৫৭ বর্ষ ৪৫ সংখ্যা / ৩ জুলাই ২০২০ / ১৮ আষাঢ় ১৪২৭
কোভিড ১৯ ও ভারতের রাজনৈতিক-অর্থনীতি
ঈশিতা মুখার্জি
অতিমারী কোভিড ১৯ পৃথিবীজুড়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। ওয়াশিংটন কনসেন্সাস উত্তর নয়া-উদারীকরণ আমাদের দেশে এমন এক অর্থনীতির জন্ম দিয়েছে যার ভিত্তিটাই লুঠ। এই পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের দেশ যখন আক্রান্ত হলো, তখন কি ধরনের অর্থনীতির চাপানউতোর আমরা দেখছি? কেন আজ আমাদের দেশ কোভিডের ফলে এতটাই অর্থনৈতিকভাবে মুখ থুবড়ে পড়ল যে, জাতীয় উৎপাদন বৃদ্ধির হার নিম্নগামী থেকে কবে উপরে উঠবে তা কেউ জানে না ? দেশে প্রধানমন্ত্রী চার ঘণ্টার মধ্যে লকডাউন ঘোষণা করেন। সারা পৃথিবীতে আমাদের এই লকডাউন বলা হয় খুব কড়া ধাঁচের। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে লকডাউনের কঠোরতার সূচক তৈরি করেছে। তাতে আমাদের দেশ সবচেয়ে উপরে। ওদিকে ক্ষুধার নিরিখেও আমাদের দেশে এই লকডাউনের ফলে ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা হুহু করে বাড়ছে। নিউ ইয়র্ক টাইমস একটি প্রতিবেদনে জানিয়েছে যে, পৃথিবীতে ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা এই বছরের শেষে দ্বিগুণ হয়ে হবে ২৬.৫ কোটি। এমনিতেই ২০১৯ সালে বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে ভারত ১১৭ টি দেশের মধ্যে ছিল ১০২ তম স্থানে। লকডাউনের ফলে কাজ হারিয়ে ক্ষুধায় মৃত্যু লকডাউনের প্রথম ধাপেই কোভিডের মৃত্যুর সাথে পাল্লা দিয়ে চলছিল। কি হলো ভারতে? কোভিড এবং লকডাউনের চিত্রায়ন করতে বললে একটি ছোট শিশুও যে ছবি আঁকবে তা কোভিডের সঙ্গে ভারতের ইতিহাসে লেখা হয়ে গেল, তা হলো মাইলের পর মাইল ধরে হেঁটে অসম্মান-অপমান মাথায় করে পরিযায়ী শ্রমিকদের বাড়ি ফিরে আসা। আবারো প্রশ্ন, কি হলো ভারতের অর্থনীতিতে? সরকার তো বলেই খালাস যে সারা বিশ্বে যা হচ্ছে, তারই ফল আমরা ভুগছি এ দেশে। কিন্তু এ দেশের রাজনৈতিক-অর্থনীতি কি পথে চলছে?
দেশে নয়া-উদারীকরণের অর্থনীতি লুঠেরা পুঁজিবাদ এনেছে। এই লুঠ দেশের মধ্যে এনেছে চরম আর্থিক বৈষম্য। এনেছে বেকারি, যা গত ৪০ বছরের রেকর্ড। এনেছে কর্পোরেটচালিত পুঁজির রমরমা। গুটিয়ে নিয়েছে সরকারি ব্যয়। তাহলে এই অর্থনীতি অতিমারীর মোকাবিলা করবে কি করে? তাই যা হওয়ার ছিল তাই হয়েছে। এক, সরকারের পক্ষে কোভিড মোকাবিলা করা সম্ভব হয় নি। সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থা বাদ দিয়ে ইতিহাসে কোনো অতিমারী কেন, কোনো মহামারীও কোনো দেশ শামাল দিতে পারে না। কিন্তু এই সরকার তো সরকারি বাজেটকে প্রহসনে নামিয়ে এনেছে কয়েক বছরে। বাজেট হয়ে দাঁড়িয়েছে পিছনের দরজা দিয়ে সরকারি সহায়তায় কর্পোরেটের মুনাফা বাড়ানো। সেখানে কোনরকম জনকল্যাণের