৫৭ বর্ষ ৪৫ সংখ্যা / ৩ জুলাই ২০২০ / ১৮ আষাঢ় ১৪২৭
ভারতে কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠার শতবর্ষ
স্বাধীনতার লড়াই থেকে দেশভাগ কমিউনিস্টদের অবস্থান দেশপ্রেমিক
সুপ্রতীপ রায়
আমাদের দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে কমিউনিস্টদের উজ্জ্বল ভূমিকা চাপা দেওয়ার হীন প্রচেষ্টা আজও চলছে। বিজেপি শাসনে এই প্রবণতা আরও বেড়েছে। রুশ বিপ্লব ভারতবর্ষের বিপ্লবীদের অনুপ্রাণিত করেছিল। সাম্যবাদী মতাদর্শ অনেকেই গ্রহণ করেন। কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠার পর থেকে ব্রিটিশ উপনিবেশবাদী শাসনের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা সংগ্রামে, স্বাধীনতা লাভে, দেশবিভাগের প্রশ্নে সব ক্ষেত্রেই কমিউনিস্ট পার্টির ভূমিকা ছিল খাঁটি দেশপ্রেমিকের।
এদেশে ব্রিটিশ-বিরোধী লড়াইয়ে ভগৎ সিং, চন্দ্রশেখর আজাদ, বটুকেশ্বর দত্ত, শুকদেব, রাজগুরু প্রমুখ’র অবদান চিরস্মরণীয়। ১৯২৪ সালে যোগেশচন্দ্র চ্যাটার্জি ও শচীন্দ্রনাথ সান্যালের উদ্যোগে গড়ে উঠেছিল হিন্দুস্থান রিপাবলিকান অ্যাসোশিয়েশন (এইচআরএ)। ১৯২৫ সালের ১ জানুয়ারি এই সংগঠনের পক্ষ থেকে The Revolutionary নামে একটি পুস্তিকা প্রকাশিত হয়। এই পুস্তিকায় সমাজতন্ত্র কথাটির উল্লেখ ছিল। যদিও সমাজতন্ত্র সম্পর্কে এইচআরএ-এর ধ্যানধারণা খুব স্পষ্ট ছিল একথা বলা যাবে না।
১৯২৫ সালের ৯ আগস্ট কাকোরি ট্রেন ডাকাতির ফলে এইচআরএ-এর প্রায় সমস্ত নেতৃত্বই গ্রেপ্তার হন বা আত্মগোপন করেন। গড়ে ওঠে হিন্দুস্থান সোশ্যালিস্ট রেভোলিউশনারি পার্টি (এইচএসআরপি)। এই সংগঠনের পক্ষ থেকে প্রকাশিত একটি দলিলে কমিউনিস্ট মতাদর্শ গ্রহণের কথা বলা আছে। সংগঠনটির অপর নাম ছিল হিন্দুস্থান সোশ্যালিস্ট রিপাবলিকান আর্মি।
সাম্যবাদী চিন্তার দিক থেকে এইচআরএ-এর থেকে এইচএসআরএ-র চিন্তাভাবনা অনেক অগ্রসর ছিল। ১৯২৯ সালের ডিসেম্বর মাসে এইচএসআরএ-র পক্ষ থেকে প্রকাশিত ‘The Philosophy of the Bomb’ নামক একটি পুস্তিকা থেকে সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারার পরিচয় মেলে। এক্ষেত্রে উল্লেখ্য, এইচএসআরএ স্বাধীন ভারতে একটি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও শ্রেণীহীন সমাজ প্রতিষ্ঠাই লক্ষ হিসাবে ঘোষণা করেছিল। প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখি, ১৯৭০ সালে কংশালদের আক্রমণে নিহত শহিদ হাওড়া জেলার প্রবীণ কমিউনিস্ট নেতা কমরেড জীবন মাইতি এইচএসআরএ থেকেই কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে এসেছিলেন।
