দিয়ে দেবেন।
তবে পূর্ব মেদিনীপুরের গড় চক্রবেড়িয়ার দুর্নীতির ঘটনায় গোটা রাজ্যজুড়ে ছিছিক্কার উঠেছে। এখানে জনৈক সাবিলা খাতুনের নাম ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা তিনবার রয়েছে। তার নামের পাশে ভিন্ন ভিন্ন ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট নম্বর দেওয়া রয়েছে। উল্লেখ থাকা ওই তিনটির মধ্যে দুটি অ্যাকাউন্ট নম্বর আবার ছত্তিশগড়ের দুর্গ জেলার ছিরহা শাখার এবং মহারাষ্ট্রের পুনের কুরকুম্ভ শাখার। বলাবাহুল্য এই তিনটি অ্যাকাউন্টেই আমফানে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া বাড়ির ক্ষতিপূরণের কুড়ি হাজার টাকা ঢুকে গেছে। সাবিলা খাতুনের নামের পাশে যে ফোন নম্বর উল্লেখ করা আছে সেখানে ফোন করলে দেখা যাচ্ছে সেটি মালদহের জনৈক বাসিন্দার। এরকম ঘটনা একাধিক ঘটেছে। তৃণমূলের নেতারা ব্যাখ্যা দিচ্ছেন, আমাদের মাথার উপর দিয়ে আমাদেরই কেউ শেষ মুহূর্তে অ্যাকাউন্ট নম্বর বদলে দিয়েছে।
হাওড়ার উলুবেড়িয়ায় যা ঘটেছে ক্ষতিপূরণের টাকা আত্মসাৎকে কেন্দ্র করে, তা পুকুর চুরির উপমাকেও হার মানিয়েছে। সেখানে কালিনগর এক নম্বর পঞ্চায়েতের জনৈক কালীপদ দাসের ১৩ জন সন্তান ক্ষতিপূরণের টাকা পেয়েছেন! না, সন্তানদের সংখ্যা নয়, সন্তানদের নামগুলি বেনজির। তাঁর সন্তানদের কয়েকজনের নাম হলো শেখ মনিরুল, উত্তম বেরা, রিয়া বেগম, মেঘনাথ সামন্ত, মুর্শিদা বেগম প্রমুখ। না কোনো ধর্ম সমন্বয় এর বিষয় নয় এটা। স্রেফ সরকারি টাকা চুরি করতেই তালিকায় একই বাবার নানা ধর্মের সন্তানদের তালিকায় ঠাই দেওয়া হয়েছে।
ত্রিপলের ছাউনির নিচে একসঙ্গে ৫ থেকে ৬টি ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার অসহায় অবস্থায় বাস করছে এমন দৃশ্য আজ গ্রাম বাংলার বিভিন্ন জেলায় দেখা যাচ্ছে তৃণমূল নেতাদের দুর্নীতির সৌজন্যে। এই দুর্দশার পেছনের সাধারণ কারণ হলো তৃণমূল কংগ্রেসের নেতাদের চূড়ান্ত সংবেদনহীন মনোভাব। যার জবাবে গ্রামের মা-বোনেরা ঝাঁটা-লাঠি হাতে প্রতিবাদ বিক্ষোভের প্রথম সারিতে দাঁড়িয়ে সোচ্চার হয়েছেন।
বিভিন্ন জেলার অপেক্ষাকৃত ছোটো ব্লক, যা তুলনায় কম লোক সংখ্যা বিশিষ্ট, সেখানেও অবাধে চলছে ত্রাণ নিয়ে রাজনীতি। মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত ক্ষোভ সামলাতে যখন স্থানীয় তৃণমূল নেতারা জেরবার হচ্ছেন তখনই সেখানে চলে আসছে নেতাদের দুষ্কৃতী বোঝাই বাইক বাহিনী। পুলিশের উপস্থিতিতেই তারা ঝাঁপিয়ে পড়ছে অসহায় গ্রামবাসীদের ওপর। পুলিশ নীরব দর্শক হয়ে থাকছে। আবার চিনতে না পারার দরুন বা গোষ্ঠীদ্বন্দের কারণে শান্তির দূত ওই বাইক বাহিনীর হাতে মার খাচ্ছে তৃণমূলের অপর গোষ্ঠীর নেতা এমন ঘটনাও বিরল নয় জেলায় জেলায়। বহু ঘটছে।
