৫৯ বর্ষ ৪২ সংখ্যা / ৩ জুন, ২০২২ / ১৯ জ্যৈষ্ঠ, ১৪২৯
রাজ্যের পঞ্চায়েত ব্যবস্থায় চুরি ও দুর্নীতির অভিনবত্ব কায়েম হয়েছে
কৃতিত্ব শাসকদলের
নিজস্ব সংবাদদাতাঃ মা মাটি মানুষের সরকারের জমানায় ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের বামফ্রন্ট সরকারের মডেলকে ধুলিসাৎ করে তৃণমূল রাজ্যের পঞ্চায়েত ব্যবস্থায় এখন চুরি আর দুর্নীতির অভিনবত্বে নতুন নজির গড়ছে রোজই। নজরদারির এবং অভিযোগ মোতাবেক ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে প্রশাসনিক নীরবতা এবং নিস্ক্রিয়তায় বিভিন্ন স্তরের পঞ্চায়েতগুলি এখন পরিণত হয়েছে সরকারি কোষাগার দেদার লুঠের সহজতম ব্যবস্থায়। একই কায়দায় চলছে জলপাইগুড়ি, কোচবিহার থেকে দক্ষিণের সাগর সহ দুই মেদিনীপুর পর্যন্ত তৃণমূলের প্রধান উপপ্রধান সহ পঞ্চায়েতের বিভিন্ন স্তরের পদাধিকারিদের চুরির টাকায় ফুলে ফেঁপে ওঠা। বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পের কাজ না পাওয়া এবং কাজ করে টাকা না পাওয়ার জেরে তৃণমূলীদের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষ তো বটেই, এমনকি অভিযোগ করছেন, বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন, পঞ্চায়েত ঘেরাওয়ে বামফ্রন্ট কর্মীদের পাশাপাশি শামিল হচ্ছেন তৃণমূলীরাও - এমন পরিস্থিতিও দেখা যাচ্ছে। এর পাশাপাশি পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে বামফ্রন্ট সরকারের সময়ের জনমুখী সুসংহত দুর্নীতিবিহীন পঞ্চায়েত ব্যবস্থার অর্জিত সাফল্যের কথা গর্বের সঙ্গে বলছেন সোচ্চারে - এমন মানুষের সংখ্যা বাড়ছে গ্রাম বাংলায়।
কেমন চলছে এখন বাংলার পঞ্চায়েত? কয়েকটি নজির দেখা যাক। পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায় চলছে আবাস যোজনার ঘরের টাকা লুটের ঘটনা। প্রতিটি ব্লকেই রয়েছে এমন নজির। নকল পরিচিতিপত্রের মাধ্যমে গরিব মানুষের নামে বরাদ্দ টাকা তুলে নেওয়া হয়েছে। শালবনী ব্লকের গড়মাল সহ আরও কয়েকটা জায়গায় গ্রামবাসীরা এই পরিস্থিতির শিকার হয়ে অভিযোগ করেছেন তৃণমূলী পঞ্চায়েত সদস্যদের বিরুদ্ধে, প্রতিকার মেলেনি এখনও।
আবার ওই জেলার গড়বেতার সন্ধিপুর বুথের ৪৩টি পরিবারের আবাস যোজনার বরাদ্দ টাকা তৃণমূলের প্রধান ও নেতারা তাদের আত্মীয়দের অ্যাকাউন্টে সরিয়ে দেওয়ার মতো দুর্নীতি তদন্তে প্রমাণিত হলেও এখনও দুর্নীতির সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। গড়বেতা ১ নম্বর ব্লকের বাসিন্দা তাজমুল মল্লিক, আরমান সরদার এমন ৪৩ জন গরিব গুর্বো মানুষ সাইবার কাফেতে গিয়ে জানতে পারেন তাদের নামে গৃহ আবাস যোজনায় লক্ষ টাকা বরাদ্দ করেছে সরকার, শুধু তাই নয়, সেই বরাদ্দ টাকা তিন দফায় অন্য অ্যাকাউন্টে সরিয়ে ফেলা হয়েছে।
