E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৭ বর্ষ ৪৫ সংখ্যা / ৩ জুলাই ২০২০ / ১৮ আষাঢ় ১৪২৭

সংখ্যালঘু সমাজের উন্নয়নে সত্যিই কি আন্তরিক মমতা?

গৌতম রায়


সল্টলেকে মাদ্রাসা শিক্ষকদের আমরণ কর্মসূচিতে সুজন চক্রবর্তী।

আরএসএস এবং তাদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপি’র মূল আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হলো মুসলমান সমাজ। তাদের লক্ষ্য হিন্দু রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। মুসলমানদের তারা দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসেবে দেখে। এই আক্রমণ যাতে রাজনৈতিক হিন্দুরা খুব ভালোভাবে ভোটের আগে শানাতে পারে, তার সুবিধা করে দিতে আসরে নেমে পড়েছেন মমতা। কারণ, কোভিড ১৯ জনিত লকডাউনে গোটা সঙ্ঘ পরিবার মুসলমান সমাজের বিরুদ্ধে যে ভয়ংকর রকমের কুৎসা করে গেল, তার মোকাবিলা তো দূরের কথা, বিরুদ্ধতা করে পর্যন্ত একটা শব্দ মমতা উচ্চারণ করেননি। এই অবস্থার ভিতরেই আমফানজনিত বিপর্যয়ে মমতার দলের সর্বস্তরের লোকেদের ত্রাণ লুঠ ঘিরে গোটা বাংলার জনসমাজের মতোই মুসলমান সমাজের ভিতরেও যথেষ্ট প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে। যে দৃশ্য মমতার গত দশ বছরে প্রায় দেখাই যায়নি, আমফানজনিত সঙ্কটের পর তাইই আমরা দেখলাম। মুসলমান জনবসতি বেশি এমন অঞ্চলে মমতা প্রশাসনের চরম গাফিলতি এবং শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেসের চরম ত্রাণ দুর্নীতির বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষ বিডিও অফিসে চড়াও হচ্ছেন। ঘেরাও করছেন বিডিও অফিস। এই ঘটনা নিঃসন্দেহে আতঙ্কিত করেছে মমতাকে।মুসলমান সমাজের একটা বড় অংশের ক্ষোভের ফসল যাতে যথেষ্ট দক্ষতার সঙ্গে ভোটবাজারে ঘরে তুলতে পারে বিজেপি, তাইই এই আকালের বাজারেও প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতার পসরাকে অত্যন্ত সুন্দরভাবে সাজিয়ে বাজারে অবতীর্ণ হয়েছেন মমতা।

কয়েকদিন আগে মাদ্রাসা সহ সংখ্যালঘুদের উন্নয়নে ৪০১৬ কোটি টাকা বরাদ্দ ঘোষণা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি। সংখ্যালঘু উন্নয়ন ঘিরে মমতার ভন্ডামোর এটা একটি উদাহরণ। কলকাতা কর্পোরেশনে বামফ্রন্টের আমলে ২০০৮ সালে মোট কর্মী ছিলেন ৩৪৭৩১ জন। তাঁদের ভিতর মুসলমান পুরুষ ছিলেন ১৫৫৫ জন। মোট কর্মীর ৪.৫%। মুসলমান মহিলা ছিলেন ১৩৬ জন।

মমতার আমলে ২০১৫ সালে সেখানে মোট কর্মী ছিলেন ২৭১২৫ জন। মুসলমান কর্মী ১৩০১ জন। শতাংশের হিশেবে ৪.৮%। বামফ্রন্টের আমল থেকে .৩ শতাংশ মুসলমান কর্মীর সংখ্যার যে বৃদ্ধি — সেটি মোট কর্মী সংখ্যা হ্রাসের দরুন। সেখানে মুসলমান নারীর সংখ্যা ১৪৯ জন।

