৫৯ বর্ষ ৪২ সংখ্যা / ৩ জুন, ২০২২ / ১৯ জ্যৈষ্ঠ, ১৪২৯
সিপিআই(এম) রাজ্য দপ্তরে কিউবার রাষ্ট্রদূত
অনিন্দ্য হাজরা
মুজফ্ফর আহ্মদ ভবনে সিপিআই(এম) নেতৃত্বের সঙ্গে সৌজন্যমূলক সাক্ষাতে কিউবার রাষ্ট্রদূত আলেজান্দ্রো সিমানকাস মারিন।
রয়েছেন বিমান বসু, মহম্মদ সেলিম, শ্রীদীপ ভট্টাচার্য এবং অনাদি সাহু।
কিউবায় প্রতিকূলতার মধ্যেও সমাজতন্ত্রকে আরও বেশি করে আঁকড়ে ধরছেন কিউবার মানুষ। তাঁদের স্লোগান, ‘‘কিউবা বিপ্লবের সুফল রক্ষা করো, সমৃদ্ধ করো, এবং সামনের দিকে এগিয়ে চলো।’’ ২৯ মে মুজফ্ফর আহ্মদ ভবনে সিপিআই(এম) নেতৃত্বের সঙ্গে সৌজন্যমূলক সাক্ষাতে এ কথা বলেন ভারতে নিযুক্ত কিউবার রাষ্ট্রদূত আলেকজান্দ্রো সিমানকাস মারিন। তাঁর সঙ্গে রাষ্ট্র, সমাজ, অর্থনীতি ও সমাজতান্ত্রিক কিউবা প্রসঙ্গে আলোচনা করেন বিমান বসু, মহম্মদ সেলিম, শ্রীদীপ ভট্টাচার্য এবং অনাদি সাহু। মারিন বলেন, কিউবার সমাজতান্ত্রিক কাঠামো ধ্বংস করতে বিভিন্ন দিক দিয়ে অপচেষ্টা চালাচ্ছে মার্কিন সরকার। যেমন, রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি করতে সামাজিক মাধ্যমকে ব্যবহার করা হচ্ছে বিশেষত কিউবার যুব সমাজকে প্রভাবিত করতে। কিউবার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে ফি বছর সাড়ে তিন কোটি মার্কিন ডলার খরচ করে। মদত দেওয়া হচ্ছে প্রতিবিপ্লবী শক্তিগুলিকে। সিপিআই(এম) নেতৃত্বের সঙ্গে আলোচনায় মারিন কিউবার বিরুদ্ধে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার চরিত্র ব্যাখ্যা করেন। মারিনের সঙ্গে আলাপচারিতায় সিপিআই(এম) নেতৃবৃন্দ জানতে চান সমস্ত প্রতিকূলতা সামলে কীভাবে সমাজতান্ত্রিক কাঠামোকে সুরক্ষিত রাখছে কিউবা? এর উত্তরে মারিন বলেন, কিউবা বিপ্লবের অন্যতম ফসল হলো সর্বজনীন স্বাস্থ্যব্যবস্থা। যার গোটা ব্যয়ভার রাষ্ট্র বহন করে। মার্কিনী ষড়যন্ত্র সামাল দিয়েই ঘুরে দাঁড়াচ্ছে কিউবার অর্থনীতি। ২০২১-২২ অর্থবর্ষে ৪ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে সে দেশের অর্থনীতি।
মারিন জানান, কিউবাকে প্রশাসনিকভাবে রাজ্য, মিউনিসিপ্যালিটি এবং পপুলার কাউন্সিলে ভাগ করা হয়েছে। একেবারে নিচুতলার স্তর হলো পপুলার কাউন্সিল। কাউন্সিলে জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ সুনিশ্চিত করার ক্ষেত্রে বাড়তি উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা পরিচালনার ক্ষেত্রে সরাসরি জনতার মতামত সংগ্রহ করা হচ্ছে। এভাবেই কিউবা জুড়ে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে জোরদার করার কাজ চলছে। অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য বর্তমানে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের দিকে বেশি নজর দেওয়া হচ্ছে। তার জন্য স্থানীয় প্রশাসনের হাতে প্রভূত ক্ষমতাও দেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষকে উৎসাহিত করা হচ্ছে। তিনি জানান, একমাত্র সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর পক্ষেই সম্ভব সাধারণ মানুষের সার্বিক উন্নতি করা। নতুন করে লাতিন আমেরিকার দেশগুলিতে বামপন্থীদের উত্থানের প্রশ্নেও আশাবাদী মারিন।
