৫৯ বর্ষ ৪২ সংখ্যা / ৩ জুন, ২০২২ / ১৯ জ্যৈষ্ঠ, ১৪২৯
সিবিআই’র প্রারম্ভিক তদন্তেই ইঙ্গিত পাহাড় প্রমাণ অবৈধ লেনদেনের
নিজস্ব সংবাদদাতাঃ আর্থিক দুর্নীতির পরিসংখ্যানের দিক থেকে মধ্যপ্রদেশের বিজেপি-আরএসএস সরকারের ব্যাপম প্রবেশিকা কেলেঙ্কারি এখনও পর্যন্ত দেশের সবচেয়ে বৃহৎ শিক্ষা কেলেঙ্কারি। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে স্কুল শিক্ষাক্ষেত্রে এসএসসি’র নিয়োগ কেলেঙ্কারির তদন্তে যে গতিতে একের পর এক চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে আসছে তা অচিরেই দেশের মধ্যে বাংলাকে শীর্ষস্থানে পৌঁছে দেবে বলে মনে করছে ওয়াকিবহাল মহল। বহু কোটি টাকা ভুয়ো প্রার্থীদের থেকে নিয়ে তাদের চাকরি পাইয়ে দেবার ঘটনা ইতিমধ্যেই প্রমাণিত। কোর্টের নির্দেশে ফেরতও দিতে হচ্ছে টাকা। তাই শেষ পর্যন্ত কোথার জল কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা কেউ জানে না। দুর্নীতিতে অনুপ্রেরণার স্রোত বয়ে চলেছে।
পরিস্থিতি এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে রাজ্যের শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী পরেশ অধিকারীকে মন্ত্রিসভা থেকে সরিয়ে দেবার জন্য রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড় এবং মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির কাছে সুপারিশ করেছে হাইকোর্ট। পরেশ অধিকারীর বিরুদ্ধে অভিযোগ, এসএসসি’র শিক্ষক পদে নিয়োগ সংক্রান্ত সমস্ত বিধি ভেঙে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ে তপশিলি জাতির সংরক্ষিত কোটায় নিজের কন্যা অঙ্কিতা অধিকারীকে চাকরি পাইয়ে দিয়েছেন তিনি। ইন্টারভিউ না দিয়েই এই প্রার্থী মেধা তালিকার শীর্ষে পৌঁছে গিয়েছিলেন। অন্যদিকে সংরক্ষিত কোটায় পরীক্ষা এবং ইন্টারভিউ দিয়ে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে মেধা তালিকার শীর্ষে থাকা ববিতা বর্মণ চাকরির নিয়োগপত্র পাননি। এই অভিযোগের ভিত্তিতে সিবিআই ইতিমধ্যেই জিজ্ঞাসাবাদ করেছে মন্ত্রী পরেশকে। আর নিলর্জ্জতার চূড়ায় গিয়ে সেই জেরা ফেরত পরেশ অধিকারীকে সংবর্ধনা দিচ্ছে তৃণমূল কংগ্রেস।
১৭ মে বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় এসএসসি মামলা সংক্রান্ত তাঁর পর্যবেক্ষণে বলেছেন, কলকাতা ও রাজ্য পুলিশের উপর ভরসা আছে। বিশ্বাস করি তাদের। কিন্তু তাঁদের হাত-পা বাঁধলে তারা সঠিক তদন্ত করবেন কিভাবে। এক্ষেত্রে রাজ্য সরকার বিধিবহির্ভূতভাবে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ এবং তদন্তের ক্ষেত্রে পুলিশকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করছে বলে মনে করছেন অনেকেই।
অন্যদিকে বর্তমান শিল্পমন্ত্রী যিনি আগে শিক্ষা দপ্তরের দায়িত্বে ছিলেন, যার আমলে পেছনের দরজা দিয়ে নিয়োগ হয়েছে সেই পার্থ চ্যাটার্জিকে দু’দিন দীর্ঘ জেরা করেছে সিবিআই। শোনা যাচ্ছে, জেরায় অভিযুক্ত মন্ত্রীরা সহ বিভিন্ন এসএসসি আধিকারিকরা ঘটনার চক্রান্তে তৃণমূল কংগ্রেসের শীর্ষ নেতৃত্ব যুক্ত বলে কবুল করেছেন। অন্যদিকে শাসক দলের পক্ষ থেকেও দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্তদের থেকে দূরত্ব তৈরি