কোনো স্থান নেই। তাই সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থায় এমনিতেই প্রাথমিক চিকিৎসা পাওয়া যেত না। এই অবস্থায় অতিমারী সামাল দেওয়া তো দূরের কথা, স্বাস্থ্য সরকারের কর্মসূচির অগ্রাধিকারে নেই। কোভিড এই সত্যকে চোখের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। দুই, এই সত্য চেপে রাখার জন্য সরকার দেশের মানুষের কাছে দুটি বিকল্পের মধ্যে বেছে নিতে বলে—জীবন রাখি না জীবিকা রাখি। ঘরে থাকুন, জীবন থাকবে—সরকার বলল। কিন্তু ঘরে থাকলে কাজ চলে যাবে, জীবিকা কি করে রাখবে মানুষ ? সরকার বলল—এত হবে না, জীবিকা রাখতে গেলে জীবনের দায়িত্ব কেউ নেবে না। বলা হলো, দেশে স্বাস্থ্য এমারজেন্সি চলছে। কিন্তু এই জরুরি পরিস্থিতির সাথে দেশের অর্থনীতির প্রশ্ন তো যুক্ত।
দেশের কোনো জরুরি পরিস্থিতি মানুষের খাওয়া-পরাকে বাদ দিয়ে হতে পারে? এটাই কর্পোরেট শাসনের জরুরি পরিস্থিতির আসল রূপ। মুনাফার এমারজেন্সিই একমাত্র এমারজেন্সি, মানুষের প্রাণের কোনো এমারজেন্সি নেই। এই হলো বর্তমান ভারতের বিধ্বংসী পুঁজিবাদের চেহারা। লুঠ হতে হতে এমন জায়গায় পৌঁছে গেছে যে তা আদৌ আর টিকে থাকবে কি না তা নিয়েই সংশয় দেখা দিয়েছে। পৃথিবীর সব দেশের পরিস্থিতি পর্যালোচনা এটাই শেখায় যে, কোভিডে আক্রান্ত হওয়া যত বাড়বে, অর্থনৈতিক অধোগতি সমান তালে হবে। দুটি আদপেই আলাদা বিষয় নয়। ভারতের তথ্য দেখলেই এই তত্ত্ব বোঝা যায়। কোভিডে আক্রান্তের রেখাচিত্র ঊর্ধ্বগামী। দেশের অর্থনীতিও অধোগামী সমান তালে। অর্থনীতিতে চলে এসেছে মুদ্রাহ্রাস এবং সঙ্কোচন, যা একটি দেশের পক্ষে মারাত্মক। বর্তমানে দেশে পণ্যের পাইকারি মূল্য সূচক কমতে শুরু করেছে, কিন্তু ভোগ্যপণ্যের মুল্য সূচক কমছে না অর্থাৎ ক্রেতার কাছে জিনিষপত্রের দাম কমছে না। অথচ বিক্রেতা দাম পাচ্ছে না। চাহিদা এবং জোগান দুইই বন্ধ থাকার জন্য এই মুদ্রাহ্রাস ঘটছে, যা ভয়ঙ্কর বিপদের ইঙ্গিত দিচ্ছে। আন্তর্জাতিক অর্থ ভাণ্ডার জানিয়েছে যে, ভারতের অর্থনীতি সংকুচিত হবে এবং এই সঙ্কোচন হবে আনুমানিক ৪.৫ শতাংশ যা ঐতিহাসিকভাবে রেকর্ড। কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রীর বক্তৃতা শুনে এই বিপদের কথা বুঝবার উপায় নেই। তার কারণ দেশের সরকারের যারা সহায় সেই কর্পোরেট ভাল আছে। তার মুনাফা হচ্ছে। তার যখন মুনাফা কমতে শুরু করেছিল, তখন লকডাউন তোলার কথা বলা হলো। কথাটা বিশ্বজুড়ে উঠে গেছে। পুঁজিবাদ লকডাউন করে নিজের স্বার্থে, তাই লকডাউন শ্রমজীবী মানুষের পক্ষে আদপেও নয়। যদি লকডাউনের সাথে কোভিড পরীক্ষা এবং জনবসতি বিচ্ছিন্ন করে তাকে রোগমুক্ত করার প্রচেষ্টা না থাকে, তা ব্যবহার করা হয় কর্পোরেটের মুনাফা বাড়ানোর জন্য। সেই লকডাউন পুঁজিপতির স্বার্থে ডাকা হয় এবং তোলা হয়। ড্যানিয়েল টেলার ২৫ মে-এর রেড ফ্ল্যাগ পত্রিকায় লিখলেন –পুঁজিবাদী লকডাউন খারাপ, পুঁজিবাদী লকডাউন তোলা আরও খারাপ। লকডাউনের সময়কে দেশের সরকার ব্যাবহার করল সুযোগ হিসেবে। দেশের মানুষের মুখ বন্ধ করার কাজে। একের পর এক জনবিরোধী বিল পাস হয়ে গেল। পাস হয়ে গেল শ্রমিকস্বার্থ-বিরোধী বিল। কাজের সময় ৮ ঘণ্টা থেকে হতে চলেছে ১২ ঘণ্টা। পেট্রোপণ্যের দাম প্রত্যেক দিন বেড়েই চলেছে। ফলে লকডাউন উঠে গেলে শ্রমজীবী মানুষ যখন কর্মক্ষেত্রে ফিরবে, তখন চরম শোষণের সম্মুখীন হতে হবে। শ্রম কোড বিল পাস হয়ে গেল। ন্যূনতম মজুরি বলে কিছু আর রইল না। ট্রেড ইউনিয়নের স্বাধীনতার উপর এলো চরমতম আঘাত। পরিযায়ী শ্রমিকদের দুরবস্থার কথা নতুন করে বলার কিছু নেই। নয়া-উদারনীতি নিয়ে এসেছিল বিপুল কৃষি সঙ্কট। কৃষকের আত্মহত্যার ঘটনা এই সঙ্কটকে চোখের সামনে এনেছিল। তাই কৃষি ছেড়ে দেশজুড়ে মানুষ কাজের খোঁজে বেড়িয়ে পড়েছিল। আজ থেকে নয়, ২০০৮-০৯ সাল থেকেই। এক রাজ্যে কাজের শেষে অন্য রাজ্যে—এভাবেই মানুষ দিনযাপন করে আসছিলেন। এই ছিল আমাদের দেশের ৯০ শতাংশ ক্যাজুয়াল, ইনফর্মাল, অসংঘটিত শ্রমিকশ্রেণি। এদের শোষণের উপর ভিত্তি করেই আম্বানি-আদানির কর্পোরেট-ভারত মুনাফা লুটেছে। লকডাউন অর্থনীতি যা করল, একই কাজ করেছিল নোটবন্দি, পণ্য পরিষেবা কর। একদিকেই এগিয়েছে এই দেশের রাজনৈতিক-অর্থনীতি। শ্রমিক, কৃষক, সব ধরনের মেহনতি মানুষের উপর চলছে কড়া নজরদারি, এক চুল মুনাফা যাতে না কমে আম্বানি, আদানি, মেহুল চোস্কি, বিজয় মাল্যদের। এদের যেন লকডাউনে শাস্তি মকুব করা হয়। এই নীতিতে সরকারি জনস্বাস্থ্য কোথায় ? তাই লকডাউন উঠছে। বাইরে থেকে আসা কোভিড ছড়িয়ে যাচ্ছে ধারাভির বস্তিতে, পরিযায়ী শ্রমিকদের মধ্যে। এদের চিকিৎসার কোনো ব্যাবস্থা নেই।
কোভিড নয়া-উদারীকরণের পুঁজিবাদের জনবিরোধী পরিচয়গুলি একটি একটি করে চোখের সামনে এনেছে। এই বৈষম্য তো ছিলই। সরকার তাকে চোখের আড়ালে রাখার চেষ্টায় ছিল। কেউ কেউ এই বৈষম্য দেখতেও পেত না। দিনে দিনে দরিদ্রের মধ্যে দরিদ্রতমের অংশ বাড়ছিল। এটা ছিলই। অনাহার, ক্ষুধা ছিলই। বেকারি ছিলই। তার উপরে কোভিড তা আরও বাড়িয়ে তুলেছে এবং এই সমস্যাকে চোখের সামনে এনেছে। জাতীয় উৎপাদন বৃদ্ধির হার কমে যাচ্ছিলই, কোভিড তার মাত্রা বাড়াল। অদৃশ্য এখন দৃশ্যমান। তাই শ্রেণি দ্বন্দ্বও এখন দৃশ্যমান। শ্রমিকশ্রেণির বঞ্চনাও এখন দৃশ্যমান। সরকারের জনকল্যাণের আদৌ কোনো ইচ্ছা নেই, তাও এখন দৃশ্যমান। তাই রাজনৈতিক-অর্থনীতির মৌলিক প্রশ্ন এবং দ্বন্দ্বগুলি আজ দৃশ্যমান। এই চোখের সামনে আসার জন্য কর্পোরেটচালিত রাষ্ট্র ও লুঠেরা-পুঁজিবাদ কিন্তু বসে নেই। তারা আরও আক্রমণ নামিয়ে আনার পরিকল্পনা গ্রহণ করছে। সঠিক অর্থনীতির প্রশ্ন তাই সঠিক রাজনীতির জন্য দেশের মানুষের লড়াই থেকে আলাদা নয়।