২০১৯ সালে মমতারই আমলে কলকাতা কর্পোরেশনে মোট কর্মীর সংখ্যা ২১৮৮৫ জন (বামফ্রন্টের আমলের নিরিখে কিভাবে কর্মী সংকোচন হচ্ছে, পাঠক দেখুন)। মুসলমান কর্মীর সংখ্যা তার ভিতরে ১১২৬ জন। মোট কর্মীর শতাংশের হিসেবে ৫.২%। এই শতাংশের বৃদ্ধিটাও মোট কর্মী সংকোচনের ফলেই। মুসলিম কর্মরত নারীর সংখ্যা মাত্র ১৩৬।

তাহলেই ভাবুন — কেমন মুসলমান সমাজের উন্নতি করছেন মমতা!! এই উন্নতির সুফল বিজেপি রাজনৈতিকভাবে কিরকম উপলব্ধি করছে — তাও ভাবুন বন্ধু।

বামফ্রন্টের আমলে কলকাতা পুলিশে মোট কর্মী ছিলেন ২৪৮৪০ জন। তার ভিতর ২২৬৭ জন ছিলেন মুসলমান। অর্থাৎ, ৯.১৩% ছিলেন মুসলমান। মুসলিম নারী ছিলেন ১২ জন।

মমতার আমলে ’১৫তে মোট কর্মীর সংখ্যা হয় ২৭৩৮৮ জন। মুসলমান কর্মীর সংখ্যা হয় ২৫৮৫ জন ৯.৪%। কোনো মুসলিম নারী তখন কলকাতা পুলিশে কর্মরত ছিলেন না।

’১৯-এ মোট কর্মীর সংখ্য হয় ২৫৯৯৪ জন। তাঁদের ভিতরে মুসলমান কর্মী হলেন ২৮৯৭ জন, অর্থাৎ ১১.১৮%। মোট কর্মীর ভিতরে মহিলা মাত্র ৫৮ জন।

ভাবুন মমতার মুসলমানদের জন্যে কর্মসংস্থান ঘিরে প্রচারের বাস্তবতা। মমতা, বাম আমলে মুসলমানদের প্রতি বঞ্চনার কথা বলেন, এই বলার ক্ষেত্রে সাচার কমিশনের প্রতিবেদনকেও একটা সময়ে ব্যবহার করতেন, সেই মমতার দশ বছরের শাসনকালের শেষে সরকারি চাকরিতে মুসলমানেরা কোন্‌ অবস্থানে আছেন?

২০১০-১১ আর্থিক বছরে বামফ্রন্ট সরকার যখন বিদায় নেয়, সেই মুহূর্তে সরকারি চাকরিতে মুসলমানের অংশগ্রহণের শতকরা হার ছিল ৫.১৯%। পরবর্তী ২০১২- ১৩ আর্থিক বছরে এই হার ছিল; ৫.২৮%। মমতা ক্ষমতায় আসার প্রথম বছর সরকারি চাকরিতে মুসলমানের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পায় মাত্র .৯%। প্রশ্ন হলো যিনি বামফ্রন্টের আমলে মুসলমান বঞ্চনার অভিযোগকে ব্যবহার করলেন ক্ষমতা দখলের উদ্দেশে, তিনি ক্ষমতায় এসে, বিজেপি’কে শক্তিশালী করতে ইমাম ভাতা ঘোষণার মতো প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতার আমদানি ঘটালেও, সরকারি চাকরিতে মুসলমানের নিয়োগের ক্ষেত্রে এক বছর সময়কালে বামেদের আমলের তুলনায় মাত্র ১% বৃদ্ধিও ঘটাতে সক্ষম হলেন না।

২০১৩-১৪ আর্থিক বছরে রাজ্য সরকারের মোট কর্মীদের ভিতরে মুসলমানের অংশগ্রহণের শতকরা হার হলো ৫.৪৭%। মমতা ক্ষমতাসীন হওয়ার দ্বিতীয় বছরে সরকারি চাকরিতে মুসলমানের অংশগ্রহণ বামেদের শেষ বছরের তুলনায় বৃদ্ধি পেল মাত্র.২৮%, মমতার প্রথম বছরের শাসনকালের থেকে মাত্র .১৯% বেশি। অর্থাৎ, দ্বিতীয় বছরেও মমতা বাম আমলের তুলনায় তাঁর শাসনকালে সরকারি চাকরিতে মুসলমানের অংশগ্রহণ শতকরা ১%ও বৃদ্ধি করতে পারলেন না।