কিউবা সংহতিতে সিপিআই(এম)’র ভূমিকার প্রশংসা করেন মারিন। তিনি বলেন, কিউবার মানুষ জানেন সিপিআই(এম) তাঁদের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন। বর্তমানে ভারত-কিউবা অর্থনৈতিক সম্পর্ককে আরও মজবুত করার কাজ চালাচ্ছেন মারিন। সেই বিষয়ে তাঁকে আগাম অভিনন্দন জানান সিপিআই(এম) নেতৃবৃন্দ।
এদিন সিপিআই(এম) পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির পক্ষ থেকে কিউবার রাষ্ট্রদূতকে স্মারক প্রদান করেন রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম। একইসঙ্গে কিউবার জনগণের প্রতি রাজ্যের জনগণের উষ্ণ আবেগের কথাও উল্লেখ করেন তিনি।
এআইপিএসও’র উদ্যোগে সংবর্ধনা অনুষ্ঠান
২৮ মে মারিনকে সংবর্ধনা জানালো সারা ভারত শান্তি ও সংহতি সংস্থা (এআইপিএসও) পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটি। কলকাতার শ্রমিক ভবনে এই সংবর্ধনা জ্ঞাপন কর্মসূচির আয়োজন হয়। এআইপিএসও’র সভায় ভাষণ দিতে গিয়ে মারিন বলেন, ‘ভারত কিউবা দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থান শহর কলকাতার। কলকাতা সহ পশ্চিমবঙ্গের মানুষের উষ্ণতা আমাদের হৃদয় স্পর্শ করে। আপনারা আমাদের স্বজন, বন্ধু এবং কমরেড।’
মারিন বলেন, অসাম্য, অবিচার শোষণের বিরুদ্ধে সারা বিশ্বের প্রগতিশীল এবং বামপন্থী শক্তিগুলিকে একযোগে লড়াই করতে হবে। বর্তমানে সমাজতন্ত্রের আদর্শে অনুপ্রাণিত সমাজ এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে আক্রমণ চালানো হচ্ছে। মার্কিন প্রশাসনের এই আক্রমণের নিশানায় রয়েছে কিউবা, ভেনেজুয়েলা সহ লাতিন আমেরিকা এবং ক্যারিবিয়ান সমুদ্র অঞ্চলের দেশগুলি। সংকট মোকাবিলায় একসঙ্গে লড়াই করা ছাড়া বিকল্প কোনও পথ নেই।
একইসঙ্গে তিনি বলেন, বেআইনিভাবে কিউবার বিরুদ্ধে আর্থিক নিষেধাজ্ঞা এবং অর্থনৈতিক অবরোধ জারি রেখেছে মার্কিন প্রশাসন। এই অবরোধ ব্যাহত করছে কিউবার অর্থনৈতিক উন্নতি। বর্তমানে বন্ধু দেশগুলিকে সঙ্গে নিয়ে আমরা সেই অবরোধ মোকাবিলার চেষ্টা চালাচ্ছি। তিনি বলেন, ভারতের মানুষ আমাদের পাশে আছেন। আমরা তাঁদের কাছে কৃতজ্ঞ।
প্রারম্ভিক ভাষণের পরে প্রশ্নোত্তর পর্বে মার্কিন অবরোধের চরিত্র বিশদে ব্যাখ্যা করে মারিন বলেন, শুধু নিষেধাজ্ঞা বা অবরোধ জারি করেই থেমে থাকেনি মার্কিন প্রশাসন; কিউবার মানুষের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক যুদ্ধ নামিয়ে আনা হয়েছে। গত পাঁচ বছরে এই আগ্রাসনের তীব্রতা বৃদ্ধি পেয়েছে। উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, কিউবার অর্থনীতির একটা বড়ো অংশ পর্যটন শিল্পের উপর নির্ভরশীল। সেখানে আঘাত করতে মার্কিন প্রশাসন কিউবায় প্রমোদতরীর প্রবেশ আটকেছে। কিউবায় জ্বালানি সংকট তৈরি করতে তেলবাহী জাহাজগুলিকে কিউবায় ঢুকতে দিতে বাধা দিচ্ছে মার্কিন প্রশাসন। কোভিড পরিস্থিতিতেও এই যুদ্ধ চালিয়ে গিয়েছে ওয়াশিংটন ডিসি। ভ্যাকসিন তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় কেমিক্যালগুলি সহ অন্যান্য চিকিৎসা সামগ্রীকেও কিউবায় ঢুকতে বাধা দেওয়া হয়েছে। এই নিষেধাজ্ঞার ফলে প্রতি বছর কিউবার ৫বিলিয়ন ডলার মূল্যের আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে। ইউক্রেন সংঘাতকে ব্যবহার করে কিউবায় রুশ পর্যটকদের আসাও বন্ধ করেছে মার্কিন প্রশাসন। এর মোকাবিলায় ভারত সহ বন্ধু দেশগুলির সঙ্গে আরও দৃঢ় অর্থনৈতিক সম্পর্ক গড়তে চলেছে কিউবা।