জাতীয় মহাফেজখানায় রাখা ব্রিটিশ সরকারের বিভিন্ন গোপন দলিল থেকে জানা যায়, ব্রিটিশ কংগ্রেসের থেকে কমিউনিস্টদের বেশি বিপদ বলে মনে করত। এই কারণে কমিউনিস্টদের বিরূদ্ধে বারেবারে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ ব্রিটিশরা এনেছিল। ১৯৩৪ সালে কমিউনিস্ট পার্টিকে বেআইনি ঘোষণা করা হয়েছিল। ১৯৩৫ সালে কমিউনিস্ট পার্টির কলকাতা কমিটি এবং কমিউনিস্ট পার্টির বিভিন্ন গণসংগঠনকে নিষিদ্ধ করা হয়। কমিউনিস্ট আতঙ্কে ব্রিটিশ এতটাই ভীত ছিল যে, ১৯৩৬ সালের ২৪ নভেম্বর কলকাতার বিভিন্ন স্থান থেকে ৩৬ জন কমিউনিস্ট কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং তাদের বিরূদ্ধে “কলকাতা কমিউনিস্ট ষড়যন্ত্র মামলা” দায়ের করা হয়। এছাড়া আরও ১৪ জন কমিউনিস্ট কর্মীকে গ্রেপ্তার করে “চেতলা (কলকাতা) রেড গার্ড কেস”রুজু করা হয়। তৎকালীন সময়ে বিভিন্ন সংবাদপত্রে কমিউনিস্ট-বিদ্বেষী প্রচার করা হতো। ১৯৩৬ সালের ১২ জুন “The Statesman” পত্রিকায় এ ধরনের একটি খবরের শিরোনাম ছিল—“Red” Agents in Indian Villages : Recruits From Terrorist : Grave Situation : Armed uprising Aimed.
ত্রিশের দশকের শেষের দিকে কমিউনিস্টদের কাজের মধ্যে ছিল ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতার জন্য আন্দোলন গড়ে তোলা, ১৯৩৫ সালের “দাস সংবিধান”বাতিলের সপক্ষে জনমত তৈরি করা, গণতান্ত্রিক অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার দাবিতে আন্দোলন, “কালাকানুন”প্রত্যাহারের দাবিতে আন্দোলন পরিচালনা, বিনাবিচারে আটক রাজবন্দীদের মুক্তির দাবিতে জনমত গড়ে তোলা, ফ্যাসিবাদের বিপদ সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করে তোলা। বলাবাহুল্য, এগুলি ব্রিটিশের বিরূদ্ধে জনগণকে সংগঠিত করার ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছিল।
সুভাষ চন্দ্র বসুর সঙ্গে কমিউনিস্ট সম্পর্ক নিয়ে বিকৃত, বিদ্বেষমূলক প্রচার করা হয়। কিন্তু ১৯৩৯ সালের জাতীয় কংগ্রেসের ত্রিপুরী অধিবেশনে সুভাষচন্দ্র বসুকে পুনরায় সভাপতি নির্বাচিত করার দাবি “National Front” পত্রিকার মাধ্যমে কমিউনিস্টরাই প্রথম করেন। ১৯৩৯ সালের ২৯ জানুয়ারি কমিউনিস্ট পার্টি সহ বামপন্থীদের সম্মিলিত প্রার্থী হিসাবে সুভাষচন্দ্র বসু পুনরায় সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৩৯ সালের মার্চ মাসে নেতাজির বিরুদ্ধে পন্থ প্রস্তাব আনা হয়। কমিউনিস্টরা এর তীব্র বিরোধিতা করেন। বঙ্কিম মুখার্জি, নীরেন্দু দত্ত মজুমদার প্রমুখ পন্থ প্রস্তাবের বিরূদ্ধে তীব্র ভাষায় আক্রমণ করে বক্তব্য রাখেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর একটার পর একটা গণআন্দোলন ব্রিটিশের ভারত ত্যাগকে নিশ্চিত করেছিল। এই পর্বে কমিউনিস্ট ছাত্রদের বড় ভূমিকা ছিল। কোচবিহারে ছাত্রদের উপর নির্যাতনের প্রতিবাদে ১৯৪৫ সালের ২৯ আগস্ট বঙ্গীয় ছাত্র ফেডারেশনের আহ্বানে কোচবিহার দিবস পালিত হয়। বিপুল পরিমাণে ছাত্র ওয়েলিংটনের প্রতিবাদসভায় অংশ নেন। ওইদিন বাংলার বিদ্যালয়গুলিতে ছাত্র ধর্মঘট পালিত হয়।
ট্রামশ্রমিকদের আন্দোলন আসলে ছিল ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলন। ১৯৪৫ সালের ৯ সেপ্টেম্বর শুরু হয় ট্রাম শ্রমিক ধর্মঘট। এই ধর্মঘটকে সমর্থন জানিয়েছিল ছাত্ররা। ছাত্র ফেডারেশনের কর্মীরা ধর্মঘটের সমর্থনে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে চাঁদা তুলেছিল এবং পথসভা করে। ১৯৪৫ সালের শেষদিকে ইন্দোনেশিয়া, ইন্দোচীন ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ভারতীয় সৈন্য পাঠাবার সিদ্ধান্তের বিরূদ্ধে ১৯৪৫ সালের ২৫ অক্টোবর ‘ইন্দোনেশিয়া দিবসে’ বাংলার ছাত্ররা সংহতি জ্ঞাপন করেছিলেন।
আজাদ হিন্দ ফৌজের বীরসেনানীদের বিচারের নামে প্রহসনের বিরূদ্ধে বাংলার ছাত্ররা গর্জে উঠেছিলেন। ১৯৪৫ সালের ২১ নভেম্বর দিল্লির লালকেল্লায় আজাদ হিন্দ ফৌজের বেশ কিছু অফিসারের বিচারের বিরূদ্ধে কলকাতা শহর কার্যত ব্যারিকেড নগরীতে পরিণত হয়েছিল। দলে দলে ছাত্ররা মিছিলে অংশ নিলেন। ডালহৌসি স্কোয়ারে ছাত্ররা অবস্থান করেন। সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা নাগাদ পুলিশ লাঠিচার্জ করে ও গুলি ছোড়ে। শহিদ হন রামেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায় ও আবদুল সালাম। ছাত্ররা সারারাত অবস্থান করেন। ২২ নভেম্বর শ্রমিক ধর্মঘট হয়। কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে শ্রমিকরা তীব্র আন্দোলনমুখী হয়েছিলেন। শেষপর্যন্ত পুলিশ হার স্বীকার করে। ১৯৪৫ সালে চট্টগ্রামে ছাত্র ফেডারেশনের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলন থেকে সাম্রাজ্যবাদের বিরূদ্ধে ‘শেষ আঘাত হানার’ এবং ‘শেষ আঘাত হানা’র জন্য ছাত্রসমাজকে প্রস্তুত থাকার প্রস্তাব গৃহীত হয়। সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন সত্যপাল ডাং কাহার। মিলিটারি অত্যাচারের প্রতিবাদে ১৫ জানুয়ারি কলকাতাতে ছাত্র ধর্মঘট পালিত হয়। ওয়েলিংটনে প্রতিবাদ সমাবেশ হয়। বক্তব্য রাখেন ছাত্র ফেডারেশনের অন্নদাশঙ্কর ভট্টাচার্য, গৌতম চট্টোপাধ্যায়, কমলাপতি রায় প্রমুখ।