২০১৪-১৫ আর্থিক বছরে সরকারি চাকরিতে মুসলমান কর্মচারী শতকরা হিসাব হলো ৫. ৭৩%। অর্থাৎ, বামআমলের তুলনায় মমতার শাসনকালের তিন বছরের মাথাতেও সরকারি চাকরিতে মুসলমানের অংশগ্রহণ মাত্র . ৫৪% বৃদ্ধি পেল।এই তিন বছরেও বৃদ্ধির হার ১% ছুঁতে পারল না।

২০১৫-১৬ আর্থিক বছরে, অর্থাৎ, মমতার প্রথম দফার শাসনকালের শেষ বছরে সরকারি চাকরিতে মুসলমানেদের অংশগ্রহণের শতকরা হার ছিল ৬.০৮%। বামআমলের শেষ বছরের তুলনায় বৃদ্ধি পেল মাত্র.৮৯%। শেষ বছরেও এই বৃদ্ধির হার ১% হলো না।তাহলেই বুঝুন, মুসলমান সমাজের জন্যে নিজেকে আত্মনিবেদিত বলে দাবি করা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের শাসনকালে ধর্মীয় আবরণের ভিতর আত্মনিমগ্নে মুসলমান সমাজকে উৎসাহিত করা হলেও, কর্মসংস্থানে মুসলমান সমাজের কি করুণ অবস্থা।

মমতার শাসনকালের অন্তিম পর্যায়ে দার্জিলিঙ জেলাতে সরকারি কর্মচারীদের ভিতর মুসলমান ছিলেন মাত্র ৩.০৩%, কোচবিহারে ৪.০৭%, জলপাইগুড়িতে ৩.৭৫%, উত্তর দিনাজপুরে ৮.৮৫%, দক্ষিণ দিনাজপুরে ৪.১৩%, মালদহে ১১.০৯%, মুর্শিদাবাদে ১৫.৬১%, নদিয়াতে ৫.০৬%, উত্তর চব্বিশ পরগনাতে ৭.০৯%, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনাতে ৫ .৮২%, কলকাতাতে ৫.৩০%, হাওড়াতে ৪.২৪%, হুগলিতে ৪.১০% , পূর্ব মেদিনীপুরে ৩.৬০%, পশ্চিম মেদিনীপুরে ২.৮৬%, বাঁকুড়াতে ৩.১১%, পুরুলিয়াতে ২.৬৬%, বর্ধমানে ৬.৮১%, বীরভূমে ১১.৭১%, আলিপুরদুয়ারে ২.৪৩%। সমস্ত জেলার গড় হিসাব অনুযায়ী সরকারি চাকরিতে মুসলমানেদের অংশগ্রহণের শতকরা গড় মাত্র ৫.৭৩%।

সংখ্যালঘু উন্নয়ন মানে কি কেবল শাসকদলের বৃত্তের ভিতরে থাকা একাংশের ধর্মীয় ব্যক্তিত্বকে তাঁদেরই ওয়াকফের টাকাতে কিছু পাইয়ে দেওয়া? মমতা যে ৪০১৬ কোটি টাকা সংখ্যালঘু উন্নয়নের জন্যে রাজ্য বিধানসভা ভোটের ঠিক মুখে বরাদ্দের কথা ঘোষণা করলেন, মাদ্রাসাগুলির জন্যে ভার্চুয়াল উদ্বোধনের ফোয়ারা ছোটালেন, এইসবের বাস্তবতা কোথায়? রাজ্য বিধানসভার ভোটের আর এক বছরও বাকি নেই। আগামী আর্থিক বছরের জন্যে পূর্ণাঙ্গ বাজেট পেশের অধিকারও বর্তমান রাজ্য সরকারের নেই। এই অবস্থাতে বাজেট বরাদ্দ ব্যতিরেকে মমতার এই বিপুল টাকা ঘোষণা কি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে আবার একটা বড় রকমের ধোঁকা দেওয়ার চেষ্টা নয়?