এক প্রশ্নের উত্তরে মারিন বলেন, আর্থিক নিষেধাজ্ঞার ফলে দেশের মানুষকে বেশ কিছু কষ্ট সহ্য করতে হচ্ছে এবং এর ফলে তৈরি হওয়া ক্ষোভকে উসকে দিয়ে কিউবায় রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরির খেলায় নেমেছে মার্কিন প্রশাসন। ২০২১ সালে হাভানা শহরে বিক্ষোভ সংগঠিত হয় মার্কিন মদতে। যদিও পরবর্তীকালে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়েছে।
এদিনের আলাপচারিতায় কিউবার স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সাফল্য তুলে ধরেন মারিন। তিনি জানান, চিকিৎসার জন্য কিউবার মানুষকে একটিও পয়সা ব্যয় করতে হয় না। সাধারণ মাথাব্যথার ট্যাবলেট থেকে শুরু করে ক্যান্সারের চিকিৎসা, সবটাই রাষ্ট্রের দায়িত্ব। প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সামগ্রী এবং ওষুধের ৭০শতাংশই কিউবাতেই তৈরি হয়।
মারিন ভারতীয় ওষুধ প্রস্তুতকারী সংস্থাগুলির সঙ্গে গাঁটছড়া বাধার বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দেন। তিনি জানান, ভারতীয় বিকল্প চিকিৎসা পদ্ধতিগুলির চাহিদা তৈরি হয়েছে কিউবায়। কিউবার চিকিৎসকদের এই বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়ার চিন্তাভাবনা চলছে বলেও তিনি জানান। ভারত সরকারের সঙ্গে এই বিষয়ে আলোচনাও চলছে।
সংবর্ধনা সভা পরিচালনা করেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য এবং এআইপিএসও রাজ্য সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য অধ্যাপক অশোকনাথ বসু। এআইপিএসও রাজ্য কমিটির সাধারণ সম্পাদক (কো-অর্ডিনেটর) অধ্যাপক অঞ্জন বেরা স্বাগত ভাষণে ভারত-কিউবা দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের নানা দিক তুলে ধরেন। এই প্রশ্নে এআইপিএসও’র ধারাবাহিক ভূমিকার কথাও উঠে আসে তাঁর বক্তব্যে।
কিউবার রাষ্ট্রদূতকে পুষ্পস্তবক দিয়ে অভিবাদন জানান এআইপিএসও রাজ্য সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য রবীন দেব, পশ্চিমবঙ্গ প্রাদেশিক কৃষক সভার সভাপতি বিপ্লব মজুমদার, সিআইটিইউ রাজ্য সম্পাদক অনাদি সাহু, এবং এআইপিএসও রাজ্য কমিটির অন্যতম সাধারণ সম্পাদক বিনায়ক ভট্টাচার্য।
মারিনের হাতে স্মারক তুলে দেন বিশিষ্ট সঙ্গীত শিল্পী ও পরিচালক কল্যাণ সেন বরাট। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ‘গীতাঞ্জলি’ ও ‘রিলিজিয়ন অফ ম্যান’ এবং কবির আঁকা ছবির একটি সংকলন মারিনের হাতে তুলে দেন এআইপিএসও রাজ্য সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য প্রবীর দেব। অশোকনাথ বসু মারিনের হাতে একটি ভাস্কর্য তুলে দেন। এছাড়াও ১৯৯২ সালে কিউবার পরিস্থিতির উপর রচিত ‘কিউবা-সংগ্রাম ও সংকট’ পুস্তিকার একটি পুরানো কপি স্মারক হিসাবে মারিনের হাতে তুলে দেন বইটির লেখক অঞ্জন বেরা।
সমর চক্রবর্তী, অশোক গুহ, গৌতম ঘোষ, ডাঃ তমোনাশ ভট্টাচার্য, দেবাঞ্জন চক্রবর্তী, পরিমল দেবনাথ, খগেন্দ্রনাথ অধিকারী, ডাঃ নির্মাল্য দাস, উৎপল দত্ত, প্রদীপ মুখার্জি, কুনাল বাগচি, অসিতাঙ্গ গাঙ্গুলি, কলতান দাশগুপ্ত, সোহম মুখার্জি সহ এআইপিএসও নেতৃত্ব এবং বহু বিশিষ্ট মানুষ সভায় উপস্থিত ছিলেন।
কল্যাণ সেন বরাটের গলায় ‘গুয়ানতানামেরা’ গানের মধ্য দিয়ে এদিনের অনুষ্ঠান শেষ হয়। ‘চিন্তন’ তাদের ফেসবুক পেজে সমগ্র অনুষ্ঠানটির লাইভ টেলিকাস্ট করে।