সমসাময়িক সময়ে বিড়লা ভবনে কেশোরাম সূতাকলের সত্যাগ্রহী ৩২ জন শ্রমিককে গ্রেপ্তারের বিরূদ্ধে ছাত্ররা আন্দোলনে শামিল হয়। কৃষ্ণনগর সরকারি কলেজের ছাত্ররা কলকাতার হত্যাকাণ্ডের নায়ক মিঃ কেসির শতবার্ষিকী উদ্বোধন অনুষ্ঠান বয়কট করেন।
১৯৪৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ক্যাপ্টেন রসিদ আলির বিচার শুরু হয়। এর বিরূদ্ধে বঙ্গীয় ছাত্র ফেডারেশন, মির্জাপুরী ছাত্র ফেডারেশনের ডাকে দশ হাজার ছাত্রের মিছিল হয়। মিছিল ওয়েলিংটনে পৌঁছালে পুলিশ লাঠিচার্জ করে। রাস্তায় ছাত্র-পুলিশ খণ্ডযুদ্ধ চলতে থাকে। পুলিশের গুলিতে নিহত হন কদম রসুল, মনোরঞ্জন গুহ প্রমুখ। কমিউনিস্ট পার্টি আপসহীন লড়াই চালাতে থাকে।
১৯৪৬ সালের জুন-জুলাই মাসে দীর্ঘমেয়াদী কারাদণ্ডে দণ্ডিত বিপ্লবী রাজবন্দীদের মুক্তির দাবিতে ছাত্ররা আন্দোলনে শামিল হন। ২৪ জুলাই বন্দীমুক্তি কমিটি ও ছাত্র ফেডারেশনের যৌথ আহ্বানে এক বিশাল মিছিল আইনসভায় প্রবেশ করে। ওই বছর ২৯ জুলাই ডাক-তার ধর্মঘট শুরু হয়। ধর্মঘটী কর্মীদের সমর্থনে ছাত্র ফেডারেশন সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করে।
সাম্রাজ্যবাদের বিরূদ্ধে জনমত সংগঠিত করার ক্ষেত্রে ছাত্র ফেডারেশন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। ১৯৪৭ সালের প্রথম দিকে হ্যানয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা এশিয়ার ছাত্রদের কাছে আহ্বান জানিয়ে বলেছিল-ফরাসি সাম্রাজ্যবাদের বিরূদ্ধে ভিয়েতনামের মুক্তিযোদ্ধাদের পাশে দাঁড়াতে। এই আহ্বানে সাড়া দিয়ে ১৯৪৭ সালের ২১ জানুয়ারি বঙ্গীয় ছাত্র ফেডারেশন ‘ভিয়েতনাম দিবস’ পালনের আহ্বান জানায়। ছাত্ররা দাবি জানিয়েছিল-দমদম বিমানবন্দর দিয়ে ফরাসি বিমান চলাচল বন্ধ করতে হবে। এস এ ডাঙ্গে, বি টি রণদিভে প্রমুখ ফরাসি জাহাজগুলি (যেগুলি ভিয়েতনামের উদ্দেশে যাচ্ছে) বয়কটের আহ্বান জানালেন।
২১ জানুয়ারি ঘটল মর্মান্তিক ঘটনা। ওইদিন কলকাতায় ছাত্রমিছিলের উপর পুলিশ নির্বিচারে গুলি চালায়। শহিদ হন ছাত্র ধীররঞ্জন, সুখেন্দুবিকাশ। ১৯ জন গুলিবিদ্ধ হন, ৫০ জন লাঠির আঘাতে আহত হন, দু’শতাধিক ছাত্র গ্রেপ্তার হন। এই নারকীয় তাণ্ডবের বিরূদ্ধে পরেরদিন সারা বাংলায় ছাত্র ধর্মঘট হয়। প্রায় ১ লক্ষ ২০ হাজার মানুষের সমাবেশ হয়। ভিয়েতনামের সমর্থনে ছাত্রদের লড়াই সারা বাংলায় ছড়িয়ে পড়ে। মৈমনসিংহে বিরাট ছাত্র মিছিল হয়। মিছিলের উপর পুলিশ গুলি চালায়। পুলিশের গুলিতে প্রাণ যায় ছাত্র অমলেন্দু ঘোষ, অনিতা বসুর। আন্দোলন বরিশাল, চট্টগ্রাম, শ্রীহট্ট, ব্যাঙ্গালোর, পন্ডিচেরী, বোম্বে, দিল্লিতে ছড়িয়ে পড়ে। ৫ ফেব্রুয়ারি সফল সাধারণ ধর্মঘট পালিত হয়।