করার নানা বাহানা করে নজর ঘোরানোর চেষ্টা হচ্ছে। এসব কিছুর তীব্র নিন্দা করে মমতা ব্যানার্জির বাম আমলে দুর্নীতির সংক্রান্ত বক্তব্য প্রসঙ্গে সিপিআই(এম) রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম বলেছেন, অগ্নিকন্যা এখন নির্বাপিত। বর্তমান থেকে বাঁচার জন্য অতীতের আড়ালে আশ্রয় খুঁজছেন। তাঁরই সরকারি প্রতিষ্ঠানে একের পর এক দুর্নীতির অভিযোগ উঠছে। ... মূল ইস্যু থেকে জনগণের দৃষ্টি ঘোরাতেই এই পদক্ষেপ করছেন তিনি।
১৪ মে হাইকোর্ট নিয়োজিত অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি রঞ্জিত কুমার বাগের নেতৃত্বাধীন কমিটি যে রিপোর্ট জমা করেছে তা এসএসসি’র রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতিকে প্রকাশ্যে এনেছে। সংবাদে প্রকাশ, কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি সুব্রত তালুকদার এবং বিচারপতি আনন্দকুমার মুখোপাধ্যায়ের ডিভিশন বেঞ্চে রিপোর্ট পেশ করে ঐ কমিটির সদস্য আইনজীবী অরুণাভ বন্দ্যোপাধ্যায় জানান একাধিক অনিয়ম ও দুর্নীতির কথা। ৩৮১জনকে বে-আইনিভাবে নিয়োগ করার কথা কমিটির নজরে এসেছে। (যদিও সংখ্যাটা অনেক বেশি বলে মনে করা হচ্ছে।) তার মধ্যে ২২২জনের নাম কোনও তালিকাতেই পাওয়া যায়নি (যার মানে দাঁড়ায় তাঁরা পরীক্ষাতেই বসেননি)। অনেক উত্তরপত্র নষ্ট করা হয়েছে। নিয়োগের সুপারিশপত্রে কারচুপি বা ভুয়ো সুপারিশপত্রের ভিত্তিতে মধ্যশিক্ষা পর্ষদ নিয়োগপত্র দিয়েছে। নিয়োগ করা হয়েছে মেয়াদ উত্তীর্ণ প্যানেল থেকে। নিয়োগ নজরদারির ক্ষেত্রে তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চ্যাটার্জির নির্দেশে তৈরি মনিটরিং কমিটিকে অবৈধ বলে উল্লেখ করা হয়েছে রিপোর্টে।
রিপোর্টে বলা হয়েছে, স্কুল সার্ভিস কমিশনের (এসএসসি) প্রাক্তন উপদেষ্টা শান্তিপ্রসাদ সিংহের নির্দেশে ভুয়ো সুপারিশপত্র মধ্যশিক্ষা পর্ষদের কাছে যেত। তার ভিত্তিতে তৎকালীন পর্ষদ সভাপতি কল্যাণময় গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর সহকর্মী রাজেশ লায়েককে দিয়ে কম্পিউটারে নিয়োগপত্র ছাপিয়ে তা শান্তিপ্রসাদের কাছে পাঠাতো। গোটা বিষয়টি সল্টলেকের এসসিসি’র নবনির্মিত আচার্য ভবন থেকে করা হতো বলে জানা গেছে। সংবাদে প্রকাশ, যে সংস্থা উত্তরপত্র মূল্যায়ন করেছে তাঁদের বিরুদ্ধেও এসএসসি অভিযোগ করেছে ফল সংক্রান্ত বিষয়ে দুর্নীতির।
বিচারপতি বাগ কমিটি সুপারিশ করেছে, শান্তিপ্রসাদ সিংহ, সমরজিৎ আচার্য, (এসএসসি’র প্রোগ্রাম অফিসার) সৌমিত্র সরকার (এসএসসি’র প্রাক্তন চেয়ারম্যান), অশোককুমার সাহা (এসএসসি’র প্রাক্তন সচিব), রাজেশ লায়েক (পর্ষদের কর্মী)’র বিরুদ্ধে ফৌজদারি আইনে ব্যবস্থা গ্রহণের। প্রতারণা, নথি জালিয়াতি, জালিয়াতি, অপরাধের ষড়যন্ত্র ধারায় এঁদের বিরুদ্ধে মামলা করার কথা বলা হয়েছে ঐ রিপোর্টে। বিভাগীয় তদন্তের সুপারিশ করা হয়েছে সুবীরেশ ভট্টাচার্য সহ এসএসসি’র প্রাক্তন কয়েকজন আঞ্চলিক চেয়ারম্যানদের বিরুদ্ধেও।
‘আধাসেনার ঘেরাটোপে এসএসসি এমন দৃশ্য আগে দেখেনি বঙ্গদেশ। রাজ্যসরকারের শিক্ষা দপ্তরের অধীন একটি দপ্তর ঘিরে রেখেছে কেন্দ্রীয় বাহিনী। সেখানে ঢুকতে পারছে না দপ্তরের কর্তারাই!’