১০০ দিনের মজুরিতে চুরি, আবাস যোজনায় কাটমানি এসব তো ছিলই। চুরির নতুন পদ্ধতি উঠে এসেছে পূর্ব মেদিনীপুরের ভেড়িকে ঘিরে। উদাহরণ নন্দকুমার ব্লক। এই ব্লকের অন্তর্ভুক্ত কাঞ্চনপুর গ্রামের প্রায় ৪০ জনের স্বেচ্ছায় দেওয়া ৪৫ বিঘা চাষযোগ্য জমি নিয়ে মাছ চাষের ফিশারি তৈরি হয়েছে। কৃষক বন্ধু প্রকল্পের টাকা সরকারের পক্ষ থেকে কৃষকরা পেলেও, ক্ষতি হয়েছে খেতমজুর এবং বর্গাদারদের। কিন্তু কৃষকরাও সেই টাকা পাচ্ছেন তৃণমূলের নেতাদের কাটমানি দিয়ে। আর জেলায় মাছের ভেড়ির রমরমার কারণে ধান চাষ না হওয়ায় সর্বস্বান্ত হয়েছেন ভাগচাষী এবং খেতমজুররা। মহিষাদল ব্লকের বিভিন্ন গ্রাম পঞ্চায়েতেও বড়ো বড়ো মাছের ফিশারি রয়েছে। সেখানেও দেখা যাচ্ছে রাজ্য এবং কেন্দ্রীয় সরকারের কৃষক বন্ধু প্রকল্পের টাকা পাইয়ে দেওয়ার মধ্য দিয়ে ব্যাপক কাটমানি পকেটে ঢুকেছে মা-মাটি-মানুষের নেতাদের।
আবার রেগার টাকা চুরিতেও নানা কারসাজি তৃণমূলের। এখানেই কুমারচক গ্রামে গত বছর ১০০ দিনের কাজে একটি খাল কাটা হয়েছে। সেখানে জব কার্ড রয়েছে এমন শ্রমিকদের কাজে লাগানো হয়। শ্রমিকদের টাকা মেটানোর পরেও যখন তালিকা প্রকাশ করা হয় তখন দেখা যায় সেই তালিকায় রয়েছে ২০জন মৃত লোকের নাম শ্রমিক হিসেবে!
দক্ষিণ ২৪ পরগনার কুলপি ব্লকের কেওড়াতলা পঞ্চায়েতে চুরির অন্য গল্প। গ্রামের মধ্যেই ঝাঁ-চকচকে নতুন বাড়ি। বাড়ির মালিক পঞ্চায়েতের উপপ্রধান পরিতোষ গোরা। তার নিজস্ব কোনো আয় নেই। তবু কীভাবে সম্ভব হলো প্রায় ৪০ লক্ষ টাকা ব্যয় করে এই বাড়ি তৈরি? তার বিরুদ্ধে তোলাবাজির কাটমানি নেওয়ার অভিযোগ তুলছেন ওই গ্রামের তৃণমূল কর্মীরাও।
তার প্রতিবেশীদের কথায়, বছর পাঁচেক আগে উপপ্রধান হবার আগে মজুরের কাজ করে সংসার চালাতেন। অ্যাসবেস্টসের ছাউনির ঘরে বসবাস করতেন তখন। ২০১৮ সালে গ্রাম পঞ্চায়েতের উপপ্রধান হওয়ার পর থেকে গত তিন বছরে তিনি বিপুল টাকা ব্যয় করে এই বাড়ি তৈরি করেছেন। অভিযোগ, আমফানে তার ঘরের কোনো ক্ষতি না হলেও নিজের স্ত্রী পুত্র ও পুত্রবধূ সহ পরিবারের সকলের নামে আমফানের ক্ষতিপূরণের টাকা নিয়েছেন। রেগা শ্রমিকদের কাজ দেওয়ার নাম করে টাকা আত্মসাৎ করেছেন। গ্রামের একটি ১৫০ ফুট পুকুর পাইলিংয়ের কাজ পাঁচটি প্রকল্প বাবদ ১ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা ব্যয় দেখিয়ে সে টাকা আত্মসাৎ করেছেন। এমন নজির সর্বত্র।