নৌসেনা বিদ্রোহ ও আজাদ হিন্দ ফৌজের বীরসেনানীদের মুক্তির দাবিতে, বিচারের নামে প্রহসনের বিরূদ্ধে ব্রিটিশ-বিরোধী গণআন্দোলনে ব্যাপক অংশের জনগণকে শামিল করেছিল কমিউনিস্টরা। ১৯৪৬ সালে ১৮ ফেব্রুয়ারি বোম্বাইতে এই বিদ্রোহ শুরু হয়। বোম্বাই ও করাচির পর কলকাতা ছিল নৌধর্মঘটের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। ১৯ ফেব্রুয়ারি কলকাতায় এই বিদ্রোহ শুরু হয়। বোম্বাইয়ের আগুন নিভে যাওয়ার পরও কলকাতায় ধর্মঘট চলতে থাকে। শহিদ হন কমিউনিস্ট ছাত্র কর্মী কমল দোণ্ডে। ২৩ ফেব্রুয়ারি ছাত্র ফেডারেশনের ডাকে ছাত্র ধর্মঘট পালিত হয়। কলকাতার রাজপথে নৌবিদ্রোহীদের সমর্থনে ছাত্র-শ্রমিকদের ঐতিহাসিক মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। ওয়েলিংটনের সমাবেশে বক্তব্য রাখেন গৌতম চট্টোপাধ্যায়, কমলাপতি রায় প্রমুখ। সমাবেশে গুলি চলে। নিহত হন ছাত্র দেবব্রত, রত্না। আহত হন ছাত্র মোহিত।
বোম্বাইয়ে বিমানবাহিনীর উপর পুলিশি অত্যাচারের প্রতিবাদে ডালহৌসি স্কোয়ারে ভারতীয় বিমান বাহিনীর ১৫০ জন ব্যক্তি অনশন ধর্মঘট শুরু করেন ২২ ফেব্রুয়ারি। ২২ ফেব্রুয়ারি করাচী ও বোম্বাইয়ে বিক্ষুব্ধ জনতার উপর গুলিচালনার বিরূদ্ধে কলকাতার বিভিন্ন বিদ্যালয়ে ছাত্র ধর্মঘট হয়। কলকাতায় বেশ কয়েকটি জায়গায় ছাত্ররা ট্রাম অবরোধ করেন।
২২ ফেব্রুয়ারি বিপিএসএফ-র ডাকে শ্রদ্ধানন্দ পার্কে এক বিশাল সমাবেশে বিশ্বনাথ মুখার্জি সহ কমিউনিস্ট নেতৃত্ব বক্তব্য রাখেন। ২৩ ফেব্রুয়ারি ওয়েলিংটন স্কোয়ারে, কলেজ স্কোয়ারে, হাজরা পার্কে, দেশপ্রিয় পার্কে ছাত্র সমাবেশ হয়। ২৩ ফেব্রুয়ারি কলেজ স্কোয়ারে বিপিএসএফ ব্রিটিশ দমননীতির বিরূদ্ধে সমাবেশ করে। ওই একইদিনে নৌরেটিংদের পক্ষেও সমস্ত বিমানবাহিনীর উপর ব্রিটিশ পুলিশী অত্যাচারের বিরূদ্ধে কর্ণওয়ালিশ স্কোয়ারে, ওয়েলিংটন স্কোয়ারে বিশাল ছাত্র সমাবেশ হয়।
নৌবিদ্রোহের সমর্থনে ২৩ ফেব্রুয়ারি কলকাতা ও শহরতলীতে লক্ষাধিক শ্রমিক ধর্মঘটে অংশগ্রহণ করেন। আজাদ হিন্দ ফৌজের দেশপ্রেমিক নের্তত্বের লালকেল্লায় কোটমার্শালের বিরূদ্ধে ও নৌ সেনাবিদ্রোহকে কেন্দ্র করে ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলনে কমিউনিস্টরা ছিল সামনের সারিতে। ১৯৪৫ সালের ডিসেম্বর মাসে সিপিআই কেন্দ্রীয় কমিটি “নতুন পরিস্থিতি ও আমাদের কাজ” শীর্ষক যে দীর্ঘ প্রস্তাবটি গ্রহণ করে তার ভূমিকাতে