২০ মে এরকমটাই লেখা হয়েছে আনন্দবাজারের একটি প্রতিবেদনের শিরোনামে বিস্ময়সূচক চিহ্ন সহ। অর্থাৎ, মুখ্যমন্ত্রীর অনুপ্রেরণায় ভরপুর আনন্দবাজার পর্যন্ত এড়াতে পারছে না রাজ্যের শিক্ষাক্ষেত্রের ভয়াবহতা পরিস্থিতির কথা। স্বীকার করতে বাধ্য হচ্ছে এই পরিস্থিতি নজিরবিহীন। তাই প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চ্যাটার্র্জির সিবিআই দপ্তরে যাওয়ার প্রসঙ্গকে ব্যঙ্গ পর্যন্ত করে ফেলছে ‘সিবিআই’র দুয়ারে পার্থ’ শিরোনামে খবর করে। একের পর এক তৃণমূলী দুর্নীতির কথা প্রকাশ্যে আসলেই এর আগে তথ্যপ্রমাণ ছাড়া মনগড়া অভিযোগ সাজিয়ে ‘বাম আমলেও এরকম হয়েছে’ এমন ইঙ্গিত দিয়ে গোটা বিষয়টা লঘু করা বাজারি পত্রিকাগুলির দস্তুর। কিন্তু তৃণমূলী কংগ্রেসের একদা দলের ‘শৃঙ্খলারক্ষা’ কমিটির চেয়ারম্যান, প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চ্যাটাজিকে সিবিআই’র টানা জেরা আর সামলাতে পারছে না মমতাময়ী মিডিয়া। কারণ মোট ৮টি ক্ষেত্রে সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। মিডিয়ার খবরে আবার উপেক্ষা করা যায়নি তৃণমূলপন্থী একাশের আইনজীবীরা যেভাবে বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের এজলাস বয়কট সহ হাঙ্গামার চেষ্টা করেছিলেন সেই অভিযোগও।
আর শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী পরেশ অধিকারী যেভাবে মেয়েকে বেআইনীভাবে চাকরি পাইয়ে দেওয়ার অভিযোগে আদালতের নির্দেশের পরেও সিবিআই দপ্তরে না গিয়ে কিছুকাল অজ্ঞাতবাসে গেছিলেন তা নিয়ে রাজ্য পেরিয়ে দেশজুড়ে আলোড়ন তৈরি হয়েছে।
যেখানে সফলপ্রার্থী তালিকায় নাম থাকা হবু শিক্ষক-শিক্ষিকারা দিনের পর দিন রাস্তায় বসে ধর্ণা দিয়েছেন সেখানে তাদের টপকে তৃণমূলী সরকার চাকরি দিয়েছে শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী পরেশ অধিকারীর মেয়ে অঙ্কিতা অধিকারীসহ নানা ভুয়ো প্রার্থীকে। তাকে দু’বছর চাকরির বেতন ফেরত দেবার কথাও বলা হয়েছে আদালতের পক্ষ থেকে। এসব বাংলা কখনও দেখেনি।
অন্যদিকে প্রকৃত সফল প্রার্থীদের দাবিগুলিকে সহানুভূতিসম্পন্ন হয়ে বিবেচনার ভিত্তিতে তাদের অবিলম্বে চাকরি না দিয়ে তাদের বিক্ষোভ জমায়েতকে অগণতান্ত্রিকভাবে হয়রানি করা চলছে। লাঠি চালিয়েছে পুলিশ। বাম ছাত্র যুবরা এই পরিস্থিতিতে ‘চোর ধরো, জেল ভরো’ শিরোনামে যেভাবে আন্দোলন তৈরি করেছে সে সম্পর্কে এবং তাদের নেতৃত্বে টেট, এসএসসি সহ একাধিক পরীক্ষায় সফলদের নিয়োগের দাবিতে যে আন্দোলন গড়ে তুলছেন, তা ক্রমশই জোরালো হচ্ছে। প্রমাদ গুণছে নবান্ন।