কলকাতা থেকে ৪৪ কিলোমিটার দূরে দক্ষিণ ২৪ পরগনার মিনাখা, হাসনাবাদ এলাকায় বঞ্চিত মানুষ নিদারুণ কষ্টের মধ্যে থেকে প্রতিদিন প্রত্যক্ষ করছেন তৃণমূল এবং বিজেপি’র যোগসাজশের নানা কীর্তিকলাপ। বাসন্তী হাইওয়ে সংলগ্ন মোহনপুরের হরিণহোল গ্রামে দেখা যাচ্ছে ফুলে ফুলে দোস্তির এক অদ্ভূত নজির। গত পঞ্চায়েত নির্বাচনের সময় এখানে সিপিআই(এম) সহ বামপন্থীরা মনোনয়ন তুলতে পারেনি শাসকদলের প্রাণঘাতী হামলার জেরে। কিন্তু এখানে বিজেপি এবং তৃণমূল নেতারা একসাথে মিলিজুলি পঞ্চায়েত চালান বলাই যায়। এখানে ক্ষতিগ্রস্তদের ১২২ জনের যে তালিকা তৈরি হয়েছে সেখানে তৃণমূলের ৬৭ জন এবং বিজেপি’র ৫৫ জনের নাম রয়েছে। এহেন তালিকার তাৎপর্য বিস্তর। বোঝাপড়াটা হলো, দু'দলেরই সর্মথকরা যেন একে অপরের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ না তোলেন তাই এই ভাগাভাগি। বলাবাহুল্য, তালিকায় যারা ঠাঁই পেয়েছে তারা সকলেই যে প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত তা কিন্তু নয়।
ত্রাণের চাল চুরি থেকে ত্রিপল কেলেঙ্কারি আর আমফান ঝড় একমাস পেরোনোর পর ক্ষতিপূরণ কেলেঙ্কারির কালো দাগ দগদগে হয়ে ফুটে উঠেছে তৃণমূলের সরকারের সর্ব অঙ্গে। বিক্ষুব্ধ মানুষের ন্যায্য প্রতিবাদেও টনক নড়ছে না। প্রশাসন একাধিক ক্ষেত্রে ডেপুটেশন নিচ্ছে না। মানছে না তালিকা প্রস্তুতির জন্য বিধি অনুযায়ী চারজনের কমিটি গড়ার অত্যাবশ্যকীয় ধাপ। জনরোষ এবং জমায়েতের চাপের মুখে পড়ে বিডিও সহ প্রশাসনিক কর্তারা যে প্রতিশ্রুতি তাৎক্ষণিকভাবে দিচ্ছেন তা কার্যকর করছেন না তারা। চাল চুরি, ত্রিপল চুরি সহ নানা চুরি ধরা পড়ার পর চোরেদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে হয়রান করা হচ্ছে যারা চোর ধরছেন তাঁদেরকেই। প্রশাসন নির্লজ্জ দলবাজিকে মদত করছে—দেখা গেছে এরকম বহু ঘটনাই।
বামপন্থী বিভিন্ন সংগঠন এই সমস্ত প্রান্তিক মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে তাঁদের ন্যায্য দাবিদাওয়ার ভিত্তিতে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করছেন। গোটা রাজ্য জুড়ে প্রায় হাজার খানেক কমিউনিটি কিচেন করে তারা সাধ্যমত এই নিরন্ন মানুষের মুখে খাবার তুলে দিচ্ছেন। দিনের পর দিন তারা সীমিত সাধ্যের মধ্যেও জারি রেখেছেন তাঁদের এই অসাধ্য সাধন।
সাধারণভাবে বলা হয়, দুর্নীতি হলো এমন একটা বিষয় যা দেশের মানুষকে গণতন্ত্রের প্রতি আস্থাহীন করে তোলে। এরাজ্যে দিকে দিকে এই চুরি ও ক্ষতিপূরণ কেলেঙ্কারির জেরে যে অবরোধ এবং বিক্ষোভের বিভিন্ন ঘটনা ঘটছে, তা আসলে রাজ্য সরকারের প্রতি সামগ্রিক অনাস্থার জ্বলন্ত নিদর্শন।