বলা হয়েছিল: “এখনই, যে কোনো উপায়ে ইংরাজদের রাজনৈতিক ক্ষমতা থেকে মুক্তি পাওয়ার আগ্রহ আমাদের জনগণের সবচেয়ে বড় ও একাগ্র ইচ্ছা রূপে দেখা দিয়েছে। তারা রাজনৈতিক নেতৃত্বে প্রত্যাশায় অধীর। কিন্তু দেশের প্রধান রাজনৈতিক সংগঠনগুলি— কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ, ইংরাজ সরকারের সঙ্গে এককভাবে বোঝাপড়ায় আসতে চেষ্টা করছে।”
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর কমিউনিস্ট পার্টি - ভারতের স্বাধীনতার জন্য চূড়ান্ত ও ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের ডাক দেয়। ক্যাবিনেট মিশন ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য আলোচনার উদ্দেশে ভারতে আসে। কমিউনিস্ট পার্টি মিশনের সামনে তার বক্তব্য উপস্থিত করে। ১৯৪৬ সালের এপ্রিল মাসে পি সি যোশী ক্যাবিনেট মিশনকে যে স্মারকলিপি প্রদান করেন তার নির্যাস ছিল : “স্বাধীনতার ঘোষণা চাই, অবিলম্বে দেশের জনগণের একান্ত ইচ্ছা অনুসারে তাদের অর্থনৈতিক দুর্গতি ও রাজনৈতিক পরাধীনতার অবসান ঘটাতে হবে, অবিলম্বে স্বাধীনতার ঘোষণা করতে হবে।’’
উপরিউক্ত স্মারকলিপিতে কমিউনিস্ট পার্টি দাবি করেছিল - (১) সমস্ত ধরনের রাজনৈতিক বন্দীদের অবিলম্বে মুক্তি দিতে হবে, (২) নৌ ও বিমানবাহিনীর সমস্ত বন্দীকে মুক্তি দিতে হবে, (৩) যে রাজনৈতিক দলকে বেআইনি ঘোষণা করা হয়েছে তা প্রত্যাহার করতে হবে, (৪) আজাদ হিন্দ ফৌজের আটক বন্দীদের অবিলম্বে মুক্তি দিতে হবে।
১৯৪৬ সালে পি সি যোশী “ক্ষমতার লক্ষ্যে শেষ সংগ্রাম” শীর্ষক নিবন্ধে লিখেছিলেন: “ভারতে স্বাধীনতা লাভ সমীপবর্তী হয়ে উঠেছে। দুনিয়াজুড়ে মুক্তিকামী মানুষ জাতীয় স্বাধীনতার জন্য সংগ্রামরত। দেশের মধ্যেও বিদেশি শাসনের বিরুদ্ধে ঘৃণাও ব্যাপক পুঞ্জিভূত হয়েছে। সাম্রাজ্যবাদীরাও সেটা বিলক্ষণ বোঝে ও জানে। যে নীতি কৌশলে তারা এতকাল দেশ শাসন করে এসেছে সেগুলি অচল। ব্রিটেনের টোরি, লেবার ও লিবারেল সব দলই ভারতের স্বাধীনতা সম্পর্কে কোনো দ্বিমত পোষণ করে না। আর কোনো মোহ পোষণ করে না যে, এই দেশে তারা আরও অনেকদিন ক্ষমতা বজায় রাখতে পারবে। তাই ভারতের মানুষদের দেশপ্রেমিক কর্তব্য হলো এক জোটে এই স্বাধীনতা ত্বরান্বিত করার জন্য কাজ করা।’’