নতুন পদ্ধতিতে চুরির রেকর্ড করেছে দক্ষিণ ২৪ পরগনার পাঠানখালী পঞ্চায়েত। এখানে নদী বাঁধের কাজ করিয়েছে তৃণমূল পরিচালিত পঞ্চায়েত। কাজ হয়েছে গত ২৮ সেপ্টেম্বর থেকে ১৩ অক্টোবর পর্যন্ত টানা ১৫ দিন। হিসেবে দেখানো হয়েছে ওই দিনগুলো উল্লেখ করে। কিন্তু বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, ওই দিনগুলোর মধ্যেই ছিল শারদীয়ার সপ্তমী অষ্টমী। অর্থাৎ পুজোর চার দিন এই কাজ হয়েছে এখানে। গোসাবার কচুখালীতেও একই কায়দায় টাকা লুট হয়েছে পুজোর কয়েকদিন কাজ করেছেন মানুষ - এমন হিসেব দাখিল করে।
কোচবিহারের কমিউনিটি টয়লেট বানানো ঘিরে প্রচুর অভিযোগ। জেলার গীতালদহ ১ গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রাক্তন প্রধান আবু আলি আজাদ তৃণমূলের নেতা। কমিউনিটি টয়লেট বানানো ঘিরে অভিযোগ প্রসঙ্গে তাঁর বক্তব্য আপনারা খুঁজে দেখুন আসলে কি ঘটেছে। পঞ্চায়েত সমিতি সূত্রে জানা গিয়েছে, ব্লকের ১৬টি গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায় ২০৪টি কমিউনিটি টয়লেট তৈরির বরাত পেয়েছিল এক বেসরকারি সংস্থা। টয়লেট তৈরির জায়গা নির্বাচন করে ওই সংস্থাকে কাজের বরাত দেওয়া হয়। অনিয়মের শুরু এরপর। অভিযোগ, ৪০টি টয়লেট খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আবার অনেক টয়লেটের কাজ অসম্পূর্ণ রয়েছে। প্রতিটি কমিউনিটি টয়লেটের জন্য জেলা পরিষদ এক লক্ষ আশি হাজার এবং সংশ্লিষ্ট গ্রাম পঞ্চায়েত কুড়ি হাজার টাকা বরাদ্দ করে। চল্লিশটি টয়লেটের অস্তিত্ব না থাকলে ৮০ লক্ষ টাকা লোপাট হওয়ার অভিযোগ ওই গ্রামের মানুষের মুখে মুখে। কারণ সংস্থা সব টাকা পেয়ে গেছে। অভিযোগ নিয়ে বিডিও অবধি পৌঁছেও কোনো লাভ হয়নি। আবার আবাস যোজনার টাকা আত্মসাৎ করার নজির রয়েছে গীতালদহ ২ পঞ্চায়েতের সদস্যদের বিরুদ্ধে। ১৭৫টি বাড়ির পুরোপুরি ভেঙে যাওয়ার অনুদানের টাকা এলেও ১০০ জনের নাম বদলে দিয়ে অন্য নামে টাকা ব্যাঙ্কে ঢুকিয়ে নিয়েছেন সংশ্লিষ্ট গ্রাম প্রধান। পরিস্থিতি এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে, এই দুর্নীতির বিরুদ্ধে হাইকোর্টে যিনি মামলা করেছেন তিনি তৃণমূলের আর এক নেতা। তার নাম নিরঞ্জন সেন। নিজের দল নিজের প্রশাসনের উপর ভরসা করতে পারছেন না তৃণমূলের ওই নেতা।
তৃণমূলী পঞ্চায়েতের চুরির এই কয়েকটি নমুনা থেকেই গোটা রাজ্যজুড়ে কি চলছে সেটা বুঝতে অসুবিধে হয় না। তাই এসব রুখতে ঘটছে পঞ্চায়েত বা বিডিও দপ্তর ঘেরাওয়ের মতো ঘটনা। রাজ্যজুড়েই এই অপশাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধে জোট বাঁধছেন মানুষ বামপন্থীদের নেতৃত্বে।