মাদ্রাসা নিয়ে অনেক কিছু ঘোষণা করেছেন মমতা। মাদ্রাসা সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে মাদ্রাসাতে নিয়োগ ঘিরে দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্ট বেশ কিছুদিন হয়ে গেল যে আদেশ দিয়েছেন, সেটির প্রয়োগ ঘিরে আজ পর্যন্ত কি অবস্থান নিয়েছেন মমতা? তিনি তো মুখ্যমন্ত্রীত্বের পাশাপাশি সংখ্যালঘু উন্নয়ন দপ্তরেরও মন্ত্রী। সুতরাং, মাদ্রাসা নিয়ে আবার নতুন করে গালগপ্পের উপস্থাপনা করবার আগে মাদ্রাসা সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হাজার হাজার আর্থিক অসহায় ছেলেমেয়ের ভবিষ্যৎ কি হবে— এ নিয়ে স্পষ্ট কিছু ঘোষণা আজ পর্যন্ত কেন মুখ্যমন্ত্রী করতে পারছেন না?

মাদ্রাসা শিক্ষাতে যে বিজ্ঞানমুখী আধুনিকতা এনেছিল বামফ্রন্ট সরকার, তা ভারতের আঙ্গিককে অতিক্রম করে গোটা আরব দুনিয়ার পর্যন্ত দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল।ধর্মনিরপেক্ষ আঙ্গিকে, আধুনিক বিজ্ঞানমনষ্কতায় মাদ্রাসা শিক্ষাকে মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিকের সমতুল্য করে, মাদ্রাসা বোর্ড থেকে পাশ করা ছাত্রছাত্রীদের পেশা জীবনের সর্বাঙ্গীণ স্তরে প্রতিষ্ঠা পাবার সুযোগ তখন ছিল।

সেই গোটা কার্যক্রম গত দশ বছরে মমতার শাসনকালে প্রায় ধ্বংস। মাদ্রাসা শিক্ষাতে ধর্মনিরপেক্ষ কাঠামো ধ্বংসপ্রাপ্ত। সময়ের নিরিখে পাঠক্রমের কোনো আধুনিক বিজ্ঞানমনষ্ক সংস্কার হয়নি। সরকার অনুমোদিত মাদ্রাসার থেকে অঅনুমোদিত, খারিজি মাদ্রাসার প্রতিই মুখ্যমন্ত্রী তথা গোটা রাজ্য সরকারের বেশি ঝোঁক। বামফ্রন্টের আমলে কিদোয়াই কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী মাদ্রাসা শিক্ষাতে যে বিজ্ঞানমনষ্ক আধুনিকতা আনা হয়েছিল তা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে বিগত দশ বছরে। আধুনিক প্রযুক্তিবিজ্ঞানের সুযোগ নিয়ে কারিগরি শিক্ষা অর্জন করে মুসলমান সমাজে কর্মসংস্থানের বিষয়টি, আধুনিক স্বাস্থ্যবিধি পালনের বিষয়— এইসবগুলি যাতে অনেক বেশি জনপ্রিয় হয়, সেদিকে রাজ্য সরকারের এতোটুকু নজর নেই। বরং আধুনিক শিক্ষার বদলে কেবলমাত্র ধর্মীয় শিক্ষার নিগড়েই যাতে আবদ্ধ থাকে মুসলমান সমাজ, মমতা সেই কাজটিই গত দশ বছরে যত্ন নিয়ে করে গেলেন।


কৃতজ্ঞতাঃ
মহম্মদ সেলিম (প্রাক্তন সাংসদ)
সাবির আহমেদ (প্রতীচী ট্রাস্ট)