স্বাধীনতার লাভের পূর্ববর্তী দু’বছরের গণআন্দোলন, ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলনের অগ্রভাগে কমিউনিস্টরা ছিল। কিন্তু ১৯৪৬ থেকে ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট পর্যন্ত রাজনীতিতে জাতীয় কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের ভূমিকা নিয়ে যত আলোচনা হয় কমিউনিস্ট পার্টির ভূমিকা নিয়ে তত আলোচনা হয় না। কমিউনিস্ট পার্টি দেশপ্রেমিক ছিল। কমিউনিস্ট পার্টি সাম্রাজ্যবাদের বিরূদ্ধে মিলিত সংগ্রামের কথা বলেছিল। তীব্র বিরোধিতা করেছিল জাত্যভিমান, সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদের। তাই কমিউনিস্টদের সম্পর্কে কটুক্তি, নিন্দা, চক্রান্ত— সবই হয়েছে।
“বলাবাহুল্য কমিউনিস্ট পার্টির এই বক্তব্য কংগ্রেস বা লীগ কোনো নেতৃত্বেরই মনঃপূত ছিল না। তদানীন্তন বড়লাট ওয়াভেলের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের স্বরাষ্ট্র দপ্তরের ভারপ্রাপ্ত সদস্য সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল কমিউনিস্ট পার্টির বিরূদ্ধে তখন সবরকমের দমনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের পক্ষপাতী ছিলেন। ওয়াভেলের সঙ্গে ১৫ জানুয়ারি ১৯৪৭-এর সাক্ষাৎকারে তিনি মত প্রকাশ করেন। তিনি স্বীকার করেন, এই পার্টিতে বহু শিক্ষিত ও বিশিষ্ট পরিবারের অনেক সদস্য আছেন। কিন্তু তারা দেশজুড়ে নানা আন্দোলন, ধর্মঘট প্রভৃতি করে অরাজকতা সৃষ্টি করছে যা রাজনৈতিক আলাপ আলোচনা চালাবার অন্তরায়। সুতরাং পার্টিকে অবৈধ ঘোষণা করা দরকার। এরই একদিন আগে ওয়াভেলের শাসন পরিষদে শ্রমদপ্তরের ভারপ্রাপ্ত সদস্য জগজীবন রাম করাচী, কইম্বাটুর, কানপুর ও অন্যত্র ব্যাপক ধর্মঘটের জন্য কমিউনিস্টদের দায়ী করে আসেন। তার মতে কমিউনিস্টরা ক্রমাগত রাজনৈতিক আন্দোলনকে বিস্তৃত করতে চাইছে।” (সূত্র: জাতীয় আন্দোলনের শেষ পর্যায়: কংগ্রেস ও কমিউনিস্ট পার্টি—বাসব সরকার। ইতিহাস অনুসন্ধান (৩৬)।
শক্তির বিচারে কমিউনিস্ট পার্টি ছিল দূর্বল। কিন্তু কমিউনিস্ট পার্টি তার সীমিত ক্ষমতা নিয়ে যে প্রচার ও আন্দোলন চালায় তার মধ্যে দেশবিভাগ এড়িয়ে যাওয়ার আন্তরিক প্রচেষ্টা ছিল। কমিউনিস্টদের এই মনোভাব প্রকাশ পায় ১৯৪৬ সালের নির্বাচনী ইশ্তিহারে। ইশ্তিহারে আহ্বান ছিল: “ভারতীয়রা ভারতীয়দের বিরুদ্ধে লড়বে না, একজোটে তাদের লড়তে হবে প্রভুত্বকারী ইংরাজদের বিরূদ্ধে”।
আরও বলা হয়েছিল: “ইংরাজরা বিভেদনীতি প্রয়োগ করে দেশকে পরাধীন করেছে এবং প্রায় দুশ বছর শাসন করছে। ভারতে তাদের সার্বভৌম ক্ষমতা শেষ হওয়ার মুখে বুঝেই তারা পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে একটা হিন্দু ও আরেকটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ট ডোমিনিয়ন গঠন করতে চায়। এটাই হলো আমাদের মাতৃভূমিকে ভেঙ্গে নতুন ধরনের দাসত্ব বজায় রাখার চতুর পরিকল্পনা...”।